বাঁকানো সবুজ কঞ্চি ও অন্যান্য কবিতা // জ্যোতি পোদ্দার

0

বাঁকানো সবুজ কঞ্চি

হেলছে দুলছে নাচছে সাপের ফনার মতো
বাঁকানো সবুজ কঞ্চি

চারদিকে জল আর জল আর কারেন্টের বুদবুদ

একটা কানি দুধ সাদা বক
কঞ্চিতে বসে বসে নাচছে আর নাচতে নাচতে বসছে

সাপের ফনার মতো নাচতে নাচতে
বড়শিতে হলুদ ঠোঁট গেঁথে ছুঁড়ে দিচ্ছে জলে
আর টপাটপ তুলছে একেকটি গোল্ডফিস
এ্যাকোরিয়ামের জলের ভেতর থেকে

চারদিকে জল আর জল আর শাব্দিক বুদবুদ
বাঁকানো সবুজ কঞ্চি সাপের ফনার মতো
হেলছে দুলছে এ্যাকোরিয়ামের জলে

 

শিরোনামহীন

এই নাও হাত— প্রসারিত হাত আর হাতের রেখার বিন্যাস
যদি পারো গুচ্ছ গুচ্ছ অনুজ্জ্বল তারাপুঞ্জ থেকে টুকে নিও
কতিপয় ভোর আর তুমি তো জানই ভোর মানে ফুলের ডাগর
চাহনি; পাখির নিশিবাস শয্যার আলতো মোলায়েম ঘুম ঘুম গন্ধ

আমার হাতের রেখা পৃথিবীর সমান বয়স আর শত কথামালা
শত ভৈরবী গুঞ্জন বর্ণে বর্ণে রঞ্জিত অক্ষর কান পাতলেই তুমি
তাদের তোমার করে নিতে পারবে তোমার মায়াবী আঁচল ভরে।

আমার হাত উপুড় করলেই সাদা নীলে কাজ করা আকাশ
আর আকাশের গুচ্ছ গুচছ অনুজ্জ্বল তারাপুঞ্জ; তুমি ইচ্ছে
করলেই তোমার করে নিতে পারো— এই নাও প্রসারিত হাত।

হাত পাতলেই পৃথিবীর ভিটেমাটি শ্মশানের চিতাকাঠ
রেখার বিন্যাস ধরে আশ্রমের খুঁজে হেঁটেছি অনেকদিন
গাঙপাড় ধরে ধরে শ্রমণ যেমন খুঁজে মুখরিত পল্লীগ্রাম

এই নাও প্রসারিত হাতের পৃথিবী আর তারাপুঞ্জের আকাশ

 

পাখি ও আমি

পাখি দেখা ও দেখানোর চেয়ে
ভালো লাগে পাখি শিকার।
পুলকিত হই;
লোভের জলে আলজিব নেচে ওঠে।
টুং টাং টাকরার শব্দে নেচে ওঠে শরীর।
নির্ভার পালকশরীর নিয়ে আকাশে আকাশে
উড়ি ও উড়াই আমার আমোদিত আহলাদ।

আহা! পাখি- মাংসল পাখি
কষানো মাংসের পাখি
গুলির ছড়রা লেগেছে বুঝি!
রক্ত ঝরছে খুব, তাই না?

জানো পাখি আমিও তোমার মতো
এখন যে শরীর দেখছো সেটিও মর্গেজ
কিংবা বলতে পারো ওয়ারলেস শরীর;
নেট কভারেজে বন্দি।
আমার বটে তবু আমার নয়।

তোমার জলরঙে আঁকা আকাশ
আর আমার পৃখিবীর মাটি
একটিও তোমার কিংবা আমার নয়;

একদিন তুমি উড়ছিলে
আমি খুন করলাম তোমাকে
একদিন আমি মাটিতে রেখেছি ঘোড়ার পা
আমি খুন হলাম

খুন আর খুনি মুলত একটা মুদ্রা
অথবা পণ্যজীবির নিছক পণ্য

 

আতা গাছ ও বর্ষাগীতি

আতার পাতায় জমা জলে লেগে আছে
উড়ন্ত পাখির ছায়ার ধারাপাত
আর মেলানো ছাতার মতো আতাগাছ
ধরে রেখেছে এক বর্ষাকাল

বর্ষা এবার তোমায় দিলাম ছুটি
একটু ঘুরে এসো নগরে
নাগরিকের চোখ খা খা বিরান চাতাল
তোমার নরম জলে ধুয়ে দাও কালচে চোখের পাড়

আমার আতাগাছ ধরে রেখেছে এক বর্ষাকাল
আর আতার পাতায় জমা জলের শরীরে
পাখিদের ওড়াওড়ি
আমাকে কোথাও যেতে দেয় না

গাছের নিকটে এলে আতার সবুজ পাতা
আমাকে ভিজিয়ে দেয় ঝির ঝির সবুজ জলে
এক বর্ষার আতাগাছ আমাকে কোথাও যেতে দেয় না।

 

সাগুদানা আলোবিন্দু

পাতার ভেতর পাতা উল্টে পাতার শরীরে লিখি কতিপয় বিবমিষা
পাতাবোন তুমি পাতাভাই তুমি তোমার শরীরে আগুন;
আগুনের গুনগুন আর লালে লাল রক্তজিভ
ঢেলে দিচ্ছে ঢেলে দিচ্ছে বিষভাণ্ড

আমি যে শোলার পুতলা মেলায় মেলায় ঘুরি
ও কারিগর ও কারিগর মরি মরি আমি মরি

ও ডাকিনী ও যোগিনী কালরাত্রি অমাবস্যা
এমন রাতেই তুমি শুষে নিলা প্রাণ?

লাল রক্তজিবে বুনো গন্ধ— গন্ধের ভেতর নরমুন্ড মালা;
উড়ছে উড়ছে বাতাস বাতাসে ভাঁজকরা অন্ধকারে।

মুণ্ডহীন খাঁজকাটা পাতারশরীর
মন্ত্রে নাচে
তন্ত্রে নাচে

নাচে তান্ত্রিকের গোল গোল মাদকচাহনি
ও শিব শ্মশানবাসী ওঠো তুমি ওঠো
শব দেহ নিয়ে কী করিবে তুমি
খোল আলোর পরতে পরতে আলোভাঁজ
সাদা সাদা সাগুদানা আলোবিন্দু
আর নয়া পয়সার ঝলক;

তুমি কাল কালীর যাত্রাবিন্দু।
আমি যে শোলার পুতলা মেলায় মেলায় ঘুরি
আমি যে চিনির ঘোড়া

আমি যে চিনির হাতি
তাপে ভাপে চাপে পাতার ভেতর পাতা উল্টে
পাতার কোমলা শরীরে লিখি যাপনের বিবমিষা

 

নর্তকী

প্রাঙ্গণে রঙ্গন ফুটে লালে লাল— গোল লাল।

ভোরলাগা আলোর ভেতর বাতাসে বাতাসে ফোটা
কী সুন্দর লাল লাল গোলবৃত্ত লাল
বৃত্তের ভেতর বৃত্তনাচে
যেমন নাচে নাচের নর্তকী

সবুজ পাতায় মিহিদানা ভোরের বৈরভী
মৃদঙ্গ বাজিয়ে বাজিয়ে ঘুরে ঘুরে যৌথনৃত্যের আলাপে
আমাকে ডাকছে;

আমি তো বিশেষ্য পদবাচ্য খুনি
কতদিন কী সুন্দর কী সুন্দর ফুল
বলতে বলতে ছিন্নভিন্ন করেছি লালবৃত্তের মুখরতা
রঙ্গনের পেলবতা নিয়ে খেলেছি নিষ্ঠুর খেলা
বাগানের গাছকে ভেবেছি লোক দেখানোর সৌখিনতা
আমার করে ভাবিনি।

ভোরলাগা আলোর ভেতর বাতাসে বাতাসে ফোটা
লাল লাল গোলবৃত্ত লালের সঙ্গত বুঝিনি
যেমন বুঝেছি পণ্যমূল্য
বাজার দরের সৌখিনতা

ছেড়েছি এবার পন্যজীবি স্বভাব
প্রাঙ্গনে রঙ্গন তুমি লালে লাল গোল বৃত্তলাল
আমাকে তোমার করে নাও
আমিও হই বৃত্তের ভেতর বৃত্তনাচের নর্তকী

 

লাস্যময়ী ঝর্ণাতলা

গুটি গুটি ঘামবিন্দু আর ফোটা ফোটা এই রঙ
সেই রঙে সাজিয়েছি ববিন কেইস
তুমি পা চালাও বা না চালাও
সেলাই মেশিন ঠিকঠিক হাস্যমুখী
লাস্যময়ী ঝর্নাতলা আঁকবে।

সেখানেই আমি স্নান সেরে
খাঁচা খেকে একে একে মুক্ত করে দেবো
মাপাখির আর্তনাদ

বাবা পাখির ক্রন্দন
পাখি তুই তোর পালকের পরতে পরতে নিয়ে
যা আমার অবসাদ
আমার বিভ্রম।

আমার ভারি শরীর নিয়ে আমি কোথাও যেতে পারি না।
স্থানু শরীরের গুটি গুটি ঘামবিন্দু আর ফোটা ফোটা
এই রঙ সেই রঙে ভরা ববিন কেইস
আমার পিতামহের—
পূর্ব পূর্ব প্রপিতামহের।

স্মৃতি বিভ্রাটের কুহকে ভুলেছি ইতিকথা
সপ্রাণ পালাগানের কৌম সমাচার।
ভুলেছি শরীরে চাষাবাদের কায়দাকানুন
আর ভুমা ও ভুমিতে সমর্পণ

তুমি পা চালাও বা না চালাও
সেলাই মেশিন আমার কালের যাত্রার রথ
ঝর্ণাতলা আমার আদি শৈশব
স্নান সেরে জলকে দেবো জলের আচমন

মাপাখি তুই
বাবাপাখি তুই
তুই আমি অনাদি কালের প্রাণসখা
তুই আমি অনাদি কালের প্রাণসখা

পালকের পরতে পরতে নিয়ে যা আমার অবসাদ আমার বিভ্রম
পালকের পরতে পরতে নিয়ে যা আমার অবসাদ আমার বিভ্রম

 

পারিবারিক কবিতা ১০

প্রজাপতিটি উড়তে পারল না।
অপরিপক্ক হাতের জলরঙের ভারে—
লেপ্টে আছে প্রসারিত সাদা জমিনে।

বিবর্ণ বিশুষ্ক জলরঙে আঁকা প্রজাপতি
সাদা জমিনে দিশাহীন গোবরে পোকা— কিলবিল কিলবিল করছে
প্রাঙ্গনের এঁকে দেয়া ফ্রেমের ভেতর।

প্রজাপতি— তুমি পাখনা মেলো বটে; কোখাও তোমার যাবার পথ নেই।
সঙ্গীহীন কারাগার জীবন— ফ্রেমের ভেতর কিলবিল কিলবিল।

প্রজাপতির পাখনায় শিশির ছিল রোদ ছিল বুটিবুটি তারা ছিল।
তবু প্রজাপতিটি বাতাসের ভেতর সাঁতার কেটে কেটে উড়তে পারল না।
ছোপ ছোপ জলরঙের ভারে প্রজাপতিটি মুক বধীর ও দিশাহীন।

আমাদের কোন বাগান নেই বাবা।
শুধু বেড রুম আর ড্রয়িং রুম।
রেলিঙ জুড়ে যে অর্কিড বাগান করেছিলাম ফুল ফোটার আগেই
পোকায় কেটেছে পাতার শরীর।

চল বাবা একটা মাঠ খুঁজি।
চল বাবা একটা বাগান খুঁজি।
শহর ছেড়ে বাগানে যাই।
প্রজাপতিদের দেশে যাই।

ওর কাজিনেরা নিশ্চয়ই ওকে চিনবে।
বাগানে গেলেই আমার
প্রজাপতির মন ভালো হয়ে যাবে, বাবা।

 

পারিবারিক কবিতা

সেভেন প্লাস প্রাঙ্গণের বই সংখ্যা দশ।
কী সুন্দর গড়গড়িয়ে
দেশ-মূদ্রা-রাজধানী-আয়তন পড়ে!
আহা! শুনতেই ভালো লাগে।

ছোটদের কম্পিউটার ল্যাবও আছে।
যদিও কী বোর্ড চিনে না— তাতে কী এসে যায়
আউটপুট ইনপুট ডিভাইসের নাম বলতে পারে বেশ।

আরো আছে বার’শ স্কয়ার ফিটের স্কুলবাড়ি
পাটভাঙা ইউনিফর্ম
কোচিং সেন্টার
আর খাতার পর খাতায় সি ডাব্লুউ এইচ ডাব্লুউ
ধরে ধরে গুড এক্সিলেন্টের লাল রঙের স্টার।

যদিও প্রাঙ্গনের কোন মাঠ নেই।
নেই হুড়োহুড়ি লুটোপটি গড়াগড়ি।
আছে তিন ফিট বাই দশ ফিটের ঝুল বারান্দা।
চকে আঁকা ক্রিজে রঙ্গন বোলার প্রাঙ্গণ ব্যাটসম্যান।
রেলিঙ ছুঁলে চার বাইরে গেলে ছয়।

প্রাঙ্গণ স্কুলে জলরঙের মাঠ আঁকে;
ছোপ ছোপ সবুজে সবুজ ঘাসের মাঠ।
ক্যানভাস ছাড়িয়েও
বহুদূর প্রসারিত একটা কালারফুল মাঠ।

চল প্রাঙ্গণ মাঠে যাই।
খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি খুঁজব
আমার চারু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
আর নাক বেয়ে ঠোঁটের কাছে জমা হওয়া রূপালি
রঙের নরম সর্দির শৈশব

এখনো জিবের ডগায় লেগে আছে নাকের পেটা
আহা! কী ভীষণ স্বাদের শৈশব

আমার চারু ইস্কুলের মাঠের কোনে হিসু
দিয়ে কাটাকাটি খেলার শৈশব।

তুই আঁক তোর কালারফুল মাঠ;
তুই বরং সূর্য ওঠার আগেই ঘাসের ডগায়
এঁকে দে রঙিন শিশির
জলভরা পুঁতিদানা।
আমি ঘুরে আসি আমাদের সাদাকালো কাঁদামাখা মাঠ।

 

সুমতি রানি দাস

একহারা গড়নে ধিঙ্গি সুপারি গাছ। কন্ঠীধারী তবে লম্বা গলার হাড়গুলোই চোখ পড়ে।

চিতার কাঠ সাজাতে সাজাতে খলবল খলবল করে যখন হাসছিল তখনই চোখে পড়ল ব্রহ্মপুত্রের চরের মতো বিরান
সুমতির বুকে কালো মতো গোল দুটি পেল্টে থাকা
অব্যবহৃত পরিত্যক্ত স্তন।
যেনো কোন পুরুষ পায়নি কোন অমৃত সুধা

সুপারি গাছ
ও সুপারি গাছ আকাশ ছুয়েছো তুমি
পুড়েছো রোদে জলে চিতা কাঠে
স্নিগ্ধ বর্ষাজলে ভেজাওনি তোমার গড়ন?

সুমতি রানি ধিঙ্গি সুপারি গাছ
অব্যবহৃত পরিত্যক্ত স্তনের সুপারি গাছ শবদাহ জ্বালাতে জ্বালাতে
কোন অজুত বছর ধরে নিজেকে পুড়াতে পুড়াতে এখন কেবলই
কন্ঠীধারী;
কেবলই চিতায় তুলছো মায়ার শরীর।
কেবলই চিতায় তুলছে ছায়ার শরীর।

আর আগুনের হল্কায়
লাল লাল লালহাসি ফুৎকারে উড়াচ্ছো চিতার পোড়াকাঠ
আর আর জাগতিক মায়ার ছায়ার ছাইভষ্ম
এমন ঝড় বৃষ্টি বাদল সন্ধ্যায়।

সুমতি, বর্ষার কদম দেখনি?
দুহাতে রাখলে শুধু নীল নীল— আরো গাঢ় নীলের অপরাজিতা
কেবলই দেখলে চিতার কাঠ ব্রহ্মপুত্রের জলে ডুবতে ডুবতে
জ্বলছে আর জ্বলতে জ্বলতে ভাসছে।

যেন মরন নাই;
মরণ নাই যেমন সুমতি রানি দাসস্য একহারা গড়নের সুপারি গাছের

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার