এস মা লক্ষ্মী, কমল বরণী, কমলালতিকা দেবী কমলিনী।
কমল আসনে, বিরাজ কমলা, কমলময়ী ফসলবাসিনী।।
কমল বসন, কমল ভূষণ, কমনীয় কান্তি অতি বিমোহন।
কোমল ক’রে, শোভিছে কমল, ধান্যরূপা, মাতঃ জগৎপালিনী।।
কমল কিরিটি মণি মনোহরে, কমল সিঁদুরে শোভে দেখি শিরে।
কোমল কন্ঠে কমল হারে, কোমল বদন দেখি যে সুন্দরে।।
কমল চরণে কমল নূপুর, কমল অলক্ত মরি কি সুন্দর।
দীন মধুসূদনের সন্তাপ হর তুমি নারায়ণী শান্তিপ্রদায়িনী।।
— শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর আবাহন
বাণিজ্যে বসতী লক্ষ্মী > প্রোডাক্টিভিটী!…
লক্ষ্ + ম্ + ঈ > লক্ষ্ মিতির গতিশীল আধার > লক্ষ্মী …
লক্ষ্মী। পৌরাণিক দেবী। উর্ব্বরতার দেবী। ভারতীয় পুরাণে যাকে পূজা করা হয় উর্ব্বরতার উৎকর্ষে। লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা। পেঁচার ডানায় চড়ে লক্ষ্মী আসে, বাঙলার কুলে …
লক্ষ্মী নামক এই দেবী এক নারী, একজন মানুষ! একটা মানুষ কী ভাবে একটা পাখীর ডানায় চড়ে আসতে পারে, ভাবনার বিষয়, ভেবে কিনার পাই না, হয়ত বা যায়, যেতে পারে … যাক! কে তারে যেতে বাধা দেয় নদীটার কূলে …
বার মাসে তের পার্ব্বণের দেশ, অর্থাৎ শ্যামলী বাংলার রূপশালী জনপদে লক্ষ্মীর আগমনে সাড়া পড়ে যায় সনাতন ধর্ম্মাবলম্বীদের মাঝে, নদীটার মনে। …
মন্দিরে মন্দিরে জাগে সাজ সাজ রব, উলুধ্বনি। হৃদয়ে মাতম ওঠে ঢাক ঢোলের মেঠোসুরে, গলায় জাগে গান— টাকঢুম টাকঢুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল। ……..
যদিওবা, লক্ষ্মী নামক এই চরিত্র কেবল ধর্ম্মীয় মাত্রায় বাঁধা পড়েনি, হয়ে ওঠেছে বাঙলীর সার্ব্বজনীন নারী! …
যাক,
এ তো গেল ধর্ম্মের কথা … কর্ম্মের কথায় আসি, মর্ম্মের কথায় আসি, মর্ম্ম? মর্ম্ম— মর্ম্মের ভিতরে লুকায়িত মর্ম্ম! এই মর্ম্ম বুঝতে হলে চলুন একটু ঘুরে ঘুরে আসি ঘুরতি পথের মর্ম্ম থেকে, কর্ম্ম থেকে, ধর্ম্ম থেকে …
ধরা যাক,
* ছেলেটা লক্ষ্মিছাড়া! মা ছেলেটাকে ভর্ৎসনা করে। অর্থাৎ ছেলেটাকে ছেড়ে গেল লক্ষ্মী, পাড়ার ষোড়সী মেয়েটা না, যে বকুলের বনে ডেকে নেয় চুপিচুপিঘ্রানে! সে ছেড়ে গেলে মা বরং খুসীই হয়, হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। …
* মেয়েটা খুবই লক্ষ্মী, তার লক্ষ্মিহাতের ছোঁয়ায় সংসারটা ভরে উঠছে, ধনেধান্যে! …
* ছেলেটা খুবই লক্ষ্মিসোনা, ইস্কুলে যায়, পড়ায় মনোযোগ, ভালো রেজাল্ট করে, প্রজাপতীর পেছনে ছোটে না দুরন্ত দুপুরে …
এমত
অনেক কথা, জীবনযাপন, ভরে আছে আমাদের চারপাশে ………………………………….
আমরা এবার
একটু অন্যপথে যাই, ঘুরে আসি, ঘুরতিপথের গানে, গানের মর্ম্ম থেকে তুলে আনি, অন্যগান! অন্যকথা! …
এখন একটা গল্প বলি, গল্পটা এরকম—
কৃষিকেন্দ্রিক এইদেশে আজ শিল্পবিপ্লবের যুগ, (কল+ই)কলি/যন্ত্রসভ্যতার যুগ, এই যুগযন্ত্রনায়, গাড়লের মতন কেশে যাওয়া মটর গাড়ীর নীচে চাপা পড়ে মারা গেছে নগর ভ্রমনে আসা প্রকৃতি চণ্ডাল! তবু এই প্রকৃতির কোলে বেঁচে থাকা… তেমনি বেঁচে থাকা একজন কৃষক (যে কর্ষণ করে, কর্ষিতার কাঙ্খায়! মাটীর শিৎকারে…) ফসল ফলায়, ভরে ওঠে গোলা! গোলার সোনালী সুখে কাটে দিন, তার ফসলের ধান খেয়ে যায় ইদুরের পাল, সামাজিক ইদুরের পালও… (সমাজ নামক বিধি তাহাকে রক্ষা করে), কিন্তু, প্রকৃতির ইদুরের হানা থেকে বাঁচার জন্যে সে তার ধনধান্য ক্ষেতে প্রয়োগ করেন কীটনাশকবাদ, যার প্রকোপে মারা পড়ে কীটপতঙ্গ, ফসলের রক্ষা হয়! ভরে ওঠে গোলাঘর। বিপরীতে রেখে যায় ভীতি— এই কীটনাশক নাশ করে যায় প্রকৃতির ভারের সাম্যতা, ভাবের সাম্যতা! যেমন, কীটনাশক কেবল ইঁদুর নাশ করেনি, নাশ করেছে অনেক প্রাণ, অপকারী ও উপকারীও, কেঁচো ফসলের অপকার না, উপকার করে। যেমন, কেঁচো (প্রকৃতির লাঙ্গল) মাটীর সঞ্চালন করে, মাটীকে উর্ব্বরা করে, করে ফসলের উপযোগী। কেঁচোকুল হারিয়ে গেলে মমতার সঞ্চালন হবে না আর মাটীর হৃদয়ে… কীটনাশক মাখা মরা কীট খেয়ে মারা পড়ে পাখী, যে ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে করে ফসলের উপকার, শোনায় কুজন, বনের মর্ম্মরে, পাতার মর্ম্মরে, কীটনাশক মেশে ফসলের ক্ষেতে, জলে, জল ভরে ওঠে বিষে, মারা পড়ে মাছের মেয়েরা, যারা ধিঁঙ্গী তালে সাঁৎরিয়ে বেড়ায় জলের বাসরে, আজ মাছ নেই, আকালের দেশে! শুধু মাছ না, জলের সংসারে বাঁচা আরো জলজ প্রাণীরাও … লোপ পাচ্ছে ভারের সাম্যতা, ভাবের সাম্যতা, প্রকৃতির … বিষেভরা জল বিল থেকে খাল হয়ে নদী হয়ে একাকার জলের সংসারে … পাশাপাশি শিল্পবিপ্লবেরে ইণ্ডাষ্ট্রিয়াল বর্জ্জ্যে ভরে যাচ্ছে খাল বিল নদী ও সাগরের মন, ভরে যাচ্ছে নদী ও সাগরের তলদেশ, জলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, উজাড় হচ্ছে বন ও বনানী, নির্ব্বিচারে কাটা পড়ছে পাহাড়, প্রকৃতিবিহীন নগর সভ্যতায় চিমনীর ধোঁয়ায় হাঁপিয়ে উঠছে পরিবেশ, পাখীরা পালাচ্ছে দিগন্তের দিকে, কোথায় অরন্য দেব? কবির বয়ান: দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর! এই যেন প্রকৃতির কান্না!! কান্নার ভেতরে কান্না!!! …
এরই মাঝে
ভোরের প্রথম আলো, জানালো, একটা নদীর ইতিকথা—
বর্ষায় প্রমত্তা, শীত কিংবা হেমন্তে শান্ত সৌম্য গোপলা নদী মির্জাপুরের গর্ব্ব। মির্জাপুর মৌলভী বাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার একটা খ্যাত ইউনিয়ন। গোপলা এখন আর সেই গোপলা নেই। গোপলা এখন মৃতপ্রায়। পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। বুকে পানী ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। শিকার দুষনেরও। রাবার এবং চা শিল্পের বর্জ্জ্য লেবু ও আনারস বাগানে ব্যবহৃত কীটনাশকের অবাঞ্চিত দূষণে গোপলা এখন তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। নদীতে এখন আর আগের মত মাছ নেই। নদীর পাড়ের মানুষের জীবনের গতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। মানুষের অর্থনৈতিক কর্ম্মকাণ্ড হয়ত জীবিকার তাগিদে থমকে যায়নি। তবে হোঁচট খেয়ে চলছে প্রতিনিয়ত। এখন আর ভীনদেশী (অন্য জেলার) বজরা নৌকা এই নদীতে নোঙর করে না বাণিজ্যে তাই লক্ষ্মীর বসতী নেই। …
এই নদী, যেন বাংলাদেশ … বাঙ্গালী ও বাঙলার প্রতিনিধি আজ, বিশ্ব জলবায়ু সন্মেলন আর পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের শহরে! …
বাণিজ্যে বসতী লক্ষ্মীর উপাচারে আজ তৃতীয় বিশ্বের ধনপতী, পূঁজিবাদী রাষ্ট্রসমুহ মেতে আছে শিল্পবিপ্লবের আঙ্গিনায়, কারখানার বর্জ্জ্য, নির্গত কার্বনে, আজ জলবায়ুর সঙ্কটে পরিবেশ ও প্রকৃতি। … কানে বাজে বিপন্নতার সুর। … বিপন্নতার গানে, জলজ গ্রহণে হারিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ, রুপসী বাঙলা, লক্ষীর বসতী! …
তবে কি নাশক ব্যবহার হবেনা? হবে। হবে ক্ষতিকারক(!) পতঙ্গের দমন। ……………………………..
তবে অন্যভাবে, অন্যগানে! মর্ম্মার্ত এমন—
প্রকৃতিকে প্রতিহত করা যাবে প্রকৃতির ব্যাবহারে, প্রকৃতিকে দিয়ে! …
ধরাযাক,
একটা পেঁচার খাদ্য তালিকায় ধরা পড়ে দৈনিক পাঁচটা ইঁদুর, অন্যান্য ছাড়া। কৃষকের জমির পাশে যে বন, সে বনে বাস করে পেঁচা, লক্ষ্মীর বাহন, কৃষিজমীর ক্ষেতের চারপাশে যে বন ও বনানী, মন ও মনানী, যেখানে বাস করে পাখী-কুল, ফোটে ফুল-কুল, যেখানে বাস করে জীবনানন্দের পেঁচা, ধরাযাক, সেখানে একশটা পেঁচা আছে, দৈনিক একটা পেঁচা পাঁচটা ইঁদুর খায়, একশটা পেঁচা পাঁচশটা ইঁদুর খায়, ধরছি, সেখানে জন্মচক্রে হাজারটা ইঁদুর জন্ম নেয়, আরও রয়ে যায় শতশত! জন্ম মৃত্যু অনুপাতপাড়ায় এই ভাবে বয়ে যায় চক্রলীলা, চক্রশীলা …………
ভাবের বাউল জানে, জীবন জীবনে বাঁচে! পরিমিত প্রানের সঞারে জেগে রবে কোলাহল, প্রকৃতির মর্ম্মে মর্ম্মে রবে কানাকানি … জানাজানি ……..
যদি
রাষায়নিক নাশকের বিপরীতে ব্যবহার করা যায়, পাখী-বিষ, তবে ফসলের পাশাপাশি বেঁচে থাকবে প্রকৃতির বাধাঁসুত্রে বাঁচা প্রাণী-কুল! পাখী-কুলের প্রতীক হয়ে দেখা দেয়, পেঁচা! এখানে পেঁচা হল বাহন, অর্থাৎ মাধ্যম, লক্ষ্মীর আগমনের। লক্ষ্মী নামক কোনও নারী আসে না, লক্ষী নামক উর্ব্বরতা ফিরে আসে প্রকৃতির মর্ম্মে মর্ম্মে! পাখী-সমাজের প্রতীক পেঁচা’র ডানায় চড়ে … কৃষক অধিক ফসল ফলায়, ফসলের ঘ্রাণে ভরে ওঠে মন ও মনানী! … গোলার শূন্যতা, দারিদ্রতা, মুছে যায় লক্ষ্মীর হৃদয়ে। …
লক্ষ্মী, বাহন পেঁচা ও কৃষি
নিবিঢ়তার সুতোয় বাঁধা এক মর্ম্মের গীতিকা! …
যারই মর্ম্মে মর্ম্মে, কবি, হয়ত কখনো আর বলে উঠবে না, ঠাকুর, বড়ই নিষ্ফলা তোমার এই দেশ! …
আরণ্যক টিটো
জন্ম—
জুন, ০৬, ১৯৭৭।
জন্মস্থান—
উত্তর গোবীন্দর খীল, হাঁদু চৌধুরী বাড়ী, পটিয়া, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
[(শৈশব কৈশোর ও তারুণ্যের সময়যাপন) বেড়ে ওঠা (পূর্ব্ব বালিয়াদী, মীরশ্বরাই, চট্টগ্রাম) নানার বাড়ীতে।]
প্রকাশিত কবিতার বই—
ফুলেরা পোষাক পরে না (সাল: ২০১৮, প্রকাশক : মনফকিরা, কলিকেতা)।
প্রকাশিতব্য বই—
অর্দ্ধনারীশ্বরবাদ : প্রকৃতিপুরুষতত্ত্ব (নন্দনতত্ত্ব), বটতলার বয়াণ (ভাষাতাত্ত্বিক গদ্য) ও উদ্ভিদপ্রতিভা (কবিতা)।
সম্পাদক— চারবাক।
{লক্ষ্মী, লক্ষ্মীর পাঁচালী, নতুন আলোয় দেখা [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্তী) অনুসৃত] প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন-এর বানান রীতিতে (যথাসম্ভবভাবে) সম্পাদিত ও প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}