আমার মাঝে আমি

0

নিস্তব্ধ রাতে একাকী বসে আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছি। আসলে নিজ থেকে কিছু ভাবতে হচ্ছে না। একটার সুতো বেয়ে আরেকটা চলে আসছে। তাই এসবের না আছে আগা, না আছে কোন গোড়া। এলোমেলো, বিশৃঙ্খল ভাবনারাশিতে জড়িয়ে যাচ্ছি ক্রমশ।
হ্যাঁ এমনই হয়। এখানে আসার পর থেকে প্রতিদিনই আমি এভাবে আমার ভেতর জড়িয়ে যাই। বিশেষত অফিস শেষে রুমে এসে একাকী বসে বিভিন্ন দিকে দৌড়তে দৌড়তে রাত বাড়ে। রাত বাড়তে বাড়তে একসময় ঘুম চলে আসে। ঘুম থেকে উঠে গেলে নতুন আরেকটি দিন শুরু হয়। কিন্তু অনেককিছুই থাকে আগের দিনের মতো-পরিবর্তনহীন, বৈচিত্রহীন, নিস্তরঙ্গ। এ এক কঠিন বৃত্ত যেন। কোন বৃত্তে ঢুকে পড়লে যেমন ঘুরপাক খেতে হয়, আমিও তেমনি অহর্নিশ ঘুরছি। এভাবেই একদিন গেছে, দুদিন গেছে, অনেকদিন চলে গেছে নিজস্ব ঘূর্ণন পথে চলে।
অথচ এখানে আসার আগে ঘূণাক্ষরেও আমার মনে আসেনি এভাবে দিন পার করতে হবে। ভবিতব্য কল্পনা করা আমার পক্ষে কখনো সম্ভব হয়নি; এমনকি ধারে কাছেও যায়নি। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। নতুন চাকরি পেয়ে এসব নিয়ে ভাবারও আসলে কোন সুযোগ ছিলো না। এমত ভাবনার চেয়ে বরং একটা নতুনত্বের আমেজ শরীর মন জুড়ে বিস্তৃত ছিলো। আচ্ছন্ন ছিলাম তাতেই। তখন সবকিছু এই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যেই চালিত হয়েছিলো। এখন সেসব ধুয়ে মুছে চলে গেছে অনেকদূরে। আমি এখন এতটা একাকী, এতটা বিচ্ছিন্ন! আমার বহুধা বিভক্ত জীবনযাপন এখন যেন একবিন্দুতে এসে মিশে গেছে। এই বিন্দুর সর্বস্বজুড়ে শুধু আমারই অবস্থান। আমি কেবল আমারই ভেতর নিমজ্জিত। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে টের পাই একটু একটু করে বিযুক্ত হয়ে যাচ্ছি আমার ফেলে আসা অনেককিছু থেকে। সেসব ফিরে আসবে না জানি। আবার বর্তমান বাস্তবতা মেনে নিতেও কষ্ট হয়। অনেকসময় মনে হয় একরৈখিক নিমজ্জ্বন সত্ত্বেও-নিজের থেকেই হারিয়ে যাচ্ছি। যেসব চিন্তা, কল্পনা আচ্ছন্ন করে রাখতো একসময়, এখন আমার মাথায় সেগুলো আসেই না। কখনো কোন ফাঁক গলে যদি এসেই পড়ে তাহলে পরিবর্তীত জীবনযাপনের সাথে মিলতে না পেরে উড়ে চলে যায়। আর এসব মিলেমিশেই হয়তো আমার এমন একটি সত্তা নির্মাণ করেছে যা অপরিচিত লাগে, আমার কাছেই।
আমি এখন সকাল নয়টায় অফিসে যাই। কর্তৃপক্ষের নানা নির্দেশনা ও জনগণের সম্ভাব্য বহুমুখী চাপ নিয়েই অফিসে ঢুকি। এরপর জড়িয়ে যাই কাজের সাথে। নতুন কাজ, অর্ধসমাপ্ত কাজ পুরনো কাজের জের টানা-এসবের সাথে দিন কাটে। যেহেতু পাবলিক রিলেটেড কাজ তাই প্রতিদিনই কিছু মানুষের সাথে কথা বলতে হয়। যারা সহজে বুঝে যায় তাদের নিয়ে সমস্যা হয় না, অল্প সময়ে সংক্ষিপ্ত কথা বলে নিলেই হয়। আর যারা কথার প্যাঁচ খেলতে চায়, ঘুরিয়ে বুঝতে চায় তাদের গলার স্বর মাঝে মাঝে চড়ে যায়। কেউবা চায় তার কাজটি দ্রুত হয়ে যাক। যদিও প্রযুক্তির কল্যাণে আগের চেয়ে অনেককিছু সহজ হয়ে গেছে-যা আমার সিনিয়র কলিগদের মুখ থেকে প্রায়ই শুনি-তবু যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে কাজ করতে কিছু সময় লেগে যায়। দ্রুত সেবা চাওয়া ব্যক্তিটি তখন দুটো কথা শোনাতে ছাড়ে না। যেহেতু জনগণকে সেবা দেওয়ার বিনিময়ে মাস শেষে বেতন পাই তাই এসব মুখ বুজে সহ্য করেই কাজ করে যেতে হয়। বিকেল পাঁচটায় বের হই অফিস থেকে। কাজের চাপ থাকলে কোনদিন আরো পরে।
যে প্রাণবন্ত মুহূর্তগুলো বিভিন্ন সময়ে পার করেছি তার সাথে বর্তমানের ব্যবধান নিয়েই দিন কাটে। একদিন দুদিন করে আমার চাওয়া না-চাওয়া, ভালো লাগা না-লাগাকে পাত্তা না দিয়েই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অতীতের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু আমাকে যেতে হয় অসহনীয় যাতনার ভেতর দিয়ে। মনে হয় আমাকে আঁচর কেটে কেটে মুহূর্তগুলো আগায়। অদৃশ্য রক্তক্ষরণে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকি প্রতিনিয়ত।
কোন কোন সময় একাকিত্বের প্রয়োজনীয়তা মানুষ অনুভব করে। চারপাশের কোলাহল থেকে একটু আড়ালে থাকতে চায়। কিন্তু যখন সেটা দীর্ঘ হয় তখন আর ভালো লাগে না, তেতো হয়ে উঠে। আমিও কী চাইনি নির্জনতা কোন সময়? আমাকে আমার ভেতর সেঁধিয়ে দেইনি? হয়েছে, অনেকবার এমন হয়েছে। একান্ত নিজের প্রয়োজনে বা পারিপার্শ্বিক নানা কারণে আমি খুব দৃঢ়ভাবে একাকিত্ব কামনা করেছি। কিন্তু এখন এই নিরবচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গতা আমাকে ক্লান্ত করে তুলেছে।
ক্লান্তির ঘনত্ব থেকে মুক্তি পেতে হাতে মোবাইল নেই। এদিক ওদিক ঢুঁ মেরে শেষে ফেসবুকে এসে থিতু হই। কখনো বা সরাসরি চলে যাই ফেসবুকের মোহময় জগতে। এ জগতের বিচিত্র রকমের পোস্ট দেখি, কোনটাতে কমেন্ট করি, কোনটাতে লাইক দেই। তবে এ জগৎ যে আবেশ ছড়িয়েছিলো একদা, যাতে ডুবে থাকার কারণে অনেকগুলো মুহূর্ত চলে গেছে কোন জানান না দিয়েই, সেটাও আর আগের মতো ভালো লাগে না। বিরক্তি এসে গ্রাস করে ফেলে। টনটন করতে থাকে মাথার রগগুলো। ফলে আর লেগে থাকতে পারিনা। বেরিয়ে আসি।
তবে গান শুনি। হ্যান্ডসেটে যেগুলো স্টোর করা আছে সেগুলো শোনার পাশাপাশি ইউটিউবেও শুনি। সুরের আচ্ছন্নতায় মোহিত হই একলা আমি। আমার একাকী জীবনের বড় সহচর এই সুর। এই মিতালীর কারণে অনেক গান শোনা হয়ে গেছে। একসাথে এত গান এর আগে কখনো শোনা হয়নি।
অথচ চাকরি পাওয়ার আগে মনে হতো, রোজগারের একট নিশ্চিত অবলম্বন পেয়ে গেলে জীবন আরো উপভোগ্য হয়ে উঠবে। কেননা কিছু করতে গেলে, জীবনকে একটু ভিন্নভাবে যাপন করতে চাইলে, যে বাধাগুলো সামনে এসে দাঁড়াতো, সেগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে থাকতো অর্থের অপ্রতুলতা। টাকার সীমাবদ্ধ যোগান আমার চাওয়াগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতো। সেদিনগুলোতে চাকরিজীবীদের দেখে আমার মনে হতো কত সুখি তারা। মাস শেষে হাতে টাকা চলে আসে। এর চেয়ে প্রশান্তি আর কি হতে পারে! তখন কল্পনা করতে খুব ভালো লাগতো যে চাকরি পেয়ে গেলে আমিও এভাবে বেতন পাবো। বাড়িতে এর একটা অংশ দেয়ার পর যা থাকবে তা দিয়ে অপূর্ণতাগুলো ধীরেধীরে পূরণ করে নিবো। জীবন হয়ে উঠবে আরো আনন্দঘন, আরো বেশি উচ্ছল।
মাস্টার্স পাশ করার আগে থেকেই তাই চাকরি পাবার দুর্মর বাসনা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আমি লেগে থাকি এর পেছনে। এ ছাড়া কোন বিকল্পও অবশ্য ছিলো না আমার কাছে। ব্যবসা যেহেতু বুঝি না, বিদেশে যাবার প্রেরণাও পাইনা-এ দুটোর সাথে আবার জড়িয়ে আছে আর্থিক অসামর্থ্য, তাই এক লাইনেই হাঁটতে থাকি। আর এ লাইনে হাঁটতে হাঁটতে এখন এসে দাঁড়িয়েছি এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
আমি যে ঘরটাতে থাকি তার ভেতরে ছড়িয়ে আছে একাকিত্বের ঘন ছোঁয়া। এখানে প্রবেশ করা মাত্রই যেন এটা টের পাওয়া যায়। রুমের ভেতর নিজস্ব কোন শব্দ নেই। বাইরের শব্দেরা থেমে গেলে ভেতরের বাতাসে ভেসে বেড়ায় এক অদ্ভুত নির্জনতা, যাতে আকণ্ঠ ডুবে থাকি আমি। এ বাড়ির বাড়িওয়ালা মাঝে মাঝে আমাকে বলেন-‘বিয়ে করেন না কেন? তাইলে তো এভাবে একা থাকা লাগতো না।’ আমার একা থাকা তাকে কি কোনভাবে নাড়া দেয়? কোন সহানুভূতি থেকে কি এমন করে বলেন? নাকি এমনি এমনি বলেন? যাই হোক তা নিয়ে মাথা না খাটিয়ে বরং কখনো মুচকি হেসে এড়িয়ে যাই, কখনো বলি এ বিষয়টি মা-বাবা দেখছেন। তবে কথাটা একেবারে বানিয়েও বলা নয় একারণে যে, তারাও আসলে খুব জোরালোভাবে চাইছেন আমি বিয়ে করি। এখন তো আর কোন পিছুটান নেই। তাই তাদের চোখে কোন বাধাও নেই। কিন্তু আমি নিজেই যে নিজের কাছে সবচেয়ে বড় বাধা। কেননা বিয়ের ব্যাপারে আমার এখনো কোন আগ্রহ জাগেনি। এ বিস্তৃত জগতে নামতে হলে যে মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন তা-ও আমার নেই। মা বাবা আকারে ইঙ্গিতে নানাভাবে বুঝালেও, নিজের সাথে আলাপ করতে গেলে তাই বেশিদূর এগুতে পারি না। থেমে যাই। হ্যাঁ, একসময় হয়তো বিয়ে করবো, প্রয়োজনের খাতিরেই এ পথে যেতে হবে। কিন্তু এখনই নয়।
জীবিকার তাগিদ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। ভবিষ্যতে উড়িয়ে নিয়ে যাবে অন্যকোন জায়গায়। জানিনা তখন আমার এই একাকিত্বের অবসান হবে কিনা। নাকি আরো গভীর নৈঃসঙ্গের ভেতর ডুবে যাবো? অনাগত সময়ের কথা কিছুই বলা যায় না আসলে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আসার আগে এখানেই থাকতে হবে আমাকে। থাকছিই তো। কাজের ভেতরে থাকছি, কাজের বাইরে থাকছি। শব্দের ভেতর থাকছি, নৈঃশব্দের ভেতর থাকছি।
কোন কোন দিন অফিস থেকে বেরিয়ে সদরের গা লাগোয়া নদীর তীর ধরে হাঁটতে থাকি। নদীর পানির চলাচল দেখি। আশেপাশের ঝোপঝাড়ে চোখ বুলাই। হঠাৎ ডেকে উঠা পাখির শব্দ শুনি। এ নদীকে বর্ষায় উথলে উঠতে দেখেছি আবার শীতে শুকিয়ে ক্ষীণতোয়া হতে দেখেছি। বর্ষার প্রবল প্রবহমানতা শীতে এসে কল্পনাই করা যায় না। যে তীব্র স্রোত চারপাশের অনেককিছু ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়, শুকনো মৌসুমে তার আশেপাশে এসে জমে নানা জঞ্ঝাল। কোনদিন আবার নদীর দিকে না গিয়ে চলে যাই সদর থেকে যেসব রাস্তা গ্রামের দিকে চলে গেছে, সেসবের কোনটির দিকে। কোনদিন আবার সদরের ভেতরেই ঘুরিফিরি।
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে অনেক মানুষ দেখি, তাদের বিচিত্র কাজকর্ম দেখি। এতদিনে যাদের মুখচেনা হয়ে গেছে পথেঘাটে হঠাৎ দেখা হলে তাদের সাথে সৌজন্য বিনিময় হয় মূলত। কদাচিৎ কারো সাথে কথা হলে উপর উপরই থাকে, গভীর হয় না। কথা গভীরে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে স্পেস দরকার সেটা কেন যেন তৈরি হয় না। চায়ের দোকানে অনেক মানুষের মাঝে বসে চা-নাস্তা খেতে খেতে বা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ফুচকাওয়ালাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলোর সাথে ফুচকা খেতে খেতে আমি অনুভব করিনি সঙ্গতার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ। এই  প্রবাহ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে।
খুব মিস করি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটাকে। এইচএসসি পর্যন্ত একটা বাঁধাধরা নিয়মে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পাল্টে যায় অনেককিছু। বাধাহীন, মুক্ত পরিবেশে জড়িয়ে যাই। গড়ে উঠে এমন এক পরিম-ল যা নতুনভাবে ভাবায়, নতুন স্বপ্ন দেখায়। আত্মিক বন্ধননিবিড় হয় যে কজনের সাথে তারা মিলেমিশে আড্ডা দেই বিকেলে, সন্ধ্যায় বা রাতে। চারপাশকে বিস্মৃত হয়ে ডুবে যাই সাম্প্রতিক রাজনীতি, অর্থনীতির হালচাল, ক্যাম্পাসের নানাবিধ বিষয়, হলিউড, বলিউড, ঢাকাই সিনেমার নায়িকাদের দৈহিক আবেদনসহ আরো অন্যান্য বিষয়ে। ফলে সময়ের হিসাব থাকে না। পড়ালেখা হয়ে দাঁড়ায় গৌণ বিষয়ে। শুধু কি তাই, বন্ধুরা মিলে একসাথে কত কনসার্টে গিয়েছি। এনজয় করেছি আনন্দপ্রদায়ী নানা অনুষ্ঠান। খুব ঝোঁক ছিলো তখন ঘুরে বেড়ানোর। অনেক আলোচনা করে প্ল্যান ঠিক করেছি। কিন্তু আটকে গেছি অর্থাভাবে। তবু এ বাধা কোনমতে ডিঙিয়ে যেখানে গেছি, বন্ধুদের সাহচর্যে উপভোগ করেছি পরিপূর্ণভাবে।
আর এখন বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলে গেছি বিভিন্ন দিকে। একেকজন একেকভাবে জড়িয়ে পড়েছি একেক দিকে। প্রত্যেকেই গড়ে তুলছে একেকটা ভিন্ন জগত। সে জগৎ যেন একান্তই নিজস¦। যৌথ অনুভূতিগুলো ফিকে হয়ে গেছে পথ চলতে চলতে। এটা খুব ভালো করে টের পাই যে, যে বন্ধন আমাদেরকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলো সেটা ক্রমাগত হালকা হতে হতে পরষ্পরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। দূরে সরে যাচ্ছি একে অপরের কাছ থেকে। অথচ তখন ভাবতেই পারিনি কোনদিন এরকম হবে; এত নিষ্ঠুরভাবে আলগা হয়ে যাবো আমরা। কিন্তু এটাই এখন বাস্তবতা। এই কঠিন, নির্মম বাস্তবতাকে না মেনেও কোন উপায় নেই।
আড্ডারত মানুষদের দেখলেই আমার সেসব দিনের কথা খুব মনে পড়ে। স্মৃতি জীবন্ত হয়ে উঠে আপনা আপনি। অফিস শেষে কোনদিন যদি হাইস্কুলের বড় মাঠটাতে গিয়ে বসি তাহলে গল্পরত মানুষদের দেখে স্বপ্নময় বিকেলগুলোর কথা মনে আসে। আমি যখন মাঠে যাই তখন অনেকেই সেখান থেকে ফেরার পথে থাকে। তবু বসে থাকি। তাদের রেখে যাওয়া সময়টুকো স্মৃতির জগতে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে উপভোগ করি। একসময় আধাঁর নেমে আসে। বাদামওয়ালা পেলে, ইচ্ছে হলে বাদাম চিবুতে চিবতে একাকিত্বে ভরপুর রুমটাতে ফিরে আসি।
বন্ধুদের পরিধি ছাড়াও বিভিন্ন দিকে আমার যাতায়াত ছিলো। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ভিন্ন ভিন্ন পরিম-লে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সেসব জায়গায় সমবয়সী যেমন ছিলো, ছিলো সিনিয়র এবং জুনিয়র। আমার আমি এভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলাম নানাদিকে। এ ছড়িয়ে পড়াতে কষ্ট যেমন ছিলো, ছিলো অনেক প্রাপ্তিও। বর্তমান অবস্থায় দাঁড়িয়ে মনে হয় পুরোটাই প্রাপ্তিতে পূর্ণ। নিজেকে মেলে ধরার এমন সুযোগ হয়তো আর কখনো হবে না।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, হয়তো এমনও হতে পারে নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে, ফেলে আসা দিনগুলোকে এখনও যতটুকু অনুভব করি, ভবিষ্যতে এভাবেও আর মনে আলোড়ন তুলবে না। দূরে, অনেক দূরে চলে যাবে জীবনের সবচেয়ে উপভোগ্য মুহূর্তগুলো।
এখানে কোন সার্কেল গড়ে উঠে না। এখানকার সম্পর্কগুলো স্পষ্টভাবেই কাজের সাথে জড়িত। ফলে এর সাথে লেগে থাকে স্বার্থ। আর স্বার্থ যেখানে জড়িত সেখানে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে পারে না। একটু আঘাতেই ভেঙ্গে পড়ে এ ঠুনকো সম্পর্ক। এমনকি কখনো হয়ে উঠে তিক্ত। পরস্পরের কাছাকাছি আসতে হলে কিছু কমন বিষয় লাগে। কাজের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেগুলো খুঁজে পাওয়া দুরূহ। আর এভাবেই ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন জগতে থেকে থেকে ক্রমশ বিবরবাসী হয়ে যাচ্ছি।
বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে প্রায়ই। কিন্তু দীর্ঘ যাত্রাপথও সময়ের স্বল্পতা সে ইচ্ছেকে গুঁড়িয়ে দেয়। সর্বশেষ গিয়েছিলাম দুমাস আগে। সেখানে গেলে চেনা জগতের আলো বাতাস গায়ে লাগে। যদিও বাহিরে থাকতে থাকতে এলাকার সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে তবু অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। নিজের বেড়ে উঠার দিনগুলোর স্পর্শ লাগে গায়ে। গ্রামের বাজারে গেলে সমবয়সী কয়েকজনের সাথে কথায় কথায় কিছু সময় কাটানো যায়। মুরব্বীদের সাথে দেখা হলে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। ঢুঁ মারা যায় আশেপাশের বাড়িতেও। এসব করে সময় কিভাবে চলে যায় বুঝতে পারি না। ফেরার টান পড়ে। সময়কে তখন মনে হয় খুব নিষ্ঠুর। মন না চাইলেও চলে আসতে হয় কর্মক্ষেত্রে। আমার নির্বান্ধব, নির্জনতার জগতে।
অনেক রাত হয়ে গেছে। অন্য আরো অনেকদিনের মতো বৈচিত্র্যহীন আরেকটি দিন চলে গেছে। নিজের ভেতর নিমজ্জিত থেকে নিঃসঙ্গ নিঃশ্বাস ছেড়ে ছেড়ে এগিয়ে আসলাম অনেক মুহূর্তকে অতীতের গহ্বরে ঠেলে দিয়ে। এই নিস্তব্ধ রাতে কবিতা শুনতে ভালো লাগবে ভেবে ইউটিউবে ঢুকে জীবনানন্দের কবিতা বের করি। ইয়ার ফোন কানে লাগিয়ে ভরাট কণ্ঠের আবৃত্তি শুনি… সকল লোকের মাঝে বসে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?… তবু কেন এমন একাকী?/তবু আমি এমন একাকী?…

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার