টমাস ট্রান্সট্রোমার ও তাঁর কাব্যভুবন

0

টমাস ট্রান্সট্রোমার ও তাঁর কাব্যভুবন

সুইডিশ কবি ও মনস্তত্ত্ববিদ টমাস ট্রান্সট্রোমার  জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ সালের ১৫ই  এপ্রিল স্টকহোমে । যদিও ২০১১ তে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, তার অনেক আগেই নিজ জন্মভূমিতেই পেয়েছিলেন “the best of the living poets” এর তকমা । আরও বড় কথা, ব্যাপক অনুবাদের মাধ্যমে তার কবিতা ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর নানা দেশে । এ পর্যন্ত প্রায় ৬০টিরও বেশি ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে । নোবেল ছাড়াও আরও অসংখ্য বড় বড় নামজাদা এ্যাওয়ার্ড তাঁর ঝুলিতে এসেছে । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য  হল – Neustadt International Prize for Literature(1990), The Bonnier Award for Poetry, The Petrarch Prize in Geramy, Nordic Council Literature Prize(1990).

ট্রান্সট্রোমারের কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘দ্যা হাফ-ফিনিশড হেভেন’(The Half-Finished Heaven), ‘ওয়িনডস অ্যান্ড স্টোনস’(Windows and Stones), ‘বালটিক্স’(Baltics),  ‘ফর দ্যা লিভিং অ্যান্ড দ্যা ডেড’(For the Living and the Dead), ‘দ্যা সরো গন্ডলা’( The Sorrow Gondola) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য  ।

প্রায় ছয় দশকের ক্যারিয়ারে লিখেছেন মাত্র ডজন খানেক কবিতার বই । জীবনের ব্যাপ্তি বিবেচনা করলে(তিনি ৮৩ বছরের সুদীর্ঘ জীবন পার করে লোকান্তরিত হন এ বছরের ২৬শে মার্চ) এ সংখ্যা খুব বড় নয় । বলা যায়, তিনি অজস্র আজেবাজে, মূল্যহীন, বা মধ্যম-মানের  লেখা লিখে তাঁর বুক শেলফ ভর্তি করেননি । বরং লিখেছেন অনেক কম, এবং যতটুকু লিখেছেন তাতেই সোনারূপা ফলিয়েছেন । তাই তো সমালোচকেরা রায় দেন তাঁকে, অনেকটা নির্দ্বিধায়, ‘পাবলো নেরুদার পরে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অনুবাদিত কবি’ হিসেবে । তাই তো নোবেল পাওয়ার কত আগেই পেয়ে যান ‘Global poet’  উপাধি!

প্রত্যেক কবিরই  অন্তরলোকে  বিরাজ করে একটি ভোগোলিক স্পেস যার রঙ,   স্বাদ ও সৌন্দর্য তাঁর সৃষ্টিকে দেয় এক আশ্চর্য সুষমা, তার কাব্যভুবনকে এক অপার্থিব আলোয় আলোকিত করে । ওই স্পেস এর সাথে তার তো নাড়ির বন্ধন, তার সাথে বিচ্ছেদ মানে তো মৃত্যুসম যন্ত্রণা । স্টকহোম-এ অবস্থিত ‘রানম্যারও দ্বীপ’(Runmaro Island) ট্রান্সট্রোমার-এর সেই জেওগ্রাফিকেল স্পেস, যা তাঁর কবিতায়   যোগায় অনুপ্রেরণা, তাকে দেয় রূপ- রস- গন্ধ । তাই দ্বীপ মাতা ‘রানম্যারও’ ফিরে ফিরে আসে তাঁর চিত্রকল্পে, উপমায়, প্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপটে । এই যেমন এরকম চিত্রকল্প, যেখানে বরফের চাক আকাশের মতো নীল এবং তা সূর্যের আলোয় আস্তে আস্তে ভাঙছে । দ্বীপের লেকের তীরে বসে কবি শুনছেন সেই মায়াবী শব্দ –
One March day I walked down to the lake shore to listen.
The ice was blue as the sky. And breaking up in the sun.
(“About History”,  অনুবাদ-রবার্ট ব্লাই)

অথবা মধ্যরাতে জলে ভাসমান একটি ডিঙ্গি নৌকার চিত্রকল্প,
Night finally. At midnight I go to bed.
The dinghy sets out from the ship.
On the water you are alone.
The dark hull of society keeps on going.
(“Under Pressure”,  অনুবাদঃ রবার্ট ব্লাই)

অথবা কর্মক্লান্ত একজন মাঝি বা নাবিকের স্বপ্ন যাতে দ্বীপগুলো বিশাল বিশাল মথ পোকার ন্যায় হামাগুড়ি দিতে থাকে-
The man who spends the whole day in an open boat
Moving over the luminous bays
Will fall asleep at last inside the shade of his blue lamp
As the islands crawl like huge moths over the glove.
(“Breathing Space July” অনুবাদ: রবার্ট ব্লাই)

স্ক্যাণ্ডিনেভিয়া অঞ্চলের ভূগোিলক চরিত্রের একটি বিশেষ দিক হল-বছরের প্রায় আট মাস দীর্ঘ শীতকাল । তাই স্বভাবতই স্বল্পস্থায়ী সামার (বা গ্রীষ্মকাল) একটি অফুরান আনন্দ এবং হিল্লোল এর বারতা বয়ে আনে । এ অঞ্চলের মানুষজন তাই অধীর আগ্রহে সামার এর জন্য আকুল হয়ে থাকে । কবি ট্রান্সট্রমের তার জীবনের প্রায় সব সামার কাটিয়েছেন তার জন্মভুমি রানম্যারও দ্বীপে । তাঁর স্বর্গপুরীতে । বলা হয় যে রানম্যারও দ্বীপ তাঁর কল্পনায় ভাষা যুগিয়েছে, তাকে দিয়েছে চিত্রকল্পের আধার । ইংরেজ ঔপন্যাসিক টমাস হাির্ডর কাছে যেমন এসেক্স (Essex), আইরিশ ঔপন্যাসিক জেমস জয়েস এর কাছে যেমন ডাবলিন(Dublin), আইরিশ নাট্যকার জন মিলিংটন সিঙ এর কাছে যেমন তাঁর অ্যারান  আইল্যান্ড(Aran Island), বাংলাদেশি ঔপন্যাসিক হরিশঙ্কর জলদাশের কাছে যেমন চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গা,  টমাস ট্রান্সট্রোমারের কাছে রানম্যারও দ্বীপও ঠিক তেমন । তেমনি কাছের, তেমনি মায়াবী, তেমন হৃদ-মাজারের । অবশ্য সুইডেেনর অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, তার বিচিত্র রূপ-রঙ, প্রকৃতির বুকে আলো-ছায়ার খেলা, মিডনাইট সান অর্থাৎ মধ্যরাত্রে হঠাৎ সূর্যমামার উদয় -এসব তাঁর কবিতার শরীরে ঝলমল করলেও তা কক্ষনোই তার কবিতাকে ‘লোকাল’ বা ‘রাস্তিক’ (rustic) বলে খাটো করবার কোন অবকাশ দেয় না। বরং, শেষ বিচারে তাঁর কবিতা, যেকোনো চিরায়ত বা ক্লাসিক -এর মতই  স্থান -কাল এর সীমাবদ্ধতাকে  অতিক্রম করে এবং বৈশ্বিক  মানবের সৌন্দর্যচেতনায় ঢেউ তোলে। তখন ট্রান্সট্রোমার এর নিজের শহর স্টকহোম আমাদের হয়ে যায়, বিনা পাসপোর্টে আমরা ঘুরে বেড়াই প্রকৃতির লীলাভূমি  রানম্যারও দ্বীপে। কবিতার ভুবনে এই বৈশ্বিক যোগাযোগ এর কারণে এবং অনুবাদের কল্যাণে সুদূর সুইডেনের কবিও আমাদের আপনার কবি হয়ে ওঠেন, লাভ করেন আমাদের ভালোবাসা ও অক্রিত্তিম শ্রদ্ধা।

ট্রান্সট্রোমারের কাব্যের অর্ন্তগত শক্তির কল্যানে লেবাননের কবি অ্যাডোনিস,  আমেরিকার প্রখ্যাত কবি, অনুবাদক ও সাহিত্য সম্পাদক রর্বাট ব্লাই (Robert Bly) বা রবিন ফাল্টন (Robin Fulton) ও রবার্ট হেস (Robert Hass),  শেমাস হিনি (Seamus Heany)-এঁরাও  হয়ে উঠেন টমাসের কবিতার গুরুত্বপূর্ণ ভক্ত-পাঠক। বিশেষ করে আমরা আমেরিকান কবি রবার্ট ব্লাই-এর কথা বলতে পারি, যিনি তাঁর জীবনের একটি বড় সময় ধরে সুইডেনে বসবাস করে সুইডিশ ভাষা আয়ত্ব করেন, টমাসের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন আর অন্যদিকে  টমাস সুইডিশ ভাষায় অনুবাদ করেন ব্লাই ইংরেজি কবিতা। তাঁদের এই বহুল আলোচিত কাব্যসখ্যতা সৃজনশীলতার একটি অনবদ্য উদাহরণ হয়ে গেছে শিল্প ও সাহিত্যরসিকজনের কাছে । ইংরেজি কবিতায় আমরা ওয়ার্ডসওয়ার্থ-কোলরিজ, আর টেনিসন-আর্থার হেলাম এসব জুটিতে সৃজনশীল বন্ধুত্বের নজির পাই । তবে ব্লাই- ট্রান্সট্রোমারের  সৃজনশীল বন্ধুত্ব সাম্প্রতিক কসমোপলিটন বা গ্লোবাল ভিলেজ এর বৈশ্বিক বাস্তবতার একটি অনবদ্য ইতিবাচক ফল । তাদের ২৫ বছরের উষ্ণ-অন্তরঙ্গ সময়ের স্মারক সকল চিঠিপত্র (correspondences) পরবর্তীতে ব্লাই বইয়ের পাতায় আবদ্ধ করেছেন Air Mail: Letters of Robert Bly and Tomas Transtromer  নামে । বলা বাহুল্য, ব্লাই ট্রান্সট্রোমার-এর কবিতার প্রচন্ড ভক্ত; তাই নিজের কবিতার বইয়ের নামকরণেও তার সুইডিশ বন্ধুর কাব্য-স্পর্শ ও ঘ্রাণ লেগে থাকে । ব্লাইয়ের একটি কাব্য-গ্রন্থের টাইটেল এ রকম  Friends,You Drank Some Darkness যা ট্রান্সট্রোমারের একটি কবিতা থেকে ধার করা । আজ তাই,  ট্রান্সট্রোমার এর কবিতার যেকোনো আলোচনায় ব্লাইয়ের নামটাও এসে পড়ে, প্রায় সাথে সাথেই ।

ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদের (European Modernism) একেবারে চূডান্ত কালপর্বে ট্রান্সট্রোমার তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 17 Poems প্রকাশ করেন । প্রকাশকাল ১৯৫৪ সাল । প্রত্যাশিতভাবেই,এ বইয়ের ১৭ টি কবিতা সে-সময়ের সাহিত্য আন্দোলন,  যেমন, অভিব্যক্তিবাদ (Expressionism) ও  পরা-বাস্তববাদ (Surrealism) এর  ছাপ  ধারন করেছে । এক  অখ্যাত তরুণ কবির প্রেম, কামনা-বাসনা, উচ্চাভিলাস, যৌবনের তেজদীপ্ত বাসনা-এসবই স্থান পায় প্রথম(debut) সংকলনে । তবে প্রকরনে এবং প্রকাশ ভঙ্গিতে ‘a promising poet’-এর সকল আলামত সে সময়-ই সমালোচকরা লক্ষ্য করেন । সময়ের সাথে সাথে মানুষ বদলায়, চিন্তার জগতে ঘটে বিবর্তন, এবং ট্রান্সট্রোমারও তাঁর প্রতিটি নতুন কাব্য সংকলনে আগের ট্রান্সট্রোমারকে ছাডিয়ে যান বা অতিক্রম করার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন তাঁর নব নব আঙ্গিকের ব্যাবহারে । বয়সের পরিপক্কতা তাঁর কবিতার জগতকেও পরিপক্কতা ও পূর্ণতা দান করে,এবং যৌবনের কাব্যভাষার লঘুতা,অকারণ ভাব-উচ্ছাস, কামনা-তেজ ও প্রকরনের বাহুল্যকে আস্তে আস্তে  পরিত্যাগ করে তিনি আরও নৈর্ব্যক্তিক, নিরাসক্ত কিন্তু প্রানবন্ত, নির্মেদ (slim), স্বল্পভাষী এক কাব্যভাষা নির্মাণ করেন । “দ্যা গার্ডিয়ান” তাঁর কাব্যভাষা এবং প্রকরণের প্রশংসা করেছে ঠিক এই ভাবে: “He(Transtromer) is such a writer whose style is so simple as to make most words vain and superfluous.” এই কমেন্টের সুত্র ধরে আমরা আর্রনেস্ট হেমিংওয়ে(Ernest Hemingway)-কে স্মরন করতে পারি; এ খ্যাতিমান আমেরিকান ফিকশন লেখক চটুল, নিরমেদ, সাবলীল ও সরল সিনট্যাক্স (syntax) এর এক অপূর্ব গদ্য ‘স্টাইল’ আবিষ্কার করেন যা হেমিংওয়ে-উত্তর প্রজন্মের জন্য একটি মডেল হয়ে উঠে । একইভাবে, ট্রান্সট্রোমারও তাঁর স্বতন্ত্র কাব্যভাষা ও অভিনব ‘স্টাইল’ দিয়ে তাঁর পরের জেনারেশনের কবিদের প্রভাবিত করছেন । তাঁর ‘স্বল্পভাষী স্টাইল’  শুধু প্রথাগত জনরার (genre) মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি; তিনি তাকে গদ্য কবিতায় বিস্তার ঘটিয়ে হাইকু (haiku) পর্যন্ত এনেছেন (স্বরণযোগ্য যে,শেষ বয়সে তিনি বেশ কিছু জাপানি হাইকু ও লিখেছেন)।

তবে তাঁর কবিতার ধারা বা মেজাজ আলোচনা করতে গেলে বরাবরই গোল বেঁধে  যাবে । আধুনিকতাবাদ (modernism) বলি, অভিব্যক্তিবাদ (expressionism) বলি, অথবা পরাবাস্তববাদ (surrealism) বা  Mysticism বলি,কোন ছকেবাঁধা কাঠামোতেই ট্রান্সট্রোমারকে সীমিত করা যাবেনা । তিনি এমন এক বিচিত্র কাব্যভূবনের নির্মাতা, যা অবিরামভাবে ছক বা কাঠামো (category or structure)-কে অবজ্ঞা করে চলে। প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায়, গ্রান্তা সাহিত্য ম্যাগাজিনের (Granta Literary Magazine) সম্পাদক জন ফ্রিমানের কথা । তিনি একবার বলেছিলেন, “He (Transtromer) is to Sweden what Robert Frost is to America.” সম্ভবত তিনি ফ্রসট নিয়ে সমালোচকদের যে বিব্রতকর হাল হয়েছিল তার একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন । সময়ের প্রেক্ষাপটে দেখলে ফ্রস্ত তো আধুনিক, মানে বিশ শতকের কবি; কিন্তু টি এস এলিয়ট বা  এজরা পাউন্দের পাশে তাঁকে রাখলে কেমন দেখায়? তাই কোন কোন সমালোচক তাকে একেবারে খাঁটি বা আউটরাইট ‘আধুনিক’ বলতে নারাজ। আবার কেউ কেউ তাকে সাচ্চা ‘আধুনিক’ বলে ঘোষণা করেন । আর একটি পক্ষ তাঁকে, সাহিত্তের ধারা বা Literary Movement-এর পুরাপুরি বাইরের কবি বলে জানান । আর তাই, সমালোচনায় সবসময় ফ্রস্ত মিসফিট (misfit) থেকে যান । ফ্রিম্যান তাই ফ্রস্ত ও ট্রান্সট্রোমারকে একই কাতারে দাঁড় করিয়েছেন । একারনে, উত্তরাধুনিক (postmodern) সাহিত্যতাত্ত্বিকদের কাছে ট্রান্সট্রোমার একটি লোভনীয় নাম।

ট্রান্সট্রোমার সমালোচনা (Transtromer criticism)-য় প্রায়ই মনস্তত্বের (psychology) কথা শোনা যায় যে, তাঁর কবিতা সাইকোলজি দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত । ট্রান্সট্রোমার পেশায় ছিলেন একজন কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট (Counseling Psychologist) যিনি একটি কিশোর রিহেবিলিটেশন সেন্টারে কিশোর মাদকাসক্ত ও কিশোর অপরাধীদের নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন । স্বভাবতই তাঁর কবিতার ওপর কাউন্সেলিং সাইকোলজির প্রভাব প্রত্যাশিত । এক সাক্ষাতকারে ট্রান্সট্রোমার জানান যে,সবাই তাঁকে এ প্রভাব বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু তিনি বিস্ময়ে ভাবেনঃ উল্টোটি কেন নয় ‘Why not the otherwise?’ অর্থাৎ তাঁর পেশার ওপর কবিতার প্রভাব নিয়ে নয় কেন? তবে কবি নিজে তাঁর কাজ নিয়ে যাই বলুন না কেন, তাঁর ক্রিটিকরা এ ব্যাপারে মোটামুটি একমত যে,মানুষের জটিল মন ও তার কর্মপ্রণালীতে (operations)-এ আলো ফেলে তাঁর কবিতা। তাই তাঁর কবিতার সমালোচনায় ‘deep psychology’র কথা চলে আসে, এবং যে মনস্তাত্তিক এর প্রভাবের কথা ঘুরে-ফিরে বলা হয় তিনি সিগমাণ্ড ফ্রয়েড  নন, কার্ল ইয়ুং (Carl Jung), ফ্রয়েড এর একসময়ের সহযোগী এবং পরে তাঁর মনস্তাত্ত্বিক ও  দার্শনিক শত্রু এবং যিনি অ্যানালাইটিক সাইকোলজির জনক। তবে কবির দীর্ঘদিনের কাব্যসখা রবার্ট ব্লাই অবশ্য ট্রান্সট্রোমারের কাব্য যাত্রাকে বলেছেন, ‘essential religious way’ .এছাড়াও ব্লাই তাঁর বন্ধুকে ‘সাহসী যোদ্ধা’ বলে প্রশংসা করেছেন কারন, ষাট এবং সত্তরের দশকে টমাস যখন লিখতে শুরু করেন সুইডেনের সাহিত্যিক ও বুদ্ধিব্রিত্তিক পরিমন্ডল মাওবাদ (Maoism)ও অন্যান্য মতাদর্শ সমালোচনা  দ্বারা ভারাক্রান্ত ছিল । তাই ট্রান্সট্রোমারকে শুরুতে বেশ কন্সারভেটিভ ‘doctrinaire critics’ -দের  সাথে লড়তে হয়েছে। এটা মোটেও সহজ ছিলনা। তবে হ্যাঁ,  টমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতায়  আধ্যাত্মিকতা বা একটি অপার্থিব আলোর অস্তিত্ব প্রায়ই চোখে পড়ে। সম্ভবতঃ একেই ব্লাই ধর্মের চূড়ান্ত পথ (‘essential religious way’) বলেছেন। তবে ধার্মিক (religious) আখ্যা দেয়া হলেও  ট্রান্সট্রোমারের কবিতা মোটেও স্থুল ধার্মিকতাবোধ আক্রান্ত নয়। এমন কি ‘Didactic Poetry’র ক্যাটাগরিতে ফেললেও তা হবে চরম ভ্রান্তি । কারন, তাঁর কবিতা কোন উপদেশের বা  নসিহতের বা ধর্মগ্রন্থের বিকল্প কিছু নয় বা প্রচারমুখী (preaching) আদর্শনামাও নয় তাঁর কবিতা । বরং তিনি তাঁর পাঠককে আত্ম-উপলদ্ধির এমন এক স্তরে নিয়ে যান যে, পাঠক বোধের চুডান্ত সীমান্তে  দাঁড়িয়ে একটি অতিন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার (metaphysical/transcendental perception) মুখোমুখি হয়, যা প্রথাগত ধর্ম–আচার বা অর্থোডক্স ধার্মিকতা কখনোই দিতে পারে না। তাঁর কবিতা পাঠে পাঠকের এই প্রত্যয় জন্মে যে, সত্য উপলব্ধ হয় একেবারে চূড়ান্ত সীমান্তে (borderland); ‘সত্য’ ‘সত্য’ বলে পাদ্রির বা মোল্লার মত সত্যান্বেষণে নামলে সত্য কেবল মরিচিকাই থেকে যায় । ধরা দেয় না। একাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটস (Academy of American Poets) তাদের ওয়েবসাইটে টমাস ট্রান্সট্রোমার সম্পর্কে এরকম-ই লিখেছে, যা কবির মিস্টিক  অভিজ্ঞতা কে মূর্ত করে তোলেঃ
“His work barrels into the void, striving to understand and grapple with the unknowable, searching for transcendence.”

“Vermeer” ট্রান্সট্রোমারের একটি অসাধারণ কবিতা যার শেষ হয় আশাবাদ দিয়ে, অবশ্যই স্থূল অর্থে নয়। নিহিলিস্ট (Nihilist) এর কাছে যা শূন্যতা বা ‘void’  বৈ কিছু নয়, কবির কাছে তার অন্য অর্থ আছে । শেষ স্টেনজাটি তুলে দিতে চাই পাঠকদের জন্য , ব্লাই এর ইংরেজি অনুবাদে-
The airy sky has taken its place leaning against the wall
It is like a prayer to what is empty.
And what is empty turns its face to us
and whispers:
“I am not empty, I am open.”

ট্রান্সট্রোমারের কবিতা হল প্যারাডক্স (paradox), উপমা (metaphor) ও চিত্রকল্প (imagery)-এর অভূতর্পুব এক কম্বিনেশন । তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমাদের সামনে যে দৃশ্য ভেসে উঠে তা একই সাথে প্রানবন্ত,ঝরঝরে এবং শৈল্পিক। এই যেমন “A Winter Night” কবিতায় একটি আকস্মিক ঝড়ের বর্ণনা এবং তা কি গভীরভাবে প্রভাব রাখে কবির মন ও মননে তার প্রমান পাই ।
The storm puts its lips to the house
and blows to make a sound.
I sleep restlessly, turn over, with closed
eyes read the book of the storm.

ট্রান্সট্রোমারকে বলা হয় ‘মাস্টার অব মেটাফোর’ (Master of Metaphor)। অভিনব, চমৎকার,আর মোহময় উপমা তৈরিতে তিনি বরাবরই তুলনাহীন।আমরা ইংরেজ কবি মেটাফিজিকল জন ডান (John Donne) এর কথা স্মরণ করতে পারি যাকেও অভিনব (ingenious) উপমার জন্য বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়, কিন্তু ডানের মত ট্রান্সট্রোমারের উপমা অত দূরাগত (far-fetched) নয় । পাঠক পড়া মাত্রই communicate করতে পারে, আর তার বোধেও সমান অভিঘাত করে।তাই আমরা দেখি, ট্রান্সটোমার কলমে ঘুম থেকে জেগে উঠার উপমা হল ‘a parachute jump from dreams’, জানালার শার্শিতে মথ পোকার বেয়ে উঠা অন্য পৃথিবীর খবর হয়ে যায়, ‘small pale telegram from the world’ । আর একটি ডুয়েট অনুষ্ঠানে দুজন পিয়ানো বাদক হয়ে যান ‘two coachmen on the same carriage.’ । পিয়ানো বলতেই মনে পড়ে গেল-ট্রান্সট্রোমার তার শহরের একজন বেশ ভাল পিয়ানোবাদক ছিলেন।  অনেক পাবলিক পারফরমেন্সও করেছেন। সংগীতের প্রতি আমৃত্যু অনুরক্ত ছিল তাঁর কবিসত্তা। তাই ট্রান্সট্রোমারের কবিতাসন্ধ্যা মানেই হল তার স্ব-কণ্ঠে কবিতা পাঠ আর সবশেষে পিয়ানো। একান্ত সাক্ষাতকারে একবার বলেছিলেন যে, তিনি শব্দ দিয়ে সংগীত লিখতে চান(‘to write music out of words’)। এজন্য সংগীতের সুর,তাল,লয়, ছন্দ-তাঁর কবিতার শরীরে খোদাই করা আছে। তাঁর অসংখ্য কবিতা আছে যে-গুলি সরাসরি সংগীত দ্বারা প্রভাবিত। যেমন- “Allegro”, “Lamento”, “Slow Music”, Vermeer”, “Sorrow Gondola”, “Balakirev’s Dream”-এসব টাইটেল-ই তার বেশ উজ্জ্বল উদাহরণ। তাই সংগীত ছাড়া ট্রান্সট্রোমারের কবিতার কথা ভাবা যায়না ।

শেষ করতে চাই, ফরাসি লেখক ও সাহিত্য তাত্ত্বিক রলা বার্থ (Roland Barthes) এর উত্তর-কাঠামোবাদী সেমিনাল প্রবন্ধ “The Death of the Author” বা “রচয়িতার মৃত্যু” দিয়ে । বার্থ তাঁর লেখায় বলেন যে, যখন একটি লেখা বা ‘টেক্সট’ রচনা হয়ে যায়, তখন বাস্তবিক অর্থে এর লেখক ওই টেক্সট এর কনটেক্সট (context) থেকে ছিটকে পড়েন অর্থাৎ পাঠক যখন ওই টেক্সট পড়তে বসে তখন তার নিজের মতো করেই পড়ে(মানে, পাঠকের অনুধাবনে লেখকের কোন প্রভাব বা কন্ট্রোল থাকেনা; এভাবেই লেখকের এক ধরনের ‘মৃত্যু’ ঘটে ।   বার্থ তাঁর প্রবন্ধ শেষ করেন এই বলে যে, লেখকের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সত্যিকার পাঠকের জন্ম ঘটে । মজার ব্যাপার হল, ট্রান্সট্রোমার-এর  একটি অসাধারন কবিতা আছে যাতে দেখা যায়,কবিতা (Text)এর  জন্ম হতে  থাকে কবির অন্তর্ধানের মধ্য দিয়ে। দু’টি ঘটনার আপাতঃ সাযুজ্য বেশ কৌতুহোলদ্দিপক । মনে হবে, কবিতার ভাষায় ট্রান্সট্রোমার যেন রলা বার্থ এর থিওরির প্রতিধ্বনি করছেন । অবশ্য কবিতাটি পাঠকদের রবীন্দ্রনাথের  ‘সোনার তরী’ কবিতাটিকে মনে করিয়ে দেবে । তাই এই কবিতার চুম্বক অংশটি তুলে দিতে চাই পাঠকদের জন্য, ইংরেজিতেই-
“Fantastic to feel how my
poem begins
While I myself shrink
It grows, it takes my place
It pushes me aside.
It throws me out of the nest
The poem is ready.”
.

.
টমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা

নিঃসঙ্গতা

ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় মৃত্যুর একেবারে থাবার মধ্যে চলে আসি আমি
হঠাৎ তুষারাব্রীত রাস্তার ভুল পাশে এসে পডে আমার গাড়ী
আগুয়ান গাডীগুলি-অতি নিকটবর্তী
ওদের হেডল্যাম্প আমায় ঘিরে ধরে দাঁড়ায় ।
আমার নাম-পরিচয়,প্রিয়তমা কন্যার মুখ,আমার চাকরি
সব একে একে ছিটকে পড়ে -আমার অনেক পেছনে সরে যায়
দূরে এবং অনেক দূরে…।
আমি হয়ে যাই অচেনা,অখ্যাত
সন্ত্রস্ত এক মামুলি বালক, খেলার মাঠে যে
শত্রু পরিবেস্টিত হয়ে আছে ।

বড় বড় বাতিগুলি আমার দিকেই ধাবমান
আমার মুখে এসে পড়ে ওদের ঘনায়মান আলো
যখন আমি প্রানপণে লড়ছি হুইলের সাথে
ডিমের সাদার মত এক ত্রাশ
শূন্য বাতাসে ভাসতে থাকে ।
সেকেন্ডের কাঁটাগুলি মার্চ করে এগিয়ে চলে-অবশ্য
ওদের মাঝে একটা স্পেস তৈরি হয়।
বিশাল হসপিটাল-দালানের সমান বেড়ে চলে ওরা
এ-রকম মুহূর্তে তুমি থামতে পার
সামান্য সময়ের জন্য আর
নিতে পার একটা ছোট নিঃশ্বাস
চুডান্ত বিপর্যয়টি ঘটার আগে।

তারপর একটা কিছু আমার নজরে আসে
হতে পারে তা একটা বালুকণা বা
মোহময় একটা দমকা বাতাস ।
আমার গাডিটি তুষারমুক্ত হয় আর নিমেষে চলে যায় রাস্তার ডান পাশে।
‘টং’ শব্দে ধাক্কা খায় একটা আস্ত পিলারের সাথে
শব্দটা একেবারে টাটকা আর সজীব
এবং তা উড়াল দেয় আঁধারের গভীরে
তারপর নিঃসাড় নীরবতা ।
সিটবেল্ট বেঁধে আমি আবার সামনে এসে বসি
তাকিয়ে দেখি,তুষার-ঘূর্ণির ভেতর এগিয়ে আসছেন ‘কেউ’
আমার খোঁজ-খবর নিতে ।

দুই
অনেক হেটেঁছি আমি তুষার-ঢাকা পথে
অস্টারগোঁটল্যান্ডের  মাঠে মাঠে
দেখিনি কোন জনমানবের এতটুকুন অস্তিত্ব

এই পৃথিবীর অন্য কোন স্থানে
মানুষের জন্ম হয়
ওরা বেড়ে ওঠে
ওরা বেঁচে-বর্তে থাকে
অবশেষে মরে যায়- ঝাঁকে ঝাঁকে ।

সদা-সর্বদা দৃশ্যমান হতে চাইলে
অসংখ্য ভিড়ের মাঝে বাচঁতে চাইলে
তোমার থাকতে হবে নিজস্ব ঢঙ আর অভিব্যাক্তি
মাটিময়-কর্দমাক্ত আদল
কলরব ওঠে,আবার থেমে যায়
তারা যখন নিজেদের মধ্যে ভাঙতে থাকে
আকাশ,ছায়া আর বালুকণা।

আমাকে নিঃসঙ্গ-নির্ভার থাকতে হবে
সকালবেলা দশ মিনিট
আর বিকেলবেলা দশ মিনিট
ঐ সময়টুকুতে আমিই পুরোপুরি
নিজের সঙ্গে থাকতে চাই-শুধু নিজের সঙ্গে
সব সামাজিকতার বাইরে ।

সবাই সবার দরজায় ধর্না দিচ্ছে
অনেকে
একজন ।

(মুল কবিতাটি সুইডিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন রবিন ফাল্টন )

কালো পোস্টকার্ড

ক্যালেন্ডারের পাতা পূর্ণ, ভবিষ্যৎ অজানা
টেলিভিশনে শিল্পী নাম-না-জানা দেশের গান গাইছে
ধুসর সাগরে,জাহাজের ডকে তুষার ঝরে পড়ছে
ছায়ারা নড়ছে অবিরাম।

দুই
যখন তুমি জীবনের মাঝপথে,মৃত এসে হাজির হয়
আর তোমার দেহের মাপজোক নেয় । তুমি
ভুলে যাও ঐ সাক্ষাতের কথা। জীবন চলতে থাকে
আপন গতিতে। কিন্তু কেউ একজন অন্তরালে
বসে সেলাই করে যাচ্ছে তোমার কোট ।

(মুল কবিতাটি সুইডিশ থেকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছেন আমেরিকান কবি রবাট ব্লাই)

লেখকের ই-মেইলঃ arhosain81@yahoo.com

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার