অনেক সাধ্য-সাধনা, চেষ্টা-চরিত্র ও নিরবধি অধ্যবসায়ের পর অবশেষে একটি মেয়ের সাথে প্রেম হয় আমার। নিকেল নিকোনো এক বিকেল বেলায় আমি আর সে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি পার্কের নির্জন কোনায় পাথরের বাঁধানো বেঞ্চিতে বসে ডেটিং করছি। পাশাপাশি বসে থাকা আমাদের দুজনার মধ্যে খুনসুটির পেন্ডুলাম ধীরে-সুস্থে দুলতে থাকে অনেকক্ষণ ধরে। কি আর করা, প্রেমকে যতই মহান এবং স্বর্গীয় বলে আখ্যায়িত করা হোক না কেন খুনসুটিই যে প্রেমের অন্যতম মূল ভিত্তি। যাহোক, একপর্যায়ে সে কোন একটা কথার সূত্র ধরে একটা ওজনদার মন্তব্য ছুড়ে দিল, “শারীরিক বেদনার চেয়ে নিশ্চয়ই মানসিক বেদনা অনেক বেশী যন্ত্রণাদায়ক।” অতঃপর মহৎ একটা কিছু বলে ফেলেছে এমন ভাব করে মতামত জানতে চাওয়ার আশায় আমার দিকে সে আড়াআড়ি ভাবে তাকাল।
আমি বিড়বিড় করে আমার মতামত জানালাম, “নিশ্চিত করে কি বলা যায়।”
সে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “কেন, এ কথা তোমার বিশ্বাস হয় না?”
আমি হালকা চালে উত্তর করলাম, “পুরোপুরি না, কেন জানি একটু একটু সন্দেহ হচ্ছে।”
সাথে সাথেই সে মুখের মধ্যে একটা কাঠিন্য ফুটিয়ে তুলে বলল, “এতে আবার সন্দেহ করার কি আছে? এরকমটাই তো সবাই বলে।”
বেঞ্চের মসৃণতা ঘেষটে আমি তার দিকে আরো খানিকটা সরে আসতে আসতে বললাম, “সবাই বললেই কি কোন কিছু সত্য বলে প্রমাণিত হয়। পরীক্ষালদ্ধ প্রমাণ ছাড়া কোন কিছু বিশ্বাস করাটা কি ঠিক, তুমিই বলো? আচ্ছা শোনো, আমার মাথায় দুর্দান্ত একটা আইডিয়া এসেছে। চলো না, দুজনে মিলে ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখি।”
খানিকটা অবাক হলেও আমার কথাটি যেন তার মনে ধরল, তবে একটু যেন ধন্ধেও পড়ে গেল। কিভাবে ব্যাপারটি পরীক্ষা করে দেখা যায় তাই যেন ভাবতে বসল সে।
তার মন এখন পরীক্ষা করার ব্যাপারটায় পুরোপুরি নিমগ্ন। এই সুযোগে আমি তার পিঠটাকে বেড় দিয়ে ধরে মসৃণ নাঙ্গা বাহুতে হাত বোলাতে বোলাতে থাকলাম এবং তার বাহুতে আমার হাতের বিচরণের মতই ধীর গতিতে বললাম, “এটা তেমন কোন কঠিন কাজ না, খুব সহজেই পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব।”
তখন সে তার স্নিগ্ধ থুতনিটা খানিকটা উপরের দিকে তুলে ব্যাপারটি পরীক্ষা করার প্রক্রিয়া সমন্ধে সাগ্রহে জানতে চাইল। তার কন্ঠস্বর কৌতুহল ও সন্দিগ্ধতায় জড়াজড়ি।
কয়েকটা গলা খাকরি দিয়ে প্রত্যেকটা শব্দের স্পষ্ট ও আলাদা উচ্চারণে তাকে বললাম, “পরীক্ষাটা হবে এরকম, যেহেতু তোমার কথা হচ্ছে— মানসিক বেদনা শারীরিক বেদনার চেয়ে বেশী কষ্টকর সেহেতু তোমার শরীরে আমি চাকু দিয়ে আঘাত করতে থাকব। আর আমি যেহেতু তোমার কথায় সন্দেহ প্রকাশ করেছি ফলে তুমি ইচ্ছামত আমাকে মানসিক যন্ত্রনা দিতে থাকবে। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা অনেক বেশী হওয়ায় আমাকে মানসিক যন্ত্রনা দানের ক্ষমতা তোমার শতভাগ আছে, এটা জানো তো?”
আমার হাতটি ইতিমধ্যে তার বাহু ছেড়ে দিয়ে তার ময়ূরের পেখমের মত ছড়িয়ে পড়া রাশি রাশি রেশমী চুলের নীচে ঘাড়, এবং পিঠের উপরের দিকের খোলা জায়গা ঘষতে শুরু করে দিয়েছে।
সে চমকে উঠে বলল, “আরে কি বলো তুমি, অদ্ভুত কথা! চাকুর আঘাতে আমি তো মারাও যেতে পারি।”
আমি ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম এই বলে যে, “তোমার যে মৃত্যু হবে না, তা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। জানো, তোমাকে কত ভালোবাসি আমি! তোমাকে ছাড়া আমার পুরো জীবনটাই যে অন্ধকারের চাইয়ে ঠাঁসা। আমাকে কি বুনো শুয়োর তাড়া করেছে যে, এত সাধের প্রেমিকাকে আমি মেরে ফেলতে যাব! তুমি মারা গেলে আমারও যে বাঁচার আর কোন সাধ থাকবে না, ডিয়ার। অন্যথা হলেও আইনের হাত থেকেই বা নিজেকে বাঁচাবো কিভাবে, যদিও জায়গাটা একটু নির্জন তবুও প্রকাশ্য দিবালোকে এরকম একটা খুনের আসামীর ফাঁসি কেউ আটকাতে পারবে না বলেই মনে হয়। আর যাই হই, এত বড় আহাম্মক আমি নই। দেখে দেখে তোমার শরীরের এমন জায়গাগুলোতে আঘাত করব যাতে তোমার মৃত্যু না ঘটে। রক্তপাত হয়ত একটু হবে। তবে ভয় পাওয়ার বড় কোন কারন নেই, কাছেই সরকারী হাসপাতাল আছে— রিক্সায় উঠিয়ে সোজা নিয়ে যাব ইমার্জেন্সিতে। কর্তব্যরত ডাক্তার কিছু ব্যান্ডেজ-ট্যান্ডেজ করে দিলে কয়েকদিনের মধ্যেই ক্ষতস্থানগুলো শুকিয়ে উঠবে। ক্ষতি হয়ত আমারই একটু বেশী হবে, বেশ কয়েকদিন তোমার সাথে ডেটিং করতে না পারার কষ্ট সইতে হবে। আর তোমার থেকে পাওয়া মানসিক যন্ত্রনায় কতটা কাহিল হয়ে উঠবো, তা তো তোমার জানা কথাই।”
সে বিস্ফোরিত চোখ মেলে চাইল আমার দিকে এবং তার পেলব ঘাড় থেকে আমার বাঁ হাতটি টেনে সরিয়ে দিল, যদিও তা ওখানেই লেগে থাকতে আঁকুপাঁকু করছিল।
আমার কথা শুনে তার বেশ খানিকটা ভয় পাওয়া ও সামান্য রাগ হওয়াকে তেমন একটা পাত্তা নিয়ে দিয়ে প্যান্টের পকেটে ডান হাতটি ঢুকিয়ে সবসময় সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আমার শখের চাকুটি বের করে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বাটনে একটা চাপ দিতেই সাই করে ধারালো ফলাটি বের হয়ে চকচক করতে লাগল। আমার চোখ দুটো তার বুক দিয়ে উর্ধ্বমুখী হেঁটে তার মুখের উপর এসে স্থির হলে দেখতে পেলাম, তার চোখ দুটি যেন এবার আর কোটরে বন্দী হয়ে থাকতে চাইছে না, ওদুটোতে এমন একটা তাগিদ লেগে আছে যে যেকোন মুহুর্তে ইদুরের মত তেড়ে গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। সবকিছুর পরও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল রইলাম এবং ছুরিকাটির তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ তার দিকে তাক করে পরীক্ষা শুরু করার ব্যাপারে তার অনুমতি চাইলাম মোলায়েম গলায়।
বেঞ্চির উপরে তার ডান পাশে রেখে দেওয়া ভ্যানিটি ব্যাগটা আস্তে করে কাঁধে ঝুলিয়ে হঠাৎ এক লাফে উঠে পড়ে আমার স্বপ্নের রাণী হাঁটা দিল পার্কের গেটের দিকে। আচম্বিতে মনে হল, সে হয়ত আমায় পাগল ঠাউরে চিরদিনের জন্য ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সে অন্য একটা ছেলের হাতে-হাত চোখে-চোখ রেখে বসে আছে, মনের পর্দায় এমন একটা ছবির আলোকসম্পাত হতেই অনুভূত হল কেউ যেন তার পেশীবহুল হাত-দুটি দিয়ে আমার ভেতরকার সকল বস্তুকে একসাথে চেপে ধরেছে। আমার বুদ্ধিশুদ্ধি সব এতটাই অবক্ষয়িত হয়ে উঠল যে বাড়িয়ে থাকা ধারালো ফলা বাটের ভেতরে ঢুকিয়ে প্যান্টের পকেটে ছুরিকাটি পুরে না দিয়েই তার পিছন পিছন জোরেশোরে হাঁটা দিলাম। আর ওদিকে তার পা-দুটি এতই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছিল যে, আশেপাশের যে কেউ তাকিয়ে দেখলে মনে করবে কোন হিংস্র আততায়ী বুঝি হত্যা করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তার পিছু ধাওয়া করেছে। আমার হাতে ধারালো ছুড়িকা ধরা থাকলেও আততায়ীর বদলে আমি ছিলাম তার প্রেমিক, একান্ত বাধিত এক প্রেমিক। আমি পিছন থেকে চিৎকার দিয়ে তাকে জানালাম যে, সে যে আমাকে একা ফেলে চলে যাচ্ছে, এতে কিন্তু আমি মানসিকভাবে প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছি। এসময় আমার গলার স্বরটা বেশ ভারীই হয়ে থাকবে। যাহোক, আমার আর্তি মিশ্রিত উচ্চারণ শুনে থমকে দাঁড়াল এবং তারপর রাজহাসের মত গর্বিত ঘাড়টি ঘুরিয়ে ভীরু ভীরু চোখ মেলে আমার দিকে ফিরে তাকাল সে। আমি হাঁটার গতি দিলাম বাড়িয়ে, ইচ্ছে হল এক দৌড়ে গিয়ে তার পা-দুটি জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেই এবং কান ধরে উঠ-বস করতে করতে বলি যে, এধরনের পাগলামীকে জীবনে আর কোনদিন তার সামনে প্রশ্রয় দিব না। বেখেয়াল প্রলম্বিত হওয়ায় উত্থিত ফলা সমেত চাকুটি তখনও আমার শক্ত মুঠিতে বাগিয়ে ধরা, ভয়ানক মনঃকষ্টে এরমধ্যেই আমার দু-চোখে সরু সরু রেখায় রক্তের আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ করে সে ছেড়ে দেওয়া স্প্রিঙয়ের মত মাথাটিকে পুনরায় সামনের দিকে ঘুরিয়ে দিল এক ঝাড়া দৌড়। মুহুর্তেই আমার পা দুটি যেন সিমেন্টের ছোট ছোট দুটি থামে পরিণত হল, চলতে পারা তো দূরের কথা বেশ কিছুক্ষণের জন্য নড়ে উঠারও কোন জো রইল না। এই সুযোগে সে আমার কাছ থেকে আরো বেশ খানিকটা দূর এগিয়ে গেল। তার ব্যাপার-স্যাপার কিছুই আমার মাথায় ঢুকছিল না। সে থেমেই বা দাঁড়াল কেন আবার হঠাৎ অমন করে দৌড়াতে শুরু করার কারনই বা কি! মুহুর্তখানেক এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর তার ফোলা ফোলা চরণ-দুটি জড়িয়ে ধরার নিদারুণ আকাঙ্ক্ষাটা আমার বুকের ভেতরে লাফিয়ে উঠল। শুধু মনে হতে থাকল, যেকোন ভাবে আজ তাকে ফেরাতে হবে, এরকম অবস্থায় চলে গেলে আবার ফিরে আসার সকল সম্ভাবনার অঙ্কুর নষ্ট করে তবেই যাবে। তবে একবার ধরতে পারলে হয়! কাকুতি-মিনতি করে জমে বরফের মত কঠিন হয়ে উঠা তার মনটাকে উষ্ণ অশ্রুর আঁচে গলিয়ে নেয়া যাবে খুব সহজেই। এসমস্ত ভেবে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলীর ছুড়ে দেওয়া তীরের ফলার মত ছুটলাম তার পেছনে পেছনে। আমার কপালটাই এমন, আমাকে তার ছেড়ে যাওয়ার দুঃখে এমনই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলাম যে, হাত থেকে ছুরিকাটি পকেটে চালান করার কথা তখনও আমার মনে আসে নি, এতটাই আমি বেকুব। এদিকে সে পার্কের গেটের একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আশেপাশের জোড়া জোড়া চোখ আমার দিকে এমন সুচারুতায় তাকাচ্ছে যেন খানিক বাদেই ওদের জোড়া জোড়া পা তেড়ে আসবে, তারপর জোড়া জোড়া হাত দিয়ে আমাকে পাকড়াও করে উত্তম-মাধ্যম দেওয়া শুরু করে দিবে। ধারালো ছুরিকা হাতে কোন মেয়েকে ধাওয়া করার মত অপরাধকে এই আমজনতা নিশ্চয়ই ক্ষমার চোখে দেখবে না। প্রেমিকা ফিরে পেতে গিয়ে অবশেষে গণধোলাইয়ে মারা পড়ব, এমনই কি আমার ললাট লিখন! হায় ভগবান! বাক্যের শেষেরকার দাঁড়ির মত দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। তার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম রাস্তার পাশে দাঁড়ানো রিক্সাগুলোর একটাতে সে পা বাড়িয়ে দিল, যেন বন্দুক হাতে শিকারি ব্যাক্তি পিছু লাগায় প্রচন্ড ভয় পাওয়া একটা ঘুঘু পাখি ডানা ঝাপটিয়ে ব্যাধের দৃষ্টি সীমানার বাইরে একটা গাছের ডালে কোনমতে নিজেকে বসাল।
মাথাটা বুকের দিকে নামিয়ে এনে ছুরিকাটির ধারালো ফলা বাটের ভেতর ঢোকাতে গিয়ে অনেক বেশী তাড়াহুড়া করায় সফল হওয়ার আগে বেশ কয়েকবার ব্যার্থতার গ্যাঁড়াকল পার হয়ে আসতে হল আমায়। অতঃপর ওটাকে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে সামনের দিকে নজর করতেই দেখতে পেলাম সেই রিক্সাটি পুরোপুরি উধাও। হায়! হায়! এখন আমার কি হবে! গেট পেরিয়ে ফুটপাতে উঠে দেখি রাস্তা দিয়ে শতশত রিক্সা চলাচল করছে। এত সংখ্যক রিক্সার মধ্যে কোনটাতে যে সে ঘাপটি মেরে বসে আছে তা বুঝতে পারা প্রায় অসম্ভব। তার ফোন নাম্বারে ডায়াল বাটন চাপতেই আবেদনময়ী একটা নারী কন্ঠ জানিয়ে দিল, তার স্মার্ট ফোনটি ঠিক এই মুহুর্তে সুইচড অফ করা। আমি মর্মাহতের মত দু-হাত দিয়ে মাথাটাকে চেপে ধরে ফুটপাতের উপর বসে পড়লাম, চোখ থেকে বৃথাই গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোটা অশ্রু, তাকে ফেরানোর কোন কাজে লাগতে না পারার ব্যর্থতায় অসহায়ের মত গলা বেয়ে নামতে লাগল শুধু। আমার মনে হল, শরীরের এখানে-ওখানে জমাট বাঁধা রক্তের ফোটা ও মাংশের ছোট ছোট টুকরা লেগে থাকা কোন দুর্দান্ত কসাই যদি আমার খুলির ভেতর থেকে মস্তিষ্কটা এবং বুকের ভেতর থেকে হৃদপিন্ডটা খুলে নিয়ে তার মাংশ কোপানোর জায়গায় রেখে বলিষ্ঠ হাতে ধরা চাপাতি দিয়ে অবিরাম কোপাতে থাকত তাহলেও বোধ করি এত কষ্ট লাগত না!