তানভীর আকন্দর গুচ্ছকবিতা

0

নাচো হে ঘুঙুর জড়ানো সন্ধ্যা

নাচো হে ঘুঙুর জড়ানো সন্ধ্যা-নাচো
সারসের চঞ্চুতে-সময়ের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে
মলিন হয়েছে চিঠি-কৃষ্ণআখর,
যতোগুলো ধ্বনি আছে ধাতুর ঝংকারে, আছে
ততোগুলো সুর,
তবু কেনো থেমে আছে গান? ভেঙেছে সেতার?

একেকটা তারা যেনো সরে যায় একেকটা চুম্বন থেকে দূরে,
একেকটা যুদ্ধের ইতিহাস পড়ে থাকে ঘোড়াদের মৃত চোখে
ফুলের পরাগ মেখে গায়ে তবু তুমি নাচো,
নাচো এই উদয়পদ্মের ধারে, নাচো
প্রেমে আর উল্লাসে-নাচো।

অধিচিন্তাপ্রবাহ

যেই মুখ দেখে মনে আসে সুনিপুণ সেই চারুপরিহাস,
শিল্পীর উন্নাসী চোখ খুঁজে ফেরে যেইভাবে নিরেট পাথরে
শিল্পের অনাম্নী প্রতিমা, কতোটা সখ্যতা আছে
সেইসব স্মৃতি বা স্বপ্নের বল্কলে?

পাখি ও পতঙ্গের কথা বলি, বলি ফুলের সুবাস-
দৃষ্টির সীমানায় কতোদূর গেলে তাকে দিগন্ত বলা যায়?
আকাশ কতোটা বিশাল এই চৌকোণা জানালায়?

একবার উড়ে গেলে সমস্তটাই যায়, তবু মনে রাখি
প্রজাপতি বসেছিলো ফুলের ওপর, যদিবা ফুলও
থাকে না আর! অথবা আমরাও উড়ে যাই,
প্রজাপতি নই, একজোড়া রঙিন পাখনায় আর
ভরসা হয় না আমাদের!

স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে ভাবি এও এক স্বপ্ন বুঝি,
অথবা স্বপ্নই এক চিরবাস্তবতা, আমাদের ঢেকে রাখে রঙিন চাদরে।

 

প্রস্থান

সামান্য মুখরতা তবে আমাকেও করে নেয় বশ,
এই ভ্রান্তি, এই রাতের আবেশ-
কতোদূর উড়ে যাবে তবে শঙ্খচিলের ডানা?
আমরাও নেমে যাই বণিক জাহাজে,
পাল তোলো, বাতাস হাঁকিয়ে নেবে মাস্তুল ভরা মেঘে।
বালিশের কোমলতা আজ বড়ো বেশি বেমানান মনে হয়,
একগ্লাস জলের তারল্য আর
কতোবার পান করা যায়, শুধু চোখের তৃষ্ণা বাড়ে!
দৃষ্টির সীমানায় তাই এঁকে নেই নীল সমুদ্রফেনা,
আমাদের শৈশবকল্পিত অভিযান।

নাবিক

এইসব অন্বিষ্ট ভুলে, আমার দিকে ফেরো
হে দিগভ্রান্ত নাবিক,
তোমার জাহাজ কতো সমুদ্রে, কতো ফেনায়িত তরঙ্গ ভেঙে
হরেক মশলার ঘ্রাণে আধেক বোঝাই-
কখনোবা স্বপ্নের মতো সেই দেশ,
কখনো দূরে দিগন্ত ঠেলে দিয়ে,
ভেসে ভেসে কতদূর, নামহীন কত
বন্দরে বন্দরে ফেলেছে নোঙর, মানুষের ভীড়ে
তুমিও নিজেকে কেবল স্থলের মানুষ ভেবে মিশে গিয়েছিলে
প্রাত্যহিক যাপনের উষ্ণ আড়ম্বরে?
কখনো জেনেছো তুমি, আকাশে মেঘের সাথে সখ্য নেই কোনো
ঘোলাটে চিমনি থেকে উগড়ে দেয়া ধূমায়িত বাষ্পের?
অথবা ধূলোর আস্তরণে যতোটাই স্বাভাবিক মনে হোক,
পুরনো ঘরের ছাদে ধূসর ধূলির প্রাণ চিরকাল পরজীবী রয়ে যায়?
আজ বন্দরে কোনো সাইরেন নেই,
নেই সারি সারি নির্জনতা ঘেরা সহস্র প্রদ্বীপ জ্বলে,
অথবা, তোমার অপেক্ষায় চেয়ে নেই নিশাচর বাতিঘর কোনো।
ভুলে গেছে তোমাকে সবাই? নাকি তোমাকেই মনে রেখে
ভুলে গেছে পৌনঃপুনিক জীবনের কূটাভাস, অসময়ে চলে গেছে ঘুমে?
তবু তোমাকেই ডাকি আমি হাতছানি দিয়ে, এসো-
এইসব অন্বিষ্ট ভুলে, আমার দিকে ফেরো
হে দিগভ্রান্ত নাবিক,
আবার বেরিয়ে পড়ি আমাদের চিরায়ত সমুদ্রভ্রমণে।

 

সিন্ধু ভৈরবী

ঘরের ভেতরে আমি অন্য এক আকাশের ছবি দেখি,
জানালার পর্দাগুলো চিরকাল গোপনতা খুঁজে,
জানি, সমুদ্রশৈবাল কোনোদিন নিজের দেহের ভাঁজে সমুদ্র খুঁজে না,
তবু ধ্বসে পড়ে বালিয়াড়ি, চকমকি ঠুকে কেউ আগুন জ্বেলেছে তবে?
কারা আজ জলের গভীরে দিলো ডুব,
তুলে আনে শঙ্খের গুঞ্জন, তবু দিগন্ত প্রসারিত হলে চিরকাল-
দেখি রাত, প্রতিটি তারার ইশারা সরে যায় মৃত্যু থেকে বহুদূরে।

ভেনাসের স্তন

যে ফুল ফোটে নি কখনোই, রাতের রহস্যে ঘেরা
পাখা আর পালকের কোমলতা, সুপ্রাচীন গ্রন্থের মতোই
কুমারী গোলাপ!
সাগরের নোনা জলে পুঞ্জীভূত ফেনায় ফেনায়
ভেসে আসে ঝিনুকের খোলসে আবৃত দেহ,
জীবনের অসীম ব্যাসার্ধ ঘিরে জেগে থাকে
ক্ষুধা আর প্রেমের পরিধি, আর তার সব সুর
পেরিয়ে গেলেই স্নায়ুর সমগ্র বিচ্ছেদ জুড়ে নেচে ওঠে
ঘুম আর স্বপ্নের সিম্ফনি!

ইকারুস

পতঙ্গ অভিলাষ আমাদের খুব চেনা,
বহুবিধ রঙে মুছে গেছে দৃষ্টির সমস্ত আলো;
তবু এই ডানা, এই মোমের আরক,
তুলে নিয়ে যাবে সেই প্রজ্জ্বলিত মোহরের টানে?
বহুদূর প্রসারিত সাগরের জল-
নীলাভ, কোমল-বুক পেতে আছে।
বারবার ফিরে আসি তাই গোলকধাঁধার পথে,
আমাদের করপুটজুড়ে প্রসারিত সর্পিল পরিহাস-
সেওতো দুর্বোধ্য নয় চিরকাল,
কেবলই উড়ে যাই তবু
পতনের আসন্ন ইশারাই মনে ধরে রেখে।

 

ঝরনাধারার হাসি

মৌন নিশিথে ফুটেছে হাস্নাহেনা
ঘুমজড়ানো আঁধারের মৌতাত
অসহ্য এ উপেক্ষা যন্ত্রণা
কতোদূর আর ইপ্সিত প্রতিঘাত?

এই তবে ভালো দূরে দূরে ফুটে থাকা
বিপরীত ফুল, রৌদ্রের স্নেহে মাখা
কতোটুকু আর বিকেল রয়েছে পড়ে?

তবুও তোমার পালকের কম্পনে
ফিরে ফিরে আসে মোহমৃত সাম্পান
ব্যর্থ জীবনে নির্মোহ স্পন্দনে
ব্যাকুল আঘাতে মুখর পুষ্পবাণ

এসেছিলে তবে প্রোত্থিত প্রেমের ছলে
ফুটেছিলো ফুল নবারুণ বিন্যাসে
ছুঁড়ে দিলে তা-ই নিষ্ঠুর হলাহলে
নির্বাক জল কাঁদে ক্রুর পরিহাসে
বিক্ষত প্রপেলার…

এ হাসি তবুও ঝরনাধারার মতো
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় ক্লেশিত পাথর মন
মাস্তুলে মেঘ জলছায়া প্রতিহত
ফিরে আসে যেন সমুদ্রে মন্থন!

হাওয়াকলের ঘূর্ণনগতি

চেতনার ভারবিন্দু হতে ছুটে গেল সময়ের দুর্বিনীত শিখা,
সেইসব আদিম অভীক্ষা
জড় ও জীবনের মাঝে ঘুচিয়ে দিচ্ছে ব্যবধান,
তবু এক কণ্ঠস্বর হাওয়ায় ঘূর্ণি তোলে-চাকা ঘোরে,
গম পেষবার কলে পিষে যায় সমস্ত তিতীক্ষা হৃদয়ের।

আমরাও আমাদের তাবৎ ইন্দ্রিয় দিয়ে ঠেকিয়ে রাখি
নিজের সাথেই নিজের পরম দূরত্বটুকু…
 

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার