শিমুলের গোপন ইশারা
০১
মাঠের নিঃস্বতায় পড়ে আছে বাঁশি। বাঁশির ছিদ্র গলে বেড়িয়ে যাচ্ছে সময়। রাখালের হাত থেকে কুড়িয়ে এনেছি বাঁশি। বাঁশির গোলক থেকে চুইয়ে নামছে দম; অন্তিম শ্বাস; বাতাসশূন্য ফুসফুসের কেঁপে কেঁপে ওঠা।
বাঁশি অর্থ, কাঁপাকাঁপা বুকে কুমারি-বাঁশ-শলাকার সুরকাতর গোলকে ঠোঁট রাখা; স্কুলের বেঞ্চে পাশাপাশি বসা মেয়েটির দুষ্টমতি চোখ; অবিবাহিত রমণীর পাড়া-ছড়ানো বদনাম; পালঙ্কের ওপর শুয়ে থাকা ডোরাকাটা চন্দ্রবোড়াসাপ; হা-মুখে চাটতে থাকা জৈবিক চুম্বন।
০২
বালিহাঁস নিয়ে এলো পালক-চিঠি। তারিখবিহীন। আকাশের কোনো তারিখ নেই। তারিখবিহীন আকাশ-শূন্যতার নাম, ‘মায়া’।
ফিরে গেছে বালিহাঁস। যাওয়ার সময় রেখে গেছে বুকের পালক। পালকে লেখা আছে, ‘চাঁদে আজ আগুন লেগেছে; আগুনের ভেতর খুঁজে পাচ্ছি না পথ’।
০৩
সব মেঘে বৃষ্টি হয় না। শূন্য লাগছে। সব শূন্যতা পূর্ণতা পায় না। এই যে তুমি কতো সহজভাবে হেসে উঠলে, এই হাসিই কখনো কখনো আমাকে পূর্ণতার ইশারা দেয়। ইশারার যে কোনো অর্থ হতে পারে; সেটা নির্ভর করে তুমি কেমন আছো, প্রেমে অথবা বিষাদে। বিষাদ হতে পারে একটি নাম না জানা সাদাঘোড়া। আর প্রেম হলো সেই সাদাঘোড়ার জন্য অতি আগ্রহে তৈরি এক জাদুর চাবুক; যা কেবলই তাড়া করে ফেরে এক শহর থেকে আরেক শহরে।
মেঘ করেছে। বৃষ্টি হলেও হতে পারে। এভাবে অনিশ্চিত বৃষ্টির সংবাদ তোমাকে জানাতে চাইনি, শুধু সাদা ঘোড়ার চোখে চোখ রেখে কী যেন বলতে চেয়েছিলাম আমি।
০৪
বস্তুর ভেতরটা কাঁপছে; হাত রেখে বুঝতে পারলাম ওটার ভেতর কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে; তাহলে কি বস্তুর ভেতরটাও মানুষের মতো ক্রমশ বদলে যেতে থাকে (?)
আমার শরীরে কোনো জানালা রাখা হয়নি; জানালা থাকলে দেখা যেতো শিমুলের গোপন ইশারা। শুয়ে আছি, সাদা পাথরের ভেতর; ভাবছি, দীপান্তরের পর মানুষ কতোটা হাঁটতে পারে। চেতনার চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখছি, দিগন্তে মিশে যাচ্ছে লোহালক্করে কাঁপতে থাকা আমাদের জাহাজ।
০৫
বিচ্ছেদের জন্য কোনো মৌসুমের দরকার হয় না; কোনো কারণ ছাড়াই তুমি ধুলোর সাথে মিশে যেতে পারো; বিচ্ছিন্ন হতে পারো তোমার ভালোবাসার মেয়েটির সাথে; অন্ধ হতে পারো অযথা কারণবিহীন।
অযথা কারণবিহীন ভালোবাসার মেয়েটি তোমাকে কোনো কিছু না জানিয়ে গর্ভে নিতে পারে অন্য কারো সন্তান।
০৬
দাদিআম্মা বলতেন, ‘শিমুল তোকে চড়–ইয়ের খসে পড়া পালক দিয়ে তাবিজ বানিয়ে দেবো; তাবিজের পালকশুভ্র গুণে তুই একদিন কোনো এক মায়াবী মেয়ের প্রেমে পড়বি’। আমার মা চড়কের মেলা থেকে ফেরার পথে বাবাকে বলেছিল, ‘আমাদের প্রথম জীবনের কথাগুলো ঘরের আসবাবের সাথে গুছিয়ে রাখো’।
আমি তাকিয়ে আছি মায়ের মুখের দিকে; প্রেমিকার মুখের সাথে মা ও দাদিআম্মার মিল খুঁজছি; পাচ্ছি না। প্রেম অর্থ প্রিয়জনদের প্রতিটি মুখ ক্রমশ পৃথক করে ফেলা; মায়ের মুখ দূরে সরিয়ে রেখে প্রেমিকার মুখ আপন করতে শেখা; স্ত্রীর পুরোনো মুখের পাশে সন্তানের মুখ ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠা।
০৭
শুনেছি ভালোলাগার অর্থ ক্রমশ শূন্যতার শোকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাওয়া। অথচ, কিছু কিছু সম্পর্ক আছে আজীবন শূন্যের দাগে এসে আটকে থাকে। তারপরও আমরা কতো সহজেই বন্ধুতার দিকে হাত এগিয়ে দেই; ভাবতে থাকি আগামীকালই দেখা হয়ে যাবে।
তোমার কি মনে আছে, আমি কথা বলতে গিয়ে ‘প্রকৃত-প্রস্তাবে’ এই শব্দগুচ্ছ উচ্চারণ করতে পছন্দ করতাম; ভালোবাসার মতো এটাও একটা মুদ্রাদোষ। এই মুদ্রাদোষের কারণেই হয়তো তুমি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলে; বিরামহীন। বিরামহীনতার অর্থ, ক্রমশ শূন্যতার ভেতর দিয়ে একসাথে পথ চলার জন্মগত জেদ।
০৮
কবিতার মতো এমন সুন্দর উপহার কারো কাছ থেকে পাইনি কখনো। এখন আপনি আগের থেকে ভালো লেখেন। মুগ্ধতার পরিমান বাড়ছে। শূন্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছি। ভাবছি একদিন এই শূন্যতাই হয়ে উঠবে পূর্ণতার মাপকাঠি।
আপনি কেনো যে এভাবে লিখেছিলেন, ‘বিরামহীন শূন্যতার নাম, ভালোবাসা।’ আমি ক্রমশ শূন্য থেকে শূন্য হয়ে যাচ্ছি; দূরতম শূন্য আকাশ। আকাশের শেষ নেই; শেষ বলে কিছু নেই। মাথার ভেতর এইসব শূন্যতার জাদু মেঘের পালক হয়ে উঠলে রাত শেষে কেনো যেন মনে হল, আপনার টেবিলের সামনে অপেক্ষারত শূন্য চেয়ারটি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
০৯
বাতাসের আঁচলে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিলাম, দেখছিলাম চোখের দৃষ্টি কতদূর যেতে পারে। পাতাদের ওড়ার ইচ্ছেকে বুকে চেপে হেঁটে গেছি ততখানি পথ যতটুকু পথ ছুঁয়ে গেছে তোমার দীর্ঘশ্বাস। আমাদের কথাগুলো দশ-আকাশ হয়ে উড়তে থাকলে তুমি বলে উঠলে, এইভাবে আমাদের মা আমাদের বাবার জন্য বাতাসে ভাসিয়েছিল ইচ্ছের সাতরঙ; যা কীনা বৃষ্টির পর ভেসে উঠেছিল দক্ষিণ দিগন্তে, বক্ররেখায়।
শিমুল অর্থ, সমস্ত বক্রতাকে রঙধনু বানিয়ে দিগন্তে ঝুলে থাকা; আর, আজীবন বয়েসি বটের মতো সবকিছু নীরবে সহ্য করা।
১০
এইমাত্র বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল আকাশ। এইমাত্র শোবার ঘরের জানালা বড়ো হতে হতে আকাশের ভেতর ঢুকে গেল। তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল তোমার চোখ এই ভোরবেলায় দখল করেছে আকাশের সবটুকু মায়া।
আসলে এভাবে দেখতে শেখা ভালো। শুনেছি এভাবে দেখতে দেখতেই নাকি ভালোবাসার দেখা পাওয়া যায়; যে নাকি লুকিয়ে থাকে আকাশের ভেতর। হয়তো এ জন্যই তুমি পৃথিবীর সবটুকু আকাশ লুকিয়ে রেখেছো তোমার চোখে।