কিছু একটা করেন। পোলাপানগুলার মুখের দিকে আর চাইবার পারি না। তিন দিন ধইরা হ্যাগো প্যাটে একটা দানাও দিবার পারি নাই। আমরা না হয় বড়ো মানুষ, সহ্য করবার পারি, কিন্তু হ্যারা তো পারে না।
কী করুম, ক? মেঘটা সাত দিন ধইরা অনবরত ঝরতাছে, একটুও থামনের নাম নাই। চাইরপাশ পানিতে ভইরা গেছে। বাইরে একটা কাকপক্ষীও দেহন যায় না। এই সময় কই যামু, ক?
তাইলে কি পোলাপানগুলান উপাস কইরা মইরা যাইব? আমি মা হইয়া এইডা সহ্য করবার পারুম না। হেইডা দেখবার আগে নিজের জীবন নিজেই শ্যাষ কইরা দিমু।
এমন সময় সুরুজ আলীর ছোটো ছেলেটা কেঁদে ওঠে, মা রে, আমার বুকটা ক্যামন করতাছে, আমারে ধরো মা, আমারে ধরো।
সুরুজ আলীর বউ ডুকরে কেঁদে ওঠে, আল্লাহ্ রে, তোমার কি কোনো বিচার নাই? তুমি কি একটুও আমাগো দিকে চইখ তুইল্যা চাইবা না? যদি না-ই চাও, আমাগো তুমি তুইল্যা নাও, তুইল্যা নাও। সুরুজ আলীর বউয়ের আহাজারি একসময় বিলাপে পরিণত হয়। সুরুজ আলীর মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোয় না। অব্যক্ত কষ্টে তার অনাহারী শরীরটা আরও অবশ হয়ে আসে। সে মনে মনে ভাবে, আল্লাহ্, তুমি আমারে এ কোন অবস্থায় ফেললা। আমি তো কোনোদিন তোমার কাছে বেশি কিছু চাই নাই। শুধু পোলাপান লইয়া কোনোরহমে বাঁচবার চাইছি। তাও কি আমার কপালে জুটব না?
এইসময় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে সুরুজ আলীর বউ বলে, শোনেন, এক কাজ করেন, কাদের মোল্লার বাড়িতে যান। হ্যায় আমাগো এই অবস্থার কথা শুনলে অবশ্যই কিছু সাহায্য করব। কইবেন, সময়মতো কাম কইরা শোধ কইরা দিমু।
তোর যে কথা! কাদের মোল্লা সাহায্য করব আমারে। হ্যারে তো চিনস না, নিজের স্বার্থ ছাড়া হ্যায় এক-পাও আগায় না। তা ছাড়া তুই তো জানস, গেল বার কার্তিক মাসে হ্যার কাছে দশ কেজি ধান কর্জ চাইছিলাম। হ্যায় আমারে কইছিল, ধান দিবার পারি, তয় মৌসুমে বিশ কেজি ধান দেওন লাগব। আমি রাজি হই নাই। মুখের উপর কইছিলাম, আপনার এত ধন-সম্পদ, তারপরও এই গরিবের কাছে সুদ লইবেন! হ্যায় তো চেইতা মেইতা আমারে বাইর কইরা দিল। সেই কথা কি হ্যার মনে নাই?
সেই কথা কি আর এত দিনে হ্যার মনে আছে। তা ছাড়া শুনি কাদের মোল্লা দানবীর লোক। মসজিদ, মাদ্রাসায় দু-হাতে দান করে।
হ, দান করে ঠিকই, কিন্তু হেইডা নাম কামানোর লাইগা, লোকদেখানো দান।
তবু যান। হ্যায় তো শ্যাষ ভরসা। যদি মুখ তুইলা চায়।
তুই যখন এত কইরা কইতাছস, তখন যাই। তয়, কাজ হইব না। কাদের মোল্লার অন্তরটা পাথ্থর দিয়া গড়া।
সুরুজ আলী ঘর থেকে বের হয়। ঘর তো নয় যেন খুপরি। তার উপর চালের অনেক জায়গায় খড় নাই। ফুটো হয়ে আছে, সেই ফুটো দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ে। সেই খুপরিতেই সুরুজ আলী তার বউ ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস করে। গ্রামের শেষ মাথায় খালের পাড়ে এক চিলতে জমিতে তার ঘর। জমিটুকুও তার নয়, অন্যের। জমির মালিক যতদিন থাকতে দেবে ততদিন থাকতে পারবে। থাকতে না দিলে ছেলেমেয়ে নিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে।
সুরুজ আলী প্রমিত দিনমজুর। প্রত্যেক দিনেই তাকে কাজ করতে হয়। কিন্তু সবসময় সে কাজ পায় না। কাজের বড়ো অভাব। ফলে যেদিন কাজ পায়, সেদিন পেটে ভাত জোটে। না হলে ছেলেমেয়ে নিয়ে তাকে উপোস করতে হয়। আর বর্ষা মৌসুমে গ্রামগঞ্জে কোনো কাজ থাকে না। ফলে এ সময় প্রায়ই তাদেরকে আনাহারে, অর্ধাহারে কাটাতে হয়।
সুরুজ আলী ঘর থেকে বের হয় ঠিকই, কিন্তু যাবে কীভাবে? উপর থেকে অঝোরে পানি ঝরছে, আর নীচে পানি থৈ থৈ করছে। সামনের খালটাও ভরে যেন নদী হয়ে গেছে। তার উপর একটাই লুঙ্গি তার, সেইটা ভিজলে ভেজা কাপড়েই থাকতে হবে। কিন্তু উপায় নাই, তাকে যেতেই হবে কাদের মোল্লার বাড়িতে।
সে লুঙ্গিটা মালকোঁচা করে আল্লার নাম নিয়ে খালের পানিতে ঝাঁপ দেয়। সাঁতরিয়ে খালের ওপারে হাঁটু-সমান পানিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ঠান্ডায় শরীর থর থর করে কেঁপে ওঠে। সে ভাবে, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ঠান্ডায় জমে যাবে। তাই সে হাঁটুপানির মধ্যেই থপ থপ করে দৌড়াতে শুরু করে। কিছুদূর যাবার পর হাঁপিয়ে ওঠে, অনাহারী শরীরে আর জোর পায় না। তবুও জোর করে পা দুটোকে টেনে টেনে এগুতে থাকে। পথ যেন শেষ হয় না। অনেক কষ্টে সে কাদের মোল্লার বাহিরের উঠোনে গিয়ে ওঠে।
উঠোন একেবারেই ফাঁকা। কোথাও কোনো প্রাণের চিহ্ন নাই। আর বাড়িটাকে মনে হয় নিঝুমপুরী। যেই উঠোন মানুষ আর গরু-ছাগলে দিনরাত ভরে থাকত, সেই উঠোন যেন এখন মৃত্যুপুরী। আর হবেই বা না কেন। তার মতো জীবন-মরণ সমস্যা না থাকলে কেউ কি এরকম দিনে ঘরের বাহির হয়?
সে আস্তে আস্তে গিয়ে কাদের মোল্লার কাছারি ঘরের বারান্দায় ওঠে। ঘরের ভিতর থেকে লোকজনের গুঞ্জন শোনা যায়। গুঞ্জন ছাপিয়ে কাদের মোল্লার কণ্ঠ ভেসে আসে। সে কী যেন বলছে, মনে হয় বয়ান করছে। বৃষ্টির শব্দে ভালো শোনা যাচ্ছিল না। সুরুজ আলী ভালোভাবে কান পেতে শোনে, কাদের মোল্লা বলছে, এই যে বৃষ্টি ঝরছে, এইডা রহমতের পানি। এই পানি যত ঝরব, তত রহমত বর্ষিত হইব। এই পানি নিয়া কোনো কটুকথা কওন যাইব না, আল্লাহ্ নারাজ হইব।
এর মধ্যে একজন বলে ওঠে, মোল্লা সাব, কথা ঠিকই আছে, কিন্তু গরিব মানুষগুলানের যে কষ্ট হইছে, হ্যারাও কি কিছু কইবার পারব না?
আরে মিঞা, নিজেরা তো ধর্মটর্ম কিছুই মান না, সেইজইন্যে এই কথা কইবার পারলা।
ছফু মিঞা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলার জন্য উসখুস করছিল। সে বলে ওঠে, মোল্লা সাব, ধর্ম তো মানুষের জইন্যে নাকি? তাইলে মানুষ নিজের দুঃখ-দুর্দশার কথা কইবার পারব না, হেইডা বোধহয় ধর্মে লেহা নাই।
কাদের মোল্লা রেগে ওঠে। বলে, যত্তসব ফাতরামো কথা। শোনো ছফু মিঞা, তুমি মনে করছ দুই ক্লাশ পইরা বিদ্যার জাহাজ হইছ। এইজইন্যে কই, মসজিদে আহো। তা তো আইবা না। আবার তুমি নাকি বাইরে বাইরে কইয়া বেড়াও, মসজিদে গেলেই মুসলমান হওন যায় না। তা কীসে মুসলমান হওন যায়, কও?
ছফু মিঞা উত্তর দেয়, আমি মুসলমান বলতে বুঝি, যে সত্যকথা কইব, সৎকাজ করব আর যার ভিতর-বাইর এক।
এতক্ষণ ধরে সুরুজ আলী বাহিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল, কিন্তু ওসব কথা তার মাথায় ঢুকছিল না। সে বারবার দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল। হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকে একজন তাকে দেখে ফেলে, সে হাঁক দেয়, কে ওইহানে?
আমি।
কাদের মোল্লা জিজ্ঞেস করে, আমি কেডা? নাম নাই?
আমি সুরুজ।
কোন সুরুজ?
খালের ওইপারে থাহি।
তখন একজন বলে ওঠে, তা তুমি ভিতরে আহো, বাইরে দাঁড়াইয়া রইছ ক্যান?
সুরুজ আলী লুঙ্গির মালকোঁচা ছেড়ে দিয়ে ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়ায়। সবাই অবাকদৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়, যেন চিড়িয়াখানার কোনো জন্তু। হঠাৎ কাদের মোল্লা ধমক দিয়ে ওঠে, ওই, এই ঝড়-বাদলের দিনে তুই এইহানে ক্যান? তামাশা দেখাইতে আইছস নাকি? যত্তসব বেজন্মার দল।
সুরুজ আলী ভয়ে কুঁকড়ে যায়। তবু সে সাহস করে বলে, মোল্লা সাব, কামকাজ নাই, ঘরে একটা দানাও নাই। পোলাপান লইয়া তিন দিন ধইরা না খাইয়া আছি। তাই এই বাদলার দিনে পানি ভাইঙ্গা আপনার এইহানে আইছি, আপনি আমারে একটু সাহায্য করেন, না হইলে পোলাপান লইয়া না খাইয়া মরতে হইব… এই বলে সুরুজ আলী দৌড়ে গিয়ে কাদের মোল্লার পা জড়িয়ে ধরে। কাদের মোল্লা খেঁকিয়ে ওঠে, আহা রে আমার সমুন্দির পো, আমি মুনে হয় দান-ছত্তর খুইলা বইছি। এই কথা শুনে সুরুজ আলী আরও জোর করে পা জড়িয়ে ধরে, বলে, মোল্লা সাব, একটু রহম করেন, আল্লা আপনার ভালো করব।
কাদের মোল্লা হো হো করে হেসে ওঠে। বলে, কী কইলি? আল্লা আমার ভালো করব, তোর কথায়? তুই আমারে হাসাইলি। কাদের মোল্লা লোকজনকে উদ্দেশ করে বলে, অ্যায় মিঞারা, শোনো শোনো, সুরুজ আলী কী কয়, হ্যার কথায় আল্লাহ্ আমার ভালো করব। সুরুজ আলী তখনও কাদের মোল্লার পা ধরেই আছে। কাদের মোল্লা দাঁত খিঁচিয়ে সুরুজ আলীকে বলে, আরে, তোর কথায় যদি আল্লা আমার ভালো করব, তাইলে তুই কি আমার এহানে হাত পাততে আইতিস? যা না সেই কথা। আসলে তগো একটাই অভ্যাস, সুযোগ পাইলেই হাত পাতবি। এইজন্য গরিবগুলানরে আমি দুই চইখ্যে দ্যাখবার পারি না। পা ছাড়, পা ছাড়… বলেই ঝটকা দিয়ে পা সরিয়ে নেয় কাদের মোল্লা।
সুরুজ আলীর বুকটা কষ্টে খান খান হয়ে যায়। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু লজ্জায়, অপমানে তার মাথা নিচু হয়ে আসে। চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ে। সে ভাবে, পৃথিবীতে তার মতো অসহায় বুঝি আর কেউ নেই। শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ হিসেবে যে যৎসামান্য আত্মসন্তুষ্টিটুকু তার মনে অবশিষ্ট ছিল মুহূর্তে তা উবে যায়। সে নিজেকে পৃথিবীর এক নিকৃষ্টতম জীব হিসেবে মনে করতে থাকে, যার নাম গরিব।
সে ধীরপায়ে ঘর থেকে বের হয়ে বাইরের বারান্দায় আসে, কিন্তু সে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তার শরীর থর থর করে কেঁপে ওঠে। সে এদিক ওদিক তাকায়, তারপর উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়াতে শুরু করে। পানির বাধা তার দৌড়ের গতি কমাতে পারে না। সর্বশক্তি দিয়ে সে পানি ভাঙে আর দৌড়ায়। মনে হয় যেন সে জনম জনম ধরে দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে সে খালের পাড়ে এসে দাঁড়ায়। তিন দিনের না-খাওয়া শরীর, মানসিক কষ্ট আর পানি ভেঙে দৌড়ানোর ফলে তার শরীর অবশ হয়ে আসে। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, খালের অথৈ পানিতে পড়ে যায়। সে তার সকল শক্তি দিয়ে সাঁতরানোর চেষ্টা করে, কিন্তু হাত-পা নড়ে না, দম বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করে। তার শরীর আস্তে আস্তে খালের গভীর পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে। অথৈ পানিতে তলিয়ে যেতে যেতে সুরুজ আলীর মনে একটাই ছবি ভেসে ওঠে, সে তলিয়ে যাচ্ছে; তার জীবন, স্বপ্ন, সংসার সবই তলিয়ে যাচ্ছে, যেমন তার বাপদাদারাও তলিয়ে গিয়েছিল…।