‘২০নং দক্ষিণ মৌসুন্ডি’ // ফারজানা তৌফিক

0

সোনা মিয়ার দোকানে একটা পেজগী রুটি আর এক কাপ মালাই ভাসাইনা চা খাইয়া পকেটে হাত দিয়া রমজান আলী দেখে পকেটে টাকা নাই, কিছু খুচরা পইরা রইছে। মহল্লার চেনা দোকান, তেমন সমস্যা হয় নাই ঠিকই কিন্তু আইজকা মুসতাইক্যার খবর আছে। মুসতাক বাপেরে না জিগাইয়া মাঝে মধ্যে পাঁচ দশ টাকা লয়। মালাই কুলফি কিনা খায়। পুলাপান মানুষ শখ আল্লাদ থাকতে পারে, এইটা ভাইবা জাষ্ট ইগনোর করছে। মাগার আইজক্যা যেইটা করছে এইটা ডাকাতি। রমজান আলী ছোটবেলায় খুব সিজিলের আছিলো। বাপে নিজ হাতে দুই-চাইরানা দিলে কোনদিন কটকটি বা কোনদিন আলুরদম কিনা খাইতো। চুরি-তো দূরের কথা বাপের কছে কিছু চাইতে ভি ছরম করতো। একবার কড কাপড়ের একটা পেন্টের শখ হইছিলো, মার পিছনে ঘ্যান ঘ্যান কইরা আদায় করছিলো তা-ও ভি বাপেরে কইতে পরে নাই ডরে। রমজান আলীর মাথা হট্ , মহল্লার সবাই জানে। চিল্লাপাল্লা করতে লাগলো, আইজক্যা মুসতাইক্যার একদিন কি আমার একদিন।

ঘরে আইসা রমজান আলীর মাথা আরো হট, মাইয়া মারজান ড্রেসিংটেবিলের সামনে বইয়া চুল ফিটিং করতাছে। ঐ মুসতাইক্যা কই? মারজান আয়নার আরো সামনে যাইয়া ঠোটে লিপিস্টিক লাগাইতে লাগাইতে কইলো, আইজ-না সাকরাইন্, ছাদে গুড্ডি উড়াইতাছে। তোর মায় কই? ‘এই’ যে আমি পাকঘরে সালুন রানতাছি’। ‘রাখো তুমার সালুন, মুসতাইক্যা’রে ডকো’। দশ-এগারো বছরের নিরীহ মুসতাক বাপের সামনে আইয়া কইলো, ‘আব্বাজান আমারে ডাকছেন’ ? ‘জিগাই আমার পকেট থেইক্যা তুই ট্যাকা লছ নাই’? ‘ঈমানে কইতাছি আব্বাজান আমি ট্যাকা নেই নাইক্কা’

‘তুই কল্পনা বেকারী থেইক্যা হট পেটিস কিনা খাইছস ‘। ‘ঈমানে কইতাছি আমি চুরি করিনাইক্কা’। ‘ তুই লইছস ভি খাইছস ভি’। ‘ আমি টিটু মিঠুর সথে খেলবার লাগছিলাম, অরা কইলো চল্ আমরা ঘটি গরম খাই।

আমি কইলাম আমার কাছে ট্যাকা নাইক্ক্যা, তোরা খা’। ‘ হায় হায় আমার কি অইবো! পুলাতো এই বয়সেই বাটপার অইয়া গেছে’, ‘বাপ-দাদার নাম ডুবাইবো, ইজ্জত মাইরা হাতে ধরাইয়া দিব। মুসতাক মাথা নীচু করে বলতে থাকে ‘আমি চুরি করি নাইক্ক্যা’। ‘যা তফাৎ যা’। এদিকে মারজানের লেখাপড়ায় মন নাই। উইড়া উইড়া বেড়ায়। টেপ রেকর্ডার ছইড়া এমুন ডিসকো নাচ নাচে, বাপ হইয়া নিজেরই সরম লাগে। বড় বে-লেহাজ মাইয়া’।

নীচতলার এক কোনের ঘরে লজিং মাষ্টার মামুন থাকে। খায় দায় মুসতাকরে পড়ায়, নিজেও ভি জগন্নাথ কলেজে পড়ে। বাঙাল হইলেও ছেলে ভাল। চোখ সব সময় পক্কার দিকে থাকে। পুলাডারে দেখলেই মারজান চোখ নাচাইয়া মুচকি হাইসা ছড়া কাটে,

‘মামুন মিয়া বেকার

তই বলে কি সাধ

নাই তার

বিশ্ব ঘুরে দেখার’।

রমজান আলী নিজ কানে শুনছে। নিজের আখের-তো ঝরঝরা করছসই, অর পিছনে লাগছস ক্যান। সত্যিই মাথাটা হট হইয়া গেছে। এক ঠিল্লা পানি ঢাল্লেও মাথা ঠান্ডা হইবো না। কম বয়স এই রমজান আলীর-ও ছিল, আউলা বাতাসে তার মনও বাউলা হইতো। মাগার ঈমানের পথ থেইক্কা এক চুলও সরে নাই।মাথায় সব সময় টুপি থাকতো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে পা বন্দি করতো। দিল ঠান্ডা থাকতো। তাই মন উচাটন্ হওনের কোন চান্সই থাকতো না। রমজান আলীর বইন ইয়াসমিনের দুই মাইয়া ঝুমুরী আদুরীরে কি সুন্দর আদপ-লেহাজের সাথে বড় করতাছে। সব সময় পরদা কইরা চলে। আস্তে আস্তে বুলি কপচায়। বইনের বাসায় গেলে কি সুন্দর কইরা কয়, ‘আসসালামুয়ালাইকুম বড় মাম্মা, ক্যামন আছেন? মারজান-মুসতাক কেমন আছে?

একটু জিরাইয়া লন। লাচ্ছি সরবত বানাইয়া আনতাছি।

আপনে-তো বুন্দিয়া

দিয়া বাখরখানি খইতে   পছন্দ করেন। আনাইয়া দেই, গরম গরম খান। শুনলেই দিলডা ঠান্ডা হইয়া যায়। মায় ভাল তো ঝি ভালো। নিজের সংসারে ক্যাওয়াজ লাইগাই থাকে। মেহনতের টাকা খোলামকুচির মত উড়ায়। খুব প্যালা হামিদার। আইজক্যা খাসির গোস্ত আনবেন গ্লাসি পাকামু তো কাইল গরুর গোস্তের ছেঁচা কাবাব পাকামু। পয়সাঅলা ঘরের মাইয়া, বপেতো দিছেও খুব। বিয়ার পর যখন গা ভর্তি গয়না পইরা কাজকাম করতো, গয়নার টুংটাং শব্দে রমজান আলী নিজেকে গর্বিত ও সম্মানিত মনে করতো।এ তল্লাটে এমুন সুন্দরী বউ কেউ আনতে পারে নাই, এমন যৌতুক ভি কেউ আনতে পারে নাই। গয়না বন্দক দিয়া  রমজান আলী ব্যবসায় লাগাইছে, অহনও উঠাইতে পারে নাই। হামিদা হাতের মানতাশা বাজুবন্ধের দুঃখ এখনও ভুলতে পারে নাই। এককালের অতি সুন্দরী ছিপছিপে হামিদা অহন মোটা ভীম অইয়া গেছে। বকা দিতে শরম লাগে। ডরে মনে মনে কুর্নিশ জানায়। শরিকি বাড়ি সবাইরে নিয়া চলতে হয়। নিলুফা ভাবির সাথে একটু গল্পগাছা হাসি তামাশা করলে হামিদা মনে হয় তক্কে তক্কে থাকে। কোন উছিলায় রমজান আলীরে ডাকবো,’মারজানের বাপ একটু শুনেনতো, দোকান থেইকা ডাইলপুরি নিয়া আসেন ,  মুসতাক খাইবার চায়। মজলিশ নষ্ট করতে অর একমিনিটও লাগেনা। মাথাটা এমনি এমনি হট হইয়া যায় না। হামিদা সব বোঝে! কয় এক গেলাস তুকমার সরবত বানাইয়া,খান ভাল লাগবো। এমন নিরীহ ভাবে কথা কইবো, দেইখা মনে হয় ভাজা মাছটাও উলটাইয়া খাইতে জানেনা। মাগার বহুত চালাক মাইয়া মানুষ, বহুত কিপটাও, আচলে ট্যাকা গিট দিয়া রাখবো তও ভি সংসারে খরচ করবো না। বাপে যে মাঝেমধ্যে  মাইয়ারে টাকা দেয় তা এই রমজান আলী জানে। এতো টাকা করে কি? ট্যাকার-তো পাখনা নাই উইড়া যাইবো। পুলাপানের পিছনেও-তো খরচ করেনা, সবতো আমারে দিয়াই করায়। খোজ নিতে অইবো। স্বামীরে এতো লুকাইয়া চুড়াইয়া চললে পরকালে জবাব দিব কেমনে! “স্বামীর পায়ের নিচেই-তো স্ত্রীর বেহেশত”। “স্বামী মারলেও স্বামী কাটলেও স্বামী”এইডা অরে বুঝাইবো কে। আবার বোরখা পইড়া মহল্লায় মহল্লায় তবলীগ কইরা বেড়ায়। সংসারটা রসাতলে গ্যালো। রশি আলগা করলে যা হয়। রমজন আলীও কম ঘোরের মানুষ না। ‘গারি তুমার, স্টেয়ারিং আমার হাতে’। মাগার চাক্কায় চুবি ঢুকলে ড়্যালা সামলাইবো ক্যাঠা! এই অধমইতো ভরসা। এ্যালা আর কি? রমজান আলী ভালই আছে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার