উড়োপাতা
পথ খুঁজতে গিয়ে ছুটতে ছুটতে মনে হলো
এখানেই থামি, এই পুরোনা দরোজা-জানালার কাছে
যেখানে এক-দুটা পাখি হয়তো ডাকে, থাকে প্রজাপতি
কখনো ফড়িংয়ের উড়াউড়ি দেখা যায়
খড়ের চালার কাছে রাত হলে নিঝুম অন্ধকার
কবে যে পথে নেমেছিলাম, কেউ কি ডেকেছিলো, আয়
হয়তো আরও কোনো দূর নগরের খোঁজ, সমুদ্রের ওপারের
থোকা থোকা মেঘ ডেকেছিলো, আমার গ্রামের ভেতর
মুঠো মুঠো জোছনা চাই, দুপুরের কলাপাতা রোদের কাঁপন
বৃষ্টি এলে ভাজা চাল দাওয়ায় বসে একেকটা বেলা-
এখনতো বন্ধক রেখেছি সময় তোমার আঙুলে
একেকটি নির্দেশ আসে, আমি ঝরাপাতা, উড়োপাতা হই
ঘুরতে থাকি, নামতে থাকি রোদমাখা ডানার ছায়ার মতো
কুড়ানো বাবুইর বাসা সেই কবে কোথায় ফেলেছি
নিজের কিছুইতো নেই, কার আছে, শূন্যতা তুমিই বোঝ!
তৃষ্ণারকাল
দূরে ডাকছে মেঘ, এপারে তৃষ্ণারকাল
আরও তীব্র বৃষ্টিকে খুঁজে: নিরন্তর বাঁশিঅলা
রাত্রিকে দিয়েছে ঘোর, ডানায় যন্ত্রণা অনেক
পাখিটির ঘুম নেই চোখে-
শুনেছি তোমার ওদিকে নাকি খুব
বইছে দখিনা হাওয়া, প্রচুর কাঙাল প্রাণ
পাঁজর দিয়েছে খুলে; দেখি পতাকার গাড়ি
কিছুই থাকে না করার
ধুলো এসে চোখেমুখে লাগে
মনে হয় আমি কারো ভুলপ্রতিবেশী
কিছুই শিখিনি আজও যেইপথে রাজার যাত্রা
সেইপথ অন্য কারো নয়!
নিরুদ্দেশের হাওয়া
কি নৈরাজ্যের কালে পাখিগুলো বেড়াতে এলো
সোনার বান্ধানো ঘাট শুনেই এসেছি, পানিতে জন্মের ভয়
তবু ঝাঁপ দিই অথই জলে, ভাসছি নিরুদ্দেশে
কবে যে নোঙর কোথায় কিছুই জানি না-
দেখো সময়ের কথা সময়ে বলতে গেলেও বিপদ
কতো কি ধারার জাল, ভুল ব্যাখ্যায় অকারণ জমে মেঘ-
তুমি চাইলেই ছিঁড়ে ফেলতে পারো রেশমসূতোর দিন
কারো ইচ্ছে হলে তাঁতঘরে বসবে ফের
তোমার ইচ্ছারা যদি ঘুড়ি হয়, হাওয়ার সাথে তুমি
ভাসতেই পারো, ঘুড়িতো কোথাও না কোথাও নামবেই।
সময়ের হাত পা
তোমার উঠোনে একটা পাখি আসতো
পাখিটি দেখতে গিয়ে তোমাকেই বারবার দেখা হতো
তুমি মানে পাতাভরা রোদ, মেঘলা বিকেল
সূর্য ডোবার আগে এক রাত দেখা না হওয়ার
ভীষণ অসুখ; শুনেছি এখন আর সুখে নেই পাড়া
মর্মর আনন্দগুলো যারা থাকতো বুকের কোণায়
এতোটা প্রকাশ্য এখন যার যা মুখে আসে
বলে দিতে পারে; গোপন বেদনাগুলো
কেবলই পাতার বাঁশি, মগ্ন হওয়া কাকে বলে
কি করে বোঝাই; সময়ের এতো হাত পা
পাখিটাই ভুল করে কোথায় যেনো বেড়াতে গেছে।
শূন্যতা
কী যে যন্ত্রণা তার, বলেছি ঘুমিয়েই থাকো
কিন্তু তার ঘুম ভাঙবেই, ঘর্ষণ না হলে অনর্থক
বেঁচে থাকা, একদিন পুড়তে দেখি কাঠি
শূন্য ম্যাচবাক্স, বুকে তার ধূ ধূ শূন্যতা-
এখন পস্তালেই কি, মানুষতো নিয়ে গেছে
যার যা প্রয়োজন ছিলো, খোসা পড়ে থাকে।
আয়ু
সারাদিন খোলা দরোজা পাহারা দিয়ে
কখন ঘুমিয়ে পড়েছে রাত, আজ নৈশ স্কুল নেই
ভাঙা বাড়ির কাছে প্রাচীনত্ব শ্যাওলার মতো
জমে আছে, সন্ধ্যার ঝিঁঝিপোকারাও
মনে হয় ক্লান্ত এখন, নীরবতা দিগন্ত বিস্তৃত
হাওয়ার কাছে পড়শির কতো বেদনার কথা
উপেক্ষায় হারিয়ে যায়; সন্তুর মতো
পুরোনো বটগাছটি এখনো যে টিকে আছে
তার পাতায় পাতায় দোলা, বাঁচার উল্লাস-
আমিতো বন্ধক রেখেছি আয়ু সময়ের কাছে
দুহাতে বিক্রি করি রাত্রি ও দিন-
বাঁচার প্রেরণা যেনো শুধু বেঁচে থাকাতে।
আগুনফুল
মেঘেদেরও ছুটি হয়, মেঘেরা বেড়াতে গিয়েছে
মাথার উপর আকাশের নিঃসীম শূন্যতা থাক
আজ ফেটে যাওয়া কার্পাস ফলের মতো উড়বে হাসি
চুলেরা নাচবে হাওয়ায়, নাচুক না ঘুমঘুম রোদে
তুমি দুপুরকে ভাঙতে ভাঙতে শূন্যতাকে
ভরে দিলে নীলে, শ্যামলরেখার মতো পেছনে পড়শি গ্রাম
পড়শি উঠোন, তোমার ওড়না থেকে রংধনু ঝরে
আগুন ফুলের মতো তুমি ফুটে থাকো সন্ধ্যার কাছে।
নীরবতা
চুপ থাকা ভালো, মাঝেমধ্যে পাখিদেরও
দীর্ঘঘুম আসে, কখন যে প্রতিবেশী পাতারা
দেখে রোদমাখা দুপুরের দেহ-
তুমি কি অন্ধ পাখি, নিজের শরীরভরা ওম নিয়ে
বসে থাকো ডালে; অদূরে ডাকছে কেউ
ভাঙছে হাওয়ার বুক, নীরবে ঝরছে পাতা
হয়তো ভাবছো তুমি এ বেলা জিতে গেলে খুব।
অপরিনামদর্শী মেঘ
প্রতিদিন তোমাকে দেখি, কী অদ্ভূত! তোমাকেই হয় না চেনা
দেখি বদলে যায় নাগরিক মুখ, সকালবিকাল বলে থাকে না কিছুই
কাঠের ঘোড়ায় চড়ে কেউ কেউ যুদ্ধজয়ের বিস্তারিত
বলে যেতে থাকে, প্রশ্নবিমুখ শ্রোতাদল আমাদেরই
কারো না কারো প্রতিবেশী, শব্দ শুনি জলচৌকি বদলে ফেলার
কতোদিন তোমাকে দেখতে দেখতে মনে হয় এ কোন
অচেনা নগরে আছি, হাত ধরে হেঁটে যাবো কিছুটা পথ, বহু বাধা-
চাঁদের শরীরটাকে ঘিরে থাকে অপরিনামদর্শী মেঘ
বৃষ্টির প্রার্থনা শেষে ঘুমিয়ে পড়েছে পাড়া, পুড়ছে খামার।
বিভ্রমের বাঁশি
মাঠের কিনার থেকে ওঠে আসা ধানের গন্ধ আজ
প্রকল্পের হাতে, তোমার উচানো আঙুলে নিষেধের চিহ্ন বুঝি
লোকায়ত ধানগল্প ভুলে গেছে খেতের কৃষক-
বুনোহাঁস এখন আর এদিকে আসে না, জলা ও বন
অরক্ষিত দুটোই, চারপাশে সম্পদ কুড়ানো গান
তোমার আঙুল থেকে দম্ভ ঝরলে কেউ কেউ এটাকেই
নীতি বলে মানে, স্তাবকের সংখ্যা এখন ক্রমশ বেড়েই চলে
তোমার তৈরি দ্বীপে বেজে চলে বিভ্রমের বাঁশি, শ্রোতা তুমি
বনের মর্মর পাতা ঝরে পড়ে, তোমাকে ছোঁয় না কিছু
ডালের পাখিটি উড়ে ছায়া নেই, রোদে পোড়ে কচিপাতাঘাস।
এখনো জলের ভয়
এখনো জলের ভয়, তাই চোখ তুলে তাকাতে পারি না
হাওয়া এলে বুঝি সবাই জলকে ঢেউ বলে ডাকে
কেউ কেউ তাতে ভেসে যায়, কারো মুঠোয় ধরা
ধুলো মাতৃভূমির, ঢেউ তাকে ভাসাতে পারে না-
নোনাজল মনে রেখো পাখির বাসার মতো অনেক
খড়কুটো নিয়ে তবে একেকটি ঘর, জীবনের গভীর থেকে
ওঠে আসা সমুদ্রের ফেনা, কিছুটা দখিন হাওয়া
পাই খোলা জানালায় উড়– উড়– মেঘের কাছে
এখন চোখ তুলে যদি দেখি রামধনু মুছে গেছে
পড়ে আছে মেঘলা বিকেল, কি নামে ডাকবো সময়!
নিরর্থক সময়ের ছবি
আমি তার রক্তমাখা ছুরি দেখতে চাইনি
বহুকাল জোছনায় ভবঘুরে কেটেছে রাত
আর তুমি কিনা চাঁদের আলোর সামনে
মেলে ধরো ধাতব সস্তার ভয়, মৃত্যুভীতি
মৃৃত্যুকে কাছ থেকে কতোবার যে
দেখা হয়ে গেছে: কখনো সিংহাসনের
কাছে যাবার ইচ্ছাই হয়নি; দূরের বাঁশিই
মনে করিয়ে দেয় ঘাসমাখা মাটির গন্ধ
এখনো প্রজাপতি দেখলে বুঝি পৃথিবী
রঙিন, ঘোর লাগা ইতিহাস হয়ে আছে
কৈশোরের ঘ্রাণ, ছুরিগুলো ফেলে রাখো দূরে
যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব নিরর্থক সময়ের ছবি।
ধূলিলিপি
শুনেছি পাহারায় থাকে হাওয়া, পাতা দুললেই বাজে বাঁশি
জানালার ওপাশে তখন চৈত্রধুলোঝড়, তোমাকে দেখার সাধ
অনেক পুরোনো এখন, বরং চুপচাপ থেকে যাওয়া ভালো
কথা হলে ভুল ব্যাখ্যা আসে ধূলিলিপি পাঠে-
ছুঁয়ে দিতে গেলে যদি ভেঙে যায় পাত্র মাটির, এই ভয়ে
দূরে বসে শালিকের ঝাঁক খুদকুড়ো খুঁটে, তৃষ্ণা মরতে থাকে
যারা ভাবে না কিছু হয়তো তারা বেশ ভালো আছে
পোড়ার রুপালি ক্ষেত দেখে না তাই কাকে বলে দহনকাল
কিছুই বোঝে না তারা, মানুষের ঘরবাড়ি ছাই হতে থাকে
গাছের শরীর থেকে চামড়া খসে পড়ে, উল্লাস করতে করতে
ছুটে অন্ধ শিকারি, ঘোড়ার লাগাম ধরে হেঁটে যায় কেউ-
তোমার তাঁবুর কাছে মরে থাকে পাখি, প্রবেশ নিষেধ।
পোড়া ঘাস
নিজেকে সমর্পণ করতে করতে দেখি
সূর্য ধূ ধূ বিকেলের দিকে নামে, ক্লান্ত পাখির ডানা
ছুঁয়ে যায় একদিন তোমার রঙিন জামার মতো
মেঘের পাহাড়; চাইলেই ফেরা হয় না কোথাও-
দেখিতো পুড়ছে ঘর, বিপন্ন পাতার বাঁশি
পুরোনো বাড়িগুলো কি রকম ছাই হয়ে যায়
পোড়া ঘাস মৃত নীতির মতো ধূসর, একা।