অসামান্য অতিথি // মোশতাক আহমদ

0

মোশতাক আহমদের গল্প: অসামান্য অতিথি

তার একটা আলাদা রকমের দীপ্তি ছিল, না হলে কী এই আমি অত সহজেই আলোকিত হই! সে ছিল এক সম্মোহনী আলো। আমরা দু জনে সেই কবে জলের মধ্যে ঘর বেঁধেছি ‘জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার’  শূন্য করে দিয়ে! দু’জনের প্রথম যৌবন যে নিয়মে চলেছে, তা অচল এখন । জলের ওপরের বস্তু, দৃশ্য, শব্দ, সময় ইত্যাদি যেসব অর্থ বহন করে অথবা সৃষ্টি করে থাকে, এখানে এই জলের নিচে তা অর্থহীন খুব। বৃষ্টির কথাই ধরা যাক। মাটির ওপরে শ্রাবণের ঝর ঝর বৃষ্টিপাতের একটা আবেদন আছে, ইঙ্গিত আছে। এখানে এই জলের মধ্যে বৃষ্টি একটা অদৃশ্য ও অপ্রয়োজনীয় ঘটনা বিশেষ। জলের ওপরে ঝড়ের ধরণ আর জলের নিচের ঝড়ের ধরণটিও সম্পূর্ণ আলাদা । তাই আমাদের দু জনের এক-জীবন-পেরিয়ে-আসা দ্বিতীয় জীবনের ঘটনা খুবই অর্থহীন, কখনোবা প্রলাপ বলেও মনে হতে পারে তাদের কাছে, যারা এখনও জলের-ওপর-জগতে  শ্বাস নেয়।

কীসের গল্প করি তবে? আমাদের ঘটমান বর্তমান, পুরাঘটিত গল্পগুলো দুর্বোধ্য ঠেকবে; অগত্যা বলা যাক জলের-ওপরে-কাটানো দিনরাত্রির কথা । স্বচ্ছন্দেই বলা যাবে, কেননা, দমকা- স্মৃতি নামে যে ব্যাপারটি দৈর্ঘ-প্রস্থ- বেধসম্পন্ন বুদ্ধিমান প্রাণিদের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে, এখানে এই জলের রাজ্যেও তা একই ধরণের আলোড়ন তৈরি করে থাকে। আমাদের ভারাক্রান্ত করে তুলে একমাত্র যে পার্থিব বস্তুটি, সে হচ্ছে ওই দমকা- স্মৃতি।

সব কথা এক সাথে বেরিয়ে আসতে চায় অর্গল খুলে, যেন বা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের টিফিনের ঘন্টা বাজে, ছোট্ট একটা দরোজা পথে বেরিয়ে আস্তে চায় গোটা চল্লিশেক কোলাহলমুখর শিশু।

মনে হয় এই তো সে দিন, সন্ধ্যাকে উপেক্ষা করে গলির মুখে হেঁটে এলো চাঁদমুখ : বাহুমূলে চিবুকে এলোচুলে ল্যাম্পপোষ্টের ফ্লুরোসেন্ট আলো ম্রিয়মাণ। গুনগুন নির্মলা মিশ্র, পায়ের শব্দ ফিরে গেলো ঘরে। আট বছর ধরে এই দৃশ্য ডেকে চললো ক্রমাগত। তারপর থেকে দেয়ালঘড়ির পেন্ডুলাম হয়েছি সারারাত এধার ওধার। ভোর হয়, ক্লান্ত লাল চোখ। দুপুর নিঃসাড় হয় উতরোল ঘুমে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসছে আবার, ‘বহু যুগের ওপার হতে’ আষাঢ় ছন্দে তুমি আসছো প্রজাপতি যেন বা, সর্বনেশে ঘড়ির চাবি যেন বা । আবার সারা রাত তরুণ উদ্যমে বারান্দার এধার ওধার করি পেন্ডুলামের মুদ্রায়।

এখনও নিশ্চয়ই মনে আছে সেই অন্তরঙ্গ –বারান্দা;  সেই ঘরঃ কখনো যার নাম ছিল বিরহবাড়ি, কখনোবা আমাদের সান্নিধ্যের আর্তনাদ শোনা যেত সেখানে। কতদিন ভেবেছি, সে বুঝি কোনো দুঃখিত দুপুরে পরচুলার কায়দায় খুলে রেখে যাবে সম্পর্কের লতাপাতা; কারণ সে মেধানির্ভর, আবেগের দলিলে চিহ্ন রাখতে চাইবে না । এখন, অন্য পরিবেশে , আমার ধারণাটি মিলে যায় অবশ্য। এই যে জলের ভেতর থেকে জলের ওপর- জগতের বাতাসে দীর্ঘশ্বাস মেশে গোপন শিশির বিন্দু ঝরে যার জলের মধ্যে- এ সবের কোনোই চিহ্ন থাকে না। ভালবাসা জানাজানি হয় হৃদয়ে , তার জন্যে কোনো প্রামাণ্য চিত্র প্রয়োজন হয় না।

আমরা সমূহ সৌন্দর্য উপভোগ করতাম নিজেদের মতো করে। একদিন, এখনও এ চোখে জীবন্ত, সে অনিন্দ্য সুন্দরকে দুপুর এসে দুমড়ে যায়। আলুথালু পড়ে থেকে সে। আজও সেই মুগ্ধতার অনুবাদ শেষ হয়নি। সে ছিল সুন্দর-কী –হতে –পারে তার এক সহজ  বিন্যাস। চোখজোড়াকে আজও বলি-  চলো চোখ, তৃষ্ণার আধার, তাকে দেখে নাও প্রসাধনহীন। কেননা  তুমি তো আর কয়েকশো বছর আগের রাধাকে চলচিত্রেও পাবে না দেখতে কখনও। চলোচোখ, হাজার বছরের ধারাবাহিকতাকে দেখে যাও তোমার সংসারে। ক্ষতি কি একটা দুপুর কৃষ্ণের সাথে বদলে গেলে। দুপুর-দুমড়ানো উত্থান পতনের এইসব বাঁক প্রাত্যহিকতায় মেখে উদ্বেল হতেন রাই, দূরদেশি রাখাল যুবার আকাঙ্খার  বাঁশি শুনবেন বলে।

জলের ভেতর আবাস এখন। একটা মাতাল দুপুর যেখানে কৃষ্ণের সাথে বদলে নিয়েছিলাম, সংসার নামের যে পালঙ্কে দেখেছিলাম আলুথালু এক অনিন্দ্য; কে জানে কৃষ্ণের জীবনটা এ জীবন থেকে হারিয়ে না গেলেও সইতো কীনা!

প্রথম সে প্রণয়কাহিনী বিস্তারিত বলা যাক। সে কোন বর্ষায়, মনে নেই, আকাশের দুই বোন রোদেলা ও মেঘলা রঙিন প্রস্তাবের লেফাফা পাঠিয়েছিল। এক ঋতু হেসে –কেঁদে একাকার ওরা আমার সম্মতির  বা অসম্মতির ভাষা বোঝেনি কিছুই- মেঘলা বোঝেনি, আমার হৃদয়ে মগজে তার জন্য কতোটা মেঘের জন্ম হয়েছিল। কেঁদে কেটে একাকার দুই বোন মিলিয়ে যায় উধাও শূন্যে, ভোজবাজি যেরকম হতবাক দর্শক রেখে যায়। প্রণয়ীকে বাহুপাশে রেখে তূরীয়ানন্দে ছুটে চলা হলো না। একটা বর্ষা চলে যায় শুধু সম্মতির ভাষা খুঁজে, আয়নায় দাঁড়িয়ে অবসাদ গুণে গুণে।

আকাশের ছোট মেয়ে বিখ্যাত সুন্দরী জ্যোৎস্নাও এসেছে সেইসব ঘর-দুয়ারে। আমি যে ভালবাসি  বৃষ্টিসোনাকে , সুতরাং ঘরজুড়ে অথই  জ্যোৎস্নার দাপাদাপি আর শামুকের নির্লিপ্ত চোখে তা দেখে দেখে যাওয়া। আকাশের এই পটিয়স মেয়েটিকে শূন্য প্রেক্ষাগৃহে দর্শক সারিতে বসে দেখি, ড্রপসিন পরে গেলে স্বস্তি পাই; চোখ কান ত্বক খুঁজে বেড়ায়  বৃষ্টিপাত । অবসন্ন দিনগুলো কেটে যায়। বৃষ্টি নামে একদিন, কাঙ্খিত ধারাজল। আনন্দ শ্রাবণ নাম রাখি তার। এই নামকরণ, অতি দ্রুত উপহাস করতে থাকে আমাকে। দেখি, বৃষ্টির প্রয়োজন নেই আর, খুঁজে বেড়াই অন্য কিছু। সম্ভবত সম্ভাব্য জলজ জীবনের গোপন প্রস্তুতি চলছিল তখন অস্তিত্বের কানকো –ফুলকায়। বৃষ্টি , বড় বিলম্বিত আগমন তোমার! ওই মুহূর্ত থেকে আমার বোধে এই প্রতীতি জাগে যে, আমার কী চাওয়া তা স্বয়ং জানি না। মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকি অতএব, অন্য কাউকে সহযাত্রী করে নিতে; হয়তোবা পাশাপাশি থাকতে থাকতে একদিন সহনীয় হয়ে যাবে সঙ্গী। সব কিছুই তো আপেক্ষিক এই সৃজনশীল জগতে।

একদিন হঠাত করেই উদ্যানে বিষণ্ণ হাঁটাহাঁটির সময়, সেই পুষ্পের  দেখা মেলে। এ এক অসামান্য মুহূর্ত! প্রকৃতির নির্বেদ আঁচল ধারণ করে নেয় সমূহ বিষণ্নতা, নীলকন্ঠ যেনবা। একটানা পাতা ঝরে। এক জোড়া বুকে দুপুর মাতাল হয়। গোলাপ বলেঃ  তোমাকে অধিকার করার অধিকার নেই; এবং বলতেই থাকে । মুহূর্তে আমাদের চারপাশকে পরকীয়া পালঙ্ক বলে মনে হতে থাকে; সে কী বিভ্রম? অবশ্য ফুলের ভাঙা রেকর্ড বাজানো শেষ হয়ে আসে, অনাড়ম্বর যুগলের তৃষ্ণায় -অগ্নিতে –ঠোঁটে উদার আর নির্ভুল বিবেচক সমুদ্র পৌঁছে দেয় কাঙ্খিত নুন। আকাশও বিবেচক – মানুষের চোখে সবকিছু সয় না বলে মেঘলা ছায়া দিয়ে পরমলগ্ন আড়াল করে দিল। সময়টা পেরিয়ে যেতেই দেখি  আমরা আমাদের এবং পরস্পরের জন্য সৃষ্টি হয়ে গেছে স্থায়ী আকুলতা।

বিকেল হয়। একবার, আর একবার তার লাবণ্যরেখা অসামান্য ছুঁয়ে যাব বলে ঝুঁকেছি যখন, আমাদের স্পর্শ করে ঝটিতি বনান্তর হয় একটি প্রজাপতি। আমার অন্ধ বিশ্বাস বা সংস্কার নেই কোনো কিছু নিয়ে। এ প্রজাপতি তো প্রকৃতির সম্মতি নিয়ে এসেছে- একটা জীবন গোলাপের পাশে থাকব, সেই অলেখা নিয়তিই জানিয়ে যায় সে। পরন্তু, আমাদের বাহুমূলে অলৌকিক কোনো পাখনা দিয়ে যায় সে, লৌকিক বিকেলে শুধু ছুঁয়ে – ঘিরে ওড়াওড়ি করব আমরা। স্বপ্নের অফুরন্ত অরণ্য দিয়ে যায় একটি প্রজাপতি।

ফুলকে ভালবেসে ফেলি। তার কিছু কথা উচ্চারণমাত্র মন্ত্র হয়ে যায় । তবু পুরোটা দেয়া হয় না তাকে। কিছুটা রেখে দিই কবিতার জন্য। তার পিঠের মতো শাদা খাতা খুলে অবাধ্য আঙুল কিছু গড়ে তুলতে চায় বুঝি তার সমান্তরাল । বিপুলা বিস্ময়, তোমাকে যে সারা দিন কী রকমের চাই আমার! তুমিহীন সময়টা ভীষণ আর্ত, উপশম অতীত। কিছুটা সময় কবিতার,সে কী সময়টাতে গোলাপ অনুপস্থিত বলে? তার প্রতি গাঢ় প্রণয়ে এইসব উচাটন হয়। রাত জেগে কত রকমের যুক্তি সৃষ্টি হয় তার উদ্দেশে। যেমন, বিপুলা বিস্ময়কে বলি, তুমিও তো দাওনি সব, ঠোঁটের বন্দরে পাইনি একান্ত অধিকার, আগুনও নোঙর ফেলে সেখানে; সোচ্চার আঙুল পুড়ে যায় উত্তাপে। একা শুধু ভালবাসা নয়, দহনও আমাকে ছুঁয়ে থাকে তোমার প্ররোচনায়।

পরস্পরের প্রশ্রয়ে দিন যায় । একদিন বৃষ্টি নামে হিংসুটে প্রতিপক্ষের ধরণে। গোলাপ সেদিন অন্তরীন থাকে। স্পর্শবিহীন ভাবনাজ্বরে শিহরিত সময় কাটে। কালিদাসি পয়ার আওড়ে যাই যক্ষ সেজে, মন্দাক্রান্তা বাদল ধারার আবহগান শুনি। এক পর্যায়ে বৃষ্টি তার গীতল চরিত্র ত্যাগ করে, বৃষ্টিসেনা সাজে; অভিসারের প্রশস্ত দিনে আমাদেরকে  সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখে। ওর আর কী এমন শক্তি ? ভালবাসার শক্তি তো তুলনায় সহস্রগুণ। ভালবাসার শত্রু হয়ে কেউ জিতবে, তা অভাবিত।

একদিন কত বর্ণিল উচ্ছ্বাসের দিন রাত ছিল। এখন এইখানে, এই জলের তলায় শুধু দমকা স্মৃতির আসা যাওয়া, তাই নিয়ে বেঁচে থাকা। জলের ওপরে এই জ্ঞান ছিল ‘দশ চক্রে ভূত ভগবান হয়’; জলের নিচের জগতে ফলিত জ্ঞান আজঃ দশ চক্রে ঘুম স্বপ্নবান। ঘুমের এক দুই তিন ইত্যাদি তরঙ্গ গুণে গাঢ় ঘুমের গহীন উজান ঠেলে চোখের পাতাকাঁপানো স্বপ্ন আসে। রোজ রাতে এইভাবে স্বপ্নাচ্ছন্ন মাথায় সে আসে, গোলাপ, আমার বিমুগ্ধ বিস্ময়! ঘুমের সরণিতে স্বপ্ন আর সুন্দর হাত ধরাধরি করে হাঁটে । বারোয়ারি প্রহরে তার ব্যাপক উপস্থিতি নেই আর। কোন জলের নিচে ফের তাকে খুঁজে পাব, এই উদ্বেগময় আগ্রহে জলসীমা মন্থন করি রোজ। শিহরিত স্বপ্নদীর্ঘ রাতে তাকে খুঁজি ; বিপন্ন জাগরণে খুঁজি তাকে।

গোলাপমণি, তোমার পাশে শুয়ে থাকে কে, রাত্রি? রাত্রিকে আমি ঘুমাতে দেব না, শাস্তি দেব, হাওয়ার পিঠে চড়ে রাত্রির শরীরে হানবো অভিশাপের চাবুক। একদিন জলের নিচে আবার তাকে খুঁজে নেব কিংবা আমাকেই খুঁজে নেবে সে, জানি।

 

মোশতাক আহমদ

মোশতাক আহমদ

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার