একটা ছোট ঘটনা, একটা আলগা মন্তব্য, কি একটা ছোট তথ্য প্রকাশ হওয়া বা না হওয়ার ফলে কি ইতিহাসের গতিপথ পাল্টাতে পারে? সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি ইতিহাস-বেত্তারাও কোনও স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। তবে মনে হয়, ব্যক্তি বা সমাজ দুইয়ের জীবনেই কিছু পরিণতি থাকে অনিবার্য্য এবং নিশ্চিত, আর কিছু পরিণতি ঘটে যেগুলি অনিবার্য্য বা নিশ্চিত ছিল না, কিন্তু যেগুলি ঘটে যায় নানান পরস্পর বিরোধী শক্তির আপতনে বা হঠাৎ ঘটে যাওয়া সমাবেশের কারণে। এই প্রসঙ্গ টেনে নিচে তুলে ধরছি একটি চিঠি, যার সঠিক ব্যাখ্যা ভারতবর্ষের ইতিহাসটিই পালটে দিতে পারত। এবং আজও যার সঠিক ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে ভারতের ভবিষ্যৎ কল্যাণ।
চিঠিটা কোনও নগন্য লোক লেখেননি, লিখেছিলেন শিকাগোজয়ী বিবেকানন্দ, দেশে ফেরার বছর খানেকের মধ্যে। আলমোড়া থেকে ১৮৯৮ সালের ১০ই জুন তারিখে স্বামিজী চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন নৈনিতালবাসী মহম্মদ সরফরাজ হুসেনকে। চিঠিটি ছিল এই রকম—
MY DEAR FRIEND,
I appreciate your letter very much and am extremely happy to learn that the Lord is silently preparing wonderful things for our motherland, / Whether we call it Vedantism or any ism, the truth is that Advaitism is the last word of religion and thought and the only position from which one can look upon all religious and sects with love. I believe it is the religion of the future enlightened humanity. The Hindus may get the credit of arriving at it earlier than other races, they being an older race than either the Hebrew or the Arab, yet practical Advaitism, which looks upon and behaves to all mankind as one’s own soul, was never developed among the Hindus. On the other hand, my experience is that if ever any religion approached to this equality in an appreciable manner, it is Islam and Islam alone. Therefore, I am firmly persuaded that without the help of practical Islam, Theories of Vedantism, however fine and wonderful they may be, are entirely valueless to the vast mass of mankind. We want to lead mankind to the place where there is neither the Vedas, nor the Bible, not the Koran, yet this has to be done by harmonizing the Vedas, the Bible, and the Koran. Mankind ought to be taught that religions are but the varied expressions of THE RELIGION, which is Oneness, so that each may choose the path that suits him best. For our own motherland a junction of the two great systems, Hinduism and Islam— Vedanta brain and Islam body— is the only hope. I see in my mind’s eye the future perfect India rising out of this chaos and strife, glorious and invincible, with Vedanta brain and Islam body. Ever praying that the Lord may make of you a great instrument for the help of mankind, and especially of our poor, poor motherland.
Yours with love,
VIVEKANANDA
বিবেকানন্দের প্রমাণ্য Letters-এর অন্তর্ভুক্ত এই চিঠি অবিভক্ত ভারতের অনেকেরই জানা ছিল। হিন্দু ও মুসলমানের মিলিত সাধনায় নতুন ভারত জেগে উঠবে। তার পূর্ণ গৌরবে, যেন তারই উদ্বোধন মন্ত্র ছিল এই চিঠি। কি উদাত্ত ছিল এর আহ্বান! অথচ সে চিঠি যেন মাঠে মারা গেল! স্বতই প্রশ্ন জাগে, এই পরণতি কীভাবে সম্ভব হল?
সমস্যাটি জটিলতর লাগে আরও একটি কারণে। বিবেকানন্দের মৃত্যুর কয়েক দশক পর থেকে অবশ্যই অনেকদিন ধরে বিবেকানন্দের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে ছোট করে দেখানো হয়েছে; বামপন্থী মহলে বলা হয়েছে তিনি ছিলেন হিন্দু পুনরুথ্থানবাদী (Revivalist)। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে নিজের জীবন বাজি ধরে যাঁরা স্বাধীনতাসংগ্রাম বা দেশসেবায় নেমেছিলেন, তাঁদের কাছে বিবেকানন্দ ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেরণা। দেশের বড় নেতারাও যে তাঁকে মানতেন, তাতে সন্দেহ নেই। অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর বই থেকে আমরা জানছি, তিলক বিবেকানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করে গিয়েছিলেন। এবং উঠতি নেতা মোহনদাস গান্ধীও তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য বেলুড় এসেছিলেন, যদিও সাক্ষাৎ হয়নি। আমরা ধরেই নিতে পারি বিবেকানন্দের এই চিঠির কথা অনেক দেশপ্রেমিকই জানতেন। তাহলে কেন হলনা এই চিঠির সদব্যবহার? কেন এল না অখণ্ড স্বাধীন ভারতবর্ষ।
এই চিঠিতে যা বলা হয়েছে তা একবার খতিয়ে দেখা যেতে পারে। বলা হয়েছে, ধর্ম্মের শেষ কথা হল অদ্বৈতবাদ। এবং ভাবীকালে তাই হবে জ্ঞানদীপ্ত মনুষ্যজাতির ধর্ম্ম। ভারতের হিন্দুর গৌরব এইটুকু, অন্যসব জাতির আগে তারা এই তত্ত্বে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু কার্য্যক্ষেত্রের অদ্বৈতবাদ মানে সর্ব্ব মানবের সঙ্গে একাত্মবোধ ও সে মতো আচরণ। বিবেকানন্দের মতে সেই পর্য্যায়ের অদ্বৈতবাদ হিন্দুদের মধ্যে কখনও বিকাশ লাভ করেনি। তিনি আরও বলছেন, যদি কোনও ধর্ম্ম লক্ষ্যণীয় মাত্রায় সেই সাম্যের আদর্শের কাছাকাছি এসে থাকে, তবে তা হল ইসলাম এবং একমাত্র ইসলাম। শুধু তাই নয়, মানসনেত্রে তিনি যেন দেখছেন, অনেক ডামাডোল ও সংঘাত পার হয়ে হিন্দু ধর্ম্ম এবং ইসলামের সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই জেগে উঠছে ভবিষ্যতের মহান ভারত।
এবার ভারতভাগের আগের সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমির দিকে নজর দেওয়া যাক। দেশটিকে টুকরো করার পেছনে ব্রিটিশদের দূরভিসন্ধি যতই কাজ করে থাকুক না কেন, সেই কু-মতলব সফল হয়েছিল হিন্দু এবং মুসলিম নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব ছিল বলে। এই অবিশ্বাসের অবশ্যই অর্থনৈতিক কারণ ছিল, কিন্তু সেই কারণগুলি জোরালো হতে পেরেছিল হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিকভাবে অজ্ঞতা ও অশ্রদ্ধার দরুন। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি ঠিক সেই ক্ষতকেই সারানোর চেষ্টা করছে বিবেকানন্দের চিঠি। শুধু ভালোমানুষী বা অন্য কোনও ধোঁয়াটে যুক্তির ওপর হিন্দু ও মুসলমানের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যকে দাঁড় করাচ্ছেন না বিবেকানন্দ। তিনি হিন্দু ও মুসলমান দুই পক্ষকেই দেখিয়ে দিচ্ছেন অপরপক্ষকে কেন মান দিতে হবে তার যুক্তি এবং কার্য্যক্ষেত্রে কীভাবে চলতে হবে। বিবেকানন্দ নির্দ্বিধায় বলছেন, অদ্বৈতবাদী দর্শন এবং ইসলামি সাম্যনীতির সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই ভারত জেগে উঠবে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, চিঠির শেষ অংশ দেশের মানুষের মাথার ওপর দিয়ে গেল। এই অংশে স্বামিজী বলছেন, হিন্দুধর্ম্ম আর ইসলাম এই দুইয়ের মিলনের মধ্য দিয়ে ভারত জেগে উঠবে, এবং সেই ভাবী ভারতের হবে (Vedanta Brain) বেদান্ত মস্তিষ্ক আর (Islam Body) ইসলাম শরীর। ঠিক এখানেই বাঁধল গোল। সকলে অঘোষিতভাবে ধরে নিলেন, ‘বেদান্ত মশ্তিষ্ক’ মানে হিন্দু হবে দেশের পরিচালক বা শাসক আর ‘ইসলাম শরীর’ মানে মুসলমানরা হবে দেশের শ্রমিক আর সৈনিক। এইরকম মনে করার অনিবার্য্য পরিণাম হল, হিন্দু আর মুসলমান কোনও পক্ষের মনে এ চিঠি নিয়ে উৎসাহ এল না। মুসলমান শুধু শ্রমিক আর সৈনিক হবে! হিন্দু নেতা কোন মুখে বন্ধুত্বের হাত বাড়াবে মুসলমানের দিকে, এই চিঠির উল্লেখ করে? আর মুসলমানরাই বা কেন তাঁবেদারি করার জন্য হিন্দুর দিকে এগোবে? অথচ চিঠিটির আগের অংশ ভালো করে পড়লে বোঝা যায়, বিবেকানন্দ আদৌ এমন কথা বলতে চাইছেন না। প্রথমত, body বললে শুধু দেহ বা শরীর বোঝায় না। ইংরেজিতে রাষ্ট্রশরীর বা রাষ্ট্রকায়া বোঝাতে body politic এই শব্দ জোড়টি ব্যবহার হয়; এমনকি, কিছু মানুষ এককাট্টা হয়ে কোথাও গেলে বলা হয় ‘go in a body’। তাছাড়া Vedanta Brain বললে তার থেকে হিন্দু বা ব্রাহ্মণের আধিপত্য বোঝায়, এমন ভাবারও কোনও অর্থ হয় না। দ্বিতীয়ত, Vedanta Brain-কে উল্লেখের ঠিক আগে বিবেকানন্দ বলছেন, তিনি চান ‘a junction of two great systems, Hinduism and Islam’, অর্থাৎ দুটি পন্থা বা দুটি ভাব ও কর্ম্মধারার মিলন। রক্তের মিশ্রণের মধ্য দিয়ে দুটি মানবগোষ্ঠীর একাকার হয়ে যাওয়ার থেকে অনেক বড়, অনেক ব্যাপক কথা তিনি বলছেন। তিনি তো এর আগেই লিখছেন practical Advaitism বা কর্ম্মে অদ্বৈতবাদের অর্থ হল সকল মানুষকে আত্মবৎ অর্থাৎ নিজের সঙ্গে এক করে দেখা। এবং সেই সত্যের কাছাকাছি যদি কোনও ধর্ম্ম পৌঁছে থাকে, তবে তা একমাত্র ইসলাম। সেই সাম্যের কাছে যাওয়া বললে নিশ্চয় কোনও শারীরিক বা দৈহিক উৎকর্ষ বোঝায় না, বরঙ বোঝায় বিশেষ ধরনের মনোভাব বা আবেগ, যেটা ফুটে ওঠে মানুষের আচরণের মধ্য দিয়ে।
তবে এত চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হত না, যদি ইতিহাসের মারে আমরা আগে থিকেই আত্মবিস্মৃত জাতি না হয়ে থাকতাম। দু’শ বছর আগে ইংরেজির ছত্রছায়ায় যে জ্ঞানচর্চ্চা ও লেখাপড়ার ধারা শুরু হয় আমাদের দেশে, তার ফলে দেশীয় ভাবনা-চিন্তার জগৎ থেকে আমাদের বিচ্ছেদ তো ক্রমেই বেড়ে এসেছে। ফলে বিবেকানন্দের চিঠি পড়তে গিয়ে আমাদের দেশের যুগযুগবাহিত পুরুষ-প্রকৃতিতত্ত্ব আমাদের বিদ্বান ব্যক্তিদের মাথায় খেলল না। যদি এই তত্ত্ব তাঁদের মাথায় সক্রিয় থাকত, তবে তাঁরা বুঝতেন বিবেকানন্দের ভাবনা-চিন্তা-মত হিন্দু ও মুসলিম এই দুটি পন্থা বা এই দুটি ভাব তথা কর্ম্মধারার সমন্বয়ে পুরুষের ভূমিকায় থাকবে অদ্বৈত বেদান্ত আর প্রকৃতির ভূমিকায় থাকবে ইসলামি জীবনচর্চ্চা।
বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন, বেদান্তের অদ্বৈতবাদ কার্য্যে রূপায়িত হবে ইসলামের অন্তর্নিহিত সামাজিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ পালনের মধ্য দিয়ে। আর ইসলামি সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ পালনের মধ্য দিয়ে। আর ইসলামি সাম্য ও ভ্রাতৃত্বনীতি দিশা পাবে ও তার সম্যক স্ফুরণ ঘটবে যদি তার কেন্দ্রে থাকে বেদান্তের অদ্বৈতবাদী চিন্তা-ভাবনা। মন (পুরুষ) এবং দেহ (প্রকৃতি) দুই পক্ষই যেমন তৃপ্তি পায় ও সার্থক হয় পরস্পরের সঙ্গে মিলন ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। অন্য কথায়, বৈদান্তিক বিচার হবে আধেয় বা ‘পুরুষ’ আর ইসলাম-পালিত সাম্য ও ভ্রাতৃত্বনীতি হবে আধার বা ‘প্রকৃতি’।
এই পুরুষ-প্রকৃতিতত্ত্ব কোন, সুদূর অতীত থেকে ভারতীয় চিন্তার মজ্জায় মজ্জায় নিহিত ছিল। রাজ্যের নীতি যাদের পালনের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হত সেই প্রজা-সাধারণকে বলা হত প্রকৃতি, প্রকৃতিপুঞ্জ ইত্যাদি, আর রাজ্যের নীতি যে কেন্দ্রে উদ্ভুত হত সেই রাজা ছিল পুরুষ পদবাচ্য বা পুরুষ। এখনও বাঙলা ও সংস্কৃত ব্যাকরণে যে প্রকৃতি-প্রত্যয়ের বিশ্লেষণ করা হয়, সেটি তো আসলে পুরুষ-প্রকৃতি-তত্ত্বের প্রয়োগ। বাক্যের মধ্যে যে ক্রিয়াপদ পাই, তার বিশ্লেষণ করে মূলস্থ ধাতুটিকে বলা হয় প্রকৃতি, আর প্রত্যয়’রা’ বিভক্তি, যার কাজ হল ক্রিয়াটিকে বিশেষ অর্থে পৌঁছে দেওয়া, তাকে ভাবা হয় পুরুষ, যে সূত্রে এসেছে ক্রিয়াপদের বিচারে প্রথম, মধ্যম ও উত্তম পুরুষের তত্ত্ব।
এই পুরুষ-প্রকৃতিতত্ত্ব ভারতীয় বিদ্বানদের মাথায় এল না বিবেকানন্দের চিঠি হৃদয়ঙ্গম করতে গিয়ে। আর তারপর আত্মবিচ্ছিন্নতার মর্ম্মান্তিক খেসারত হিসেবে এল দেশভাগ বা ভারতবর্ষের ত্রিখণ্ডীকরণ।
অনেকে ভাবতে পারেন, দেশভাগ তো হয়েই গেছে, এতদিন পরে বিবেকানন্দের চিঠির কথা তুলে কি লাভ হবে? ইতিহাস তো আর পালটে দেওয়া যাবে না। তাঁদের স্মরণ করাতে হয়, ইসলাম ধর্ম্মাবলম্বীরা ভারতে কোনও নগন্য সংখ্যালঘু নয়; ভারতের নাগরিক হিসেবে ভারতবর্ষে বাস করেন বহু কোটি মুসলমান। এমনকি, ভারতে যত মুসলিম আছেন, পৃথিবীর অপর কোনও একটি রাষ্ট্রে এত মুসলিম নেই। এই বিপুল সংখ্যক মুসলিম এবং সংখ্যায় তার থেকে অনেক বেশী হিন্দু জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও প্রীতির কি আর কোনও প্রয়োজন নেই? দেশভাগের প্রায় অর্ধশতাব্দীরও বেশী কাল ধরে মাঝে-মাঝেই যে হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে কখনও ছোট, কখনও বড় আকারের রক্তক্ষয়ী, হানাহানি হয়েছে, তারপর নিশ্চয় কেউ এমন কথা বলবেন না। সেই বিশ্বাস ও প্রীতির শক্ত বনেদ হতে পারে পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর বিবেকানন্দের এই চিঠির প্রাসঙ্গিকতা আজও অটুট আছে। আর পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্কের কথা ভাবে কি আকাশকুসুম কল্পনামাত্র? দুই জার্মানি, দুই ভিয়েতনাম তো এক হয়ে গেল!…