দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে
৪০.
বাধ্যগত ছিলো না সে কোনো কালে। অবাধ্যতার অভিশাপে ঝুলে তাই ঘুরে বেড়ায় পথে প্রান্তরে আর দেখে, জগতের সকলেই প্রায় বাধ্যতার শেকলে বাঁধা। এমনকি তারা নিজেরাই বেঁধে রেখেছে নিজেদের এবং ঘর থেকে বেরুবার সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে নেয় নিজেদের শেকলের সৌন্দর্য্য, বাধ্যতার। এতো বাধ্য কেনো সকলে? ভাবে, অবাধ্য আর আনাড়ী লোকটা এবং দেখে বাধ্যগত লোকজনের উপর যখন শান্তি বর্ষিত হচ্ছে তখন তার দিকে তেড়ে আসছে একটা অবাধ্য বর্শা, তাকে গেঁথে ফেলবার আশায়। সে বর্শাটাকে ভালোবাসে, হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে এগিয়ে যায় বাধ্যগত পৃথিবীটাকে প্রদক্ষিণ করার দৃঢ় সংকল্পে আরো অবাধ্য আরো আনাড়ি রূপে, রূপসার তীর ধরে।
৪১.
মেঘালয় থেকে এসে মেঘ সাহারার দিকে যাবার আগেই ঝরে পড়ে কেনো, এই ভাবনায় আচ্ছন্ন আবহাওয়াবিদের পুরো পরিবার। পারিবারিকভাবে তারা মেঘমুখী হয়ে থাকে। সেখানে মেঘের শরীর জুড়ে ছুটোছুটি করে জলরঙ্গে আঁকা সব ঘোড়া, গাধা আর উট। যাদের কি-না ছোটার কথা ছিলো সাহারার বুক চিরে। আবহাওয়াবিদের বুকে ব্যথার মেঘ জমলে সে তার দপ্তর সরিয়ে নেয়ার কথা ভাবে সাহারার কাছাকাছি। কারণ সে জানে আবহাওয়া দপ্তরকে ঘিরেই ঘোরাফেরা করে পৃথিবীর যতো মেঘ, মেঘের ঘোড়া, গাধা আর উট। মেঘের ঘোড়ারা যদি দাপ্তরিকভাবেই নেমে পড়ে সাহারার বুকে, মরুর মজ্জ্বায়। এই ভেবে শান্ত হয় আমাদের আবহাওয়া অফিস আর পুরো পরিবার, আবহাওয়াবিদের।
৪২.
হৃদয়ের ডাক শোনার জন্য যার বুকেই মাথা রেখেছি পেয়েছি পাথরের প্রণাম। প্রস্তর যুগে আছি। পাথরের প্রতি এতো মোহ মানুষের অথচ মোহন পাথর নেই একটাও। তথাপি পাথর থরে থরে সাজানো। তথাপি পাথর ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যেতে চাই কিন্তু কিছু পাথর পেছনেও বাঁধা। সামনে পেছনে পাথর। মানুষ এতো পাথর প্রবন যে প্রস্তর যুগটাকে ধরে রেখেছে সুকৌশলে। বেঢপ আর কুৎসিত সব পাথর বিভিন্ন নামে নানান অবয়বে সচল। সচেতনে পথ চলতে গিয়েও রেহাই নেই। একেকটা পাথর একেক নামে এসে বাধা দেয়। প্রস্তর যুগেই আছি তবে।
৪৩.
শিশুদের সাথে থাকি। শিশু শিক্ষালয়ে। তাদের কাছে পাঠ নেই। জগতের সকল পাঠই মূলত শিশুতোষ এবং সকল সুসমাচার শিশুদের সখ্যতায় পাওয়া অথচ আমরা কি-না তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাতে অনিচ্ছুক আর অপারগ এবং তাদের এড়িয়ে চলার একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করে আমরা তার নাম দিয়েছি ব্যক্তিত্ব। সম্ভাবনার আঁধার এই সব শিশুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমরা অনবরত তাকিয়ে থাকি শিশুদেরই ব্যর্থ সংস্করণ বৃদ্ধদের দিকে যারা কি-না তাদের শৈশবকে অস্বীকার করে, শৈশবের স্বপ্নকে প্রত্যাখান করে জলের পঁচন আর বাতাসের দূষণকে ভালোবেসে শেষমেষ নিজেদের ভর তুলে দিয়েছে নিজেদের মতোই বেঁকে যাওয়া একটা লাঠির উপর। আর কে না জানে এই সব লাঠির যতœ তারা এমনভাবে নেয় যেভাবে তারা নিয়েছিল তাদের অবাধ্য শিশ্মের যতœ সারা জীবনভর। ভর ও বেগের সূত্রে শিশুদের তাই কিছুই যায় আসে না তাই শিশুদের সাথেই থাকি, শিক্ষা শিক্ষালয়ে।
৪৪.
পাথর কেটে এগিয়ে যাওয়া লোকটার হৃদয়ে পাহাড়ে পথ তৈরির সংকল্প। অথচ বর্বর পাহাড়িরা পাথর ছুঁড়ে মারছে তার দিকে আর লোকটা একহাতে পাহাড় কাটছে এবং অন্য হাতে তার দিকে তেড়ে আসা পাথর খ- থেকে নিজেকে রক্ষা করছে। রক্ষাকর্তার বেশে এগিয়ে এসে বর্বরদের সর্দার জানালো, এই পাহাড় তাদের দেবতা এবং কারো অধিকার নেই এর গায়ে বল্লম চালানোর। চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরির সংকল্প করা লোকটা তার হাতিয়ার গোছাতে গোছাতে সর্দারকে বললো, কিন্তু আমিতো তোমাদের দেবতা হতে চাইনি। দেবতার ভ্রম থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলাম।
৪৫.
পাহাড় বেয়ে উঠে যাওয়ার সময় দৃষ্টিগ্রাহ্য পাহাড়ের চূড়া তার গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলো বার বার। অতঃপর সে তার সমস্ত গতিকে সঙ্গে করে আছড়ে পড়ে পাথরের রাস্তায় যেটা কি-না পাহাড় কেটেই তৈরি এবং যা তাকে ধরে রাখতেও পারছে না। রাস্তাগুলো বরাবরই সরল আর সমতলমুখী আর কে না জানে কেবল অথর্ব আর অর্বাচীনরাই সমতলের মাপজোখ নেয়। কিন্তু সে ডিঙ্গোচ্ছে পাহাড় আর স্পর্শ করছে চূড়া এবং একটা চূড়া স্পর্শ করার উল্লাসের উন্মাদনায় পুনরায় সে ছিটকে পড়ে পাথরের রাস্তায় এবং রাস্তা থেকে পুনরায় সমতলে। আহা সমতলে এতো এতো তল আর মোহনীয় চূড়া! চুর হয়ে থাকে সে চূড়ায় চূড়ায়, সমতলের, আজীবন।