সাভারে বংশী নদীর তীরে অবারিত সবুজের মাঝে গাছপালায় ঘেরা মোহর আলীর বাড়িটি এক স্নিগ্ধ ছায়াময় ঘেরাটোপে আবৃত। ছোট্ট বসত বাড়িটিতে পাশাপাশি দুখানা মাটির ঘর। ঘরের লাগোয়া উপরে ছনের ছাউনি দেয়া চারদিক খোলা একফালি রান্নার জায়গা। সাভার অঞ্চলে বেশ মাটির ঘর পরিলক্ষিত হয়। মাটির ঘরের মূল উপাদান এঁটেল মাটি। মাটির স্তুুপ কিংবা ব্লকের পর ব্লক সাজিয়ে মাটির ঘর তৈরী করা হয়। মাটির ঘর তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা করে। গরমে ঠান্ডা এবং শীতকালে উষ্ম থাকে। মোহর আলী নরম কাদা মাটি, ধানের তুষ, গাবের আঠা দিয়ে মাটির ঘর নিকিয়ে নতুনের মতো করে রাখে, ওর বউ গৈরবী তাতে আলপনা এঁকে দেয়। বাড়িটির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মোহর আলী গৈরবীর ভালোবাসার অর্ঘ্য। মোহর আলী বলে এই সোনার জায়গা ছাইরা কোথাও যাইয়া দুইদন্ড শান্তি পাই না। বাইরে থেইকা যতই হয়রান হইয়া আসি না কেন এক লোটা কূয়ার ঠান্ডা পানি খাইলেই সব পেরেশানী দূর হইয়া যায়। টানি অঞ্চল চারদিক কি সুন্দর ফটফটা যতই বন্যা হোক, বর্ষা হোক আমগো গেরাম জাইগা থাকে। বাড়ীর সীমানায় কামিনী গাছে থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে সেদিকে চেয়ে মোহর আলী বলে এটাই আমার বেহেশ্ত খানা।
গৈরবী চৌকির তলা থেকে একটা মাঝারি সাইজের কাঁঠাল বের করে আনে। দ্রুত পাকানোর জন্য কাঁঠালে গোড়ার দিকে একটু ছিদ্র করে লবন গুজে দিয়েছিলো। হাতে সরিষার তেল মাখিয়ে গৈরবি কাঁঠাল ভাঙতেই বড় বড় রসালো কোয়া বেড়িয়ে আসে। একটা টিনের থালায় কাঁঠাল মুড়ি নিয়ে মোহর আলীর সাথে খেতে বসে গৈরবি বলে আমাগো গাছের কাঁঠালের রোয়া যেমন মধুর মতো বিচিও খুব স্বাদের। ভাবছি কয়ডা চারা উঠামু। আমার পুলা কাঁঠাল ভালো খায়। তোমরা বাপ পুতে মিলাইতো একটা কাঁঠাল সাবার কইরা ফালাও। মোহর আলী হেসে বলে ঠিকই কইছস বউ। আমার পুলা কই গেলো? অরে অনেকক্ষন দেহিনা। ওদের দেড় বছরের ছেলেটি কোমরে ঘন্টি নিয়ে বাড়ীময় ছুটোছুটি করে বেড়ায়। মোহর আলী ডাকে “গিনি অ গিনি কই গেলা”, চানমুখখান একটু দেহাইয়া যাও তো বাজান। বাচ্চাটি দৌড়ে এসে ওর ছোট্ট দুই হাতের মুঠিতে করে কিছু শুকনো কাঁঠাল পাতা মোহর আলীর হাতে দেয়। মোহর আলী চমৎকৃত হয়ে বলে বাপরে বাপ আমার গিনির কতো বুদ্ধি। গৈরবিকে বলে দেখছো গিনির মা, আমার গিনি তোমার লেইগা খড়িজাবা টুকাইয়া আনছে, অয় জানে মায় রানবো। প্রকৃতির উজার করা আলো বাতাস শুষে নিয়ে লকলকে সতেজ পরিপুষ্ট চারা গাছের মতো বেড়ে উঠছে বাচ্চাটি। ওর দুষ্টুমি, খলখলে হাসি বাড়িটিতে প্রাণের ফোয়ারা ছোটায়। মোহর আলী গৈরবির দিন কাটে এক ভালোবাসার ঘোরের আবেশে।
সর্দিতে বাচ্চাটির নাক মুখ লেপটে আছে। গৈরবি আঁচল দিয়ে নাক মুছে দেয়। বাচ্চাটি বড়দে অনুকরণ করে আবার নাক পরিস্কার করে। মোহর আলী হেসে বলে এক্কেবারে পাকা বুইড়া কি সুন্দর কইরা হিনাথ ঝাড়ে। এহ্-হে নাকটা লাল হইয়া গেছে। নাকে আর হাত দিওনা বাজান। আহো আমরা গল্গ করি। অহন কও বড় হইয়া তুমি কি হইবা। বাচ্চাটি আধো আধো করে বলে রিশকা চালামু।
মোহর আলী পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক যুবক। কর্মঠ এই যুবকটি জীবনের সমস্ত গ্লানি, উচ্ছাসের ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নেয়। তারুণ্যের সারল্য প্রতিটি মুহূর্ত অম্লান হয়ে ধরা দেয় মোহর আলীর কাছে। ওর বউ কুড়ি একুশ বছরের এক ছটফটে চঞ্চলা সুন্দরী যুবতী। সব সময় যেন উড়ে উড়ে বেড়ায়। হাসি, তামাসা, রাগ, অনুরাগ দিয়ে বাড়ীটিকে মাথায় করে রাখে। মোহর আলী বলে আমরা গরীব মানুষ পুলারে তো সহায় সম্পত্তি দিতে পারুম না তাই সুন্দর একখান নাম দিলাম আমার পুলাই আমার গিনি আমার সাত রাজার ধন আমার আন্ধার ঘরের মানিক। গৈরবি দুষ্টুমি করে বলে আর আমি ? মোহর আলী বলে তুই আমার বুকের পিঞ্জিরার ময়না পাখি। মোহর আলী সুরে সুরে গেয়ে উঠে তোরে “হৃদমাঝারে রাখবো ছেড়ে যাবো না, তরে “হৃদয়মাঝে রাখবো ছেড়ে যাবো না, ছেড়ে গেলে সোনার গৌড় আর পাবো না”। গৈরবি আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়, হাত খোপাতে কামিনী ফুল গুজে তীর্যক দৃষ্টিতে মোহর আলীর দিকে তাকায়। মোহর আলী মুগ্ধ হয়ে যায়। একটু বিহ্বল হয়ে পরে। মনে মনে চিন্তা করে এটাইকি বেহেশ্ত। প্রাপ্তির বদান্যতায় মোহর আলীর হৃদয় পুর্নতার ঢেউ খেলে যায়।
উনুনের কাছে বসে রান্নার যোগাড় করছে গৈরবি, পাশেই ছোট্ট ঝুড়িতে রাখা নিজেদের মাচানের মিষ্টি কুমড়ো শাকের কচি ডগা, একটা মাটির মালসায় রাখা কিছু কুচো চিংড়ি এবং শেষ হয়ে যাওয়া সিরাপের বোতলে ছটাক খানেক সরিষার তেল। ফালা ফালা কাঁচা মরিচ দিয়ে কুমড়োর ডগা, চিংড়ির সহযোগে এই পদটি মোহর আলীর অতি প্রিয়। সাথে গরম গরম ভাত। পাতে এক টুকরো লেবু, একটু পেয়াজ ওদের সংসারের বিলাসিতা হলেও এইটুকু না হলে মোহর আলীর মন ভরে না।
মোহর আলী সাংসারিক কাজকর্ম শেষ করে বউ বাচ্চাকে রিকশায় চাপিয়ে অদুরে নদীর ঘাটে নিয়ে যায় গোসল পর্ব সারাতে। গোসলাদি শেষ হলে আবার নিয়েও আসে। ভালোবাসার গড়িমায় সুখী গৈরবির মুখ মন্ডলে সবসময় আলোর দ্যুতি উপচে পড়ে। দিনশেষ মোহর আলী ক্লান্ত হয়ে বাড়ী ফিরলে গৈরবি কুয়ো থেকে পানি তুলে দেয়। মোহর আলীর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত গায়ে মালিশ করে দেয়। দুজনের সমন্বয়ে সংসার চলে এক ছন্দময় উচ্ছলতায়। সুখী জীবনের নির্যাস যেন এই সংসারেই লুকায়িত আছে। অনাবিল সুখশান্তি ভালোবাসা নিজেদের মধ্যে জিইয়ে রাখে এই দম্পতি। এসব দেখে প্রতিবেশী বউদের চোখ টাটায়। তারা মনের কষ্ট গোপন রেখে হাসি হাসি মুখে জানতে চায় সুখ উপচানো সংসারের রহস্য কি ? এটা কি ঘোড়াপীর মাজারের কেরামতি? নাকি কোন তুক্তাক্, পরামর্শ চায় নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করার জন্য। রহস্যময়ী গৈরবি মুচকি হাসে। প্রতিবেশী বউয়েরা গৈরবিকে শত্রু ভাবতে শুরু করে। যেন নিজেদের অতৃপ্ত জীবনের জন্য গৈরবিই দায়ী। যাবতীয় সুখশান্তি ভালোবাসা গৈরবি একাই পেয়ে যাবে তা কি করে হয়। নিজেরা প্রত্যাশামতো স্বামীর আদিখ্যেতা, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত, আর গৈরবি সব নিয়ে মোহর আলীর সংসারের রানী হয়ে বসে আছে ব্যাপারটা ওদের কাছে কাঁটার মতো বিধে। গৈরবিকে জাদুকরী ডাইনী মনে করে। মনে মনে গৈরবির অসুখী জীবন কামনা করে। গৈরবিকে ঈর্ষার কারণে ওরা একজোট হয়ে থাকে। পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য সম্প্রীতি বজার রাখে।
হঠাৎ একদিন গৈরবির সংসারে বংশী নদীর হাওয়া থেমে যায়। কামিনী ফুলের সুবাস আর গৈরবিকে আলোড়িত করে না, বাসি ফুলের মতো নেতিয়ে থাকে গৈরবি। অনেক সাধ্য সাধনা করেও গৈরবির মুখ থেকে কেও কথা বের করতে পারে না। মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে গৈরবি। চঞ্চল ছটফটে ওদের ছোট্ট ছেলেটি চুপ্চাপ্ হয়ে গেছে। অবোধ শিশু ওর অবচেতন মন সংসারের কিষ্টতা উপলব্ধি করতে পারে। লক্ষী বাচ্চার মতো মায়ের কাছে বসে থাকে। অযথা বায়না করে না, বাবার শূন্যতা অনুভব করলেও মুখে কিছু বলে না। ছলছল চোখে বাবার আগমন প্রত্যাশা করে। প্রতিবেশী বউয়েরা মোহর আলীর অন্তর্ধানে পুলকিত হলেও ম্লান মুখে গৈরবিকে সান্তনা দেয়। দুপুরের কাজকর্ম শেষ করে সবাই একত্রিত হয়ে মোহর আলী-গৈরবির সংসারের হাল হকিকত নিয়ে মেতে উঠে। মাজেদা ওর ছোট্ট মেয়েটিকে কোলে শুইয়ে হালকা চাপড় দিয়ে ঘুম পাড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বলে, মোহর আলী গেল কই ? গৈরবির তো বেহাল দশা। অর রাঙামুখে কেও যেন একপোছ কালি মাখাইয়া দিছে। এতো ফুটানি আছিলো এহন কেমন চুপসাইয়া গেছে। সারাদিন মটকা মাইরা পইড়া থাকে। জমিলা, আক্কাছের বউ জ্যোস্নার উকুন বাছতে বাছতে বলে গৈরবির তাপ্যিস সহ্য করতে না পাইরাই মোহর আলী পালাইছে। তন্ত্রমন্ত্র পইরা মোহর আলীরে ভেড়া বানাইয়া রাখছিলো আমরা কি ঘাষ মুখে দিয়া চলি, সব বুঝি। পাপ বাপেরেও ছাড়ে না। আল্লাহর ঘর অতো সোজা না। অহন বুজুক কত ধানে কত চাইল। এই যে আমাগো রাবেয়া ভাবী, গৈরবির চাইয়া কি কোন অংশে কম সুন্দর ! কই এতো দেমাগ তো দেখায় না, সারাদিন সংসারের লাইগা খাইটা মরে। সোয়ামীর সেবাযতœ করে। আমাগো আয়য়ুব নবী রহিমা বিবির গল্প শোনায়, ভালো ভালো বুদ্ধি পরামর্শ দেয়, “কয় পতি পরম গতি”, সোয়ামীরে ভজলে আল্লাহরে পাওয়া যায়। রাবেয়া একটু লজ্জিত হয়ে বলে আমি আর কি ধার্মিক, আমার ছোট বইন হইলো নামাজ রোজায় পাঞ্জেকানা। অতোটুকু মাইয়া তার এক ওক্ত নামাজ কাযা হয় না। আর রূপের কথা যদি কও অর রূপের কাছে আমি বান্দি, আমার বইন কদুর মতো ধলা, নাক-নকশাও অনেক সুন্দর। অর তেলা গালে মাছি বইলে পিছলাইয়া যায়। আমরা ভালো পুলা খুজতাছি, তোমরাও দেইখো, অর বিয়ার লেইগা আমার বাপে মাথা থেইকা পাও পর্যন্ত রূপার গয়না বানাইয়া রাখছে। সোনার মাকড়ি, নাকঠাসা সব দিয়া বিয়া দিমু আমরা। পুলা যদি ভালো হয় বিয়াতো হইলেও চলবো। গল্পের আসরটিকে আরেকটু প্রাণবন্ত করার জন্য চালভাজা, আখের গুড়ের ফিকে চা নিয়ে বসে। দিনগুলিকে সেলিব্রেট করতে চায়।
ওদের এই আনন্দ উল্লাস বেশীদিন স্থায়ী হয় না। মাস তিন চারেক পরেই মোহর আলীকে গ্রামে ঘুরাঘুরি করতে দেখা যায়। ক্রমশ দেখা গেলো ছেলেকে কোলে নিয়ে দোকান থেকে পটেটো চিপস, ম্যাঙ্গো জুস কিনে দিচ্ছে। উঠোনে বসে গৈরবির সংগে গল্প করছে, হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে। প্রতিবেশী বউয়েরা তো হতবাক, এতোটা আশা করেনি। কোথায় গৈরবির দেমাগ ভাংবে তা না মোহর আলী এসে সব ভন্ডুল করে দিলো। ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মোহর আলী এমন বলদের বলদ, নীড়ছাড়া পাখির মতো দাপড়াইয়া মরে। মর্দপুলা তুই, একঘর ভাঙ্গে ভাঙ্গুক আরেক ঘর গড়বি। মোহর আলী চাইলে রাবেয়া বুর আবিয়াতো বইনের লেইগা আমরাই সম্বন্ধ করতাম। জ্যোস্না বলে, কাইল ওগো ঘরে ফুচকি দিয়া দেহি মোহর আলী গৈরবির চুল আঁচড়াইয়া দিতাছে। এই দুই নয়নে যে কতো রঙ্গ দেখুম। আসলে সব জাদুর খেল, জাদুকরী ডাইনীর হাত থেইকা মোহর আলীর আর বাঁচন নাই।
মোহর আলীর চলে যাওয়া-ফিরে আসা নিয়ে ওদের মধ্যে বিভ্রান্ত সৃষ্টি হয়, ভেবে কুল কিনারা পায়না ওরা, গৈরবির দেমাগ আরেকটু বাড়বে সেই কল্পিত ভয়ে শঙ্কিত হয়ে থাকে। নিজেদের দূর্বল ক্ষমতাহীন ভাবে। গৈরবির সুখে দুঃখিত হয় এবং নিজেদের প্রতি অনাস্থা জাগে। ওরা বলাবলি করে গৈরবি হইলো চিকন চালাক, অর বুদ্ধির সাথে আমরা পারুম না, কথায় আছে রাজার চাইয়া চুরের বুদ্ধি বেশী। তাজ্যব লাগে কেমনে কেমনে সবকিছু ঠিক কইরা ফালায়। প্রতিবেশী বউয়েরা মোহর আলীর বাড়ীতে আসে গল্পের ছলে আসল ঘটনা জানার জন্য। গৈরবি হাসিমুখে সবাইকে অভ্যর্থনা জানায়। ঘন দুধের কাওনের ক্ষীর দিয়ে আপ্যায়িত করে। গৈরবির পড়নে নতুন শাড়ী। জবা কুসুমের তেল মাথায় লাগিয়ে টান টান করে খোপা বাঁধা। একটা শীতল পাটি বিছিয়ে আসরের মধ্যমনি হয়ে বসে পান খেতে খেতে গৈরবি সবিস্তারে সব খুলে বলে।
মোহর আলী গৈরবির সাংসারিক কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে মুখ ফসকে বলে ফেলে তরে তালাক দিলাম, এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক, আইন তালাক। এক পর্যায়ে গৈরবি মুর্ছিত হয়ে পরে থাকে। রাগ কমে গেলে মোহর আলীর সম্বিৎ ফিরে আসে। অনিচ্ছাকৃত কথাটি বলার জন্য অনুতপ্ত হয়। গৈরবির মুখে পানির ছিটা দেয়। গৈরবি উঠে ঘোমটা টেনে বসে। কেননা মোহর আলী এখন পরপুরুষ। মোহর আলী অনেক কাকুতি মিনতি করে সব ভুলে যাওয়ার জন্য। গৈরবি অনড় থাকে। না-জায়েজ সংসার করতে গৈরবি রাজী নয়। গৈরবি বলে কেও না জানুক মাথার উপর একজন আছে, সে সব জানে। অগ্যতা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে বাড়ী ছেড়ে চলে যায় মোহর আলী। ধর্মের ভয় ওকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে। বউ সন্তানের জন্য বুক ফেটে গেলেও নিজেকে শক্ত রাখে। এক বুক শূন্যতা নিয়ে নদীর ঘাটে বসে থাকে। মোহর আলী ছিলো স্রোতের উজানে সাতার কাটা এক দক্ষ সাতারু। এখন ওর জীবনে ভাটির টান। নদীর উথালি পাথালি ঢেউয়ের মাঝে নিজেকে মনে করে পথভ্রষ্ট এক দিশাহারা মাঝি। দুরে ভেসে যাওয়া নৌকার হারিকেনের আলোকে আলেয়া বলে ভ্রম হয় মোহর আলীর। এমনি এক ভাবনার সন্ধিক্ষণে হঠাৎ মোহর আলীর মনে পড়ে যায় আরে বাইন তালাক তো বলা হয়নি। মোহর আলীর মন পালকের মতো হালকা হয়ে যায়। সংসারে ফিরে আসার সম্ভাবনা টুকুর জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানায়। হারানো মানিক ফিরে পাওয়ার আনন্দ অনুভূত হয় মোহর আলীর হৃদয়ে এবং মুক্ত বিহঙ্গ নির্ভার হয়ে সংসারে ফিরে আসে। সংসারটিকে মোহর আলীর মহার্ঘ্য মনে হয়। তাই আরো নিবিড়ভাবে সংসারকে আকড়ে ধরতে চায়। সবকিছু জানার পর প্রতিবেশী বউয়েরা ঈর্ষাম্বিত দৃষ্টিতে গৈরবির দিকে তাকায়। প্রাণপণে নিজেদের কষ্ট চেপে রাখার চেষ্টা করে। তর্জনীতে একটু চুন জিবে ঠেকিয়ে অহংকারী ভঙ্গিতে প্রতিবেশী বউদের দিকে তাকিয়ে মহাসুখি গৈরবি বলে আসলে গিনির বাপে “বাইন তালাক কইছাল্ না”।