লোক-সংস্কৃতি মানে সহজ কথায় লোকের ভাবনা, লোকজনের সংস্কৃতি, সাধারণের সংস্কৃতি। লোক-সংস্কৃতির সংজ্ঞা নিয়ে পন্ডিতজনের নানা মত আছে। বলা চলে সংস্কৃতির কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা চোখে পড়ে না। পণ্ডিতে পণ্ডিতে জ্ঞানের তোলপাড় থাকায় সংজ্ঞা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন। তবে সবকটিরই যুক্তি বিবেচনা অগ্রাহ্য করারও নয়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও নিহাররঞ্জন রায় সংস্কৃতি নিয়ে গভীর বইপত্র লিখেছেন, কিন্তু মূলকথা হচ্ছে, সংস্কৃতি পঁষঃঁৎব যা পঁষঃরাধঃরড়হ থেকে এসেছে অর্থাৎ চাষকরা, যত্নকরা ইত্যাদি। পরবর্তীকালে আরও বহু মহাজন সংস্কৃতি নিয়ে লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, গোপাল হালদার এমনকি সমকালীন মার্কসবাদী পণ্ডিত বদরুদ্দীন উমর এর নাম উল্লেখ করা যায়। বাউল মরমিয়াদের গানেও সংস্কৃতির চাষাবাদের কথা উঠে এসেছে। যেমন- ‘মন তুমি কৃষি কাজ জান না/ এমন মানব জমিন রইল পতিত/ আবাদ করলে ফলত সোনা’ ইত্যাদি।
‘লোকশ্রুতি’ জানুয়ারি ১৯৮৯ সংখ্যায় নদীয়ার চয়ন উদ্দিন মল্লিক ও রূপচাঁদ সরকার এর যে লোক-সংস্কৃতির জারিগান প্রকাশিত হয়েছে তার অংশ বিশেষ নিম্নরূপ:
“কারে বলে লোক সংস্কৃতি শোনো সবে।
যাহার সাহায্যে অরাজক দূর হবে।।
সমাজ গঠন আচরণ অনুষ্ঠান।
জনহিতে নানা স্থানে বহু প্রতিষ্ঠান।।
হিংসা নিন্দা দলাদলি না থাকিবে আর।
ছোঁয়াছুয়ি না থাকিবে কাহারও মাঝার।।
পুরানো দিনের লুপ্ত তথ্যের সন্ধান।
দ্বিতীয় উেেদ্দশ্য এই অতীব মহান।”
এসবের মাঝে মানুষের শ্রম ঘাম থেকে উৎসারিত সৃষ্টিই গুরুত্ব পেয়েছে। সহজ কথায় মানুষের বৈষয়িক বস্তুগত জীবন ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে যে দর্শন, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিন্তা, চেতনা ইত্যাদি রয়েছে, তার সামাজিক প্রতিফলনই হচ্ছে সংস্কৃতি-যার নানা ব্যাখ্যা হতে পারে। ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে তার নানা ভাগ-পর্ব থাকলেও মূল ভিত্তি-ভূমি কিন্তু মানুষের বস্তুজগত, যার আধুনিক ব্যাখ্যা অর্থনীতি বা ভিত্তিকাঠামো, পক্ষান্তরে ভাব বা চেতনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুই উপরি কাঠামো। এ দুটির জড়াজড়িতে জগত-সংসার প্রবাহিত, জীবন ও সংস্কৃতি এভাবেই আবর্তিত।
আমাদের বুঝে নেওয়া ভালো যে, মানুষ প্রাণিজগৎ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর থেকে মানুষ এই গ্রহে বিকাশমান প্রাণি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এখনও এই বিকাশের যাত্রা অব্যাহত আছে। পৃথিবীতে যত মিথ, পুরাণ, গল্প, গাঁথা, রূপকথা, রূপকাহিনী ইতিহাসে আছে, লোকভা-ার কিন্তু মানুষ। মানুষের অক্ষর উদ্ভবেরও আগে মুখে মুখে লোক-সংস্কৃতির তথ্য ভা-ার সমৃদ্ধ করেছে। এখনও নিরক্ষর মানুষের ভাষার লোকভা-ার গুরুত্ব হারায়নি। ভাষার উদ্ভবের পরও মানুষ তার চর্চা ও গবেষণার মধ্য দিয়েও লোক সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হয়েছে। তাই মানুষের আদি ভাষা কিন্তু লোকভাষা।
ভৌগোলিক পরিবেশ, আর্থ-সামাজিক অবস্থা-ব্যবস্থায় জীবন ও জীবিকায়, দেশে দেশে তার রূপ-রূপান্তর ঘটেছে-কিন্তু মূল যাত্রা বিন্দুর সঙ্গে লোক-সংস্কৃতির একটা অন্তর্লীন সাযুজ্য রয়েছে। জগত ও জীবন যেহেতু মানুষের বস্তুময় জীবনকে বাদ দিয়ে নয়, সেহেতু লোকসংস্কৃতি ও মানুষের জীবন থেকে উৎসারিত হওয়াতে তা কাল-কালান্তরে পরিবর্তিত হবে, তাতে কি, কিন্তু অধুনা আমাদের ভাবনায় ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, নাগরিক সংস্কৃতি যেভাবে গ্রামীণ সংস্কৃতিকে আচ্ছন্ন কিংবা তাড়িত করে রেখেছে, তাতে লোক-সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য, বৈশিষ্ট্য রক্ষা পাবে কি, না লোক-সংস্কৃতি একদিন লোপাট হয়ে যাবে কি না; এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তাড়িত করে থাকে লোক-সংস্কৃতির প্রতি একটা গভীর মমত্ববোধ থেকে। যার ফলে লোক-সংস্কৃতির প্রতি একটা দরদ বা আকর্ষণ বোধ থেকে এমনও ধারণা তৈরি হয়ে আছে যে, নাগরিক জীবন থেকে দূরে, বহুদূরে নিস্তরঙ্গ জনপদে, পাহাড়ে, টিলায়, বনে-জঙ্গলে, নদীর কিনারে গড়ে উঠা যে মানুষের বসতি, তাদের জীবন ও জীবিকা, সংস্কৃতি যেভাবে আছে তা সেভাবেই থাকুক। তাতেই লোক-সংস্কৃতির অকৃত্রিম অবস্থা রক্ষা পাবে। লোক-সংস্কৃতির প্রতি এমন প্রগাঢ় মমত্ববোধ থেকে এমন ধারণা জন্ম নিতে পারে, তা কিন্তু সঠিক নয়, ভ্রান্ত। সংস্কৃতি নদীর স্রোতের মতো বহমান- লোক-সংস্কৃতিও তাই। পুরাণ কাহিনীতে আছে, দেবী অন্নদার নিকট ঈশ্বরী পাটনী এই বর প্রার্থনা করেছিলো যে, ‘আামার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’ এই আর্তি তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থারই প্রতিফলন। এরকম কথা পৃথিবীর অপরাপর মানুষের ধর্ম ও কাহিনীতে আছে। সমকালীন সমাজেও এমন আর্তি নিঃশেষ হয়ে যায়নি।
আমাদের ব্রিটিশ ভারতে একদা ব্রিটিশরা এ দেশে চা বাগান পত্তন করে। চা বাগান প্রতিষ্ঠার কাহিনী যেমন আছে, লড়াই সংগ্রামও আছে। চা বাগান প্রতিষ্ঠার লোভনীয় আবেদন কিভাবে এখানকার লোক জীবনকে তাড়িত করেছিল, তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই লোকছড়ায়:
“এই মিনি আসাম যাব রে
দেশে বড় দুঃখ আছে রে
আসাম দেশে রে মিনি
চা বাগান হরিহর। (সবুজ)”
তখন ঝাঁকে ঝাঁকে তাড়িত হয়ে ভারতের উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বাকুড়া, মেদিনীপুর, উড়িষ্যা প্রভৃতি এলাকা থেকে আয় রোজগারের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ ঘোষিত সিলেট আসামে লোকজন আসতে থাকে। কিন্তু এভাবে দেশত্যাগ, স্বজন, প্রিয়জন ছেড়ে কোম্পানির অধিক টাকার লোভে তারা এলেও তাদের জীবনের হিসাব মেলেনি। বরং ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের শোষণ নির্যাতন তথা শ্রম দাসত্বের শিকার হয়েছে তারা। তারা ফিরে যেতে বিদ্রোহ করেছে, কিন্তু এখানে থেকে গেছে অনেকেই। তখন তাদেরই কণ্ঠে উচ্চারিত এ লোকভাষা:
“হায়রে নিঠুর শ্যাম
ফাঁকি দিয়া পালাইল আসাম
সর্দার বলে কাম কাম
বাবু বলে ধরে আন
সাহেব বলে লিব পিঠের চাম।”
চা বাগানে সর্দার, বাবু ও সাহেব (ম্যানেজার) এর নিষ্ঠুর নির্যাতনও এই লোকছড়ায় উচ্চারিত হয়েছে। শুধু চা বাগানেই নয়, যেখানেই মানুষ আছে, তা গ্রামে হোক, শহরে হোক, মানুষের জীবন যেখানে আছে সংস্কৃতিও সেখানে আছে। লোকসংস্কৃতি বিলুপ্ত হতে পারে না, বিবর্তিত হয় মাত্র। মানুষ থাকবে, লোক-সংস্কৃতি থাকবে না, তা হয় না। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ও লোক-সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে থাকে। লোক-সংস্কৃতি মানুষের নাড়ির স্পন্দন- তা গ্রামেই হোক আর শহরেই হোক।
অনেকের ধারণা এলিট, বিদ্বান কিংবা নগর জীবনে লোক-সংস্কৃতি মরে যায়- তা কিন্তু ঠিক নয়। লোক-সংস্কৃতির অসংখ্য দরজা-জানালা আছে। লোক-সংস্কৃতি বিশেষ কোনো পূর্ব ধারণা থেকে তৈরি হয় না। লোক-মানুষের অন্তর থেকে রচিত হয়। এই অর্থে লোক-সংস্কৃতি বিলুপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই; এটা উৎপাদন ও পুনঃউৎপাদনের মতো।
একদা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ জাতিসত্তাটি পর্যন্ত বিলুপ্ত করে দিতে উদ্যত হয়েছিল, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি, বরং প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা রক্ষা পেয়েছে এবং আমাদের জীবন, সাহিত্য-সংস্কৃতি এমনকি আমাদের লোক-সংস্কৃতিরও রূপায়ন ঘটেছে নবতরভাবে। খানসেনাদের নিয়েও লোকছড়া রচিত হয়েছে। সুতরাং লোক-সংস্কৃতি নিয়ে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এটা কোনো বদ্ধ জলাশয় নয়- প্রবহমান নদীর স্রোত, তা ভাঙ্গে, গড়ে। এমনকি তথ্য প্রযুক্তির দৌরাত্ম্যেও লোক-সংস্কৃতির বিতাড়নের ভয় নেই। লোক-সংস্কৃতি কেবল নতুন পরিপ্রেক্ষিতে শরীর পাল্টায়।
সহায়ক সূত্র: লোকশ্রুতি সংখ্যা ১৯৯৯, সম্পাদক: মিহির ভট্টাচার্য্য