একটি একমুখী প্রেমের গল্প

0

প্রথম যেদিন মেয়েটিকে প্রেম-ভাষণ শুনিয়েছিলাম, বসেছিলাম আলগোছে বয়ে চলা এক অচেনা নদীর তীরে ছড়িয়ে থাকা ঘাসের বুকে। গায়ে গায়ে স্পর্শহীন পাশাপাশি বসা দু’জনার দৃষ্টি প্রবাহিত হচ্ছিলো সামনের প্রবহমানতার দিকে। আমার চোখ দু’টি নদীটির  সমান্তরালে আরেকটি নদী হয়ে উঠেছিলো-সৌম্য-সজল-আবদ্ধ নদী; কোন নদীর পানিই সেদিন উপচে উঠে নি।
মেয়েটির নাম নীপা। নীপা একবার আমার মুখের আকুলতার প্রলেপ মাখা মুখের দিকে চোখ মেলে তাকায়-তার চোখ দুটোকে মনে হয় যেন মরা নদীতে জেগে থাকা শুকনো চর-কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে, দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় বিপরীত পাশে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ এমনকি সামনের কাদা-জলের নদীটির দিকেও আর ফিরে তাকায় নি।
দু-হাতে বেড় দিয়ে ধরা ভাঁজ করে রাখা দু-হাঁটুর মাঝে মুখ ডুবিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রোদ রঙা মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত বসে থাকলো একবার। সবুজ থেকে তার চোখ দুটো ক্রমান্বয়ে উঠে গেলো নীলে, একটুবাদেই উল্টো পথে নেমে এলো। গিলোটিনে মাথা রাখার ভঙ্গিমায় দু-হাঁটুর মাঝে আড়াআড়িভাবে থাকা বাহুর উপর থুতনী রেখে প্রায় নিঃশব্দ নদীটির দিকে মেয়েটি এবার তার দৃষ্টি মুক্ত করে দিলো, রাজনৈতিক সমাবেশের উদ্বোধন ঘোষণার সময় আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীরা যেভাবে দু-হাত উপরের দিকে মেলে ধরে সাদা কবুতর ছেড়ে দেয়। খানিকবাদে তার মুখ উপরের দিকে উঠতে শুরু করে, ভূ-পৃষ্ঠের সাথে ৪৫ ডিগ্রী কোণে আসার পর চোখের দৃষ্টি স্থির হয়।
বসার ভঙ্গীতে এবার সে খানিকটা পরিবর্তন আনলো বাম দিকে হেলে পড়তে থাকা মাথাটি খানিকটা কোনাকুনিভাবে স্থিত হলো থাইয়ের উপর কনুই রাখা হাতের তালুর উল্টা পাশের উপর গাল রাখায়, অপর হাতটি অন্য পায়ের হাঁটুর উপর এমনভাবে রাখলো যেন ঢালু পাড়ে বসে ডোবার জলে ফেলা বড়শির ছিপ।
এ-পাড়ে বসে থেকেও কেনো তার মন হাড়গিলে ধরনের নদীটিকে খুব সহজেই ছাড়িয়ে গিয়ে ও-পাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গুল্ম-ঝোপগুলোর কোন একটাতে আশ্রয় নিয়েছে,  মেয়েটি বোধ হয় তা নিজেও জানে না।  
আস্তে আস্তে তার মুখের চামড়ার জলোভাব কমে যেতে থাকে, আর তার বড় বড় চোখ-দুটো চেপে আসতে শুরু করে দু-পাশ থেকে কৃষকের কাটতে থাকা চরাক্ষেতের আলের সংকীর্ণতায়।  
লম্বা লম্বা বিরতি দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে চলতে থাকা আমার প্রেম-বক্তৃতা উদাসী মেয়েটির মনের পর্দায় লেগে প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার দিকে নয়, নদীটির দিকেও নয়, ফিরে যাচ্ছিলো অন্য কোন পানে। আর একই ব্যাপারের দুই বিপরীতধর্মী প্রান্তের কারণে আমাদের দুজনেরই ক্রমান্বয়ে করুণ থেকে করুণতর হয়ে উঠা যেন শীতে কাবু ব্যক্তির মতো চাদর গায়ে খানিকটা কুঁজো হয়ে কুয়াশার ভেতর দিয়ে নীরবে হেঁটে যাচ্ছিলো।   
শিকার ধরার আশায় ধূর্ত শিয়ালের সতর্কতায় বিকেল রাত্রির বিশাল গহ্বরের দিকে এগিয়ে চলার কালে ক্ষণিকের জন্য সন্ধ্যার ছোট গর্তটিতে এসে আশ্রয় নিলো। চুমু খেতে অনিচ্ছুক ঠোঁটের মতো পরস্পরের সাথে সেটে থাকা নীপার ঠোঁট দুটি খানিকটা ফাঁক হলো, কোন কথা বের হয়ে এলো না, তবে ফাঁকটাও বুজে গেলো না।
অন্ধকার এমন মাত্রায় চাগিয়ে উঠলো যখন আবছাভাবে মুখাবয়ব টের পাওয়া গেলেও মুখের রেখায়, ভ্রুর কুঞ্চনে, চোখের নড়াচড়ায় অভিব্যাক্ত অনুভূতি ঠাহর করা যায় না। অন্ধকারের এমন সুযোগের প্রতীক্ষাতেই সে বোধ হয় ছিলো, যাতে করে তার মুখম-লে ভেসে উঠা আমার প্রতি অপ্রেমানুভূতি আঁধারের আবরণে ঢাকা পড়ে। মাঝে সামান্য পুরু তবে দু-পাশে সরু হয়ে আসা একটা ক্ষুদ্র রেখার মতো ফাঁক করে রাখা ঠোঁট দুটির ভেতর দিয়ে এতোক্ষণে বেরিয়ে আসে কয়েকটা টুকরা-টুকরা কথা। আমাকে ভেবে এক কোয়ার্ক পরিমাণ প্রেমাকর্ষণও নাকি তার বুকে স্পন্দিত হয়ে উঠে না কখনও। তার কাছ থেকে প্রেম পাওয়ার আশা যেন আমি সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে দেই। এমনকি এ-ব্যাপারে আমার প্রতি সামান্যতম করুণাপরবশ হয়ে উঠাও নাকি তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। গ্রাম্য লোকদের কাছে থেকে বাক্যাংশ (চযৎধংব) ধার করে বলা যায়- সে আমাকে একেবারে ‘পুইছা না কইরা’ দিলো। তবে কথাগুলো বলতে গিয়ে তার কণ্ঠস্বর এতোই নমনীয় হয়ে উঠলো যে, শব্দগুলো উচ্চারণের সময় মাঝখানে বা কানি-কোনাতে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। জবাই হওয়ার কালে পশু-পাখির কষ্ট যাতে কিছুটা হলেও কমে- এমন আশায় যেমন ছুরি বা বটি শান দিতে দিতে অনেক বেশি সুচারু হয়ে উঠার ফলে নরম হয়ে পড়ে এবং জবাই করার কালে ধারালো অংশ মাঝে মাঝে ভেঙ্গে যায়- ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।
নিষেধ পেয়ে আমার প্রেমটি যেনো সহজ-সরল, বোকাসোকা ধরনের নির্দোষ, জেদী, চাষাড়ে ব্যাক্তির হঠাৎ রেগে উঠে উচ্চপদস্থের সাঙ্গোপাঙ্গোদের হাতে মার খাওয়ার সম্ভাবনা জেনেও তেড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বেড়ে চলতে লাগল এবং একসময় ইউটার্ন করে বিরক্তির দিকে মুখ করে এগোতে শুরু করলো। যখন- যেভাবে তাকে পেতাম, বেদনা ভরা প্রেমের ঝাঁপি নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়াটা যেনো আমার অভ্যাসে পরিণত হল- বেশ শক্তপোক্ত একটা অভ্যাস। প্রত্যেকবারই সে নিজের ভেতরে লুকিয়ে পড়তে পড়তে একসময় প্রথমবার-বলা-কথাগুলো একই ঢঙে পুনরাবৃত্তি করে চুপ হয়ে যেতো, মাঝে মাঝে তার মুখের আবহে গোপনে ফুটে উঠত দুর্বহ ক্লান্তির চিহ্ন।
প্রথম প্রেম-ভাষণের পূর্বে তার সাথে আমার সম্পর্ক বেশ সহজ-সতেজ, সাবলীল ছিলো বলতে হয়; তবে এরপর থেকেই তা কেনো যে তা কেমন পা-ুর, ধূসর, আর ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে উঠে! নীপার প্রতি আমার একমুখী প্রেমের উলম্ফনই-মনে হয়-তার ও আমার মধ্যকার বন্ধুত্বকে এক কোপে দু-খ- করে ফেলে দু-দিকে টানতে টানতে মাঝখানের বিস্তর বাড়িয়ে চলে। আমার সাথে দেখা হলেই যেন তার শরীরে লাগানো জীবনের হুক এক ঝটকায় খুলে যায়- জীবন থেকে সে হয়ে পড়ে সম্পূর্ণরূপে আলাদা। মাঝে মাঝে তার সাথে আমার সময় কাটানোর সুযোগ, অন্যভাবে বললে আমার সাথে তার আটকে পড়ার বিপত্তি তৈরি হলে জীবনের সহজ-স্বাভাবিক, সাদামাটা খুচরা কথাও সে আমাকে বলতে পারে না, তার ঠোঁট-দুটোর উপর অদৃশ্য তবে বেশ দৃঢ় একটা আবরণ চেপে বসে। আমি কিছু একটা বলতে শুরু করার কালে তার মুখভাব এমন হয়ে উঠে যেনো পর্বত-গুহায় আটকা পড়া কোন ব্যাক্তির হাতে-পায়ে লোহার বেড়ী পড়ানো শুরু হয়েছে। উল্টো দিকে, তার মন যতোই ঘুমোট হয়ে উঠতে থাকুক না কেনো তাকে দেখা মাত্রই আমার হৃদয়ে কিসের যেন এক মুক্তির আনন্দ প্রফুল্ল হয়ে উঠে। তবে কিছুক্ষণ বাদেই অবশ্য তার বিষণœ মনের ভার আমার উপর চেপে বসে আমাকেও পিষ্ট করা থেকে রেহাই দেয় না। এসব কিছু সত্ত্বেও তার সাথে আচম্বিতে সাক্ষাৎ ঘটে গেলে বা আমার সকরুণ আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য আমার সাথে দেখা করতে এলে, আমি তাকে সহজেই ছাড়তে পারতাম না-নানা ছল-ছুতায় চলতো তাকে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখার আপ্রাণ প্রয়াস। তাকে কাছে পেলে আমি আনন্দে ঝলমল করে উঠতাম, আর আমার থেকে ছাড়া পেয়ে সে খুশীতে বাকবাকুম করতে থাকত।
পরপর বেশ কয়েকটি ঘটনার জট পাকানোয়, সেখান থেকে নীপার বের হয়ে আসার ব্যর্থতায় ও যেকোনো ভাবে হোক তাকে আটকে রাখার আমার সচেতন প্রচেষ্টায়- এক রাত্রে বাসার ছাদের দিকে উঠে যাওয়া অন্ধকার, নির্জন সিড়িতে দু’জনের মাঝে অভদ্য কিছু দু’জনেই কল্পনা করে নিয়ে নীপার সাথে পাশাপাশি বসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। অন্যসময়ের মতো এবারও আমার প্রেম-বক্তব্য শুরু হতে দেরি হয় নি, আবদ্ধ নির্জনতা পেয়ে কক্ষপথ-বিচ্যুত মহাশূন্যে ভেসে বেড়ানো গ্রহের মতো দিশাহারা হয়ে উঠলাম আমি। হাহাকার ভরা কণ্ঠে আমার প্রতি তার প্রেমহীনতায় ভেতরে যে রান্না করা সুজির রঙের, ফুস্কুড়ি ভরা, দাঁদ আকৃতির যে গোলাকার ক্ষত তৈরি হয়েছিলো; তা খুঁচিয়ে, খামচে, আঁচরে, চুলকিয়ে, ঘষে, নখ খুটে আরো বীভৎস করে তুলে তাকে দেখানোর চেষ্টায় রত ছিলাম। বসে থাকা সিঁড়ির দুইধাপ নীচের সিঁড়িতে পায়ের পাতা রেখে নীপা এমন স্তব্ধ-নিথর হয়ে বসেছিলো যে মনে হলো, মোজাইক করা সিঁড়ির উপর সে আরেকটা সিঁড়ি বৈ কিছু নয়।
তলদেশ থেকে উঠতে থাকা জলে যেমন ধীরে ধীরে ভরে যেতে থাকে নতুন কাটা পুকুর, ঠিক তেমনিভাবে আমার চোখে জমে উঠতে থাকা জল একসময় নীচের পাতা উছলিয়ে নাকের দু-পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে। বাম পাশের ধারাটি মুখগহ্বরের ভেতরে প্রবেশ করায় পানসে জিহবাটা নোনা স্বাদে ভরে উঠে; আর ঠিক তক্ষুণি সরল অংক কষতে গিয়ে হঠাৎ তালগোল পাকিয়ে ফেলার মত ভয়ানক আক্রোশে ফুঁপিয়ে উঠি আমি, শুনতে পেয়ে নীপা সামান্য নড়ে উঠে সাথে সাথেই আবার স্থির হয়ে যায়। গ্রীক পুরাণের অভিশপ্ত টাইটান দেবতা এটলাসের ঘাড়ের উপর অনন্তকালের জন্য চেপে বসা পুরো বিশ্বটাকে সরিয়ে নিলে সে যেমন ভারমুক্ত হবে, তার পাশে বসে থেকে চোখ হতে কয়েকটা ফোটা অশ্রুর গড়িয়ে পড়ায় এবং ভেতরের শব্দগুলোর অর্থহীন ফোঁপানোয় পরিণত হওয়ায় আমিও তেমনি হালকা বোধ করলাম। মসৃণ ঢাল বেয়ে ক্ষুদ্র গোলাকার কোন বস্তু পড়তে থাকার গতিতে ফুঁপিয়ে কান্নার এগিয়ে চলা এবং চোখের অশ্রুরাশির গড়িয়ে নামা অব্যাহত রইলো।
একপর্যায়ে যা ঘটলো তা শুনে পাঠক যতটা বিস্মিত হবেন, তার চেয়ে অনেকবেশী হতবাক হয়েছিলাম আমি। আপনারা তো শুধু আমার জবানীতে ছোট্ট ঘটনাটির সাদাসিধে বিবরণ শুনবেন, আর আমি ছিলাম ঘটনাটির কেন্দ্র। আমার ভেতরে সমাবেশ হওয়া প্রচুর সংখ্যক অনুভূতির অধিকাংশই আমার কাছে ছিল সম্পূর্ণরূপে নতুন; সেই অভূতপূর্ব অনুভূতিগুলো স্মৃতির রোমন্থনে আর কখনও জাগিয়ে তুলতে পারি নি- বুকের ভেতর পেলে একবারই মাত্র অনুভব করা যায়, তারপর সারা জীবনের জন্য থেকে যায় অধরা। আর পরিচিত যে অনুভূতিগুলো সে-সময় অনুভব করেছিলাম, ঘটনাটা শুনলে এমনিতেই সেগুলো- আমার মতো অত তীব্র মাত্রায় না হলেও-অনুভব করতে পারবেন বলেই আশা করি; আর আমিও কিছুটা- সাধ্যে যতোটা কুলায়-বর্ণনা করার চেষ্টা করবো।  
যাহোক, চলুন তাহলে এবার ঘটনাটির কাছে যাওয়া যাকঃ নীপার একটি হাত হরিণ-ক্ষীপ্রতায় এগিয়ে এসে আমার কপালের সামনের একগোছা চুল তার ছোট মুঠিতে নিলো, পায়ের পাতা পিছলে নেমে এলো কয়েক ধাপ নীচে, ফলে থাই দিয়ে তৈরি বুকের সামনের দেয়াল গেল সরে; এরমধ্যেই অপর হাত দিয়ে তার পরনের কামিজের প্রান্ত কয়েক ভাঁজ গুটিয়ে ধরে এক হ্যাঁচকা টানে খানিকটা উপরের দিকে উঠিয়ে মুহূর্তখানেকের জন্য থেমে সামান্য চেষ্টায় হাতের কয়েকটি আঙুল ব্রা-এর নীচে সেঁধিয়ে তারপরে আরেকটা আলতো টান, বুকের ঐ-পাশটিতে আঁধার ছাড়া কোন আব্রুই আর রইলো না; মুঠিতে চুলের গোছা ধরা হাতের সাহায্যে ত্বরিৎ মমতায় আমার মুখ টেনে নামিয়ে বসিয়ে দিলো বাচ্চাদের ফুটবল আকারের তার তুলতুলে স্তনের উপর, তৎক্ষণাৎ আমার ভেতরে ঘটে গেল স্বল্পসময়-দৈর্ঘ্য সুপারনোভা ধরনের কিছু একটা। মুঠ ছেড়ে দিয়ে নীপার ফোলা ফোলা আঙুল আমার চুলের ভেতর দিয়ে বইতে শুরু করে, গালের উপর টের পাই অপর হাতের বায়বীয় স্পর্শ। কয়েকমুহূর্ত পর মাছের চোখের মতো তার ছোট্ট স্তনাগ্রটি আমার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ঢুকে জিহ্বার ডগা স্পর্শ করা মাত্রই আমার দেহ-ঘড়ির (ইরড়ষড়মরপধষ পষড়পশ) কাটা যেন পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল, একপর্যায়ে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল; তার স্তনের উপর আমার মুখের ক্রমশ বেশি করে চেপে বসতে থাকায় গাড়ির এক্সিলেটরে চালকের পায়ের চাপ ফেলার মতো বিশ্ব-সময় (ঁহরাবৎংধষ ঃরসব) এর সাথে সাথে আমার শরীর-মনের সময়-প্রবাহের গতি বেড়েই চলতে থাকলো…  

গল্পটি এখানেই শেষ।
এখানে যা বলব তা গল্পের অংশ নয় কোনমতেই, পাঠ-প্রতিক্রিয়া মাত্র।
আমার লেখার পাঠক আমি নিজেও। গল্পটি পড়তে পড়তে শেষ পর্যায়ে এসে একটা খটকা বোধ করলাম। আমি বাদে গল্পটির আরো কোন পাঠক যদি থাকে তাহলে বোধ করি তিনিও এখানে এসে একটা হোঁচট খাবেন। কেউ কেউ হয়ত এই ধাক্কা খাওয়ার ব্যাপারটাকে পাঠকদের চমকিত করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা গল্পের নিছকই একটা টুইস্ট মনে করে আমোদিত বোধ করতে পারেন, তাদের কথা অলাদা। যাহোক, খটকাটা হচ্ছে, গল্পের নীপা নামের মেয়েটি হঠাৎ এমন প্রায় অস্বাভাবিক একটা কা- কেন ঘটালো। এর পেছনের ব্যাখ্যাটা আসলে কি? গল্পটির লেখক হিসেবে এই ঘটনার তেমন কোন বিশ্লেষণ আমার জানা নেই এবং এটা শুধুই একটা গল্প হওয়ার কারণে গল্পের নীপা নামের মেয়েটির অস্তিত্ব গল্পের বাইরে নেই বিধায় ঘটনার পেছনের কারণটি তার কাছ থেকে জেনে নেবো-এমনটাও সম্ভব নয়; তাই পাঠক মাত্র হয়ে ঘটনাটির বিশ্লেষণ হিসেবে নিজের একটা অভিমত দাঁড় করানোর চেষ্টা করবো এবং এমন অধিকার অন্য কোনও সমালোচক বা অন্যান্য পাঠকের মতো আমারও আছে নিশ্চয়ই।

গল্পের কথক চরিত্র যখন অন্ধকার, নির্জন সিড়িতে বসে নীপা নামের মেয়েটিকে তার প্রেমপূর্ণ হৃদয়ের বেদনার কথা শোনাচ্ছিল তখন মেয়েটি হয়তো কথক চরিত্রের প্রতি সামান্যতম প্রেম বোধ না করা সত্ত্বেও বেশ ভালোরকম সহানুভূতি-প্রবণ হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে ছেলেটির নিজস্ব দুঃখ, কষ্ট এবং বেদনার অনুভূতি ধীরে ধীরে মেয়েটির মধ্যে সঞ্চারিত হওয়াটাই স্বভাবিক। প্রেমহীনতায় ছেলেটির ভেতরে যে বিশ্রী ক্ষত তৈরি হয়েছিল, ঐ অভিজ্ঞতায় ভেতর দিয়ে না গিয়েও কেবলমাত্র ছেলেটির মুখ থেকে বর্ণনা শোনার ফলেই মেয়েটির ভেতরেও ঐরকমই একটা ঘা তৈরি হয়ে থাকবে। এমনও হতে পারে যে, একপর্যায়ে মেয়েটি ছেলেটির দুঃখে ছেলেটির চেয়েও বেশি কষ্ট পাচ্ছিল। অন্ধকারের মধ্যে ছেলেটি দেখতে না পেলেও মেয়েটির চোখ থেকে নীরবে অশ্রু ঝরছিল না, তাই বা কে বলতে পারে। ছেলেটি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠার দিকে নিজেকে নির্দ্ধিধায় ঠেলে দিলেও অপরের দুঃখে কেঁদে উঠার মতো লঘুতার লজ্জায় মেয়েটিকে হয়তো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠাকে বুকের ভেতরে জোর করে চেপে রাখতে হয়েছিল। ফলে মেয়েটির মধ্যে সঞ্চারিত দুঃখের কিছুটা অংশ চোখের জলের মধ্য দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হলেও বেশিরভাগ অংশ ভেতরেই থেকে গিয়েছিল। মেয়েটির চোখ থেকে অশ্রু পড়ার কথা, যেটা একটু আগে উল্লেখ করেছি, তা আমার অনুমান মাত্র। যে কারণে মেয়েটি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতে পারে নি ঠিক একই কারণে সাধ্যমত চেষ্টায় চোখের জলকে বোধ হয় সে ঠেকিয়ে রেখেছিল- এমন হওয়াটাও বিস্ময়কর নয়। আরেকটা ব্যাপার হল, ছেলেটা তার নিজের দুঃখ মেয়েটির মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়ে নিজে বেশ কিছুটা হালকা হয়েছিল। তবে মেয়েটি তার মধ্যে সঞ্চারিত হওয়া দুঃখ এই মুহূর্তে আরেকজনকে বলে নিজে কিছুটা ভারহীন হবে তেমন উপায় তার কোথায়! মেয়েটি নিশ্চয়ই তার মধ্যে সঞ্চারিত হওয়া ছেলেটির দুঃখ ছেলেটিকেই বলতে পারে না, তাহলে ব্যাপারটার কেমন হাস্যকর হয়ে উঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়। দুঃখ নির্গমনের রাস্তা ছেলেটির থাকলেও, এরকম কোন পথ মেয়েটির সামনে ছিল না। ছেলেটির দুঃখ যেহেতু মেয়েটির দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল, ফলে এ-কথা প্রায় নির্ধিদ্বায় বলা যায়- ছেলেটির দুঃখ যতোই কমে আসছিল, মেয়েটির বেদনা পাল্লা দিয়ে ততোই বেড়ে উঠছিল। মেয়েটির কষ্ট ছেলেটির দুঃখের চেয়ে বেশি হওয়ার আরেকটি কারণ এখানে থাকতে পারে- তার প্রতি প্রেমে পরিপূর্ণ ছেলেটির প্রতি ভালোবাসাবোধ না করার কারণে মেয়েটি বোধ হয় নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল, একটা অপরাধ বোধে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়ছিল তার মন এবং এর ফলেই হয়তো তার কষ্টটা খানিকটা বেড়েই গিয়েছিল। এইসবগুলো অনুমানসিদ্ধ যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, একটা সময় মেয়েটির ভেতরে সঞ্চারিত হওয়া দুঃখের পরিমান ছেলেটির নিজস্ব কষ্টের চেয়ে পরিমানে অনেক বেশি ও ওজনে বেশ ভারী হয়ে উঠেছিল। যাহোক,  মেয়েটির ভেতরে ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠতে থাকা এই দুঃখ নির্গমনের কোন রাস্তা না পেয়ে একপর্যায়ে একগুয়ের মত স্নায়ু-পথ বেয়ে সামনের দিকে ধাবিত হয়ে স্তনে এসে চিনচিনে টক ধরনের শারীরিক ব্যাথার আকারে জমা হয়। সহজ কথায় বললে, মানসিক দুঃখ পরিণত হয়েছিল শারীরিক ব্যাথায়। নীপার ভেতরে শুধু দুঃখই নয়, ছেলেটির একঘেয়ে রোমাঞ্চহীন প্রেমের কারণে তৈরি ছেলেটির প্রতি একধরনের বিরক্তি, বিরক্তির ফলবশত একধরনের ক্লান্তি এবং ছেলেটির প্রতিনিয়ত প্রয়োগ করতে থাকা আবেগীয় চাপ- এগুলোও নির্জন সিঁড়িতে দুজনে পাশাপাশি বসে থাকার মুহূর্তে অনেকবেশি পরিমাণে জমে উঠছিল। এগুলোও বোধ হয় স্নায়ু-পথ বেয়ে দুঃখগুলোর পিছন পিছন এসে স্তনের ভেতরে দুঃখ রূপান্তরিত হয়ে তৈরি হওয়া টক মতো চিনচিনে শারীরিক ব্যাথাটাকেই শক্তিশালী করে তোলে বা অন্যধরনের শারীরিক ব্যাথায় রূপান্তরিত হয়ে ঐ ব্যাথার পাশে অবস্থান নেয়। শরীরই তার নিজস্ব কর্ম-প্রক্রিয়ায় খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে অন্য কারো শোষণ ব্যাতিরেকে স্তনের ভেতরে আস্তানা গাড়া- এই মুহূর্তে শারীরিক ব্যথায় পর্যবসিত হয়ে উঠা- দুঃখ, বিরক্তি, ক্লান্তি, চাপ নিজ থেকে বের হতে পারবে না। তাই বোধহীন শরীর হয়তো যাকে সামনে পেয়েছে এই শারীরিক ব্যাথাকে শোষণ করার জন্য তাকেই কাজে লাগিয়েছে। এটাও হতে পারে যে, এই পর্যায়ে এসে মেয়েটি হয়তো তার স্তনে জমা হওয়া দুঃখ, বিরক্তি, ক্লান্তি, চাপ বের করে দেওয়ার উপায় খুঁজতে খুঁজতে একসময় যে মানুষটা এগুলোর জন্য দায়ী তার মুখটিকে নিজের স্তনের দিকে টেনে নামিয়েছে জাস্ট শোষণ-প্রক্রিয়ার একধরনের যন্ত্র হিসেবে। তবে, ঘটনা সংগঠনকালে ভেতরের একটি ব্যাপার উল্টে যায়। ছেলেটি যখন মেয়েটির স্তনে শারীরিক ব্যাথার আকারে জমা হওয়া নিজেরই দুঃখ, নিজেরই তৈরি করা বিরক্তি, ক্লান্তি, চাপ মুখ দিয়ে টেনে নিচ্ছিলো তখন তা পরিণত হয়ে উঠে মুখ-সুখে যা একধরনের শারীরিক সুখ, এবং তা যখন ধীরে ধীরে নীচের নামতে নামতে হৃদপি-ে এসে পৌঁছায় তা পরিণত হয়ে উঠে মানসিক সুখে। মেয়েটি যেমন দুঃখ থেকে ধীরে ধীরে নিষ্কৃতি পেয়ে নির্ভার হয়ে উঠছিল, ঠিক তেমনি ছেলেটি ভেসে যাচ্ছিল অনাবিল শারীরিক এবং মানসিক সুখের প্রবাহে। এই ঘটনায় ছেলেটিই যে শুধু প্রথমে শারীরিক আনন্দ ও পরবর্তীতে মানসিক আনন্দ পাচ্ছিল ব্যাপারটা তা নয়, দুঃখ নিষ্ক্রমণের ফলে মেয়েটি নিজেও পেয়েছিল একধরনের শারীরিক সুখ এবং এটাও একপর্যায়ে অবধারিতভাবেই মানসিক সুখে রূপান্তরিত হয়। যাহোক, ভেতরের ঘটনাপ্রবাহকে পর্যায়ক্রমে সাজালে এরকম দাঁড়ায়- মানসিক কষ্ট, শারীরিক কষ্ট, শারীরিক সুখ, মানসিক সুখ-এই মুহূর্তে এই চারটি ব্যাপারই মেয়েটির ক্ষেত্রে ঘটে আর কেবল শেষের দুটি ঘটে ছেলেটির ক্ষেত্রে। আমরা জানি- দুঃখ, বিরক্তি, ক্লান্তি, চাপ থেকে মুক্ত হওয়ার ফলে উদ্ভূত সুখ কখনও কখনও অন্যভাবে পাওয়া সুখের থেকেও অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে, ফলে এখানে এসে আমরা এটাও মনে করতে পারি- এই মুহূর্তে মেয়েটির পাওয়া সুখ ছেলেটির সুখের চাইতেও বেশি ছিল। 

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার