অগ্নিজলের বিবিধ কড়চা // রেজওয়ান তানিম

0

এক

সে এক ভিন্ন সময়ের আলাপন।

তখন ছিল না পৃথিবীর কোথাও বিশাল সাম্রাজ্য কিংবা খুব অল্প জায়গায় লক্ষ লক্ষ বা কোটি মানুষের আবাস। ছিল না মানুষেরই তৈরি দেয়াল কিংবা কাঁটাতারের ‘দেশ’ ও ‘বিদেশ’ নামের ছোট বড় সীমান্তের কৃত্রিম বেড়াজাল। মানুষ তখন সদ্যই আবিষ্কার করেছে চাকা, দূরদূরান্তে মাল-সামান পরিবহণ কিংবা ঘুরে বেড়াতে নবলব্ধ আয়াসের নানামুখী বাহাস নিয়ে হয়ত সান্ধ্যকালীন গপ্পের আসরগুলো প্রায়শই মশগুল থাকত। যার মাথা থেকে এমন মহৎ চিন্তা বের হয়েছে, সবাই বাহবা দিয়ে পান করত তার স্বাস্থ্যের নামে। যদিও তখনও তারা শেখেনি কিভাবে চাকায় লোহা বা ব্রোঞ্জের বেড় পরাতে হয়, তবুও অনেক নতুনের পথে এ এক আনকোরা উল্লম্ফন।

তখন মানুষ ছোট ছোট দলে বিভক্ত থাকত আর অনেকগুলো দল মিলে একটা নগর তৈরির ধারণা কেবল শুরু হয়েছে মাত্র। নিজেদের মধ্যে শক্তি, সামর্থ্য ও প্রভাবের বিচারে নেতা ঠিক হত তখনকার দিনে। সেরকম এক নেতার নাম ধরা যাক খুসরো, পারভেজ কিংবা শাহরিয়ার। বহু প্রাচীন সে জনপদ বর্তমান অবস্থায় আসার আগে নিজেকে গড়েছে ভেঙেছে অসংখ্যবার। নিতান্ত সাদাসিধে ও কৃষিজীবনে অভ্যস্ত হতে শুরু করা লোকেরা তখন হয়ত কল্পনাতেও আনতে পারেনি ক’শত কিংবা হাজার বছর পরে পৃথিবীকে তাক লাগানো পারস্য সাম্রাজ্যের জন্ম হবে, তার সম্রাটের ঐশ্বর্য ও বিত্তের প্রদর্শনী ঝলক লাগাবে তাবৎ বিশ্বজুড়ে; এমনকি সে সাম্রাজ্য শেষের ক’হাজার বছর পরও লোকমুখে শোনা যাবে গাঁথা, রচিত হবে শাহনামা।

সেই শাহ বা রাজাদের একজন খুসরো বা পারভেজ কিংবা শাহরিয়ারের অন্দরমহলে দিনের বেশিরভাগ সময়ে  মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়ে বেড়ায় এক অষ্টাদশী কন্যা। সম্ভ্রান্ত বংশীয় আর শহরের শাসনকর্তার প্রিয়তম কন্যা হিসেবে জন্ম থেকেই পেয়ে এসেছে ভীষণ আদর। অতি আদরে মেয়েটার বখে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এমন কথা খুসরো বা শাহরিয়ারের স্ত্রীকে শুনিয়ে টিপ্পনী কেটে যায় আশপাশের গেরস্থ ঘরগুলোর মুরুব্বি মহিলারা। সেসব কানকথা বলে উড়িয়ে দেয় গৃহস্বামী, ওসব কানে তোলার আগ্রহ কখনোই ছিল না তার। তবে আজকের ঘটনা ভিন্ন।

এই কিছুক্ষণ কে যেন মহান খুসরো বা শাহরিয়ারের কাছে খবর এনেছে, রাজকন্যা কোথাকার এক পথের ভিখিরির প্রেমে পড়েছে। সে নাকি শহরের ব্যস্ত এক রাস্তার মোড়ে সকলকে গান শুনিয়ে পয়সা কুড়ায়। এরকম হতচ্ছাড়ার সঙ্গে রাজনন্দিনীর সংসার ভাবনারও অতীত, কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না। লোক পাঠিয়ে মহামান্য পিতৃদেব আদেশ করলেন অন্দরমহলের চাকর বাকড়দের, ‘অবাধ্য কন্যাকে গৃহবন্দী কর’। কিন্তু তার আগেই মেয়েটা নিরুদ্দেশের পানে যাত্রা শুরু করে।

মেয়েটা ছুটছে। চোখেমুখে ভীষণ অস্থিরতা। আঁধার করে আসা রাতের কালো উপেক্ষা করে সে আগাতে থাকে আখরোট, খোবানি, খেজুর এরকম নানা জাতের ফল এবং সুরভিত ফুলে পূর্ণ রাজকীয় বাগান ও কাঁটাঝোপ এড়িয়ে। পেছন থেকে কেউ অনুসরণ করছে কিনা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও সে বুঝতে পারে ছুটে আসছে আজ্ঞাবহ সান্ত্রীর দল। ধরা পড়লে আর রক্ষে নেই।

সৈন্যদল আর রাজকন্যার এই ইঁদুর বিড়ালে খেলার মাঝেই সামনে পড়ল রাজকীয় রসুইঘরে, উপায় না পেয়ে কন্যা ঢুকে পড়ল সেই বিশাল ফটকের বাড়িটায়। দু তিন ঘর পাশে দাওয়ায় শুয়ে থাকা কেউ একজন উল্টোপাশ থেকে ‘কে রে ওখানে’ বলে হাঁক ছাড়লেও কোন উত্তর দিল না রাজকন্যা। এরপর আরও ভিতরে ঢুকে দিন দশেক পরেই নতুন বছর উদযাপনের ও রাজ ভোজনের উদ্দেশ্য জমা করে রাখা নানা ধরণের ফলফলাদি সমৃদ্ধ ঘরে ঢুকে সে দরজা ভিজিয়ে দিল। উল্টোপাশ ফিরতেই দেখল একটি বড় পিপার উপরে লেখা আছে ‘সিমআ’১। রাজকন্যার মাথায় চমক খেলে গেল, এই অবস্থায় সান্ত্রীদের হাতে ধরা পড়া কিংবা পিতার কাছে অসম্মানের শিকার হবার চেয়ে বিষ খাওয়া অনেক ভাল। অনেকটা বিষ খেয়ে নিলো রাজকন্যা আর শুয়ে পড়ল মেঝেতে।

আশ্চর্য হলেও সত্য বিষ খাবার পর রাজকন্যা মারা যায়নি, বরং সারাদিনের ধকল ও নানাবিধ ঝঞ্ঝাটের ভিড়ে অভুক্ত রমণী বিষ পান করে কিছুটা সতেজ হয়ে উঠল। রাজা তার কন্যার মুখে বিষপান ও পরবর্তীতে বিচিত্র ফলাফল শুনে তার ক্রোধ পরিত্যাগ করলেন আর আদেশ দিলেন সেই বিষ রাজার সামনে পরিবেশনের জন্যে। পরবর্তীতে রাজার রন্ধনশিল্পীরা আবিষ্কার করলেন বিষ বলে যে বড় পিপাটি লেখা ছিল তা আসলে পচা আঙুরের, কেউ যাতে ওর দিকে হাত না বাড়ায় সে জন্যে অমন সাবধান বাণী। আর পচে বিষ হয়ে যাওয়া বলে যাকে ভাবা হয়েছিল সে আসলে অন্য কিছু, যাকে আদর করে বাংলায় বলি দ্রাক্ষারস।

এ নিছকই গল্প হয়ত২, তবে ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’ এই প্রপঞ্চে বিশ্বাস রেখে যদি খোলা মনে মেনে নেই; এরকম কোন মহত্তম ভুল থেকেই আবিষ্কার হয়েছিল আঙুরের মদ্য, যাকে বলা যায় ‘ওয়াইন বা দ্রাক্ষারস’ তবে বোধহয় খুব বেশী ভুল হয় না। মানুষ যেদিন থেকে কৃষিজীবী সমাজ গড়েছে, সংঘবদ্ধ হয়েছে; একত্রে বসবাসের নানারকম সুযোগ ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে শিখেছে, মোটামুটি তখন থেকেই মানবজাতির সঙ্গী দ্রাক্ষারস। কবে, কোথায়, কিভাবে এর শুরু এ নিয়ে বরাবরের মতই তর্ক রয়েছে, তবে উপরের গল্পটির মত এ বিষয়ে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয় যে, এর সুলুক সন্ধানে নামলে বড় আকস্মিক কোন এক ঘটনার দেখাই মিলবে। এ লেখাতে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষের জীবনের সাথে বিবিধ প্রকার ও স্বাদের অগ্নিজলের মিঠেকড়া সম্পর্ক আর প্রথার দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব।

দুই

পারস্য থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আরো পুবের দিকে যাই, মানব ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের একটি, চীন ও আশেপাশের এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা বিশাল সাম্রাজ্য। অচল গিরিধারা হিমশৈল চোমালুংমা বা হিমালয়ের সদা প্রহরায় গোটা পৃথিবীর আর সব অঞ্চল থেকে প্রায় আলাদা হয়ে থাকা দেশটির দ্রাক্ষারস পানের ইতিহাসও কালের বদলে হয়ে উঠেছে হিমালয় ছুঁই ছুঁই। ধারণা করা হয় মানুষের জানাশোনা ইতিহাসের ঠিকুজি মেলানো শুরু যখন থেকে, তখন থেকেই ওখানে মদ্যপানের সূত্রপাত।

খ্রিস্টজন্মের ৭০০০ বছর পূর্বে অর্থাৎ প্রায় নয় হাজার বছর আগে অন্য ফলের সাথে কিংবা আলাদা করে গাঁজানো আঙুর রস পানের প্রমাণ মেলে বিভিন্ন পুরাকীর্তি বিশ্লেষণে। এছাড়াও জর্জিয়ায় খ্রি. পূ. ৬০০০ কিংবা পারস্য সাম্রাজ্যে খ্রি. পূ. ৫০০০ সালেও খোঁজ মেলে দ্রাক্ষারস সেবনের। প্রায় সমসাময়িক সময়েই প্রাচীন গ্রিসে ও সিসিলিতেও এই চর্চা শুরু হয়। এসব দেশ থেকে বিভিন্ন পানীয়ের গ্লাস কিংবা জারে পাওয়া গেছে টারটারিক এসিডের অস্তিত্ব যা কিনা আঙুরভিত্তিক অগ্নিজলের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

আজকের দিনেও ওদেশে মদ্যপান প্রবণতাকে পরম আদরের সাথেই গ্রহণ করা হয় এবং তাদের আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণের প্রবণতাও বাড়ছে। চিনারা মূলত সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিংবা পাড়া মহল্লার আড্ডায় সকলে মিলে একসাথে বসে পান করতে পছন্দ করে এবং প্রতিযোগিতা মূলক পানে এদের আগ্রহ দেখা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে স্বাস্থ্য বিষয়ক পত্রিকা ল্যান্সেট এর রিপোর্টে জানা যায়, ভোক্তা প্রতি মদ্যপানের দিক থেকে চায়না, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে গেছে।

বিশ্বকে নানানভাবে সমৃদ্ধ করা চীন যেমন মদ্যপানে পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত তেমনি এর সাহিত্যেও দ্রাক্ষারসের কথা এসেছে বহুবার। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে গোটা চিন শাসন করা টাং ডাইনেস্টির সময়টাকে বলা হয় ওদেশের শিল্প সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। সেই স্বর্ণযুগের উজ্জ্বলতম কবির নাম লি বাই যিনি লি পো কিংবা লি তাইবাই নামেও পরিচিত।

আপাদমস্তক রোম্যান্টিক এ কবির কিংবদন্তীতুল্য রচনাবলীর আরও অনেক দুঃখজনক ভাবে অলিখিতই রয়ে গেছে ভাগ্যদোষে। হয়ত চিনাসাহিত্য কিংবা বিশ্ব আরও অমূল্য সব কাজ পেত, যদি না আজন্ম সূরাপ্রেমী এই কবি একরাতে প্রচুর মদ্যপানের পর অদ্ভুত এক বিভ্রমে চন্দ্রাহত অবস্থায় চাঁদকে ভালবেসে ফেলতেন আর সেটাকে ধরতে উদভ্রান্তের মত এগিয়ে না চলতেন।

‘আমার হাত ভর্তি চাঁদের আলো, ধরতে গেলেই নাই’ এই মন্ত্রে বিশ্বাস রেখে তিনি ফিরে এলেন না, বরং এগিয়েই চললেন যতক্ষণ না সামনে এক বিশাল নদী পড়ল। নদীতে চাঁদের ছায়া দেখে তিনি চাঁদ ধরতে গেলেন এবং মাতাল অবস্থায় ডুবে মরলেন। সোমরসের মত্ততায় সলিল সমাধি হল চিনা সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্রস্টার।

চিনা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, এই কবি এখনো চৈনিক সমাজে কি ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন, সেটার প্রমাণ স্বরূপ কবির একটি কবিতা এখানে উল্লেখ করছি। কবিতাটি মূল চাইনিজ থেকে মিলিয়ে অনুবাদে আমাকে সাহায্য করেছে বন্ধুবর হুয়াং ওয়েনজে। লি বাই এর কবিতাটি শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্য। এক পূর্ণিমার রাতে অশেষ আলো ঢেলে দেয়া জ্যোৎস্না ধারায় ভিজে, সূরা পান করতে করতে কবি লেখেন—

শয্যা থেকে দেখি, নেমেছে সামনে, দীপ্ত চন্দ্রসুধা!

মনে হয় যেন মেঝেতে চলছে তুষার জমার গাঁথা।

মাথা উঁচু করে দেখি অপলক সেই শুভ্র পূর্ণ চাঁদ

মনে পড়ে যায় বাড়ির ছবিটা, অবনত হয় মাথা।

নৈশব্দের ভাবনাগুলো

 লি বাই

কবিতাটি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। চিনা সমাজে চাঁদ একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। চিনা বর্ষপঞ্জি চাঁদের চলনের সাথে বদলে যায় আর ওদের সমস্ত উপলক্ষই সেই চলনের হিসাব মেনে চলে। তাই সাধারণ কর্মচারী কিংবা কর্মকর্তাদের ছুটির অবকাশ মিলত পূর্ণিমার সময়টাতে।

কবিতাটি লেখবার সময় কবি রাজ কর্মচারী (সভাকবি) হিসেবে কাজ করছেন টাং ডাইনেস্টির তৎকালীন রাজধানী চাং’আন এ, নিজের শহর কিংবা বাড়ি থেকে বহু দূরে। আশ্চর্য এক চন্দ্রালোকের রাতে কবিতা লিখছেন আর পান করছেন সূরা। সামনের দীপ্ত চন্দ্রসুধা দেখে কবির মনে হচ্ছে যেন মেঝেতে শীতের রাতে জমে থাকা ঝকঝকে তুষারের মত চন্দ্রালোক ঝলক দিচ্ছে আর এই মধু পূর্ণিমাতেই কবির মনে পড়ে যাচ্ছে বাড়ির ছবিটা, আর সে কারণেই মাথা নুয়ে পড়ছে দুঃখের ভারে।

তিন

দ্রাক্ষারসের সুধা আর চাঁদের শোভা এই দুই নিয়ে চিনা ভাষায় শুধু লি বাই লিখেছেন ব্যাপারটা এমন নয় বরং আরও অসংখ্য কবির লেখায় এসেছে এরা। প্রকৃতপক্ষে সংরক্ষিত হয়েছে পুরাকালের এমন সব সাহিত্যকীর্তির দিকে তাকালে একথা বললে দোষ হয় না যে, বিশ্বের সব ভাষা ও সাহিত্যেই সোমরসের বন্দনাগীতি হয়েছে বিস্তর। কবিতায়, রচনায় এমনকি প্রার্থনালিপিতেও এসেছে চন্দ্রাহত মনের আবেগ আর সোমরসের বেখেয়ালি কল্পনা।

সাহিত্যে অগ্নিজলের অবাধ আসা যাওয়া আসলে প্রমাণ করে একটা কথাই; দ্রাক্ষারস জাতীয় পানীয়ের নিত্যকার বন্দনা, জয়জয়কারের প্রধান কারণ আর কিছুই নয়, কল্পনা। কল্পনাই মহান করেছে যাবতীয় শিল্পকে। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষ যখন সন্ধ্যার অবকাশে, দম ফেলা হাসি গানে কিংবা কথা ও কবিতার উচ্ছলতায় মেতে ওঠে তখন পানীয় হিসেবে সূরা কিংবা দ্রাক্ষারসের উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে ওঠে।

পরিমিত হারে এ পানীয় সেবনে কারো কারো চাঞ্চল্য নিবৃত্ত হয়, কারো বেলায় দেখা যায় মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে সারাদিনের কর্ম ক্লান্তি ভুলে। শুধু যে অবসরে কিংবা আড্ডায় কিংবা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে এর ব্যাবহার সীমাবদ্ধ ছিল এমন নয় বরং মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চগুলোর একটি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেও এর ব্যবহার ছিল দেখার মত।

আমরা যদি প্রাচীন গ্রীসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম ইলিয়াড ও অডিসির দিকে তাকাই তাহলে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার সাথে সূরা কিংবা দ্রাক্ষারসের নিবিড় যোগাযোগের খোঁজ পাই। ট্রয় যুদ্ধের দশম বছরে যখন গ্রীক বাহিনীর সবচেয়ে অগ্রগণ্য সেনানায়ক মারমিডনদের রাজা একিলিস গ্রীক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রাজা আগামেমননের উপর ক্রোধবশত যুদ্ধবিগ্রহ থেকে নিজেকে ও সেনাদলকে দীর্ঘদিন সরিয়ে রাখার পর যখন যুদ্ধে পুনরায় নামতে সম্মত হন; তখন রাজা আগামেমনন একটা হৃষ্টপুষ্ট শূকর বলি দিয়ে ও সুরভিত লাল মদ্য ছিটিয়ে দেবতা জিউসের নামে শপথ করে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেন। এইভাবে ইলিয়াড ও ওডিসিতে অসংখ্যবার এসেছে এই জাতীয় শপথ ও পূজার উপলক্ষ যাতে সুরভিত মদ ছিটিয়ে দিয়ে ও পান করে গ্রীক ও ট্রয়ের নেতৃস্থানীয় লোকেরা পূজা অর্চনা করে দেবতাদের কৃপালাভের চেষ্টা করছেন।

প্রাচীনকাল থেকেই দুধ ও পানির তুলনায় মদকে মনে করা হত অধিকতর নিরাপদ। একথা শুনে আজকের দিনে আশ্চর্য হওয়া খুবই স্বাভাবিক, কি করে পানির চেয়ে মদ নিরাপদ হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে রেফ্রিজারেটর বিহীন তৎকালীন সময়েও দুধের মত পানি নষ্ট হবার ভয় না থাকলেও পানি যেহেতু সর্বপরিবাহী ও আদর্শ দ্রাবক, তাই বিশুদ্ধ পানির খোঁজ পাওয়া ছিল অনেকটা সোনার হরিণ খোঁজার মতই; বিশেষ করে বড় বড় শহরগুলোতে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্যে। আজকের দিনের মত জলশোধন ব্যবস্থা ছিল না সেকালে। সেকারণেই পানীয় মদের গুরুত্ব এখনকার চেয়ে প্রাচীন যুগে ছিল ঢের বেশী। আমরা দেখেছি একিলিসের বিখ্যাত সহচর ও ভ্রাতৃপ্রতিম প্যাট্রোক্লাস ট্রয় যুদ্ধে নিহত হবার পর মৃতদেহ যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য একিলিসের মা দেবী থেটিস মন্ত্রপূত লাল মদ লাশের শরীরের নাক, কান ও মুখের ফুটো দিয়ে শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেন।

সেকালের গ্রীস কিংবা এর আশেপাশের দেশগুলোর সমাজ ব্যবস্থায় অতিথি কিংবা ভিক্ষুক আপ্যায়ন ও ভালভাবে পানাহারের ব্যবস্থা করা খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হত। তাদের কাছে অনেক সময় মনে হত দেবতারা মানুষকে পরীক্ষা করতে আসছেন ভিক্ষুক কিংবা অতিথি সেজে। সে কারণেই তাদের আপ্যায়নে ভালো মানের মদ পরিবেশিত হত। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের দৌত্য কার্য, মন্দিরে কিংবা অন্যত্র দেবতার পূজায় এমনকি শপথ অনুষ্ঠানেও হরদম ব্যবহার হত লাল মদ্যের।

পশ্চিমা সভ্যতার আজকের যে যাত্রা, তার বীজ বপন হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রিসে। সেখানকার আচার প্রথায় দ্রাক্ষারসের গুরুত্ব অপরিসীম, এ কথা বলাই বাহুল্য। আর এই গ্রীক সমাজব্যবস্থা থেকেই বহু কিছু সরাসরি নকল করে নেয় রোমান সাম্রাজ্য। রোমান সাম্রাজ্যের ‘এরিস্টক্রেট’ লোকজন এই দ্রাক্ষারসের আরও নানারকম ব্যবহার বের করেন। তার মধ্যে মজার একটি রেড ওয়াইনে গোসল। বড় বড় হাউস বা বাথটাব দ্রাক্ষারসে পূর্ণ করে তারা গোসল করতেন সকলে মিলে। এই ধরণের গণ গোসলখানায় সাধারণত উচ্চশ্রেণীর লোকেরই প্রবেশাধিকার থাকত। এই গোসল নাকি দেহের খসে পড়া চামড়ার ঝরে যাওয়া তরান্বিত করত এবং দেহে এক ধরণের সতেজ অনুভব নিয়ে আসত।

রোম সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ লোক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে গেলে, সম্রাট কন্সট্যানটিন যখন খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করলেন তখনও দ্রাক্ষারসের মাহাত্ম্য কমে গেল না বরং তার আরও প্রসার ঘটল যার সাক্ষ্য দেয় চুপচাপ বয়ে যাওয়া কালের কলস…

চার

কল্পনা আর আবেগের মিশেলে যে দ্রাক্ষারস হয়ে উঠেছে স্বর্গীয় পানীয়, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে তাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে ফরাসিরা। অগ্নিজলের সাথে ফরাসিদের গাঁটছড়া বাঁধা আড়াই হাজার বছরেরও আগে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে লিখিত উৎপাদন পরম্পরাই ফ্রেঞ্চ ওয়াইনকে করেছে বাকি বিশ্বের থেকে একদম আলাদা। সাধারণত ফরাসিদের কাছে দ্রাক্ষারস মধ্যাহ্নভোজন কিংবা রাতের খাবারের সাথে সহায়ক পানীয় হিসেবেই অনেকটা অনাদিকাল থেকে গুরুত্ব পেয়ে আসছে। ফ্রেঞ্চ চিজ আর মদ পাশাপাশি না হলে, খাওয়াটা সত্যিই অপূর্ণ রয়ে যায় ফরাসিদের কাছে।

ইউরোপের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের খোলনলচে বদলে দেয়ার সূত্রপাত যেসব ঘটনা কেন্দ্র করে তার একটি ফরাসি বিপ্লব। বিপ্লবের বিবিধ সুফলের সাথে অগ্নিজলের সহজপ্রাপ্যতাও গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হিসেবে দেখা দেয়। বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের ভুবন বিখ্যাত ওয়াইন প্রস্তুতির মূল কাঁচামাল নানা জাতের আঙুর চাষের অধিকার ছিল শুধুমাত্র চার্চের এখতিয়ারে। পরবর্তীতে জনগণ নিজের ইচ্ছেমত আঙুর চাষের অধিকার লাভ করে।

ফ্রান্সের অগ্নিজল কেন বাকি বিশ্বের চেয়ে আলাদা তার পিছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ত ওদের দেশে পাওয়া নানান জাতের আঙুর। এইসব আঙুর এখন প্রায় সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে একসময় যেগুলো ছিল অনেকটাই ফরাসিদের একচ্ছত্র অধিকার। গুরুত্বপূর্ণ জাতগুলো যেগুলো আজকের দিনেও সকলের কাছে সমাদৃত সেগুলো হল Cabernet Sauvignon, Chardonnay, Pinot noir, Sauvignon blanc এবং Syrah।

দৈবক্রমে আকস্মিক কোন এক ঘটনার প্রেক্ষিত ইতিহাসের পট আমূল বদলে ফেলা ঘটনা ঘটেছে বহু। সেরকম একটার জন্ম ওলন্দাজদের হাতে। ফ্রান্সের কনিয়াক নামক শহরের মাটিতে যে আঙুরের জন্ম তা থেকে তৈরি হয় সেরা জাতের ‘কনিয়াক ওয়াইন’। ফ্রান্স থেকে মদ কিনে নিজ দেশে নিয়ে পান করতে গিয়ে তারা দেখতে পায় স্বাদ বদলে কেমন বিস্বাদ হয়ে গেছে। এর থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কনিয়াককে দুবার রিফাইন করা হল, তাতে দেখা গেল স্বাদ আর বাজে ভাবে নষ্ট হল না। বরং এই করতে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক স্বাদের জন্ম হয় যাকে ব্র্যান্ডি নাম দেয়া হয়। ডাচ ভাষার শব্দ ‘ব্রেনদেভ্যাং’ অর্থ দাড়ায় ‘বার্ন্ট ওয়াইন’ বা ‘পোড়া মদ’।

ফরাসিদের জীবনে মদ কিভাবে মিশে আছে তার প্রমাণ মেলে সাম্প্রতিক সময়ের এক ঘটনায়। ইরানের প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয় সফরে গেলে মধ্যাহ্নভোজনের মেন্যু নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। ভীষণ নাক উঁচু বলে পরিচিত ফ্রেঞ্চরা অতিথির খাবার পরিবেশনেও নিজস্বতা জাহির করে, ফলশ্রুতিতে ইরানি সফরকারী দল মধ্যাহ্নভোজন বাতিল করতে বাধ্য হয়। ইসলাম ধর্ম মোতাবেক মদ নিষিদ্ধ বলে এটি পরিবেশন করা ভোজে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায় প্রতিনিধি দল। দুটো বিপরীতমুখী আদর্শের এই দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়েই জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

দ্রাক্ষারস বা সূরা নিয়ে মানুষের কৌতূহল ও ক্ষেত্রবিশেষে ভুল ধারণার শেষ নেই। যে সব দেশে এসব নিষিদ্ধ তাদের কাছে মদ মানেই মাতলামো এবং অসুস্থ চিন্তার উদ্রেক। অথচ বিভিন্ন প্রকার নেশাদ্রব্য যে এর চেয়ে ঢের বেশী ক্ষতিকর সেদিকে চোখ বুঝে থাকতে দেখা যায় অনেক দেশের সরকার ও প্রশাসনকে।

যা হোক, চোলাই পদ্ধতির আধুনিকায়ন ও বিজ্ঞান দিয়েছে হরেক রকম অগ্নিজলের সমাহার। তা সত্ত্বেও ঘরে বানানো কিছুর আবেদন একেবারেই আলাদা। ঘরে কি করে এই পানীয় তৈরি করা সম্ভব সেই দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক।

শুরুতেই উল্লেখ করেছি বিশ্বের প্রথমদিকে যেসব অঞ্চলে অগ্নিজল সেবন প্রক্রিয়ার উদ্ভব ঘটে আর মধ্যে পারস্য বা আজকের ইরান অন্যতম। আজকালকার দিনে ইরানে ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাবে সুরাপান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হলেও প্রাচীন ফারসি সাহিত্যে মেই এবং বাদেহ অর্থাৎ মদের বন্দনার দেখা মেলে হরদম। এমনকি পারস্য সাহিত্যের সিগনেচার বলে পরিচিত ‘রুবাই’ এর বেশিরভাগেই সাকি ও সূরা এই দুটি উপমা দিয়েই বক্তব্যকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

মদ্যপানের দীর্ঘ সংস্কৃতি আজকের দিনেও তরুণ ও কিছুটা নিয়ম ভাঙা বহু ইরানির কাছেই সাম্প্রতিক ইসলামী বিপ্লব পরবর্তী নিষেধাজ্ঞার চেয়ে অনেক বেশী আকর্ষণীয় ও যৌক্তিক। দেশের বাইরে পা রাখা মাত্র এমনভাবে নিজেদের বদলে ফেলেন যে বিশ্বাস করা মুশকিল, অমন কট্টর ইসলামী অনুশাসন মেনে চলা দেশের লোক এরা। তবু এর মাঝেও লুকিয়ে ছাপিয়ে কেউ কেউ নিজেরা ঘরে মদ চোলাই করেন এবং তৈরি করেন দ্রাক্ষারস কিংবা বিয়ার।

খুব ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজ একেবারেই অবৈধ। যদি সরকারের লোক কিংবা পুলিশ কখনো কাউকে ধরতে পারে তাহলে মৃত্যুদণ্ডের শঙ্কা রয়েছে। ঘটনাক্রমে আমার এক ইরানি বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় (নাম তার নিমা পুইয়া) হয় যে কিনা ঘরে মদ চোলাই করত। বেশিরভাগ সময়ে বিয়ার উৎপাদন করলেও মাঝে মাঝে মদও তৈরি করত ওদের পরিবার। ওর কাছ থেকেই রেসিপিটা জোগাড় করা। এখানে যে মদ্য তৈরির কথা বলা সেটার বাংলা নাম দেয়া যেতে পারে ‘গোলাপগন্ধী দ্রাক্ষারস’ ইংরেজিতে, রোজ ওয়াইন।

গোলাপগন্ধী দ্রাক্ষারস

যা যা লাগবেঃ

মিষ্টি আঙুর ( কালো আঙুর হলে ভাল) এক কিলোগ্রাম,

গোলাপ পাপড়ি – একটি,

আতপ চাল কিংবা গমের দানা কয়েকটি,

ঢাকনা যুক্ত কাঁচের যার,

পরিষ্কার ছাঁকনি, কাপড় কিংবা অন্য যে কোন ধরণের।

যা করতে হবেঃ

এক) প্রথমে আঙুরগুলো ভাল করে ধুয়ে বোঁটা ছাড়িয়ে ভাল করে চটকে নিতে হবে। ইলেক্ট্রনিক বিটার না থাকলে হাতেই করে নেয়া যেতে পারে। লক্ষ রাখতে হবে আঙুর বেশী টক হলে চলবে না, সেক্ষেত্রে ওয়াইনের বদলে ভিনেগার হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।

দুই) সমস্ত আঙুরের রস পরিষ্কার কাঁচের জার কিংবা নির্ধারিত পাত্রে ঢালতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে আঙুরের বিচি যেন অধিক পরিমাণে চলে না যায়। পাত্র নির্ধারণের বেলায় খেয়াল রাখতে হবে যেন পাত্রটি খুব ভাল করে আটকে নেয়া যায় যেন বন্ধ করার পর এতে কোনরকম বাতাস প্রবেশ করতে না পারে।

তিন) এবারে এই দ্রাক্ষারসে দিয়ে দিতে হবে গোলাপ পাপড়ি, একটা সমস্ত গোলাপের পুরোটাই। আর সাথে দিতে হবে গমের দানা কিংবা গোটা চার পাঁচ আতপ চাল।

চার) এবার নির্ধারিত পাত্র যার মধ্যে সমস্ত দ্রাক্ষারস ঢেলে দেয়া হয়েছে তার মুখ খুব ভাল করে আটকে দিতে হবে, যেন কোন বাতাস ঢোকার সুযোগ না থাকে। এরপর শুকনো ও ছায়াময় জায়গায় রেখে দিতে হবে।

পাঁচ) দিন কয়েক পরে দেখতে হবে জারের ভেতরের তরলে গাজন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কিনা। শুরু না হলে আরও কয়েকটা চাল দিয়ে দিতে হবে।

ছয়) দিন দশেক পরে, গাজন প্রক্রিয়ার ফলে এক ধরণের ফ্যানা বেরিয়ে জারের ঢাকনায় চাপ সৃষ্টি করবে, যা অনেক সময় চাপের কারণে ছিটকে খুলেও যেতে পারে। খুলে না গেলে নিজে থেকে খুলে নিতে হবে।

সাত) এরপর ছাঁকনি দিয়ে ঐ তরল ছেঁকে নিতে হবে। তরলটির রং হবে খুব হালকা গোলাপি রং আর সাথে থেকে যাবে মৃদু গোলাপ গন্ধ। গোলাপগন্ধী এই দ্রাক্ষারস ইচ্ছেমত বেশ কয়েকবার ছেকে নেয়া যেতে পারে।

এভাবেই খুব সহজেই করে ফেলা যায়, ঘরে তৈরি গোলাপ সুরভিত দ্রাক্ষারস। তৈরি হয়ে গেলে তিন সপ্তাহ থেকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত রেখে দেয়া যেতে পারে পান করবার পূর্ব পর্যন্ত। বিষয়টা নির্ভর করছে যারা এটি সেবন করছেন তাদের উপর। আশা করছি লেখাটি যারা পড়ছেন তাদের কেউ যদি দ্রাক্ষারস ঘরে তৈরি করতে চান, তবে এই প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করে তৈরি করবেন রোজ-ওয়াইন বা গোলাপগন্ধী দ্রাক্ষারস।

 পাঁচ

‘‘বিয়ার হলো মানব সৃষ্ট, আর ওয়াইন ঈশ্বর প্রদত্ত।’’ এই উদ্ধৃতিটি ষোড়শ শতকের বিখ্যাত জার্মান খ্রিস্টধর্ম সংস্কারক যাজক মার্টিন লুথারের। তার বক্তব্যে একথাই প্রমাণ করে ধর্ম আজ যা আছে কাল তা নাও থাকতে পারে। এজন্য চলে আসে আচার প্রথার বদল ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কিন্তু পানীয় হিসেবে অগ্নিজল রয়ে যায় একই গুরুত্বে, একই মহিমায় ধীর স্থির, সহস্র বর্ষব্যাপী।

মূলত রোমানদের কাছ থেকেই পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে যায় দ্রাক্ষারস থেকে মদ উৎপাদনের প্রক্রিয়া। ওদের থেকেই আঙুর চাষ, উৎপাদনের কলাকৌশল রপ্ত করে জার্মানরা। জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়ায় দ্রাক্ষালতার চাষ যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মোসেল নদীর তীরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল যা, জার্মানি, ফ্রান্স ও লিশটেনস্টাইনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত।

সুরার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মধ্যযুগে খ্রিস্টীয় মঠগুলো ব্যাপকভাবে ওয়াইন তৈরির চেষ্টা চলতে থাকে। এ কাজে চার্চের সন্ন্যাসীরা এত দক্ষ হয়ে ওঠেন যে তাদের দক্ষতা সম্পর্কে কথিত আছে, মাটি দেখে বা ছুঁয়েই তারা বলে দিতে পারতেন কোন মাটিতে দ্রাক্ষালতার চাষ ভালোভাবে সম্ভব।

ওয়াইনের স্বর্গীয় স্বাদ ও উপযোগের বহুল প্রশংসা সত্ত্বেও পানীয় হিসেবে এটি জার্মানি ও আশেপাশের মধ্য ইউরোপের দেশগুলোয় সর্বসাধারণে ঠিক ততটা জনপ্রিয় ছিল না। আসলে জনপ্রিয় ছিল না বলাটা ভুল, কেননা দাম ও উৎপাদন ব্যয়ের কারণে সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ ছাড়া সাধারণের পক্ষে ভাল এক ফোঁটা দ্রাক্ষারসের নাগাল পাওয়া কঠিন ছিল। সাধারণ্যে যে মদ মিলত তা তুলনামূলক বিস্বাদ। আর মাত্রার গাঢ়ত্বের কারণে এই মদ নিত্যদিন পানের উপযোগীও ছিল না। সে শূন্যস্থান পূরণে করত স্বল্পমাত্রার এলকোহল সমৃদ্ধ অগ্নিজল যা বিয়ার নামে পরিচিত।

জার্মানিকে বলা হয় বিয়ারের দেশ। দীর্ঘকাল যাবত জনপ্রতি সবচেয়ে বেশী বিয়ার সেবনের তালিকায় জার্মানির অবস্থান ছিল প্রথম। সম্প্রতি সে অবস্থানে ফাটল ধরিয়েছে চেক রিপাবলিক। সাধারণত বছরে গড়ে একজন জার্মান প্রায় একশ লিটার বিয়ার পান করেন। ইদানীংকালের এক জরিপে দেখা গেছে চেক রিপাবলিকের লোকের বেলায় তা গড়ে দেড়শ লিটার। তা সত্ত্বেও সবচেয়ে বেশী বৈচিত্র্যের বিয়ার উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে জার্মানি এখনো শীর্ষ। দেশটির ১৩০০ এর মত ছোট বড় ব্রুয়ারিতে ৫০০০ ধরনের বিয়ার প্রস্তুত হয়৷ এত বিপুল সংখ্যক বৈচিত্র্য অভিজ্ঞ জিহ্বা ছাড়া কারো পক্ষে বোঝা কঠিন হলেও বাজারে সচরাচর যেসব বিয়ারের দেখা মেলে তার অধিকাংশের স্বাদ ও মানের তারতম্য বোঝা খুব কঠিন বিষয় নয়। 

মধ্য ইউরোপের এই দেশগুলোতে কেন বিয়ার এত জনপ্রিয় এর উত্তর বহুল আলোচিত অতীতের কাছেই লুকিয়ে আছে। মধ্যযুগে ডায়রিয়া, প্লেগ ইত্যাদি নানাবিধ রোগে ইউরোপে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে প্রায়শ। পানীয় জল আর খাবারের মধ্যে জীবাণুর আক্রমণ ঠেকানোর কোন উপায় জানা ছিল না সাধারণ মানুষের। আর হালকা এলকোহল যুক্ত পানীয়টির যে কিছুটা ঔষধিগুণ রয়েছে তা চোখ এড়ায় নি কারোই। আর তাই বয়স্ক এমনকি একটু বড় হয়ে ওঠা শিশুরাও বিয়ার পান করত। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে খনিশ্রমিক হিসেবে হাড়ভাঙা খাটুনি দেবার পর লোকেরা এক বোতল বিয়ার পান করে দূর করত সমস্ত দিনের ক্লান্তি ও শক্তি নাশ করা শ্রমের কাল দাগ।

সেই অভ্যাস আজকের দিনেও তাই জার্মানি কিংবা ইউরোপের অনেক দেশেই দেখতে পাওয়া যায়। কাজ শেষে বের হয়ে ঘরে ফিরবার পথে সাবওয়ে কিংবা এস-বানে চড়তে চড়তে বিয়ারের বোতলে চুমুক, এ খুব পরিচিতি দৃশ্য মধ্য ইউরোপে। বিয়ার জার্মান জাতির জীবনে কেমন করে জড়িয়ে আছে তার প্রমাণ মেলে বিয়ার নিয়ে ওদের নানাবিধ চুটকির মাঝে। সেরকম একটাই এখানে উল্লেখ করছি —

এক লোক রাস্তার পাশে বসে আছে। ভিখিরি মতন। সে অদৃশ্য কাউকে শাপ শাপান্ত করছে আর বিয়ার খাচ্ছে। লোকটার গায়ে ছেড়া জামা আর গায়ে থেকে কেমন উটকো গন্ধ আসছে।

দূর থেকে একটি লোক গালিগালাজ শুনতে পেয়ে কাছে এসে বলল,

গুটেন টাগ (শুভ দিন)। এই সুন্দর দিনে কাকে গালি গালাজ করছ…

বিয়ার খেতে থাকা লোকটা বলল,

কাকে আবার। এই সর্বনাশা বিয়ারকে।

ওই তো আমার সব শেষ করল। ওর জন্যই তো আমি আজ পথে।

তখন পথচারী লোকটি বলল, তবে খাচ্ছ কেন?

খাচ্ছি কারণ, ‘বাইবেলে আছে শত্রুকে ভালোবাসো’। আর বিয়ার আমার সবচেয়ে বড় শত্রু!

ছয়

নর্স পুরাণ অনুসারে ভাইকিঙরা বিশ্বাস করত যারা প্রকৃত যোদ্ধা তারা মৃত্যুর পরে আজগার্ড নামের স্বর্গে যাবে আর সেখানকার শাসক সর্বপিতা ওডিন এর সাথে প্রাসাদোপম ভালহালাতে বসে বিয়ার পান করবে। পরিবেশনের পাত্রগুলো উপচে উঠবে সোনারঙা বিয়ারে আর সাহসী যোদ্ধারা পানাহার ও গল্পে মেতে উঠবে। এ থেকেই বোঝা যায় শুধু জার্মান জাতিই নয় বরং বহু প্রাচীন যুগ থেকে কেল্ট ও অন্যান্য উপজাতি গোষ্ঠী সোনা রঙা এই পানীয়ের স্বাদে মেতেছিল। আর এই পানীয়ের ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার মূল কারণ নিহিত আরও অনেক দূরে, পুবে। যাকে আজকের বিশ্বে মধ্যপ্রাচ্য বলে লোকে চেনে।

বিয়ারের ইতিহাস প্রায় দশ হাজার বছরের পুরনো, শস্যের উৎপাদন ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়া শুরু হবার পরপরই পৃথিবীতে এর আবির্ভাব। সুমেরীয় সভ্যতায় প্রাপ্ত কীলকাকার ফলকগুলো থেকে পাওয়া তথ্য আমাদের জানিয়েছে মিশরীয় সভ্যতায় এবং বাবেল মান্দোর (প্রাচীন ব্যবিলনে) বিয়ার পরিবেশিত হত বড় টেবিলে। এমনকি মানব জাতির প্রথম জানাশোনা আইনের কাঠামো যাকে ‘কোড অফ হামুরাবি’ বলা হয় তাতে বিভিন্ন উপায়ে চোলাই করা বিয়ারের দাম নির্দিষ্ট করা ছিল এবং তা লঙ্ঘনের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।

একটা সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় লিখন পদ্ধতিগুলোর অন্যতম বলে বিবেচিত, মিশরের হায়ারোগ্লিফিক লিপিতেও মানুষের পছন্দের পানীয় হিসেবে বিয়ারের প্রসঙ্গ এসেছে। ফারাওগণ নিয়মিতই বিয়ার খেতেন বলে জানা যায়। প্রাচীন মিশরীয় বিয়ার চিল বার্লির তৈরি এবং তুলনামূলক মিষ্টি। সে কারণেই এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছেও এটি খুব আদরণীয় ছিল। প্রচলিত আছে পিরামিড তৈরিতে যারা কাজ করতেন তাদেরকেও বিয়ার দেয়া হত, এতে প্রচুর শর্করা থাকায় এটি শক্তি যোগাতো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের।

বিজ্ঞান যত এগিয়েছে বিয়ার কিংবা মদ চোলাই এর প্রক্রিয়া তত বেশী হয়ে উঠেছে আধুনিক এবং দক্ষ। বিখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর আবিষ্কার করেন যে এলকোহল তৈরির মূল প্রক্রিয়া গাজনের পেছনে মূলত দায়ী ইস্ট। আর ডেনমার্কের উদ্ভিদবিজ্ঞানী ইমিল ক্রিসটিয়েন হ্যানসেন চোলাইকরণের ইতিহাস আমূল বদলে দিয়েছিলেন চোলাইকাজে সবচেয়ে পারদর্শী ইস্ট প্রজাতিকে শনাক্ত করার মাধ্যমে। এতে চোলাইকাজ হয়ে ওঠে তুলনামূলক সহজ এবং অধিক ফলদায়ী।

একথা সত্যিই শুনতে অনেকটা আশ্চর্য লাগবার কথা যে, এই হাজার হাজার বছর ধরে চোলাইকরণ প্রক্রিয়া চলতে থাকলেও বিষয়টি এখনো যথেষ্ট কঠিন। প্রযুক্তির অনেক উৎকর্ষ সত্ত্বেও এখনো একেক জায়গায় একেক পদ্ধতি অনুসরণ হয়। তবে সাধারণ ভাবে সব বিয়ারে প্রধান চারটে প্রধান উপাদান থাকেই— যব, হপ, জল এবং ইস্ট। চোলাইকরণের পুরো প্রক্রিয়াকে সরলভাবে বললে চারটে ধাপে বিভক্ত: শস্যের মণ্ড তৈরি, যবসূরা প্রস্তুতিকরণ, গাঁজন প্রক্রিয়া এবং পরিপুষ্ট অবস্থা।

গাঁজন সম্ভবত চোলাইকরণ পদ্ধতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই ধাপে যবসূরাতে বিদ্যমান সরল চিনিগুলো ইস্টের দ্বারা অ্যালকোহল ও কার্বন ডাই অক্সাইডে পরিণত হয়। মোটামুটি এক সপ্তাহ সময়ের মাঝেই পুরো বিষয়টা হয়ে যায়। সময়কাল সাধারণত উৎপাদন প্রক্রিয়া, তাপমাত্রা, উৎপাদিত বিয়ার কি ধরণের হবে তার উপর নির্ভর করে। 

সাত

জাতি হিসেবে জার্মানরা একটা অভিযোগ খুব প্রশান্তি নিয়ে উপভোগ করে, আর সেই মধুর অভিযোগটা হল; সব বিষয় নিয়ে অসহ্য রকম দীর্ঘ পরিকল্পনা। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা অবশ্য সেদিকেই সায় দেয়।

এ এক বিচিত্র ব্যাপার কোথাও ঘুরতে যাওয়া কিংবা কোন কাজে হাত দেয়ার আগে পরিকল্পনা মাফিক সব ওদের হিসেব করে রাখা চাই। তাই বিয়ার উৎপাদন বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়নে জার্মানরা যে প্রথম স্থান অধিকার করবে এ আর আশ্চর্য কী?

সেই ১৫১৬ সালে তৈরি হয় জার্মান ‘বিয়ার পিউরিটি আইন’ যাকে পৃথিবীর প্রথম খাদ্যগুণ নিয়ন্ত্রক আইন বলে অভিহিত করা যায়। পাঁচশ বছরের পুরনো এ নিয়ম অনুযায়ী বিয়ারের উপাদান হবে শুধুমাত্র চারটি— হপস, বার্লি, খামির এবং পানি এমন নিয়ম কড়াকড়ি ভাবে পালন করা হয়।

জার্মানি সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিয়ারগুলোর একটি হল পিল্সনার বা পিলস্‌, যার শুরু চেক রিপাবলিকের পিলজেন শহরে। এর বিভিন্ন প্রকার ও মাত্রা আছে, তবে উৎপাদন প্রক্রিয়া মোটামুটি একই।

অনেকেই বলে থাকেন খাঁটি পিল্সনার পেতে হলে যেতে হবে পিলজেন, চেক রিপাবলিক এ। পিলজেনের বিয়ার কেন আলাদা তার পেছনের রহস্যটা শুধুমাত্র প্রযুক্তিতে নয়, বরং কাঁচামাল ও উৎপাদন পরিবেশের উপরে নির্ভর করে বলেই অনন্য। অনেকটা আমাদের দেশে যেমন শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতেই জামদানি শাড়ি কিংবা মসলিন উৎপাদিত হয় বা হত।

গম থেকে প্রস্তুতকৃত জার্মান ভাইস বিয়ার অনেকের কাছেই সমাদৃত, এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে বিয়ারের তিতকুটে ভাবটা তুলনামূলক কম। জার্মান ভাষায় ভাইস শব্দের অর্থ শাদা, তাই বলে ভাবা ঠিক হবে না যে এর রং শাদা। তুলনামূলক হালকা বলেই হয়ত এই নামের উৎপত্তি। এছাড়াও গ্রেট ব্রিটেনে ভীষণ জনপ্রিয় আরেকটি বিয়ার হচ্ছে পোর্টার বিয়ার, যার ইতিহাস খুবই সাম্প্রতিক। অষ্টাদশ শতাব্দীতে লন্ডনে প্রথম এর চোলাই হয়, যা ঝলসানো মণ্ড থেকে তৈরি বলে এর রং গাঢ়।

বিয়ার কিভাবে পরিবেশিত হবে তাও প্রকারভেদে বদলে যায়। কোন কোন বিয়ার সরাসরি বোতল থেকে আবার কোনটা বড় লম্বা গ্লাসে পরিবেশনের পর পান করা হয়। আমেরিকানরা খুব ঠাণ্ডা বিয়ার পছন্দ করলেও অন্যান্য দেশে স্বাভাবিক অবস্থায় কিংবা সামান্য ঠাণ্ডায় পান করা হয়।

বিয়ার, জার্মানি, পান বিষয়ক চুটকি আর ‘অক্টোবর ফেস্ট’ সবগুলো যেন এক সূত্রে বাঁধা। জার্মানির সবচেয়ে সমৃদ্ধ অর্থনীতির প্রদেশ বাভারিয়ার রাজধানী মুঞ্চেন (মিউনিখে) এ প্রতি বছর বিয়ারের এই মহোৎসব শুরু হয়। বিষয়টা একটু আশ্চর্যের কেননা যদিও একে ‘অক্টোবর ফেস্ট’ নামে সারা বিশ্ব জানে, তবুও এর শুরু আসলে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে, শেষ অক্টোবরের প্রথম হপ্তায়।

এর ইতিহাসটা বেশ চমকপ্রদ। বাভারিয়ার ক্রাউন প্রিন্স ল্যুডভিশ প্রিন্সেস থেরেসেকে বিয়ে করার আনন্দঘন মুহূর্তে ১৮১০ সালে অক্টোবরের বারো থেকে সতেরো তারিখ পর্যন্ত উৎসব আয়োজিত হয়। উৎসব শেষ হয় ঘোড়দৌড়ের মাধ্যমে। উৎসবের ব্যাপক সাফল্যে পরের বছরগুলোতেও আয়োজন হতে থাকে। তবে অক্টোবর তুলনামূলক ঠাণ্ডা হওয়ায় সেপ্টেম্বরের দিকে এগিয়ে আনা হয় যেন শেষটা হয় অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে।

সেই থেকে ইউরোপের বৃহত্তম বিয়ার উৎসব চলছে প্রতিবছর মিউনিখে। শুধু যে মিউনিখেই হয়, বিষয়টা এমন নয়। পুরো জার্মানি জুড়েই মাসব্যাপী এক ধরণের মেলার মত হয় যাতে পানাহার, গল্প, আনন্দ আর বিভিন্ন ধরণের রাইডে চড়ার পাশাপাশি ওপেন এয়ার কনসার্টে মেতে ওঠা এই জার্মান জাতিকে দেখে তখন চেনাই দুষ্কর হয়ে ওঠে। পেটে দু বোতল বিয়ার না পড়লে যে জাতি হাসতে ভুলে যায় তাদের জন্য বিয়ারের এমন প্রায় মাসব্যাপী উৎসব ভীষণ দরকার বৈকি। বিয়ার নিয়ে জার্মানির সবচেয়ে পরিচিত চুটকি গুলোর একটি ‘বিধবার সাথে বাজি’। ওই দিয়েই শেষ করছি আজকের এই লেখা— অগ্নিজলের বিবিধ কড়চা।

বিধবার সাথে বাজি

তিন বন্ধু হালকা মাতাল অবস্থায় একদিন একটা উঁচু দেয়ালের উপর উঠে হাঁটা নিয়ে বাজি ধরল। তাদের নাম যথাক্রমে স্টিভ, বব, এবং জেফ। তো, যেই ভাবা সেই কাজ তিনজনই উঠে গেল।

হাটতে হাটতে পা ফসকে স্টিভ হঠাৎ পড়ে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভবলীলা সাঙ্গ হল তার।

একটু পরে পুলিশ এলো, এম্বুলেন্স এসে লাশ নিয়ে গেল।

বাকি বন্ধুরা এই অবস্থায় করণীয় কি তা নিয়ে ভাবছে। বব আর জেফের মনে হল স্টিভের বউকে খবরটা জানানো উচিত।

বব বলে উঠল, এই ধরনের সংবেদনশীল সে ভাল সামলায়, তাই এই কাজের দায়িত্ব সে নিজের কাঁধেই নিতে চায়। জেফও সায় দিয়ে বলল, রাতে দেখা হবে।

কয়েক ঘণ্টা পরে বব ফিরে এলো, হাতে ছয় বোতল বিয়ারের একটা প্যাক একটি ছয় প্যাক।

“কি বলেছিলে স্টিভের বউকে?” জেফ জিজ্ঞেস করল   

“হ্যাঁ”, বব বলল

“সেই দুঃখেই কি এতগুলো বিয়ার আনলে?”

বব জেফকে জানায় “আরে না, ওর বউই আমাকে দিল”

“কি বললে?” জেফ চেঁচিয়ে বলল, “স্বামী মারা যাবার খবর শুনে তোমাকে বিয়ার দিল?”

“অবশ্যই,” বব বলল।

“কেন?”

“যখন মহিলা দরজা খুলল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি স্টিভের বিধবা?’

‘বিধবা, আপনি কি পাগল’ মহিলা রেগে বলল, ‘না, না, আপনি ভুল করছেন, আমি বিধবা নই!’

তখন ওকে নিশ্চিত করে বললাম, “আপনার সাথে ছয় বোতল বিয়ার বাজি, সত্যিই আপনি বিধবা!”

টীকা:

১) ‘সিমআ’ শব্দের অর্থ বিষ বা বিষাক্ত জাতীয়।

২) পারস্য সাম্রাজ্যে বহুল প্রচলিত একটা গল্পগাঁথা, যার অনেক রকম সংস্করণ প্রচলিত হয়েছে মানুষের মুখে মুখে। তাতে আরেকটু রং চড়িয়ে এখানে পরিবেশন করা হল।

ঋণস্বীকার:

ভিটাস ভিনিফেরা ও অন্যান্য লেখাপত্র, ইমন জুবায়ের

চলমান প্রসঙ্গ, চণ্ডী লাহিড়ী, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড (ভারত)

বিরহের অন্তরালে, সত্যম রায় চৌধুরী, পত্র ভারতী (ভারত)

বিয়ার সোনালী পানীয়র গল্প, সচতেন থাক এর ব্লগ

উইকিপিডিয়ার ববিধি প্রবন্ধ

ডয়চে ভেলের বিভিন্ন সংবাদ ও তথ্য।

প্রচলতি জার্মান জোক্স

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার