জিজ্ঞাসা
নাযারেথের পাশ দিয়ে, ধুলোমাখা মুখে ঘরে ফেরে
আহত প্যালেস্টাইন। সন্ধ্যার পর্দা-ঘেঁষে সেই কি ডাকে
—ইম্মানূয়েল!! দ্যাখো নাযারেথের ধুলো আজও
আগের মতো আছে।
প্রতিটি সিনাগগ, মসজিদ আর চার্চ একই ইটে তৈরি
তবু চারিদিকে এত রক্ত কেন?
একটা হাহাকার-খচিত প্রশ্ন গালিল প্রদেশ থেকে
উড়ে উড়ে বোধিবৃক্ষ আর হেরা গুহা হয়ে
দামেস্কাসের দিকে গেছে…
প্রজাপতি
প্রজাপতি নিয়ে আমি কোনও কবিতা লিখিনি।
কারণ, ‘প্রজাপতি’ উচ্চারণে নির্গত হাওয়ায়
সে কেবল দূরেই উড়ে গেছে।
আর ভাবিয়েছে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের কোন বিন্দু
থেকে প্রজাপতি শেষ পর্যন্ত প্রজাপতি হয়ে উঠল।
আর এই যে তাকে নিয়ে আমি কোনও কবিতা লিখিনি
এবং তার বিবর্তন নিয়ে এত চিন্তিত—
এতে করে তার কিছুই যায় আসে না।
প্রজাপতি আজও প্রজাপতিই রয়ে গেছে।
উচ্চারিত ধ্বনির হীমবাহে সরে গেছে ক্রমশ দূরে
অথচ আগুনের সাক্ষাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে জ্বলন্ত শিখায়। চিরকাল।
পলাতক
কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ
বেরিয়ে পড়ব
এই অন্ধকারের মখমল বেয়ে
ওপরে, আরো ওপরে
যদি সাড়া পাওয়া যায়।
চোখ খুলে খসে পড়ছে কুয়াশার ঢল…
বেহিসেবী ভাঁজে বিপর্যস্ত চাদর।
কিছু আনন্দ নেমে যাবে অবগাহনে
কিছুটা প্রকল্পগামী রাস্তায়, আরোহন।
প্রাচীন সুরের মতো
বিলীন হবার বাসনায়
আকাশের শেষ তারাটির সাথেও
হবে না কোনও কথা আর।
কাউকে কিছু না বলে
চুপচাপ সরে যাব
কেবল পরিচিত বেড়াল মুখ-ফিরে চাইবে একবার।
ছায়াদাত্রী
দেবদারুকে বললাম— আমি একা। দেবদারু বলে—
সে তো আমরা সবাই, তবে যেদিন থেকে
আমি ছায়া দিতে শিখেছি সেদিন থেকেই
আমার যাবতীয় নিঃসঙ্গতা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে
বনের তিতির….
কবিতার কিমিয়া
রৌদ্র, মেঘ ও সমুদ্র— এই শব্দগুলো ছাড়া কবিতা হয় না। সুতরাং স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার একটা স্বভাবজাত ঝোঁকের কারণে আমার কবিতা থেকে এই তিনটি শব্দ বাদ পড়ে গেলো। তার বদলে স্পাইসি ফুড এবং থেকে থেকে আগুনের কথাও উঠে এলো। আগুন বরাবরই কেন্দ্রাতিগ এবং আমাকে মনে করিয়ে দেয়— পৃথিবীর একটা গোপন অসুখ আছে। ভয়ে পলাতক আমি ছুটতে ছুটতে আপাতত মকরক্রান্তিতে। অসহায়। এবং এই মুহূর্তে ভ্রাম্যমান আবহাওয়ার বিষাদলিপি খুঁজতে গিয়ে দেখি ব্যক্তিগত কবিতার নির্যাস উড়ে উড়ে শেষ পর্যন্ত কিনা রৌদ্র, মেঘ এবং সমুদ্রে গিয়েই মিশেছে!
ভূমি
মাঝ রাস্তায় ঘূর্ণি-ছাড়া আলো।
চেতন অবচেতন ভেসে যায়
মধ্যদুপুর রাত্তিরে চমকালো
ছুটলো ঘুড়ি বক্ষ-মহল্লায়।
কক্ষ ছেড়ে বাইরে খানিক এসে
বৃক্ষ-শালিক দেখছে সুতোর টান
তক্ষশীলায় বুকের জমিন ঘেঁষে
শিবলী শাহেদ গাইছে নদীর গান।
বলছে নদী, আমার মতই তুমি
আমার মতোই ভাঙ্গন সারা গায়
মীন-জাতকের যেমন হৃদয়ভূমি
আমার মতো তোমারও তড়পায়…?
নদীমাতৃক
সুরমা যদি না মিলিত কুশিয়ারার ডাকে
আমরা কি আর মেঘনা পেতাম মেঘনা নদীর বাঁকে!
কোথায় যাচ্ছে ইরাবতী কোথায় কীর্তিনাশা
কোন্ ইশকুলে ব্রহ্মপুত্র শিখছে জলের ভাষা!
বাংলাদেশের সব নদী যায় উড়ালদিঘি গ্রাম
বুকের ভিতর একটা নদী— ‘সোমেশ্বরী’ নাম….
শৈলী এবং উড়াল বিষয়ক
দুর্দহনে ডুবে গেছে আবহাওয়া, স্থির বক্ষশৈলী।
আমাদের কক্ষপথে কেবল বাতাসের কানাকানি।
ফলে জানাজানি হয়ে গেছে মেহেরুজ-সংলাপ।
পূরবী, পূর্ব দিকে চলো। ওদিকটায় আর কোনও
পৃথিবী নাই। কেবল ঝাও-পাখিদের অক্ষক্রীড়া আর
উড়ে যাবার অভিপ্রায়…
ত্রিবেণীর ঘাট
পৃথিবীর জন্ম হলো। আমি তোমার হাত ধরে
মাটিতে নামলাম, হাঁটলাম। হাজারো পাখি-প্রলাপ
আমাদের সঙ্গে। তারপর ক্রমশ স্থুলতার দিকে যেতে
যেতে পার করে দিলাম সহস্র বছর। কখনো পায়ে
হেঁটে, কখনো নৌকায়। এভাবে যেতে যেতে
একদিন এক কুমারী মায়ের গর্ভে পুনরায় আমার
জন্ম হলো। আমার নাম রাখা হলো ইম্মানূয়েল।
আর তুমি ম্যাগদালিন। দু জনে মিলে পাঠ করলাম
ভ্রুণ-প্রকল্পের আদ্যোপান্ত। শুদ্ধতার নামে বাপ্তিস্ম
দিলাম পৃথিবীকে। অথচ দেখো পৃথিবীটা কেমন
অচ্ছুতের দিকেই ধাবমান। এই পরিকল্পনা বিনাশের
দরুন আমাদের ভেতর এখন ওই সহস্র বছরের
ফারাক। আমি এখান থেকে হাত নেড়ে তোমাকে
ডাকি। কখনো ইভ কখনো ম্যাগদালিন নামে।
তুমি তখন এক নারী, দুরত্বের ভারে ক্লান্ত। তবুও
চিৎকার করে যেন বললে— আদিতে আমরাই
ছিলাম, ফের দেখা হরে ত্রিবেণীর ঘাটে…….
অনুযোগ
নদী থুয়ে আয়ো তুমি, তুলে ন্যাও মালা
দেহ খুলে গান গায়ো এবেলা ওবেলা
কড়িমা’র হাতে ধরি আরো দূরে যায়ো
সমুখে না পাও আমারে, স্বপনেতে পায়ো।
নিভা হাতে টান মারো সুতো আমি’টারে
তবু আমি উড়ে যাব আকারে প্রকারে।
ঘুড়ি ভেবে তুমি মোরে উড়ায়ো উড়ায়ো
হরষে না পাও আমারে, বিষাদেতে পায়ো।
সুতো আমি, ঘুড়ি আমি, আমি উড়ে যাওয়া
হাওয়া গায়ে গুনি শুধু পাওয়া বা না-পাওয়া
এই শোকে আরো দুটো গান তুমি গায়ো
জীবনে না পাও আমারে, মরণেতে পায়ো।