(প্যাট্রিক লেন : কানাডার প্রধান কবিদের একজন, ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। হাইস্কুলের শিক্ষা শেষ করেন নি, জীবনের নানা ওঠাপড়াকে অবলম্বন করেছেন, কবিতা লিখেছেন। ট্রাকের ড্রাইভার হিসেবে কর্মজীবন শুরু, কাঠের মিলের শ্রমিক হিসেবেও জীবন কাটিয়েছেন, আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর শিক্ষকতাও করেছেন। পঁচিশটির মতো কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা প্যাট্রিক লেন গদ্য রচনাতেও সমান পারদর্শী। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে এই কবির মৃত্যু হয়, মার্চ মাসেই জন্মেছিলেন তিনি।)
সেই মহিলাটির জন্য, সন্তানের ছাই হাতে যে নেচেছিল
বিস্ময়জনক, আমাদের যাবতীয় স্বচ্ছতা যেভাবে সুন্দর,
সূর্যের দিকে তুলে ধরা একটুকরো ছেঁড়া মসলিন, বাতাস শিশুর ত্বকের মতো মনোরম।
শোক এসব করে আমাদের কাছে
এবং আরও মহান বানানো হবে আমাদের, কারণ আমরা ক্ষুদ্র।
পরিত্যক্ত কার্তুজের ভিড়ে উজ্জ্বল এক নুড়িকাঁকর।
কখনও কখনও আমি সেই সুতীব্র আঁচিল, প্রেমে হিংস্র, জীবন্ত যাকিছুর মতো পরাজিত।
লিটল হেল গেট
প্রাচীন সেই অন্ধকারের স্বপ্ন দেখবো আজ রাত্রে, মনোরম
আমি বলবো নীলাভ, আর আমার ছুকরি বউ কান্না জুড়ে দেবে বাবার মেরে ফেলা বেড়ালছানার জন্য
আমার মনে থাকবে হাঁটু গেড়ে বসা পাতলা পা দুটি জড়িয়ে রয়েছে নীল পোষাকের পাপড়িগুলি
বরফ রাস্তার মতো ছড়িয়ে রয়েছে, লিটল হেল গেট-এ
নদীতে বজ্রপাতের শব্দ
পৃথিবী কেমন ফুরিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায় যখন আমরা সবাই বিধ্বস্থ
হেরে যাওয়ার থেকে সুমধুর আর কিছু নয়
আহা, প্রিয় সব অপূর্ণতা
একটি মেয়ে হাঁটুর ওপর ধরে আছে মৃত বেড়াল ছানা
আর আমাদের মাঝে যা-কিছু হামলে পড়ে, কয়েকটি নদী, বরফের ভেসে যাওয়া।
* লিটল হেল গেট : কানাডার ছোট্ট একটি নদী।
আসিনিবোয়েন
তুমি এবং গ্রীষ্মের গাঢ় রাত্রি, এখন অনেক দূর, ভোরবেলায় সব শান্ত।
কালকে সকালে, নদীতে হাঁসগুলি ছিল শব্দহীন, আমি ছিলাম অপরিচ্ছন্ন
উষ্ণ পাথরগুলি জলে ফেলছিলাম আর তুমি বলে চলেছিলে সব প্রত্ন-মানুষের
কথা গান গেয়ে, শান্ত স্রোতের পাশে। যদি আমি কঠোর হতাম, আমার বিশ্বাস
দীর্ঘ সেই নদীর হাঁসগুলিকে দেখতে পেতাম মসৃণভাবে এগিয়ে চলেছে কোনো জলাশয়ের দিকে।
অনেক পাথর জলে গেল, তোমার চুলের ভিতরে দুলছিল বুনোহাঁসের পালক, আর তুমি হাসছিলে
হাঁসগুলিকে মনে পড়ে তোমার ? পাখিগুলি যাদের ডানায় ছিল গান ?
মায়ের কাছে শুনেছিলে তারা নাকি পাখিদের ভূত। আবার তুমি-ই বলতে, তোমার মা ছিল খ্যাপাটে।
তারপর শহরটাকে সঙ্গে নিয়ে তুমি গরাদের আড়ালে হারিয়ে গেলে, ঘরগুলি ফাঁকা।
এমন এক সময় যখন আমার পূর্ব জীবনগুলির একটি বদলে যাচ্ছিল।
আমাকে কঠোর দেখাত, কিন্তু তোমার কোনো খোঁজ ছিল না।
সকল রাস্তায় ঘুরে ঘুরে, পশ্চিমের ধূসর বৃষ্টির দিকে চলে গেছি।
এটা অনেক দূর, হেঁটে গিয়েছিলাম সেই স্থানে যেখানে সূর্য ডোবে।
* আসিনিবোয়েন উত্তর আমেরিকার এক প্রাচীন প্রজাতি, রান্নার কাজে উত্তপ্ত পাথরের ব্যবহার প্রচলিত ছিল এই জনজাতির মধ্যে।
নিঃস্তব্ধ হাঁসগুলি
এবং সেইসব চলে যাওয়া: নিঃস্তব্ধ হাঁসের দল ভোরের ভিতর থেকে উড়ে যায়
তাদের বিবর্ণ ডানাগুলি চাঁদকে আড়াল করে, ভেঙে যায় অলীক সব আলো।
হালকা স্রোত বয়ে যায় নুড়িকাঁকরের ওপর দিয়ে, ভাঙ্গা খোলসের ওপর দিয়ে
কিনারায় বেজে ওঠে ড্রাম, দীর্ঘ গৃহস্থালি জুড়ে গেয়ে চলে আদিম প্রজাতি
তোমাকে বলেছিলাম, ছোটবেলায়, আমি উড়ে যেতে পারতাম।
সেই সব মেঘের নামে শপথ করে বলছি, যে মেঘগুলি আমাকে সমুদ্রে নিয়ে যেত।
কিন্তু সেইসব দিন চলে গেছে।
বাতাস গাছের ভিতরে শুভ্র তেজ ভরে দেয়।
তারাগুলি জড়ো হয় ভয়ংকর আগুনের মাঝে, অনন্ত তুষারের ভিতর।
সেখানে কোনো গল্প নেই, যদিও আমি সেগুলিকে গল্পের মতো বানিয়ে নিয়েছি।
হাঁটু গেড়ে বসে, আমি হাঁসেদের গোঁজামিল দেওয়া ভাষার অনুবাদ করে চলেছি,
এই লুপ্তপ্রায় ভাষায় প্রতিভাত হয়ে আছে তুষারের ভিতরে পড়া হাঁসেদের ছায়া
…
ক্যালিগ্রাফি
প্লাম ফলগুলি ফুটে উঠবার আগে। তারও আগে।
সমুদ্র থেকে বাতাস ও কুয়াশা ধেয়ে আসবার আগে।
অপ্রকৃত ভোরবেলায় ছোট্ট বাদামী এক বাদুড় গিলে নিচ্ছে সুগন্ধি মথ।
যে কোনো উৎসব আসলে আলোর প্রতিশ্রুতি।
র্যাকুন যেভাবে কেবল একটি লেজ, ব্যর্থ প্রতিবিম্বের ভিতরে এক স্খলন।
বাশো ঘরে ফিরছেন, তার কান ক্ষতবিক্ষত, রাত্রির শুভেচ্ছায় মগ্ন।
এবং, অনুগ্রহ করে, আমি ভুলে যাওয়ার আগে—।
এটা লেখ।
এটা লিখে রাখ :
বুড়ো ইঁদুরেরা পায়ে করে মোচড়ের পর মোচড় দেয় সুস্বাদু বীজগুলিকে সব।
সিংওলা পেঁচা মৃত্যুর সংকল্পে লীন প্রান্তরের খাঁড়া এক দণ্ডের ওপর।
আর, হ্যাঁ, ভ্রাম্যমাণ এক প্রকাণ্ড সীলমাছ চাঁদের গান গেয়ে উঠবার আগে
অন্ধকারে, তোমার হাতখানি আমার হাতের মধ্যে ছিল।
* র্যাকুন একধরনের ছোটো আকৃতিবিশিষ্ট সর্বভূক লোমশ প্রাণী, উত্তর আমেরিকায় এদের দেখতে পাওয়া যায়।
……
(স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত : ১৯৮১ সালে জন্ম, মেদিনীপুরে বসবাস। লেখালিখির প্রকাশ মূলত শূন্যদশক থেকে, লিটল ম্যাগাজিনে। কবিতা, অনুবাদ, কবিতা বিষয়ক লেখালিখিতে বিশেষ আগ্রহ। দুটি কাব্যগ্রন্থ ও দুটি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত। গুয়ান্তানামোর বন্দিদের স্মৃতিকথা সাক্ষাৎকার কবিতা ও ছবি সম্বলিত অনুবাদ গ্রন্থটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বইপত্তর থেকে, বইটি সমাদৃত হয়েছে।)