অনেক সময় সবচেয়ে সহজ ব্যাপারের পিছনেই থাকে সবচেয়ে কঠিন সত্য। আপেল মাটিতে পড়ার চেয়ে সহজ সরল ঘটনা আর কী হতে পারে! কিন্তু তাই নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলা হয়, তখনই টনক নড়ে। সত্যিই তো, আপেল কেন মাটিতে পড়ে? কেন সোজা দিগন্তের দিকে ছুটতে শুরু করে না? সত্যিই তো, বঙ্গভাষী কেন বিশেষ দিনে ঘুড়ি ওড়ায়? কেন ঘুড়ি কাটাকাটির খেলা খেলে? ভাবুন, ভেবে দেখুন, উত্তর পাবেন না। যে ইংরেজি-শিক্ষিত আধুনিকতাবাদী উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবেন, তাঁর উত্তর অনেকটা তাদের উত্তরের মতো হবে, যারা নিউটনকে বলেছিল, ‘মাটিতে পড়বে না তো কি আকাশে উড়ে যাবে!’
যাকগে, আমরা মূল প্রসঙ্গে যাই। বিশ্বকর্ম্মা বলতে কী বোঝায়, সর্ব্বাগ্রে সে কথাটারই তো মানে জানা চাই। তার পরে তার পূজা কেন হয়, এবং সে পূজায় ঘুড়ি ওড়ানই বা হয় কেন, সে বিষয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তারও আগে জানা দরকার– বিশ্ব মানে কী? বিশ্ব, বিশ্বকর্ম্মা ইত্যাদি শব্দ তো আর অর্থহীনভাবে সৃষ্টি হয়নি।
বিশ্ব শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হল, ‘বিশ্ (প্রবেশ) বহন করে যে’। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত বঙ্গীয় শব্দকোষ তার মানে দিয়েছেন : সর্ব্ব, নিখিল, সমগ্র, সমস্ত, অশেষ, নরদেবতাগণের অন্তর্গত গণদেবতাবিশেষ, বিশ্বদেব… ইত্যাদি। কিন্তু সবার আগে জানিয়েছেন, এই বিশ্ব হল আসলে ‘পৃথক পৃথক স্থূলশরীরে প্রবিষ্ট চৈতন্য’। তার মানে ‘চৈতন্য’ নামে এক সত্তা, দুনিয়ার সমস্ত বাহ্যবস্তুর ভিতরে যে ঢুকে বসে আছে, সে-ই হল বিশ্ব। আজকাল আমরা কিন্তু বিশ্ব মানে world বুঝে থাকি। সে বোঝা ভুল কি না, নিবন্ধ শেষে সে বিষয়েও নিশ্চিত হয়ে যাব আমরা।
বিশ্ব শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ হল– যার ভিতরে অন্য সত্তা থেকে প্রেরিত শক্তির কোনো একটি রূপ প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, এবং সে সেই প্রবিষ্ট শক্তিকে বহন করে নিয়ে চলেছে; অর্থাৎ, ‘বিশ্-কে (প্রবেশনকে) বহন করে যে’, সেই হল বিশ্ব। তার মানে, বিশ্ব সত্তাটি হল আসলে ‘প্রবিষ্টবাহী’; তা সে বঙ্গীয় শব্দকোষ -কথিত ‘প্রবিষ্ট-চৈতন্য’-বাহী হতে পারে, একটি সামান্য মাটির কলসী কিংবা একটি কাঠের খাটও হতে পারে, যার ভিতরে মানুষ তার মেধা (=চৈতন্য) ও শ্রম ঢুকিয়ে দিয়েছে; একজন সেনাপতি কিংবা সৈন্যবাহিনী হতে পারেন, যার ভিতরে শাসকরাজা তাঁর ইচ্ছা ঢুকিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন; এমনকি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডও হতে পারে, যার ভিতরে স্বয়ং পরমাপ্রকৃতি তাঁর ইচ্ছা ঢুকিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। সেই ইচ্ছাই তো চৈতন্য। বঙ্গীয় শব্দকোষ-ও একরকম ঠিক কথাই বলেছেন।…
আমাদের পূর্বসূরীগণ ‘অদৃশ্য কিন্তু সমাজে বিশেষভাবে সক্রিয়’ সত্তাকে বোঝাতেই এই বিশ্ব শব্দটি তৈরি করেছিলেন। আমরা দেখছি, সেই বিশ্ব মানুষের তৈরি করা কৃত্রিম বিশ্ব (খাটপালঙ্ক, ঘটিবাটি, জামাজুতো, বাড়িঘর … সভ্যতার সমস্ত উপকরণ) হতে পারে, পরমাপ্রকৃতির তৈরি করা অকৃত্রিম বিশ্বও হতে পারে। মোটকথা, যার ভিতরে কেউ কিছু ঢুকিয়ে দিয়েছে এবং সে সেটা বহন করে নিয়ে চলেছে, সেই বাহকই বিশ্ব; অর্থাৎ, যে সত্তাই ‘প্রবিষ্টবাহী’ তাকেই বিশ্ব বলা যায়, তা সে কৃত্রিম হোক আর অকৃত্রিমই হোক।
কিন্তু এখন, এই ২০০০ খিস্টাব্দের লাগোয়া সময়ে আমাদের অভ্যাস তো দূষিত হয়ে গেছে। এখন আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো বিশ্ব শব্দের বাংলা মানে বিশ্ব শব্দের ভিতর থেকে নিষ্কাশন করি না। এখন আমরা ইংরেজি world শব্দের বাংলা মানে রূপে বিশ্ব শব্দটিকে বুঝি। ফল হয়েছে এই যে, এখন আমরা বিশ্ব বললে world বুঝি। স্বভাবতই সেই world ‘প্রবিষ্টবাহী’ কি না, সে প্রশ্নই অবান্তর হয়ে গেছে। তার মানে, একালের বাংলায় বিশ্ব শব্দটি world-বাচক হয়ে সম্পূর্ণভাবে প্রতীকী হয়ে গেছে। এখন আমরা চাইলে তাকে ‘পরমাপ্রকৃতির ইচ্ছাবাহী’-বিশ্ব বলতে পারি বটে, তবে world শব্দের ভিতরে সেকথা বলা নেই। এখন এতদিন পরে, আমাদের পূর্বপুরুষদের (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক) শব্দার্থ-নিষ্কাশন রীতি যখন বোঝা যাচ্ছে, এবং সেই রীতিতে বিশ্ব শব্দের মানে যখন ‘প্রবিষ্টবাহী’ বলে জেনেই গেছি, তখন এসব গৌণ প্রসঙ্গকে পাশে সরিয়ে রেখে আমরা বরং আমাদের কাজের কথায় নিরত হই।
বিশ্ব শব্দের অর্থ যদি ‘প্রবিষ্টবাহী’ হয়, তাহলে বিশ্বকর্ম্মা শব্দের অর্থ কী– এবার সেকথা আমাদের জানতে হবে। আমরা বিশ্বকর্ম্মা শব্দটির ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ পাচ্ছি– ‘বিশ্ব (প্রবিষ্টবাহী) বানানোর কর্ম্ম করেন যিনি’। বঙ্গীয় শব্দকোষ বলেছেন– ‘বিশ্ব কর্ম্ম যাঁহার’, তিনিই বিশ্বকর্ম্মা। তার মানে, কোনো কিছুর ভিতরে কোনো শক্তি-প্রভৃতি প্রবেশ করানোর কাজ করে বিশ্ব বানান যিনি, তিনিই বিশ্বকর্ম্মা। তবে তিনি কী কী বানান, কোন্ কাল থেকে সেসব বানাচ্ছেন, বঙ্গীয় শব্দকোষ এবং পৌরাণিক অভিধান তার কিছু কিছু সংবাদ দিয়ে গেছেন। বিশ্বকর্ম্মা শব্দের প্রতীকী অর্থ দিতে গিয়ে বঙ্গীয় শব্দকোষ জানাচ্ছেন– “সৃষ্টিকর্ত্তৃবিশেষ, দেবশিল্পী, ত্বষ্টা। বিশ্বকর্ম্মার মাতা বৃহস্পতিভগিনী ‘যোগসিদ্ধা’ বা ‘যোগসত্তা’, পিতা অষ্টম বসু ‘প্রভাস’।… মঙ্গলকাব্যে ইনি চণ্ডীর আজ্ঞায় দেউলনির্মাণ, কাঁচুলিলেখন, নগরনির্মাণ, ও নৌকাগঠনের শিল্পী। শূন্যপুরাণে, ধর্মস্থাননির্মাণ ও ধান্যচ্ছেদনার্থ সোনার কাস্তিয়া গড়ায় ইনিই কর্ম্মী। অন্নদামঙ্গলে শিবের সিদ্ধির ঘোটনা কুঁড়া, অন্নপূর্ণার রত্নহাতা, রত্নমুকুট, পানপাত্র, ভূষণ, কাঁচুলি, শাড়ী, উড়ানী, ইনিই যোগাইয়াছিলেন। বিশ্বেশ্বরের দেউল ও অন্নপূর্ণার পুরীর ইনিই নির্মাতা। শিবায়নে চাষী শিবের চাষের নিমিত্ত লাঙল ফাল কোদাল দা উখুন পাশী জোয়াল মই ইত্যাদির কর্ম্মকার রূপে ইনিই শাল বসাইয়াছিলেন। …বিশ্বকর্ম্মাই শিল্পপণ্ডিত, সূর্য্য, সূর্য্যের সপ্তরশ্মির একতম, পরমেশ্বর, আদিপুরুষ… ইত্যাদি।”
পৌরাণিক অভিধান বাড়তি যে-কথা জানাচ্ছেন, তা হল–
“… বেদে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বকর্ম্মা বলা হয় ।… ইনি শিল্পসমূহের প্রকাশক, অলঙ্কারের স্রষ্টা, দেবতাদের বিমান-নির্মাতা। এঁর কৃপায় মনুষ্যরা শিল্পকলায় পারদর্শিতা লাভ করে। ইনি লঙ্কানগরীর নির্মাতা । ইনি উপবেদ, স্থাপত্যবেদের প্রকাশক, এবং চতুঃষষ্ঠি কলার অধিষ্ঠাতা… ঋগ্বেদ অনুসারে ইনি সর্বদর্শী ভগবান ।… ইনি পিতা, সর্বজ্ঞ, দেবতাদের নামদাতা এবং মর্ত্যজীবের অনধিগম্য । ইনি সর্বমেধ-যজ্ঞে নিজেকে নিজের কাছে বলি দেন।… ইনি অস্ত্রাদিও প্রস্তুত করেন । …বিশ্বকর্ম্মা নিজের কন্যা সংজ্ঞার সহিত সূর্য্যের বিবাহ দেন। সংজ্ঞা সূর্য্যের প্রখর তাপ সহ্য করতে না পারায়, বিশ্বকর্ম্মা সূর্য্যকে শানচক্রে স্থাপন করে তাঁর উজ্জ্বলতার অষ্টমাংশ কর্তন করেন। সেই কর্তিত অংশ… দ্বারা তিনি বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিবের ত্রিশূল, কুবেরের অস্ত্র, কার্তিকেয়র শক্তি ও অন্যান্য দেবতাদের অস্ত্রশস্ত্রাদি নির্মাণ করে দেন।”
সমস্ত তথ্য ও তত্ত্ব বিচার করলে দেখা যায়– প্রাচীন কাল থেকে আমরা যাঁদের কামার কুমার তাঁতি মুচি দরজি… ইত্যাদি রূপে সাধাসাধি করে আসছি, মধ্যযুগ থেকে যাঁদের আমরা কারিগর, ওস্তাগর… ইত্যাদি রূপে সেধে আসছি, ব্রিটিশ যুগের পর থেকে আমরা যাঁদের ইঞ্জিনিয়ার, টেকনোলজিস্ট, বাসনির্মাতা, ট্রেননির্মাতা, লোহাকোম্পানি, তামাকোম্পানি, বিমাননির্মাতা… ইত্যাদি রূপে সাধ্যসাধনা করে আসছি, সম্প্রতিকালে আমরা যাঁদের স্পেসক্রাফট-ডিজাইনার, হার্ডওয়ার ইঞ্জিনিয়ার, কমপিউটার নির্মাতা… ইত্যাদি রূপে সাধনা করতে শুরু করেছি– এঁরা সবাই বিশ্বকর্ম্মা নামক সত্তাটির অংশ। এঁরা মূলত তাঁদের উৎপাদিত বস্তুর ভিতরে শ্রম ও মেধা প্রবেশ করিয়ে দিয়ে (= বিশ্-কর্ম করে দিয়ে) নির্মিত বস্তুটিকে সমাজ-আকাশে
উড়বার জন্য ছেড়ে দেন।
বোঝাই যায় যে, বিশ্বকর্ম্মা শব্দটির সঙ্গে যে বিশ্ব শব্দটি লেগে রয়েছে, সেটি উৎপন্ন বা পণ্য বাচক। স্বভাবতই, এই বিশ্বকর্ম্মা সত্তাটির ‘অদৃশ্য কিন্তু সক্রিয়’ সামাজিক ভূমিকা ছিল, আছে, থাকবে। মানুষের সমাজে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল কবে কখন কীভাবে এবং আবির্ভাবের পর থেকে আজ পর্যন্ত সত্তাটি কী কী ভূমিকা গ্রহণ করেছে– সে সবের একটা বিশাল ইতিহাস থাকার কথা, আছেও। তবে কোন সময় থেকে কারুকর্ম্ম প্রচলিত হয়েছিল, তার পর্য্যায়ক্রমে বিন্যস্ত ইতিবৃত্ত বিশ্বের অন্য কোনো দেশের প্রাচীন ইতিহাসে পাওয়া গেছে বলে আমরা শুনিনি; সে ইতিহাস রয়েছে কেবলমাত্র আমাদেরই।২ আদিকাল থেকে মধ্যযুগের আগে (প্রায় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত কালখণ্ডে বিশ্বকর্ম্মা সত্তাটির সামাজিক ভূমিকার বিস্তারিত ইতিহাস আমরা পাই আমাদের পুরাণকারগণের রচনায়, বিশ্বকর্ম্মার কাহিনীতে, ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায়। তার পর থেকে প্রায় ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আমাদের সমাজে বিশ্বকর্ম্মার ভূমিকার ইতিহাস প্রায় একইভাবে পাওয়া যায় আমাদের মধ্যযুগের পদাবলী সাহিত্যে। উপরের উদ্ধৃতাংশে সেই ইতিহাসের কিছু কিছু উল্লেখ করা হয়েছে, যা পড়তে হয় ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায়। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বকর্ম্মার সামাজিক ভূমিকার ইতিহাস অত্যন্ত নিখুঁত ও খণ্ড খণ্ড ভাবে এবং বিস্তারিতভাবে প্রতীকী ভাষায় জানা গেলেও সেগুলি যে বিশ্বকর্ম্মার ইতিহাস, সেকথা আমরা জানি না। অতীতহারা হয়ে গিয়ে সেই বিশ্বকর্ম্মাকে একালে আমরা নানা নামের মিস্ত্রি (যথা রাজমিস্ত্রি, ছুতারমিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি … ইত্যাদি), craftsman, fabricator, welder, plumber, manufacturer, builder, construction worker, industrial worker … ইত্যাদি অজস্র খণ্ড খণ্ড ইংরেজি নামে শনাক্ত করে থাকি। তার মানে, বিশ্বকর্ম্মা সত্তাটি সারা দুনিয়া জুড়ে অজস্র নামের ‘প্রবিষ্টকরণ-কর্ম্মী’ রূপে কোটি কোটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন।
এইখানে একটি অত্যন্ত কঠিন কিন্তু অতি সহজ সরল কথা জানিয়ে রাখা যাক। আমরা যাঁদের পূজা-অনুষ্ঠানাদি করি, আমাদের তেমন সকল দেবতাই বাস্তব; তাঁরা অলীক কিছু নন, বিশ্বকর্ম্মার মতোই তাঁরা মানুষের সমাজে নানা রূপে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা তাঁদের চিনতে বুঝতে পারতেন, এমনকি একালের তথাকথিত মূর্খ ধর্মপ্রাণ সহজিয়া সাধারণ বাংলাভাষীরাও তাঁদের কমবেশি চিনতে বুঝতে পারেন, আমরা ইংরেজি শিক্ষায় কলুষিত অধঃপতিত মানুষেরা তাঁদের চিনতে পারি না, বুঝতে পারি না।…
আরও একটি কথা এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা খুবই জরুরি । আমাদের প্রাচীন জ্ঞানী মানুষেরা কোনো ‘অদৃশ্য কিন্তু সক্রিয়’ সত্তাকে চিনতে বুঝতে পারার পর, তার কথা অন্য সকল সমাজসদস্যকে জানিয়ে রাখার অনন্য পন্থা আবিষ্কার করেছিলেন। প্রথমত, তাঁরা সেই সত্তাটির ক্রিয়াকারিত্ব অনুসারে তার একটা নামকরণ করতেন, যেমন বিশ্বকর্ম্মা, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, নারায়ণ, শিব… ইত্যাদি। কিন্তু একটি নামশব্দ শুনে কি সব মানুষ বুঝতে পারে– সত্তাটি মানুষের সমাজে কীরকম শুভ বা অশুভ ক্রিয়া করে থাকে? না। সত্তাটির নামটুকু শুনে সব মানুষ তাকে চিনতে বুঝতে পারে না। সেই কারণে আমাদের পূর্বপুরুষেরা সেই সত্তাটিকে বোঝানোর জন্য আরও অন্তত চারটি উপায় গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা মানুষের সমাজে সেই সত্তার উদ্ভব ও ক্রিয়াকলাপের কাহিনী প্রচলিত ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় বর্ণনা করেন, প্রতীকী ছবি আঁকেন, প্রতীকী মূর্তি বানিয়ে ফেলেন এবং সবশেষে সত্তাটির সম্পর্কে কিছু প্রতীকী আচার-অনুষ্ঠানের প্রথার প্রচলন করেন, যার থেকে সত্তাটিকে অনেক স্পষ্ট রূপে বোঝা সম্ভব । তার মানে, উপলব্ধ সত্তাটিকে নামশব্দে, কাহিনীতে, ছবিতে, ভাস্কর্য্যে, আচার-অনুষ্ঠানের অজস্র বিধি-বিধানে আবদ্ধ করে অনুবাদ করে নেন তাঁরা। ফলত, ভারতবর্ষের সংস্কৃতির জ্ঞানরসের বিশাল সরোবরটি অজস্র উপলব্ধ সত্তার নামশব্দে, কাহিনীতে, ছবিতে, প্রতিমায়, আচার-অনুষ্ঠানের অজস্র বিধিবদ্ধ প্রথায় ভরে টইটম্বুর হয়ে যায়।
মধ্যযুগের বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির দিকে তাকালে সেই টইটম্বুর সরোবরটিকে সুস্পষ্ট দেখা যায়।
কিন্তু কালের লিখন কে খণ্ডাবে! বাংলার মাটিতে ব্রিটিশের পদার্পণের পরবর্তী যুগে সেই নাম, কাহিনী, ছবি, প্রতিমা, আচার-অনুষ্ঠানাদি তাদের অর্থ হারিয়ে ফেলে; থেকে যায় অর্থহীন নাম, অর্থহীন কাহিনী, অর্থহীন ছবি, অর্থহীন প্রতিমা, অর্থহীন অজস্র আচার-অনুষ্ঠানের নিয়ম, বাঁধাবাঁধি। ফলত, আমাদের সেই জ্ঞানরসের বিশাল সরোবরটি শুকিয়ে যায়। সেই শুকনো
সরোবরটি চোখে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের। ‘ততঃ কিম’ নিবন্ধে তিনি জানান –
“আসল কথা, কোনো দেশের যখন দুর্গতির দিন আসে, তখন সে মুখ্য জিনিসটাকে হারায়, অথচ গৌণটা জঞ্জাল হইয়া জায়গা জুড়িয়া বসে। তখন পাখি উড়িয়া পালায়, খাঁচা পড়িয়া থাকে। আমাদের দেশেও তাহাই ঘটিয়াছে। আমরা এখনো নানাবিধ বাঁধাবাঁধি মানিয়া চলি… (সেই) বন্ধনগুলি আমরা আপাদমস্তক বহন করিয়া বেড়াইতেছি।… সাত্ত্বিকতার যে পূর্ণতা তাহা ভুলিয়াছি, রাজসিকতার যে ঐশ্বর্য তাহাও দুর্লভ হইয়াছে, কেবল তামসিকতার যে নিরর্থক অভ্যাসগত বোঝা তাহাই বহন করিয়া নিজেকে অকর্মণ্য করিয়া তুলিতেছি। অতএব এখনকার দিনে আমাদের দিকে তাকাইয়া যদি কেহ বলে, ভারতবর্ষের সমাজ মানুষকে কেবল আচারে-বিচারে আটে-ঘাটে বন্ধন করিবারই ফাঁদ, তবে মনে রাগ হইতে পারে কিন্তু জবাব দেওয়া কঠিন । পুকুর যখন শুকাইয়া গেছে, তখন তাহাকে যদি কেহ গর্ত বলে, তবে তাহা আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি হইলেও চুপ করিয়া থাকিতে হয় । আসল কথা, সরোবরের পূর্ণতা এককালে যতই সুগভীর ছিল, শুষ্ক অবস্থায় তাহার রিক্ততার গর্তটাও
ততই প্রকাণ্ড হইয়া থাকে।”
পরমাপ্রকৃতির অশেষ কৃপায় আজ আমাদের গোচরে এসেছে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্তার্থবিধি। তার সাহায্যে আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের রেখে যাওয়া নামশব্দ, কাহিনী, ছবি, প্রতিমা, আচার-অনুষ্ঠানাদির অর্থ কমবেশি নিষ্কাশন করে নিতে পারছি। বাংলাভাষীদের জ্ঞানীগুণী মানুষেরা যেদিন সবাই মিলে হাত লাগিয়ে সেই সমস্ত কাজ সমাধা করে সেগুলিকে একালীকরণ করে নিতে পারবেন, সেদিন আমাদের সেই জ্ঞানরসের শুকনো সরোবর আবার জ্ঞানরসে ভরপূর হয়ে থই থই করবে, ভরে উঠবে ফুল প্রজাপতি পাখীতে…। আমাদের দুজনকে নিমিত্ত খাড়া করে স্বয়ং পরমাপ্রকৃতি সে কাজ শুরু করে দিয়েছেন, অদূর ভবিষ্যতে সে কাজ তিনি নিশ্চয় সম্পন্ন করে ফেলবেন আশা করা যায়। আজ এই মুহূর্তে তাহলে বিশ্বকর্ম্মা, তাঁর পূজা ও অন্যান্য আচারাদির অর্থ নিষ্কাশন করে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক।
সমগ্র সমাজে যত ‘বিশ্ব-কর্ম্মী’ আছেন (যাঁরা মাটি কাঠ বা অন্যান্য কাঁচামালে বা ‘সৎ-প্রকৃতিতে’ নিজেদের শ্রম মেধা… ইত্যাদি প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার কাজ করেন), তাঁদের সমগ্র স্বরূপটিকে বিশ্বকর্ম্মা বলে। অন্য সকল পূজার মতো বিশ্বকর্ম্মা পূজাও এক ধরনের প্রতীকী আচরণ। বাস্তবে এই বিশ্ব-কর্ম্মীরা যা যা করেন, এবং তাঁদের সঙ্গে অন্য মানুষেরা যে সকল আচরণ করেন, তারই প্রতীকী আচার প্রথারূপে পালন করা হয় বিশ্বকর্ম্মা পূজায়। সেই কারণে, বিশ্ব-কর্ম্ম করা হয় যে হাতুড়ি, ছেনি, করাত, তকলি, ভ্রমর, ঢেরা, কাটারি… ইত্যাদি অজস্র হাতিয়ারের সাহায্যে, বিশ্বকর্ম্মা পূজার সময় সেই হাতিয়ারগুলিকে নানাভাবে সম্মান প্রদর্শন করা হয়, তাদের বিশ্রাম দিয়ে, ফুলপাতা ইত্যাদি দিয়ে নমস্কার করে। সম্মান প্রদর্শন করা হয় সর্বপ্রকার কলগুলিকে (যন্ত্র বা মেসিনগুলিকে), তা সে সামান্য অটো-রিক্সা, বাস, ট্যাক্সি থেকে শুরু করে বড় কলকারখানা যাই হোক। এমনকি বামপন্থী মিছিলে হাঁটা যে অটোওয়ালা যুবকটি বিশ্বকর্ম্মা পূজার দিন অটো বন্ধ রেখে তার অটোটিকে সকাল সকাল ধোয়াধুয়ি করে ফুল-পাতা দিয়ে নমস্কার করে, সে জানেও না, আমাদের দেশে যখন বিশ্বকর্ম্মা পূজার প্রচলন হয়, তখন অটো-বাস-ট্যাক্সি… এসব আবিষ্কার পর্যন্ত হয়নি। অথচ সে বোঝে, তার অটো-রিক্সাটিও বিশ্বকর্ম্মা-সত্তার কৃতিত্বের অংশই বটে। বিশ্বকর্ম্মাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব না করলে বাংলার হাতুড়ি-করাতের দোকানদারেরা সারা বাংলা জুড়ে তাঁদের যে সকল দোকান রয়েছে, সেগুলির অধিকাংশের নাম তাঁরা কি ‘বিশ্বকর্ম্মা ভাণ্ডার’, ‘বিশ্বকর্ম্মা স্টোর্স’… ইত্যাদি রাখতেন? আমরা ইংরেজি-শিক্ষিত আধুনিকতাবাদীরা এসব বুঝি না, বুঝতে পারি না।…
যাই হোক, সারা পৃথিবী জুড়ে এই যে নানা শ্রেণীর বিশ্ব (উৎপন্ন) স্রষ্টাগণ তাঁদের বিপুল পরিমাণ উৎপাদন করে চলেছেন এবং সেই সব উৎপন্নকে সমাজ আকাশে বা বাজারে ছেড়ে দিচ্ছেন, এ তো সাক্ষাৎ দেখা যায় না, অনুভব করে নিয়ে বুঝে নিতে হয়। এরূপ ‘অদৃশ্য কিন্তু সক্রিয়’ সত্তাকে বোঝানোর জন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা কেবলমাত্র বিশ্ব, বিশ্বকর্ম্মা… ইত্যাদি নতুন নতুন শব্দের সৃষ্টি করেননি, তার প্রতীক চিত্র ও প্রতিমা গড়েছেন, এবং তাঁর প্রতি প্রতীকী আচরণেরও ব্যবস্থা করেছিলেন, যা অর্থহীন প্রথা রূপে আজও প্রচলিত রয়েছে। বিশ্বকর্ম্মা পূজা এবং পূজার দিনে ঘুড়ি ওড়ানো সেই প্রথাই বটে। প্রশ্ন হল, এর উদ্দেশ্য কী ছিল?
আজ আমরা জানতে পারছি, এর উদ্দেশ্য ছিল– লোকে তথাকথিত লেখাপড়া জানুক আর নাই জানুক, তাঁরা যেন কর্ম্মীদের (= বিশ্বকর্ম্মার) অজস্র কর্ম্মফলগুলিকে (= পণ্যাদিকে) বাজারে উড়ে বেড়াতে দেখতে পান, এক শ্রেণীর পণ্যের দ্বারা অন্য এক শ্রেণীর পণ্যের উড়ে বেড়ানো রুখে দেওয়া দেখতে পান, (যথা, বাজারে উড়ে বেড়ানো প্রতিযোগিতায় বালুচরী শাড়ীর কাছে ধনেখালি শাড়ীর হেরে যাওয়া দেখতে পান) এবং সেটিকে গ্লানিমুক্ত মনে মেনে নিতে পারেন; মোটকথা জনসাধারণ যাতে, সারা সমাজ-আকাশ জুড়ে বিশ্বকর্ম্মার ও তাঁর কর্ম্মফলের উড়ে-বেড়ানো ঘুরে-বেড়ানো অখণ্ডভাবে দেখতে পান, সেই উদ্দেশ্যে প্রতীকী প্রথা রূপে ঘুড়ি-ওড়ানোর সূচনা করা হয়; ঘুড়ির ভোঁ-কাট্টা খেলার সূত্রপাত করা হয়। মধ্যযুগের পরেও বেশ কিছুকাল বাংলার সমাজমন এই প্রকার বোধের দ্বারা এত ব্যাপকভাবে জারিত ছিল যে, এসব কথা বুঝতে মানুষের অসুবিধা হত না। সমগ্র সমাজমন এইরূপ বিশ্ব, বিশ্বকর্ম্ম, বিশ্বকর্ম্মা ও সেই সকল কর্ম্মের ফলাফল বিষয়ক জ্ঞানে সম্পূর্ণরূপে জারিত ছিল। এমনকি সমাজমনের সেইরূপ মাটির উপর দাঁড়িয়ে লোকে কাব্য-সঙ্গীতাদি সৃষ্টি করত এবং লোকে সেসব বুঝতেও পারত। মধ্যযুগের শেষ সময়েও গায়ক-শ্রোতারা এসব অনায়াসে বুঝে নিতে পারতেন।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতা রামপ্রসাদ সেন সেই ঘুড়ি-ওড়ানোর ধারণাকে রপ্তানিকরণ পর্যন্ত উপলব্ধি করে নিয়ে তাকে ‘বাহ্যপণ্য-বিশ্ব’ লেনদেনের ধনলোক থেকে ‘রসপণ্য-বিশ্ব’ লেনদেনের জ্ঞানলোকে উন্নীত করে মহত্তম সঙ্গীত রচনা করে গেছেন। বোঝা যাচ্ছে যে, ‘জনসাধারণ’-এর (= মহামায়ার) ‘শ্রমিক, কারিগর… ইত্যাদি’ (= বিশ্বকর্ম্মা) অংশটিকেই যে কালী ও শ্যামা বলে, সেকথাও তিনি সুস্পষ্টভাবে জানতেন এবং সেই তত্ত্বের সাহায্যেই মানুষের জন্মান্তর ও মুক্তির তত্ত্বের অবতারণা করতে পারতেন । রামপ্রসাদ গেয়েছেন–
‘শ্যামা মা উড়াচ্ছে ঘুড়ি (ভব সংসার বাজার মাঝে)।
(ঐ যে) মন-ঘুড়ি, আশা-বায়ু বাঁধা তাহে মায়া দড়ি।।
কাক গণ্ডি মণ্ডি গাঁথা, তাতে পঞ্জরাদি নাড়ি।
ঘুড়ি স্বগুণে নির্মাণ করা, কারিগরি বাড়াবাড়ি।।
বিষয়ে মেজেছে মাঞ্জা, কর্কশা হয়েছে দড়ি।
ঘুড়ি লক্ষে দুটা একটা কাটে, হেসে দেও মা হাত চাপড়ি।।
প্রসাদ বলে, দক্ষিণা বাতাসে, ঘুড়ি যাবে উড়ি।
ভবসংসার সমুদ্র পারে, পড়বে গিয়ে তাড়াতাড়ি।।’
এর থেকে বোঝা যায়, রামপ্রসাদের যুগ পর্যন্ত তিনি ও তাঁর গানবোদ্ধা মানুষজন ঘুড়ি-ওড়ানোর রহস্যটি ভালোই জানতেন। একালে আমরা বিশ্বকর্ম্মা পূজা করি, ঘুড়ি ওড়ানোর খেলা খেলি, ভোঁ-কাট্টা করে অন্যের ঘুড়ি কাটি… কিন্তু কেন করি, তার কিছুই জানি না । কার্যত একালেও যে আমরা উৎপন্ন ও পণ্য উৎপাদক কর্ম্মের বা বিশ্ব-কর্ম্মের সাধনা করি, সেই কর্ম্মজাত পণ্য বাজারে উড়িয়ে দেওয়ার ক্রিয়ায়/ক্রীড়ায় মত্ত থাকি, একটি কোম্পানির পণ্য দিয়ে অন্য কোম্পানির পণ্যের উড়ে বেড়ানো রহিত করে দেওয়ার খেলা খেলি, সেকথা তো সত্যিই। কিন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আধুনিকতার দ্বারা দূষিত হওয়ার কারণে আমরা বাস্তবের প্রকৃত ঘটনার (ঘট > ঘুট > ঘুড় > ঘুড়ি) ঘুড়ি-ওড়ানোর খেলার সঙ্গে প্রতীকী বিশ্বকর্ম্মা পূজা, প্রতীকী ঘুড়ি ওড়ানোর কোনো সম্পর্ক এখন আর দেখতে পাই না । ভাবি, এসব সেকেলে লোকদের বোকা-বোকা প্রথামাত্র।
রামপ্রসাদের উপরোক্ত গানটি কি আধুনিক কবিদের কোনো নতুন পথ দেখায় না।…
আজ আমরা শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর মতো পূর্বসূরীদের প্রণাম জানাই। তাঁদের দিয়ে যাওয়া ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে আমরা দুজন সেই সব কথা কমবেশি জানতে পারছি এবং আপনাদেরও জানিয়ে দিতে পারছি।
টীকা :
1. দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের প্রতিটি বস্তুর ভিতরে চেতনা রয়েছে, একথা আমাদের পূর্বপুরুষেরা বহু প্রাচীন কাল থেকে জানতেন। ‘বিশ্ব’ শব্দটির ভিতরেই সেকথা ঢুকিয়ে রেখেছেন আমাদের প্রাচীন শব্দবিদেরা। কিন্তু তাতে কী! আমরা তো বহু প্রাচীন কাল থেকে জানতাম– গাছের প্রাণ আছে । যেদিন জগদীশচন্দ্র বসু সেকথাটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করলেন, তখনই কথাটি সর্বজনমান্য সত্যে পরিণত হল । অদূর ভবিষ্যতে জগদীশচন্দ্রের মতো আমাদের অপর কোনো উত্তরসূরী আসবেন, আশা করা যাক, যিনি ‘ধূলিকণার ভিতরেও চেতনা আছে’ – আমাদের এই বহুকালক্রমাগত বিশ্বাসটিকেও বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণ করে
সত্যে পরিণত করবেন।
2. এই ইতিহাস পাওয়া যায় আমাদের পুরাণাদি গ্রন্থে। আমরা উৎপাদন, উত্তানপাদ, কারুষ প্রভৃতি শব্দের ব্যাখ্যায় তার কিছু কিছু সংবাদ দিয়েছি। সেই সকল সংবাদ নিয়ে আমাদের দুজনের লেখা দুই খণ্ডে বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ গ্রন্থটি ইতোমধ্যেই
প্রকাশিত হয়েছে।
3. গ্রীক পুরাণে দেবতাদের কামার Hephaestus-এর কথা আছে। আমরা দেখেছি, ভারতীয় পুরাণাদির ক্রিয়াভিত্তিক পাঠের পর কেউ যদি গ্রীক ও রোমানদের পুরাকথা পাঠ করেন, তিনি অনায়াসে বুঝে যাবেন, আমাদের পুরাকথা ও ইউরোপের পুরাকথা আসলে একই পুরাকথা। পার্থক্য এই যে, আমরা সেটা পেয়েছি কমবেশি সমগ্রভাবে, এবং ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায়। আর, ইউরোপ তার অতীতকে পেয়েছে পোকায় কাটা শতচ্ছিন্ন ইতিহাস গ্রন্থের মতো, কাটা-কাটা, ছাড়া-ছাড়া, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। আজ আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আমাদের বিশ্বকর্ম্মার কাহিনীকে শতচ্ছিদ্র করে দিয়ে জলে-কাদায় চুবিয়ে নিলে দেখা যায়, সেটিই Hephaestus-এর কাহিনী হয়ে গেছে। তার মানে, Hephaestus-এর কাহিনীকে আমাদের বিশ্বকর্ম্মার কাহিনী দিয়ে পুনর্নির্মাণ করে নেওয়া যেতে পারে। তবে কথাটি তো শুধুমাত্র Hephaestus-এর ক্ষেত্রেই খাটে না, পাশ্চাত্যের সমস্ত
পুরাকথার ক্ষেত্রেই খাটে।