চোখের জমিতে ফোটাও নন্দন পুষ্প ও অন্যান্য কবিতা // নুসরাত জাহান

0

জল-ঘুমের মিথ্যাচার নেই

একটা জল দরকার,
এক জীবন জল দরকার।জলের নীচে জেগে থাকা নীল নীল লতানো আকাশ, তাতে ফুটে থাকা কুসুমকুমারী চোখ দরকার।চোখের পাটাতনে গা বিছিয়ে একদিন খুব ঘুমাবো দূর্বাঘাস ঘুম!

এই ইউক্যালিপটাস খুব মসৃণভাবে সুন্দর।এখানে শরীর খোঁজা হাত কখনো জানেনা ঘুমেরও চোখ আছে।তারা বৃক্ষ।তারা বৃক্ষের নিজস্ব তপস্যার জল থেকে বর পেয়েছিলো।সে জলে কোন ক্লান্তি নেই।

শুধু ক্লান্ত হয়ে যায় এই প্লাস্টিক ধূলো,প্রেমাসক্ত চিৎকারে বাড়ি খাওয়া পোড়া চাঁদ,ঘোর ঘোরালো অনুভূতিদের পথ হারানো অসহায়তা।প্রেমিকেরা চেয়ে দেখে প্রেমিকার লাশ,তাদের চোখগুলো খুলে পড়ে মিছিলের নীচে।বাৎসরিক জ্বরে তারা কেবলই নিত্যনতুন সভ্যতা শিখে।সভ্যতা হলো মিথ্যার খুব স্নিগ্ধ নাম।

পৃথিবীর শেষ দূর্বাঘাস ঘুম যাদের কাছে তারা যেন লুকিয়ে থাকে বৃক্ষের শেকড়ে।

 

ভোরবেলার অঞ্জলি

সুন্দর এবং অন্ধকারের অভাব বোধ হলে আমি জলের কাছে যাই।জলের এক দীর্ঘ করুণ আনন্দগাথা আছে।নদীর কাছে গেলে, জলের কাছে গেলে আমি শুনি পৃথিবীর সময়ের আকাঙ্খিত ডাক, শুনি কাকের ঘুম না ভাঙা ভোরের মতো মোহময় সুর,জলের কাছে গেলে শুনি আমার ভেতরেই বেজে ওঠা ঝরাপাতা, জলজ জীবনের গল্প শুনি।কবেকার কোন ফড়িং এর ডানা বৃষ্টিতে গলে গিয়ে সমুদ্রে আটকা পড়েছিলো তার মুক্তির গল্প শুনি।শুনতে শুনতে নিজেকে অন্ধকার মনে হয়।নিজেকে অন্ধকার ভাবতে ভাল লাগে। রাত হয়ে পৃথিবীর আয়ু পেরোনো সমস্ত প্রাচীন জলের গায়ে মেখে যেতে ভাল লাগে।ভাল লাগাও এক রকমের সবুজ জল।সেখানে নুয়ে যায় দূর্বাঘাসের শীষ,ঘাসফুলের টুকরো লাল।কৃষ্ণচূড়ার ডালের নীচে ঘনায় সবুজ অন্ধকার।

সেই প্রত্যাশিত নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কাছে আমি সময়কে বিসর্জন দিতে চাই।ঘুড়ি উড়ানোর গল্পে এক জীবন কাটানো এক করুণ বালকের মতো আকাশকে চোখে পুরে নিতে পারলে আমরাও,আমরাও একদিন ঠিক পেয়ে যাবো স্বচ্ছন্দ নীলবন।মাছরাঙাদের উৎসবে স্বর্ণলতার গাছে শ্রাবণ শেষের ফুল আমরাও গুঁজে নেবো খোঁপায়।সেই সন্ধ্যায় কোনো বৃক্ষের কান্না থাকবে না।কোন গর্ভবতী গাছের কাছে দ্বিখন্ডিত ভ্রূণের গল্প থাকবে না।কোন অতিরঞ্জিত মিথ্যার ভার বইবে না প্রকৃতি,অভিমানের চেয়ে দামী কোনো অলংকার থাকবে না তার।কেবল কড়ই গাছের ডালে চাঁদ উঠবে বলে সব মানুষ ঘাসের ওপর এসে বসবে, কেবল পানাফুলের মূর্ছা যাবার কষ্টে অশ্রু জমবে প্রেমিকের হাতে।সেখানে একটা পদ্মফুল ফোটার অপেক্ষায় আমরা অনন্তকাল ভোর হয়ে বেঁচে থাকবো।

 

শহর অথবা ঈশ্বরদের নিয়তি

এই যে এই আশ্চর্য বাতাসটা হচ্ছে এখন,এই যে বৃষ্টির আসি আসি ভাব,জোছনার ঢল,নিমফুল আর মুকুলের কেমন জানি গন্ধ— এই বাতাসটায় হাত বুলালে মনে পরে আমদের ভেতরে গভীর শূন্যতায় একটা বিরান নদী একা বয়ে যায়।নদীটা অনেক অভিমানে জমে যাওয়া বাষ্পীয় চোখের মতো টলটল করে।তখন লোহার গ্রিল, তখন তেঁতুল গাছের পাতা, পাতায় আলোর নকশা তখন মাথার ভেতরে অনেক পুরাতন ঝিঁঝিঁর ডাক এবং ঠিক তখন নিজেকে পৃথিবী এবং সময় নামক অদ্ভুত দুই পরস্পরগ্রাসী সরিসৃপ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়।আমাদের অকাল ঘুমন্ত অস্পৃশ্যতার থেকে; যোনী,রক্ত,হত্যা,শরীর,ধর্ষণ,মানুষ,ও শিশ্ন থেকে ডুমুরপাতার ছায়া পড়া ড্রেনের কালো জলে গলে যাওয়া সাদা চাঁদ অনেক তীব্র সত্য মনে হয়।

কবেকার কড়ই গাছ কবেকার সবুজ মাঠ কবেকার গোধূলীর ঘুড়ি কবেকার একটা সাদা উঠোনের গল্প বহু বসন্ত আগের এক সদ্যমৃতা নারীর নাম খুঁজছে—

এখন, যখন শহরের রোজনামচায় ঈশ্বর নিজের নিয়তি লেখে।

 

পথিকজন্মের উপাখ্যান

এই তো বেশ বয়ে চলেছে সময়
খেয়ালি স্রোতের টানে বৈচিত্র্যময় জোয়ার ভাটায় ভেসে
আমরা সবাই সূর্যকে বলি
“ডুবে যা আমার জলে”।
মেঘে মেঘে পলাশের রঙ গাঢ় হয়ে এলে অবলোহিত আকাশে তখন বেজে ওঠে
নীড়ে ফেরার গান।

আমাদের গল্পগুলো শুরু হয়।
এক আকাশের নীচে হঠাৎ কখনও মোহনায়
মহাকালের বহমানতা একাকার করে জেগে ওঠে পথ
আমাদের গল্পের পথ।

হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে বসি এক ঘন জারুলের ছায়ায়।
আমাকে অভ্যর্থনা জানায় জন্মের শিকড়

এরও অনেক ইতিহাস আছে।

প্রত্যেকটি ঝরা পাতার মর্মরে
শুনতে থাকি এক অলিখিত মহাকাব্য।
ঠিক তখন মাথার ওপর শালিকের সংসারের শব্দ;
সেই ক্রুর বক্র হাসি হেসে জারুলকেও বলি “ভাল থেকো”।

দীর্ঘ নিঃশ্বাসে উড়ে যায় পাতাগুলো।

মোহভীত সজাগ পথিক,
মধ্যাহ্নের অরুণ প্রেমে রক্তকে বিশুদ্ধ কর
আদিগন্ত ভালবাসার দাবানলে নিঃশেষ হোক সেই সব হাতছানি
যারা তোমাকে অর্ধ রাখতে চেয়েছিল।
পথ এবং জারুল,
“ভালবাসার ব্যাখ্যা হয় না কোনদিন।”
তাই অন্ধকারের বিদর্ভ নগরে বেঁচে থাকে কোন তীক্ষ্ণ প্রহর
বিদ্ধ হবার আর্তনাদ শোনে না প্রকৃতি,
যে ইতিহাস লেখেনি মহাকাল
নিভৃত জন্মের সে পথ বেঁকে গেছে লৌকিক আলোয় এবং অনেক দূরে।
আমি একতারার সুর ধরে হাঁটি,
পেছনে ক্রমশ বেড়ে চলে ছায়াগুলো—
সেই যে বালকের গল্প—
যার ঘুড়িটা লাটাই ছেড়েছিলো
তারপর ঘুড়ির পিছে ছুটে হয়তো সে নিজেও…
আমি হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়াই
ঘুড়ি এবং নিরুদ্দেশ বালকের মাঠে।
ঘোলাটে আকাশের নীচে
গতরাতের অসমাপ্ত কবিতাগুলো ঘাসের ডগায় জমে থাকে।
অতঃপর নিজেকে মেলে ধরলে
ওরা আমার চুল পিঠ ভিজিয়ে তোলে
শিশিরের গন্ধে দু চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমে
আমি ঘাস হয়ে ঘুমাতে থাকি।

এমন এক স্বচ্ছন্দ সময়ে বাতাসে ভেসে আসে কাশফুলের ঘ্রাণ, আমার শৈশব— কানে যেনো বেজে ওঠে শঙ্খ,ফড়িঙের ডানা ঝাপটানি,আরও দূরে ফেরিওলার ডাক।

আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন পায়ে তার অনুসরণ করে এক অরণ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে থামি;
যেখান থেকে ফিরে যায় সেই সব ছায়া
যারা জলকে তৃষ্ণা দিতে চেয়ে প্রলয় এনেছিলো।

নক্ষত্র খচিত অন্ধকার—
দীঘির স্বচ্ছ জলে আমি সপ্তর্ষির কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হই।
নির্লিপ্ত পদক্ষেপে জল থেকে উঠে আসে দর্শন,
আমাকে ভেদ করে তার প্রসারিত দৃষ্টি হঠাৎ কখন
একটা বিশাল আয়না হয়ে ওঠে।
আশ্বিনের মায়াবী আলোর জাল—
আলোতে আমি এবং আমি মুখোমুখি বসে থাকি,
তার নিশঙ্ক শীতলতার সামনে,ভাঙতে থাকে বিবর্তনহীন সত্তা
ভাঙতে ভাঙতে তার জন্মান্তর হয়;
তখন আমার কথা হয় আরও সত্যের সাথে,
আমৃত্যু প্রচ্ছন্ন সেই আরও সত্যের সাথে আমার কথা হয়।

অন্তবিহীন দ্বন্দ্ব অথবা বিসর্জনে
আমার দর্শন এবং ছায়া পরে থাকে ঘাটে
আর জলের অতলে তলিয়ে যেতে থাকে এক অন্তঃসার শূন্য পথিক।

পেছনে তখনও শুকনো পাতা মর্মরিয়ে ওঠে।

 

চোখের জমিতে ফোটাও নন্দন পুষ্প

তোমার চোখ দাও
আনন্দ পাতি
আনন্দে রাখি তোমার চোখ,
তোমার দৃষ্টি;
তোমার থেকে দূরে।
তোমার মনের ওপর, হৃদয়ের জমিতে যে ইটভাটায় গাছ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে জীবন, তার থেকে অনেক দূরে—

দেখো, পূর্ণ গর্ভবতী ধান কাটতে বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় কেঁদে ওঠা কৃষকের মতো সত্য হবে আমাদের দুঃখ!

তোমার চোখদুটো দাও শরৎ,
কান্না দেখি,
কুমারী কান্নায় রাখি তোমার অমূল্য অশ্রুর নুন
তোমার স্থবিরতা থেকে বহুদূরে বাঁচিয়ে রাখি নুনের আগুন যার উত্তাপে জন্ম হয়।যে জন্মেরও অন্তরে ধরা আছে দাবানল।
এখানে আগুনের শীতেই বিপর্যস্ত সব!
আগুনের শরীরেই জমাট হয়েছে স্যাঁতস্যাঁতে অসুখ; সেসবে হাত সেঁকে খুব বেঁচে থাকছি এমন সান্ত্বনা—

শরৎ, তোমার চোখদুটো শুধু দাও,
এখানে রাখি,
ভালবাসি;
এ মাটিতে কড়ই গাছের শেকড়ের মতো বিস্তৃত হয়ে ভালবাসি।
নুয়ে থাকা দুগ্ধবতী ধানের মতো,
মা যখন বিদায় দিয়ে ফিরে যায় সেই পৌষের নিংড়ানো ক্ষেতের মতো শূন্য হয়ে ভালবাসি।
প্রাগৈতিহাসিক বটগাছের মতো ভালবাসারা,
বোধিবৃক্ষের মতো ভালোবাসারা,
হিজলের মতো আমাদের ভালবাসারা,
সব এসে এক একটি চোখে কেন্দ্রীভূত হবে।পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে টেনে নিবে প্রবল আকর্ষণে আমাদের বিক্ষিপ্ত, ক্লান্ত হৃদয়— প্রেমিকের চোখের সামনে দাঁড়ানো সভ্যতায় কথার বিলুপ্তি হবে সেদিন।

পৃথিবী জানবে, পুরুষের সুন্দর চোখ সৃষ্টির এক নিখাদ খুঁত!
সেখানে হাত কাটা মৌর্যবংশীয় নারীদের হৃদয় বয়ে আমরাও নারী হয়েছি বহুযুগ পর।

আমাদের ভালবাসারা নদীপাড়ের শ্মশানের মতো বিশুদ্ধ মুক্তি পাবে।

তুমি, তোমার চোখ দাও আমায়।
চোখদুটো বাঁচিয়ে রাখি,
ভীষণ নিটোল দুঃখ রাখি!
তোমার চোখে জমা রাখি আমার আয়ুর নিঃশ্বাস।
তোমার মৃত্যুর নিঃসঙ্গ গল্প ধরে রাখি চোখের কুয়াশায়।
তোমার নষ্ট ভ্রষ্ট মৃত্যু থেকে দূরে-দূরে রাখি,
তোমার ক্ষয় থেকে বাঁচিয়ে রাখি তোমর চোখ।
আমাদের শুধু দেখাটুকু বাঁচাতে পারলে বেঁচে যেত এ জগত!
অথচ, দেখার মৃত্যু হলো বলে মরে যাচ্ছে মা।
আমরা মা কে খুবলে খেয়ে ঢেকুর তুলতে শিখে যাচ্ছি!
আমরা অসহায়তায় বীভৎস হয়ে গেছি শরৎ, মানুষের চোখ ঘষটে এ ঠুলি ছিঁড়ে উপরে নেবার মতো কোনো ভালবাসা নেই আমাদের হাতে!
সমস্ত নিকষ অন্ধকার শুষে অন্ধরা আরও অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে,
আমরা কিছুই বাঁচাতে পারছি না!

ওই চোখদুটো,
এখন আমাদের অস্ত্বিত্বের শেষ আশ্রয়ের মতো,শেষ খড়কুটো এই বিক্ষুব্ধ শতাব্দীর সামনে;
এখানে বেঁচে থাকা মানে আজন্ম পথ তোমার চোখের দিকে যাওয়া।
বইয়ের তাকে বসা চড়ুইদের ডানায় রাখা ওই চোখ আমাকে দাও—
যে ছাদ পৌঁছে গেছে আকাশের কাছে তার পিছনে আড়াল হওয়া গোধূলিকে দেখে নিতে, কলমিশাকের গন্ধে ভিজে যাওয়া শৈশবের মতো যত্ন করে তুলে রাখি।
একদিন বাঁচবো বলে,বাঁচাবো বলে,বেঁচে থাকা দেখবো বলে তোমার ওই চোখদুটো আজ আমার খুব প্রয়োজন!

স্বপ্নের গায়ে অন্ধত্ব নামার আগেই,
তোমার চোখদুটো দাও।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার