অর্জুন: আমাদের আজ ওরা এলিয়েন ভাবে।
এসবের সূত্রপাত ভন দানিকেন
করে কী যে বিপত্তির সূচনা হয়েছে!
আমাদের দিব্য অস্ত্র, সেগুলোকে ওরা
ভিনগ্রহী হাতিয়ার ভেবেছে এখন।
মন্দিরের আকৃতিতে স্পেসশিপ আছে-
যাতে চড়ে অ্যাস্ট্রোনট দেবতারা এসে
পৃথিবীতে নাকি ১ কলোনি গড়েছে!
শুনে তো মোহিত ওরা- এই ওরা চায়।
তার সঙ্গে মিশিয়েছে কাহিনিও কিছু।
তুমি নাকি রক্তে আছো চেঙ্গিস খানের-
তোমার যে দিগ্বিজয় কৌরবের হয়ে,
মঙ্গোলিয়া নাকি সেই পথে পড়েছিল-
‘কর্ণ’ শব্দ থেকে তাই খান-এর পদবি,
এসব থিওরি আজ বেশ প্রচারিত।
জানো দাদা শুনে বেশ চিন্তিত হয়েছি।
আমাদের সামর্থ্য ও বল নিয়ে ওরা
আজ শেষে এ-রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে!
হিরোদের সীমা বোঝে সে ক্ষমতা নেই।
হিরোশিমা-কুরুক্ষেত্র ঘুলিয়ে ফেলেছে।
কর্ণ: এত কিছু! কার মুখে শুনেছিস তুই?
অর্জুন: সহদেব বলেছিল এই তো সেদিন।
ইউটিউবের কিছু ডকুমেন্টারির
এই হল আকর্ষণ- বহু লোক দ্যাখে।
যদি কেউ সার্চ করে ‘এলিয়েন গডস’-
এসবের খোঁজ আজ অতীব সহজ।
ও খুব নজর রাখে পৃথিবীর দিকে-
কী চলেছে সারাদিন জানায় আমাকে।
পৃথিবীর প্রতি ওর টান রয়ে গেছে-
কিছুটা প্রেমের মতো মনে হয় যেন।
কলিযুগ আজ প্রায় পচে গলে গ্যাছে-
আমি আর তাই অত খবর রাখি না-
ভালো কোনো বই পেলে পড়ে-টড়ে দেখি-
কুন্দেরা বা পামুকের লেখা যদি পাই।
বেশ কিছু সিনেমাও দেখা হয়ে গেছে।
কিন্তু যদি পলিটিক্স- সে আর বোলো না,
সবকিছু বড় বেশি খেলো মনে হয়।
সহদেব শুনি নাকি আছে ফেসবুকেও-
কোন এক রমণীর ফেক প্রোফাইলে।
আমেরিকা থেকে এক দামি মোবাইল
একিলিস ওকে কিনে এনে দিয়েছিল।
কী করে ওসব করে শিখিয়ে দিয়েছে।
একিলিস মেয়ে সেজে সেক্স চ্যাট করে।
সহদেব যেন এক জগত পেয়েছে।
মাথাখানা কিন্তু ওর পুরোপুরি গেছে-
দিনরাত মেতে আছে ফেসবুক নিয়ে।
মুখে বলে খুঁজে নেবে আজ অশ্বত্থামা
পৃথিবীর কোন দেশে লুকিয়ে রয়েছে।
সেও নাকি ফেসবুকে উঁকিঝুঁকি দেয়।
তাকে খুব লজ্জা দেবে সহদেব চায়।
ওসব অছিলা দাদা। আসলে মজেছে।
কর্ণ: সহদেব মজে গেল! এ কী করে হয়!
ও তো ছিল সবচেয়ে ধীরস্থির ছেলে।
যুধিষ্ঠির জুয়া পেলে সব ভুলে যেত-
কিন্তু সহদেব ছিল দূরের পথিক।
বরং নকুল হলে মেনে নেওয়া যেত,
বিস্ময়ের কিছু নেই দুঃশাসন হলে-
দুর্যোধন ওর মাথা চিবিয়ে খেয়েছে,
নিজের চরিত্র কিছু বজায় রেখেছে-
ভাইটাকে অধঃপাতে পাঠিয়ে দিয়েছে।
অর্জুন: সঙ্গদোষ। এছাড়া তো অন্য ব্যাখ্যা নেই।
একিলিস ওর খুব ভালো বন্ধু আজ।
তার সঙ্গে ভিড়ে গেছে ওডিসিয়াসও।
গ্রিসের চরিত্র তুমি ভালো করে জানো।
কাম আর ক্রোধ ওরা উদ্যাপন করে।
যাকে পাও মেরে দাও, যাকে পাও শোও-
দ্বাপরের রীতি ওরা জানে না মানে না।
স্বর্গ হোক মর্ত্য হোক কোনো ভেদ নেই।
কর্ণ: এ-কথাটা ঠিক নয়। ওরা মহাপ্রাণ।
সরল হিংস্রতা সে কি ভীমেরও ছিল না?
ঊরু ভেঙে ভ্রাতাবধ, কিংবা রক্তপান-
একিলিস নৃশংসতা অত তো করেনি!
প্রিয়মের কান্না দেখে হেক্টরের দেহ
নিজের চোখের জলে ফিরিয়ে দিয়েছে।
সহদেব বন্ধু ওর- জেনে গর্ব হয়।
বর্শার নিক্ষেপ বল, কিংবা তরবারি
একিলিস একাকী তো ত্রিশের সমান-
হেক্টরও তো উড়ে গেছে, দাঁড়াতে পারেনি।
ওর পরাক্রম দেখে কলিযুগ নয়-
ত্রেতার বা দ্বাপরের লোক মনে হয়।
দ্বাপরের অস্ত্রশক্তি যদি পেয়ে যেত-
তবে ও তো আমাদের কম কিছু নয়।
গোড়ালির দুর্বলতা মেরে দিল ওকে।
প্যারিসের সঙ্গে আমি কথাও বলিনা-
লাশ সেজে খুন করে! গুপ্তহত্যা করে!
ও যে সেই মহাবীর হেক্টরের ভাই,
মহারাজা প্রিয়ামের প্রিয় ছোট ছেলে-
ভেবে শুধু ঘেন্না হয়, করুণাও নয়।
ট্রয় ধ্বংস হল ওর মিথুনের লোভে।
হেলেনের মুখে ওর কোন স্বপ্ন ছিল?
আমার তো ওই মুখ কদর্য লেগেছে!
শুধু যেন তীব্র এক ফুল ফুটে আছে-
ছিঁড়ে নিলে খুশি হবে, দলে-পিষে দিলে।
অর্জুন: হেলেন তো প্রিয় সখী আজ দ্রৌপদীর।
আর মহারানী সীতা- বেশ জমে গেছে।
ওরা খুব মেনে চলে দ্রৌপদীর কথা।
কর্ণ: ওদের যে জমে যাবে সে তো স্বাভাবিক!
নারীর যৌনতা ছাড়া মহাকাব্য নেই।
দ্রৌপদী ছাড়া কি কোনো কুরুক্ষেত্র হত!
সীতা ছাড়া রামায়ণ হত না কখনও।
হেলেন অছিলা ছিল ট্রয়ের পতনে।
অ্যাম্বিশন পূর্ণ হল অ্যাগামেমননের।
যে কোনো জোটের হয় এক পরিণতি।
নেতার আকাঙ্ক্ষা সব, বাকি অর্থহীন।
দুর্যোধন হেরেছিল। রাম জিতেছেন।
অর্জুন: দুর্যোধন আর রাম! কী করে মেলাও!
কর্ণ: মেলাই কারন ওরা সাম্রাজ্য চেয়েছে!
দুজনেই নিজেদের স্বার্থের অধিক
সম্রাট হিসেবে ঠিক কর্তব্য করেছে।
দুজনেই অবিচল রাষ্ট্রধর্ম যদি
চরম পরীক্ষা চায়- অকাতরে দেবে।
ভেবে দ্যাখ কতখানি রাষ্ট্রনিষ্ঠ হলে
সীতার মতন স্ত্রীকে ত্যাগ করা যায়!
কলিযুগে রাঘবের ওই আচরণ
আলোচ্য হয়েছে আর ধিক্কার পেয়েছে।
কলিযুগে অচল তো ত্রেতার আইন-
কী করে বিচার করে, কোন অধিকারে!
সম্রাট ছিলেন রাম, গেরস্থ তো নয়!
দুর্যোধন রাজা ছিল। দ্বাপরের রাজা।
তোরা শুধু চেয়েছিলি পাঁচখানি গ্রাম!
সেটাও দিল না দ্যাখ, যুদ্ধ মেনে নিল।
সুচের আগার মাটি সাম্রাজ্যের চেয়ে
কোনো অংশে কম নয়, কূটনীতি বলে।
গৃহস্থের নীতি নয় সম্রাটের নীতি-
বিনাযুদ্ধে এক কণা মাটিও না দেওয়া।
যদি দেয় ভিক্ষা দেবে, প্রাপ্য বলে নয়।
কুরুক্ষেত্রে যদি হত কৌরবের জিত-
দুর্যোধন রাম হত, আমি হনুমান,
আর শকুনির স্থান কৃষ্ণের বদলে-
সভাকবি জেনে রাখ লিখে রেখে যেত।
রাজার ঈশারা বুঝে কত শত শ্লোক
ডিলিট করেছে ব্যাস- হিসাব কী আছে?
তার সঙ্গে রাশি রাশি ব্যাসকূট মিলে-
মহাভারতের পাঠ দুঃসাধ্য করেছে।
দুর্যোধন যোগ্য রাজা, যুধিষ্ঠির নয়-
এ বিশ্বাস আজও আমি টলাতে পারিনি।
যুধিষ্ঠির ভীরু লোক। দৃঢ় শাসকের
গুণ তার মধ্যে খুব অল্পই তো ছিল।
দুর্যোধন ডিক্টেটর, কিন্তু সু-শাসক,
যদিও সে কথা জেনে গোবিন্দকে আমি
ব্যর্থ করে দিতে পারি- ক্ষমতা ছিল না।
পৃথিবীকে ভারমুক্ত করেছেন উনি-
যথার্থ শাসন তার পরের বিষয়।
অর্জুন: ডিক্টেটর দক্ষ হলে রাষ্ট্রের চেহারা
বাহিরে বাহিরে খুব ঝলমল করে।
আজও লোকে স্বর্ণলঙ্কা বলে-
সোনার অযোধ্যা কিন্তু কারো মুখে নেই।
কর্ণ : রাবণ আদর্শ আজও অনেকের কাছে।
আজও উপাসনা হয় মহিষাসুরের।
হিটলার স্তালিনের সে পূর্বপুরুষ।
যুদ্ধের আগের সেই জার্মানির ছবি,
অথবা রাশিয়া দ্যাখ সোভিয়েত যুগে-
বিশ শতকের ওরা দুই লঙ্কাপুরী।
উপরে উপরে সব কত ঝলমলে!
যেন কোনো কষ্ট নেই সমাজ-সংসারে!
রাষ্ট্রের উন্নতি শুধু- বাকি তুচ্ছ সব।
ভেতরে ভেতরে কিন্তু ফাঁপা হয়ে ছিল।
তবুও তো শক্ত রাজা বাহিরের রূপে
কিছুটা সম্মান তার রাজ্যে বয়ে আনে।
শাসক দুর্বল হলে ভিতরে বাহিরে
লোকে শুধু হাসে আর উপহাস করে।
শাসকের পায়ে মেকি হাওয়াই চপ্পল
প্রগতির পথে আজও মানানসই নয়।
অর্ধনগ্ন ফকিরের ভেক ধরে কেউ
অবিশ্যি ঠকাতে পারে, অসম্ভব নয়,
কিন্তু তাতে জনগণ প্রতারিত হলে-
রাষ্ট্রের কপালে গাঢ় অন্ধকার নামে।
রাবণের তেজ থেকে মুক্তি হল বটে,
বিভীষণ রাজা হতে পৃথিবী কী পেল?
জ্ঞান আর বিজ্ঞানের স্বর্ণলঙ্কাপুরী
মাথা তুলে বহুকাল দাঁড়াতে পারেনি।
অর্জুন: কুরুক্ষেত্র যুদ্ধও তো এই পৃথিবীকে
ক্ষত্রিয়ের ভার থেকে মুক্ত করেছিল।
ধর্মের বিজয়ে হল ধারণ সুগম।
ভীষ্ম, দ্রোণ, দুর্যোধন, এই বসুষেণ
সেই লক্ষ্য পূর্ণ করে প্রাণ দিয়েছিল।
সন্তানের মৃতমুখ দেখেছি অনেক।
পরম শ্রদ্ধেয় কত আত্মীয়ের দেহ
শেয়ালে কুকুরে মিলে ছিঁড়েছে দেখেছি।
কিন্তু কিছুই কি তাতে সুরাহা হয়েছে?
মাধবের মৃত্যু হল। কলিযুগ এল।
সব ছিল উপন্যাস- আজ মনে হয়।
কর্ণ: এ যুগে বীরত্ব নেই, আছে শুধু জোর।
আছে শুধু লোভ আর আছে শুধু ভয়।
পেশিশক্তি পশুশক্তি এক হয়ে গেছে।
কলিযুগে ট্রয়যুদ্ধ- কত অর্থহীন!
দেশে ফিরে ভেবে দ্যাখ, অ্যাগামেমননের
কী কুৎসিত মৃত্যু হল মহিষীর হাতে!
জেগে আছে আজও কিন্তু বীর একিলিস,
বেঁচে আছে দীপ্ত হয়ে হেক্টরের নাম।
ইউলিসিস আজও শুধু ভ্রমণ পিপাসা।
ওরা ছিল মহীরুহ। দীর্ঘ কিছু প্রাণ-
দ্বাপরের স্মৃতি যেন মনে এনে দেয়।
প্যারিস কিছুই নয়- চালাক লম্পট।
মুখশ্রী দারুণ ওর, খুবই সুপুরুষ।
কিন্তু কোনো কাপুরুষও প্যারিসের চেয়ে
এ জীবনে আমি ভাই কখনো দেখিনি।
ঘেন্না ছাড়া ওকে কিছু দিতেও পারিনি।
অর্জুন: সুপুরুষ তুমি কিছু কম ছিলে নাকি!
অস্ত্র পরীক্ষার দিন তোমাকে দেখে তো
শিলা ও সবুজে ঢাকা পর্বতের মতো
দুর্জ্ঞেয় অজেয় এক পুরুষ ভেবেছি।
যেন এক দীপ্ত ষাঁড় মানুষের রূপে!
কিন্তু সে তো ফেলে আসা জীবনের কথা!
এ জীবন নয় দাদা। পৃথিবীর বলো।
হাজারে হাজারে এত বছর কেটেছে,
পৃথিবীর প্রতি আজও অনুরক্ত তুমি।
কিছু যেন পড়ে আছে ওখানে তোমার।
প্যারিসের প্রতিই বা এত রাগ কেন?
কথা তো হচ্ছিল আজ ফেসবুক নিয়ে!
যাই বলো, সহদেব সুস্থ নয় আজ।
একিলিস গ্রিক লোক। ওর সয়ে যাবে।
শিশুর সারল্য নিয়ে বেঁচে থাকে ওরা।
কর্মফল-টল নিয়ে কিছুই ভাবে না।
দিব্যাস্ত্র ধারণ করে অন্য জগতের
মহাজাগতিক দায় ছিল না ওদের।
বেড়াল যেভাবে খেলে ইঁদুরকে নিয়ে-
ওরা মৃতদেহ নিয়ে স্রেফ খেলা করে।
সহদেব অন্য এক পৃথিবীর লোক।
ভিন্ন দেশ। ভিন্ন ধর্ম। ভিন্ন আচরণ।
সংস্কৃতির ভেদ সে তো তুমি ভালো জানো।
ক্ষত্রিয় ও শূদ্রের সংস্কৃতির ভেদ-
প্রতাপ ও দলিতের সম্পর্কের বিষ-
পৃথিবীতে আজীবন খেয়েছে তোমাকে।
রাষ্ট্র আর জীবনের সমান দু-টান-
ছিঁড়ে গেছ তুমি এক বিপ্লবীর মতো।
জন্ম যে কিছুই নয়, যাপন আসল-
পৃথিবীকে সেই বাণী শিখিয়েছ তুমি।
কর্ণ: পৃথিবীর টান তাই আজও টের পাই।
ইচ্ছে করে নেমে যাই, কাজ করি কিছু।
বিপ্লবের যে আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ রয়েছে,
গিয়ে আজ পূর্ণ করি, হাতে অস্ত্র নিই।
অস্ত্রের আঘাত নামে- যোদ্ধাটির নয়-
অস্ত্রটি স্বয়ং যেন গন্তব্যকে বাছে-
অস্ত্র তাই যোদ্ধাটির আত্মার দোসর।
প্রতিযোগিতার নেশা জীবনের শেষে
কেটে গেছে। আর নেই। কারন জেনেছি
প্রতিযোগী কোনোদিন মেলেনা ভুবনে-
আজ জানি তুই ছিলি অন্য এক ‘আমি’-
যেহেতু আমার কোনো পরিসীমা নেই-
দর্পণ হিসেবে তোকে পেতে হয়েছিল।
‘আমি’ নামে কেউ নেই যদি জেনে যাই।
যুদ্ধ তো আসলে এক অভিনয় শুধু-
শুধু এক খেলা যাকে ঠিকভাবে খেলে
নিজের ভূমিকাটুকু রেখে যেতে হবে।
বিপ্লবের রক্তপাত- শুধু খেলা নয়,
অন্য এক পৃথিবীর স্বপ্ন যে সেখানে।
অর্জুন: চে গ্যেভারার মৃত্যু- তার দুটো চোখ-
বিপুল বৃক্ষের মতো- ঝড়ের আঘাতে
নিহত সে- পড়ে আছে সটান তাকিয়ে-
আমার তো মনে হয় ওই মৃতদেহ
কুরুক্ষেত্রে রাধেয়র শবের মতন।
কিংবা কোনো সূর্য সেন- নেতাজী সুভাষ-
কলিযুগে আমি যেন রাধেয়কে পাই।
ভুল পথ নিয়েছিল ওরা ইতিহাসে-
উদ্দেশ্য মহৎ ছিল- সঙ্গী আর প্ল্যান
সঠিক চয়ন করা হল না ওদের।
তুমি সেই একই ভুল করেছ জীবনে-
দুর্যোধন রাজা হলে তোমার কথায়
জন্মের বদলে শুধু কর্মের সুবাদে
মানুষের সামাজিক অধিকার দেবে-
তুমি হবে অগ্রদূত সেই বদলের-
এ আশা করাটা খুব বোকামি তোমার।
আজও সেই খেদ নিয়ে বসে আছো তুমি।
কর্ণ : আমি জানি পৃথিবীতে কিছু পিপাসাকে
ফেলে রেখে আজ এই স্বর্গলোকে আছি।
টের পাই, আজও সেই অতৃপ্ত রয়েছি।
অর্জুন: কিন্তু দাদা সে জীবন আজ আর নেই।
কর্ণ : ফেলে আসা শরীরের ক্ষতগুলো নেই-
কিন্তু কিছু তীক্ষ্ণ ব্যথা আত্মায় রয়েছে।
যত বলি ‘আমি’ নেই- চেতনার মূলে
আমিত্বের বোধ এসে কড়া নেড়ে যায়।
লক্ষ্মণের চেয়ে তাই ইন্দ্রজিৎ প্রিয়।
সৌমিত্রর শৌর্য ছিল প্যারিসের চেয়ে।
কিন্তু ইন্দ্রজিৎ বধ হাস্যকর কাজ।
রাবণের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল আজও।
রাম আর লক্ষ্মণের আমি বন্ধু নই।
আজও আমি একিলিস কিংবা হেক্টরের
যতটা বন্ধুত্ব চাই, প্যারিসের নয়।
একিলিস শত্রু হলে আমি যুদ্ধ করে
প্রাণ নিয়ে প্রাণ দিয়ে গর্বিত হতাম।
কুরুক্ষেত্র সেই তৃপ্তি আমাকে দিলনা।
মৃত্যুকে জিতেছি ঠিকই, তৃষ্ণা রয়ে গেছে।
জন্মের অধিকারে অপমান ছাড়া
জীবনে যখন আমি পাইনি কিছুই-
সামর্থ্যের অধিকারে তবে ভোর হোক-
সমাজে বদল আমি একা এনে দেব-
এ-শপথ নিয়ে হাতে ধনুক ধরেছি,
নিজের মস্তক শেষে উপহার দিয়ে
সেই ব্রত হাস্যকর যবনিকা পেল।
আমার উদ্দেশ্য যে কী দুর্যোধন তার
বিন্দু বা বিসর্গ কিছু বোঝেনি তা জানি।
ওর কত চাতুরিতে সহায় হয়েছি-
আমিই ছিলাম ওর দর্পের কারন।
ভীম আর পাঞ্চালীর অপমান নিয়ে
সারাটা জীবন জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে
জীবনের শেষে এসে আত্মপরিচয়
গোবিন্দের মুখে আমি যখন শুনেছি
বুঝেছি এতই দেরি ঘটে গেছে আর
পিছু ফিরে তাকাবার অবকাশ নেই।
দুর্যোধন ছিল বাঘ- তার পিঠে চড়ে
নতুনের আশা করা নির্বুদ্ধিতা ছিল।
অনেক অপ্রাপ্য মৃত্যু ঘটিয়ে ফেলেছি।
প্রতিশোধ ঠান্ডা এক খাবারের নাম-
উনুনে যতই তাকে গরম রেখেছি
প্লেটে এসে পৌঁছতেই বাসি হয়ে গ্যাছে-
জিভে এলে তার আর আকর্ষণ নেই।
শুধু তোর প্রিয় পুত্র অভিমন্যু নয়,
আজও আমি অনুতপ্ত- কেন ঘটোৎকচ-
আমার হাতেই তার মৃত্যু লেখা হল!
কুরুক্ষেত্রে তার ওই ভূমিকাই ছিল।
এই তাপ অর্জুনের বোধগম্য নয়।
তুই ছিলি ব্যাটম্যান। আমি তো জোকার!
শরীরের দাগ লাগা কবচের ব্যথা-
সে ব্যথা কি শরীরের! সে তো শুধু স্মৃতি!
শরীর মিলিয়ে যায়, স্মৃতি রয়ে যায়।
প্রেতলোক এক ফাঁকা স্মৃতির পৃথিবী।
পাঁচতারা বিপুল এক হোটেলের মতো
এখানে আয়েশ আছে। শান্তি কিছু নেই।
অর্জুন: পৃথিবীতে গোবিন্দের কথায় চলেছি-
সব ধর্ম বাদ দিয়ে শরণ নিয়েছি।
গাণ্ডীব আমার হাতে, ছিলা তো উনিই।
কিন্তু দাদা এই হাত সেই হাত নয়।
স্মৃতি শুধু প্রতারক, তুমি কি জানো না?
অভিমন্যু মরেছিল যে তোমার হাতে-
আমি তো সে কথা আর মনেই রাখি না।
আজ ও তো রাধেয়র ভক্ত হয়ে গেছে!
ও তোমাকে সূতপুত্র রূপে ভালোবাসে
বাকি সব পরিচয় মিথ্যে ওর কাছে।
ভীষ্ম নয়, ভীম নয়, যুধিষ্ঠির নয়-
এমনকি আমারও খুব দাম-টাম নেই-
তুমি ওর আইডল, তুমি ধ্যানজ্ঞান।
কৃষ্ণের চেয়েও তুমি ফেভারিট ওর।
সপ্তরথী ঘিরেছিল, কিন্তু শুধু তুমি
ভেবেছিলে যাতে ও না বেশি কষ্ট পায়।
বীরগতি দিতে শুধু তুমি নাকি জানো।
কর্ণ: যেভাবে শূকর মারে বনের জাতিরা,
ওরা চেয়েছিল ওকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে,
গলা থেকে আর্তনাদ টেনে বের করে
পান্ডবের মনোবল পুরো ভেঙে দিতে,
যাতে তোর যুদ্ধে আর স্পৃহাই না থাকে।
তার আগে জেনে গেছি ওর পরিচয়-
তাই ওকে ছেড়ে দিই প্রথম সুযোগে-
দুর্যোধন রেগে যাবে যদিও জানতাম।
মরার মুহূর্তে আমি যখন তাকাই-
অভিমন্যু চেয়ে ছিল- কৃতজ্ঞ দু-চোখ।
সে কথা ভোলেনি আজও, ভেবে স্বস্তি পাই।
সে তো পুত্র বৃষসেন আজ তোর প্রতি
কোনো তিক্ততাই আর বহন করেনা।
তুই তাকে মেরেছিলি, এ তার গৌরব-
বলে, ‘অন্য কেউ নয়, জোর বেঁচে গেছি।
কর্ণের ছেলেকে যদি কেউ মারে তবে
একমাত্র লোক ছিল কাকা ধনঞ্জয়।’
ওকে কিন্তু মেরেছিলি, স্বরূপ না জেনে-
আমার কষ্টটা তুই একবার ভাব!
অর্জুন: আর আমি? ভাবো দাদা যখন জেনেছি
মহাবীর বসুষেণ অগ্রজ আমার-
আমি তাকে অসহায় নিধন মার্ডার করেছি-
নিরস্ত্র সে, রথে নেই, পিছু ফিরে আছে…
অর্জুনের নামে আজও সন্তানের নাম
ভারতে রাখে না কেউ বাঙালিরা ছাড়া।
করন নামের ছেলে অসংখ্য রয়েছে
হিন্দি বলয়ের সব প্রদেশগুলোতে।
করন জোহর ভাবো- সে তো সেলিব্রিটি।
যত বলি ভুলে গেছি, স্বর্গলোকে এসে
কিছু খেদ কোনোদিন রেহাই দেবে না।
কর্ণ : কেন এত দুঃখ তোর? কিসের মার্ডার!
অনেকে বুঝেছে ওটা আত্মহত্যা ছিল।
তুই আমি জানি ছিল আত্মবলিদান।
গোবিন্দের অভিপ্রায় যা ছিল, ঘটেছে।
কেউ হত্যাকারী নই, কেউ নই হত-
দুজনেই অভিনেতা ওঁর নাটকের।
তোর পরাজয় চেয়ে সেদিন লড়েছি।
কিন্তু তোর মৃত্যু হলে বৃথা হত সব!
তোকে না হারালে ওই জীবনের কোনো
অর্থ বুঝে পৃথিবীকে ছাড়া তো হত না।
কিন্তু তোকে মেরে দিলে গোবিন্দের ব্রত
মিথ্যে হয়, পৃথিবীর ভার রয়ে যায়।
কর্ণ যদি বেঁচে থাকে কুরুক্ষেত্রে তবে
দুর্যোধন জয়ী হবে, গোবিন্দের হার।
তখন ভাবিনি পরে কলিযুগ এলে
কোনো বলিদান আর স্থায়ীই হবে না।
ভাবিনি বিপ্লবের ওটাই নিয়তি-
হাস্যকর হয়ে যায় বিপ্লবের ফল।
মা ফলেষু কদাচন- অতএব শুধু
যুগান্তের শর্তে দেব প্রাণবলি আমি-
ভীষ্মের মতন আর দ্রোণের মতন-
আকস্মিক আক্রমণে গাণ্ডিব খসিয়ে
সংজ্ঞাহীন রেখে তোকে রথ থেকে নেমে
চাকা নিয়ে বহুক্ষণ অভিনয় করে
বুঝেছি যখন তোর সম্বিৎ ফিরেছে,
কানে এল গোবিন্দের শেষ শব্দগুলো-
‘পাপীটিকে বধ করো, আর দেরি নয়!’-
ফিরে যে তাকাব তার সময় মেলেনি-
তৎক্ষণাৎ ঘাড়ে এক তীক্ষ্ণতম ছোঁয়া-
মাথা কেটে পড়ে গেল বিনা বেদনায়।
লোকে বলে মৃতমুখে সূর্যতেজ ছিল-
ধূলায় লুন্ঠিত মাথা- কিন্তু অমলিন-
খোলা চোখ সরাসরি- দৃষ্টিতে শুনেছি
কোনো গ্লানি কোনো খেদ নজরে আসেনি।
নিজের শবের ব্যাখ্যা অন্যদের মুখে
শুনেছি কারন আমি নিজে তো দেখিনি।
সূর্যদেব সে সুযোগ দিলেন আর কই!
অঞ্জলিক মেরেছিলি, সম্মানিত আমি।
সামান্য অস্ত্রে তো মৃত্যু ঘটেনি আমার।
গোবিন্দকে তৃপ্ত করে কোনো খেদ নেই।
হারাবারও কিছু নেই। ছিল কর্মফল।
চয়েসের খেলা শুধু। আকাঙ্ক্ষার খেলা।
দুজনে চেয়েছি যেটা পেয়েও গিয়েছি-
আমার বিজয় হল। তোর শত্রুনাশ।
বলিদান তোরও ছিল- সেও কম নয়।
আমি যদি প্রাণ দিই, তুই তবে দিলি
বীরত্বের অহংকার, যোদ্ধার সম্মান।
আমার আয়ূধে যদি মৃত্যু তোর হত-
তাতে কোনো পরাজয় অপযশ ছিল না তো তোর।
হত্যার কলঙ্ক নিয়ে গোবিন্দের পায়ে
অগাধ অঞ্জলি কিন্তু দিয়েছিস তুই!
ফলের প্রত্যাশা ভুলে ওই আত্মত্যাগ-
ওর তুল্য পৃথিবীতে খুবই কম আছে।
অর্জুন : আমার ভেবেছ তুমি কেমন বেজেছে!
মৃত্যু ঢের শ্রেয় ছিল ও গ্লানির চেয়ে।
প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ যদি পৃথিবীতে থাকে-
জানতাম তুমি ছাড়া আর কেউ নয়।
শত্রু তো পেয়েছি আমি না চেয়ে অনেক-
যোগ্য কোনো রাইভ্যাল আর তো মেলেনি।
একলব্য সরে গেল গুরুর কৌশলে-
নিজের ছেলের শিক্ষা- সেখানেও তিনি
শিষ্যকে বঞ্চিত করে কিছুই দেননি-
অশ্বত্থামা রয়ে গেল আমার পেছনে।
শুধু তো তুমিই ছিলে ষাঁড়ের মতন
একরোখা হিংস্র তেজী- ক্রোধের আগুন
মুখে নিয়ে ভিড়ে যার প্রবেশ ঘটেছে।
রাজপুত্র নও তুমি। লালনে পালনে
প্রশ্রয়ের ছিটেফোঁটা কোথাও ছিল না।
কী করে ধনুক পেলে রহস্য সেটাই!
সারথির ছেলে হয়ে বেড়েছ বেঁচেছ-
কী করে যে হলে তুমি শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর!
গোবিন্দের কথা মেনে সেখানেও ছল!
যোগ্যতর যোদ্ধা তুমি সকলেই জানে…
শেষ যুদ্ধে হেরে গেছি, আমিও তা জানি।
বীরত্বের অভিমান ভুলিয়ে কেশব
যা বলেছে আমি শুধু তাই করে গেছি।
কর্ণ: কিন্তু কিছু লোক আছে, আজও তারা ভাবে
কর্ণ আর ধনঞ্জয়- কার শৌর্য বেশি।
মৃত্যু হল পরাজয়, বেঁচে থাকা জয়-
এই হল কলিযুগে জীবন দর্শন।
তারপরে বিপ্লবের স্বপ্ন দ্যাখে লোকে!
গীতাকে ওরাই আজ ধর্মগ্রন্থ ভাবে।
কিন্তু সে যে কোন ধর্ম, হিন্দু কাকে বলে-
সে কথা তো বহুকাল ধুয়েমুছে গেছে!
আদালতে হাত দিয়ে মিথ্যে কথা বলে,
বাড়িতে রেখেছে যাতে প্রেতাত্মা না আসে।
তবে বলি বীরত্বের পরোয়া না করে
গোবিন্দের সব কথা মেনেছিলি তুই-
এটা কিন্তু তোর কোনো দুর্বলতা নয়।
তোর পাশাপাশি উনি আমারও সারথি।
আমার গীতার কথা পৃথিবী জানেনি-
ভীষ্মের যে গীতা ছিল, দ্রোণের যে গীতা-
সেসবের প্রচলন হল না ওখানে-
জুডাসের গসপেল হয়ে রয়ে গেল।
ওগুলো যে আত্মবলি, কজন বুঝেছে!
ব্যাসদেব সে সুযোগ দিতে ভুলে গেছে।
তুই-আমি জিতে গেছি দুজনে মিলেই-
সূর্যাস্ত হলেই কিন্তু সুর্যোদয় জেতে-
দুইয়ে মিলে ধন্য হয় সূর্যের জীবন।
ওই দ্যাখ… চেনা চেনা… কে যেন চলেছে…
মুঘল পোশাক আছে… শাহজাদা দারা?
খুব কম দেখা পাই, লুকিয়েই থাকে।
কথা তো বলে না কিছু, দেখে সরে যায়।
কী বলিস, ডাকি ওকে?
অর্জুন: যদি আসে, ভালো।
কর্ণ: শাহজদাদাআআআআআ একবার আসুন এদিকে…
দারাশুকো: মেঘের লক্ষণ নেই! গর্জন কিসের!
কর্ণ: অস্ফূটে কী যেন বলে চলে গেল সেই…
অর্জুন: অত জোরে ডাকে নাকি! কী যে করো তুমি!
কিছু পরে দেখা পাবে আলমগীরের।
দাদাটি যেখানে যান আজকাল উনি
পেছনে যান, সকলে দেখেছে।
কর্ণ: এ আর কিছুই নয়। অপরাধবোধ।
অর্জুন: স্বর্গ আর অপরাধ! কী যে বলো দাদা!
ও-দুটো তো একসাথে মেলাতে পারিনা!
কর্ণ: মেলানোর কিছু নেই। মিলেই রয়েছে।
স্বর্গ শুধু মাত্রাভেদ, আর কিছু নয়।
গুণের ফারাক কিছু আমি তো দেখিনা।
এখানেও সকলেই মুক্তি পেতে চায়।
নাহলে এখানে এত শুষ্ক মুখ কেন?
কেন আজ নত চোখ আলমগিরের?
ভীম আর দুর্যোধন- বাক্যালাপ নেই।
একিলিস যদি থাকে, প্যারিস সেখানে
ঢুকেছে এমন তুই দেখেছিস, বল?
নাথুরাম কিন্তু আজও মোহনদাসের
সঙ্গে তীব্র তর্ক করে, সেটা তো জানিস?
অর্জুন: যুধিষ্ঠির যদি হন দুর্বল শাসক,
শাহজাদা দারাশুকো সম্পর্কে কী বলো?
সাম্রাজ্যে তবে তো হক আউরঙ্গজেবের-
যেহেতু কঠোর তিনি, অনেক নির্মম?
তবে ওঁর ভ্রাতৃহত্যা অন্যায় কী করে?
কর্ণ: এটা কিন্তু কলিযুগ, ভুলেছিস নাকি?
দ্বাপরের রাজধর্ম এখন অচল।
যুধিষ্ঠির পেয়েছিল সত্ত্বগুণ শুধু,
রজোগুণ অল্প ছিল, প্রমাণ করেছে-
পাশা খেলে সব হেরে, শল্যকেও মেরে।
কিন্তু তমোগুণ ওর কিছুই ছিল না।
দ্বাপরে সম্রাট হতে তমোগুণ চাইই।
দয়ামায়া কত ছিল, সত্যবাদী কত-
ওসব শাসনে কোনো প্রসঙ্গ ছিল না।
অর্জুন: কিন্তু দাদা শাসন তো অন্ধকার নয়!
কর্ণ: অন্ধকার কাটা যেত অন্ধকার দিয়ে।
কেশবের কথা ভাব, কত ছল ওঁর!
প্রয়োজনে যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে যেতেন।
যে কোনো কৌশলে যদি শত্রুনাশ হত-
নৈতিকতা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।
কিংবা ভাব কত হিংস্র জরাসন্ধ ছিল!
তাকে পরাজিত করে আনন্দ পেয়েছি-
কিন্তু সেও দক্ষ ছিল শাসক হিসেবে।
তমোগুণ তাকে সেই দক্ষতা দিয়েছে।
সে যুগের কোনো রাজা যুধিষ্ঠির নয়।
প্রত্যেকে পেয়েছে তার আঁধারের জোর।
আর ছিল রজোগুণ- মেজাজ হিসেবে।
রাজার মেজাজে হত আসল শাসন,
মর্জি খুব খেটে যেত, সে সুযোগ কম।
মন্ত্রী ছিল, সেনাপতি, অমাত্য অনেক-
ব্যুরোক্র্যাসি জারি ছিল রাজা অনুসারে।
সম্রাটের কাজ ছিল নিজেকে যতটা
রাষ্ট্রের মুখশ্রীরূপে পেশ করা যায়।
মুখে আবশ্যক ছিল প্রত্যয়ের ছাপ,
নিটোল পান্ডিত্য নয়- অটল, নির্মম।
প্রজাদের মনে ছিল ভালোর পিপাসা-
কালোয় সুরক্ষা পেত আলোর বলয়।
কালো রঙে খারাপের অবসান করে
একজন রাজা তাই সুশাসন দিত।
দেবতার সহায়তা তার সঙ্গে ছিল-
দানিকেন তার কিছু আভাস পেয়েছে।
অর্জুন: এ-কথাটা না মানার উপায় তো নেই।
বৃক্ষের সময় ওটা, আগাছার নয়।
দ্বাপরের সেই দিন কলিযুগে নেই।
এখানে অসংখ্য ঘাস- হলুদ ধূসর
মলিন মনের দিন প্রতিদিন আজ।
কোনো মহীরুহ আর নজরে পড়ে না।
কর্ণ: কলিযুগে অন্ধকার কাটে আলো এলে-
শাসকের থাকা চাই উচ্চ সত্বগুণ।
রাজা তো নিজেই আজ প্রজার সমান-
শরীরী উচ্চতা তাকে ছেঁটে নিতে হবে!
মনের প্রসার আজ আসল ব্যাপার।
রাজা হোক, মহারাজা, অথবা সম্রাট,
রাষ্ট্রপতি হোক কিংবা প্রধানমন্ত্রীই-
ঘাসে ঘাস হয়ে তাকে আলো দিতে হবে।
অশোকের কথা ভাব- মেটামরফোসিস!
চণ্ডাশোক হয়ে কি সে কিছু পেরেছিল?
রক্তপাত, প্রাণনাশ- নির্বোধের মতো,
যে যুগে সন্ন্যাসী নেই, সে যুগের বীর
শরীরের শক্তি নয়, মানসিক বল
যার অনাবিল আছে সে-ই হতে পারে।
আকবরের কথা ভাব, সে তো অশিক্ষিত,
আলমগিরের সঙ্গে তুলনা কি হয়?
দারাশুকো রাজা হলে মুঘল বংশের
আলো আরো বহুদিন ভারতে ছড়াত।
অর্জুন: আজ ভাবি গোবিন্দ কি ভুল করেছেন!
দ্বাপরের স্বপ্নটি যে কলিযুগে এসে
অ্যাতটা আলাদা হবে, অ্যাতটা অচেনা-
মনে তো হয় না উনি ভেবে দেখেছেন।
ঈশ্বরের ভুল হয়, এই পৃথিবীতে
বহুবার বহুভাবে প্রমাণ হয়েছে।
প্রতাপের অবসানে সাধারণ লোক
স্বর্গসুখ পেয়ে যাবে, এ ভাবা কি ঠিক!
কর্ণ: যে ভুল কৃষ্ণের ছিল, যিশুরও হয়েছে।
যিশু তো বলেই দিল, শান্তি দিতে নয়
তরবারি নিয়ে তার পৃথিবীতে আসা।
মহম্মদ আরবেও একই ব্রত নেয়।
ওরা যা চেয়েছে তার বিপরীত হল।
নিজের সমষ্টিকে শান্তি দিতে ওরা
যুদ্ধের আশ্রয় নিতে পিছুপা হল না।
যুদ্ধকে পেরিয়ে তবে শান্তিকে পাওয়া-
এমন কঠিন পথ সোজা নয় হাঁটা।
বিশেষত কলিযুগে স্পষ্ট নয় কিছু।
ধর্মযুদ্ধ কাকে বলে, কে আর বুঝেছে!
ঈশ্বরের কোন নাম কার কত প্রিয়-
তার অর্থ ধর্ম নয়, সে তো উপাসনা!
ঈশ্বরের কোন নাম কে যে বেছে নেবে
এটা যদি জন্মগত না হত তাহলে
বহু প্রাণ বেঁচে যেত, শান্তি জয়ী হত।
ব্যক্তিগত ঈশ্বরের বদলে যে কেন
সমষ্টির দেবতার প্রচলন হল!
ভাষার ফারাকে থাকে ঈশ্বরের নাম।
ধর্মযুদ্ধ নামে চলে ভাষার লড়াই-
সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব থেকে বহু রক্ত ঝরে।
অর্জুন: দোষ হয় ঈশ্বরের। বেচারা ঈশ্বর!
অন্য গ্রহে রাজা থেকে খুশি ছিল না সে।
দেবতার দল নিয়ে পৃথিবীতে এল।
পৃথিবীতে প্রাণ দেখে খেলার সুযোগ
পেয়ে সোজা ভুলে গেল নিজের সীমানা-
সে যে এক অনাহূত ওই জগতের।
পৃথিবীর কেউ নয়, ডাকেনিও কেউ।
অদল-বদল করে জেনেটিক কোড-
এককোষী থেকে সে-ই মানুষ এনেছে।
নিজের গ্রহের যত প্রযুক্তি ও কলা
ছিটে-ফোঁটা দিয়ে গেছে সময়ে সময়ে।
প্রচুর দিয়েছে যদি যোগ্য লোক হয়-
আর্ক অব কভেন্যান্ট, পাশুপত হোক,
সুদর্শন চক্র কিংবা ব্রহ্মাণ্ড আয়ুধ।
আজও আসে তার লোক- আজও সে ভোলেনি-
খেলার নেশায় সে-ই মানুষ গড়েছে।
আজও খোঁজে যদি পায় মহৎ মানুষ-
যার মধ্যে আছে প্রাণ অন্য পৃথিবীর-
পরশুরামের মতো অথবা মোজেস।
ক্রিস্টোফার মার্লো হোক… আইনস্টাইন…
বেচারা ঈশ্বর! শুধু হতাশ হয়েছে।
মানুষ পেয়েছে তার শরীরী আদল,
কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা- সে পাওয়ার নয়।
যত দিন গ্যাছে লোক খাটো হয়ে গ্যাছে।
আজ সেই ঈশ্বরের নামের ফারাক-
পৃথিবীতে রক্ত হয়ে ঝরেই চলেছে।
ফ্লাইং সসার থেকে একবার নেমে
ওই দেবতারা যদি ফাঁস করে দ্যায়-
ঈশ্বর কিছুই নয়, সভ্যতার নাম-
প্রযুক্তির নাম আর বিজ্ঞানের নাম।
কেন যে বলে না ওরা! কিসের বারণ!
খেলার বদলে আজ নিছক দর্শক
হয়ে কী যে সুখ পায় ঈশ্বরের মন!
কর্ণ: প্রথম ঈশ্বর খেলা শুরু করেছিল-
উত্তরাধিকারের ক্রমে সে খেলা কমেছে।
পিতা ঈশ্বরের চেয়ে সন্তান ঈশ্বর
নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে আরো কিছু বেশি।
এই ঈশ্বরের আর খেলা বাকি নেই।
তার ভূমিকা তো আজ অরণ্যদেবের।
করোটি গুহাটি আজ বহু-বহু দূরে।
কিংবা এক ধৃতরাষ্ট্র, অন্ধ কিন্তু নয়-
সুদূর দর্শক হয়ে নিজের ফসল
নিজের আগুনে যত খাক হয়ে যাক-
তাকে শুধু চুপ থেকে সয়ে যেতে হবে।
যতই অপ্রিয় হোক, দেবতা পাঠিয়ে
রিপোর্ট নেবে সে, পরে আবার পাঠাবে।
মানুষের চোখে কিছু দেবতার যান
তর্কের বিষয় হবে, হাসাহাসি হবে।
দানিকেন এসে যদি বুঝিয়ে না দিত-
মন্দিরের রূপ কিংবা গীর্জা মসজিদ-
দেখে কেউ ভেবেছে কি স্পেসশিপ যেন-
প্রাচীন মানুষ যাকে গড়ে বলেছিল
ঈশ্বরের উপাসনা যদি হয় তবে
দেবযান-আকারটিই সঠিক মানাবে?
অর্জুন: অথবা ইউ এফ ও বলো, হিস্ট্রি চ্যানেলের।
আজ লোকে ভুলে গেছে বসুষেণ যে কে-
ভুলে গেছে কর্ণ নাম জন্মগত নয়-
কবচ কাটার ফলে পেয়েছ ও নাম।
গুগলে গিয়ে তো কেউ তোমার মুখের
অদ্ভুত অদ্ভুত সব ছবি খুঁজে পাবে।
স্টার প্লাসে সিরিয়ালে তোমার ভূমিকা
নিয়েছিল কোন এক বেঁটে ফর্সা ছেলে-
মুখে তার গোঁফ নেই, কামিয়ে ফেলেছে-
গোঁফ ছাড়া রাধেয় কি বেশি হ্যান্ডসাম?
একজন অভিনেতা, গোঁফ ছিল তার-
আশির দশকে তার নামডাক ছিল-
বি আর চোপড়ার সেই মহাভারতের-
পঙ্কজ ধীর-এর রূপে ভারতে তোমাকে
বহু লোক আজ চেনে, অন্য রূপে নয়।
দু-দলে বিভক্ত আজ তরুণ সমাজ-
একদল অর্জুনের অন্ধ ফ্যান, আর
আরেকদল বলতে চায় তুমি শ্রেষ্ঠ বীর।
লিওনেল মেসি আর রোনাল্ডোর মতো
ফেসবুকে আমাদেরও ফ্যান পেজ আছে-
দু-দলের রোজ চলে কথা-কাটাকাটি।
কর্ণের ফ্যানের কাছে অর্জুনের নাম
দুঃসহ- যেমন ছিল কৌরব শিবিরে।
আমার ভক্তরা ভাবে তুমি বদ লোক।
এসবও বলেছে কিন্তু ভাই সহদেব।
সেও দুই সম্প্রদায় আমাদের নামে।
এতখানি হেয় আর কিছু হতে পারে?
মানুষে পোকায় আজ ভেদ কিছু নেই।
অভ্যাসের বেঁচে থাকা, অভ্যাসে মরণ-
এর মধ্যে ক্ষুদ্র কিছু স্বার্থসিদ্ধি শুধু।
আর কিছু হানাহানি- নামের কারনে।
কর্ণ: কর্ণধর্ম, পার্থধর্ম- হয়ত কোনোদিন
আমাদেরও নাম নিয়ে রক্তারক্তি হবে।
আচ্ছা তুইই বল পার্থ, তোর মনে হয়
ফের কোনো কুরুক্ষেত্র প্রয়োজন আজ?
আমি যেন হাতে পাই ধনুকের ছোঁয়া-
মনে হয় যে আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ রয়েছে-
নেমে গিয়ে আজ তার সমাপ্তি তো করি।
যে যুগে ধর্মের নামে কিছু সম্প্রদায়
ভূগোল ও ইতিহাস ঘুলিয়ে ফেলেছে-
আত্মপরিচিতি যারা নিজের নিজের
খুঁজে না পেয়েও ওই গ্রহটিতে আছে-
ঈশ্বরের নামে তারা মানুষকে মারে!
শ্রীকৃষ্ণকে মন্দিরের বিগ্রহ বানিয়ে
সে যুগের কোনো লাভ হতেই পারে না।
প্রতাপের চেয়ে বেশি জঞ্জালের ভার
ধরণীকে ভারি করে তুলেছে ওখানে।
সাহিত্য ও দর্শনের স্বরূপ ভুলেছে,
ভুলে গেছে ধর্মগ্রন্থ ঈশ্বরের নয়-
ভিন্ন এক সমাজের আকাঙ্ক্ষায় লেখা।
ইচ্ছে হয় নেমে যাই, তোকে সঙ্গে নিই,
বিজয় ও গাণ্ডীবের যৌথ টংকারের
ধ্বনিতে মুছিয়ে দিই যত ক্লেদ আজ
ফেলে আসা পৃথিবীকে গ্রাস করে আছে।
অর্জুন: আর নয়। ঢের হল। মুক্ত হতে দাও-
পৃথিবীকে ভুলে যেতে হবে আমাদের।
দ্বাপরের যুগ আর ফেরার তো নয়।
এ যুগে গাণ্ডীবে জানি সেই শক্তি নেই-
কৃষ্ণের সঙ্গেই তাকে ধরারও ক্ষমতা
আমার এ হাত থেকে চিরতরে গেছে।
পুতুল ছিলাম আমি কেশবের হাতে-
তিনি যদি মন্দিরের দেওয়াল না ভেঙে
ফলার চালিয়ে যান, তবে তাই হোক।
তুমিও তো ক্রীড়নক- ভুলে গেলে নাকি?
আজ আর বিজয়ের নাগাল পাবে না-
আমাকে অজ্ঞান করে তুমি রথ থেকে
নেমেছিলে সে-ই ছিল অন্তিম বিদায়-
কর্ণ : হ্যাঁ, বিজয় চলে গেছে তার যথাস্থানে-
আজ তার অধিকার পরশুরামের।
অর্জুন: জানো দাদা, আমি কিছু সিনেমা তো দেখি-
আজ ওটা সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারা,
সাহিত্যের চেয়েও তো বেশি লোক চায়।
অমিতাভ বচ্চনের নাম কি শুনেছ?
বিজয় নামের কিছু চরিত্র করে সে
ভারতের শ্রেষ্ঠতম অভিনেতা আজ।
বিশেষত ‘দিওয়ার’ নামে এক ফিল্ম
সেখানে সে অ্যান্টি-হিরো- ঠিক যেন তুমি!
নায়কের চরিত্রটি শশী কাপুরের-
অমিতাভ দাদা তার, এক স্মাগলার,
আর শশী পুলিশের চরিত্র করেছে-
সে ভূমিকা অর্জুনের, বুঝে নিতে পারো।
কুলি ছিল অমিতাভ, সেই কাজ ছেড়ে
আন্ডার ওয়ার্ল্ডে এক ডন হয়ে গেছে-
এই সময়ের এক অঙ্গরাজ যেন-
এই যেন প্রতিশোধ সমাজের প্রতি।
কিন্তু তার বিল্লাটিকে সযত্নে রেখেছে-
সাতশ ছিয়াশি লেখা বিল্লাটির গায়ে-
যতদিন ওই বিল্লা রেখে দিতে পারে-
কোনো গুলি তার দেহে ক্ষত করবে না-
ঠিক যেন মনে পড়ে অক্ষয় কবচ!
সিনেমার শেষে এসে চরিত্রটি দেখি
পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে সবেগে
চিতাবাঘ যেন এক শিকারীর মুখে।
পুলিশ অবিশ্যি আর অন্য কেউ নয়-
তার ভাই আজ তার প্রাণ নিতে পারে-
ন্যায় বিচারের নাকি পরাকাষ্ঠা সেটা।
হাত থেকে সেই বিল্লা খসে পড়ে গেল।
মরে গেল অমিতাভ ভাইয়ের বুলেটে।
সমাজের জয় হল। কিন্তু কোন জয়?
দর্শকের মনে শুধু বিজয়ের প্রতি
সবটুকু ঢেউ জাগে সহানুভূতির-
গান্ডীবের প্রতি শুধু সমর্থন থাকে-
সমর্থন থাকে বটে, ভালবাসা নয়।
দ্যাখো দাদা, কিছু নয়, তবু ভেবে দ্যাখো
আমাদের স্মৃতি কিন্তু মানুষের মনে
অনেক গহিনে গিয়ে বাসা বেঁধে আছে।
আজও কিন্তু বেঁচে আছি জনমানসের
ইতিহাসবোধ আর চেতনার ভিতে।
কেউ আজ দুর্যোধন, কেউ যুধিষ্ঠির-
কেউ আজ ধৃতরাষ্ট্র, কেউ বা বিদুর।
দ্রৌপদীর অসম্মান আজও সেই ঘটে-
আজও কিছু দুঃশাসন কর্মকর্তা আর
বসুষেণ আজও এক দুরূহ দর্শক।
ভীষ্ম আর গুরু দ্রোণ আজও তো আছেন-
মাথা হেঁট, নিজেদের নিয়মেই বাঁধা।
শুধু কোনো গোবিন্দের দেখা তো মেলে না।
মহাভারতের তাই অন্ধ দিন আজ।
যেটুকু বিচার হয়, শুধু কাহিনিতে।
তবু বসুষেণ আর অর্জুনের স্মৃতি
মোছেনি এবং সেটা মুছেও যাবে না।
কর্ণ: বিপ্লবের স্বপ্ন হয়ে বেঁচে তো আছিই-
জানি আমি আছি আজও মানব হৃদয়ে-
কোনো এক অন্য রূপ নিয়ে ঠিকই আছি।
বিপ্লব তো দিব্যতার কারন জীবনে-
মরণের পরে তাকে ভুলে যাই যদি-
তবে ফেলে আসা দিন মিথ্যে হয়ে যায়।
আমি আজও অনুরক্ত পৃথিবীর প্রতি-
এ-লেখার শুরুতেই বলেছিস তুই।
কলি আর দ্বাপরের সীমানায় আমি-
দুই কোণ কেটে ফ্যালা সরলরেখাটি।
অভ্যাস আমার শুধু স্বপ্ন নিয়ে বাঁচা।
আজও যদি রূঢ়ভাবে সত্যি কথা বলি-
যেমন বলেছি সেই পাশার আসরে-
ভেবেও দেখিনি তাতে পরে নিন্দা হবে-
যদি তাতে ধর্ম কিছু নড়ে যায় যাক-
কলিযুগে কর্ণ আর অর্জুনের কথা
গোবিন্দের চেয়ে ঢের কাছের জিনিস।
কিছু কিছু মন আজও জীবন্ত রয়েছে-
কিন্তু তারা কেশবের নাগাল পাবেনা-
ভক্তিমার্গ অবসন্ন পুরোপুরি দেখি-
খুব কম লোক জানে ভক্তির স্বরূপ।
জ্ঞানযোগ কর্মযোগ- কার সাধ্য আজ?
যেহেতু পৃথিবী আজ এক তৃণভূমি-
ভগবৎ গীতা আজ সেই এক বই-
যার বাণী বুঝে নিতে মহীরুহ চাই।
মানুষ সহজে আজ উপন্যাস বোঝে-
ফুকো বোঝে বড় জোর, কার্ল মার্ক্স বোঝে-
অমেয় ও অমলিন মহান গ্রন্থের
দর্শনের যোগ্য হওয়া দুষ্কর তাদের।
ভাষা থেকে চলে গেছে অর্থের স্বরূপ-
শুধু ওরা মানে খোঁজে- অন্ধরা যেমন।
উদাহরণের লোভে কিছু লোক আজ
কর্ণের চরিত্র খোঁজে নিজের হৃদয়ে।
আমাদের ওরা হয়তো আত্মীয় ভেবেছে।
অচেনা ঈশ্বর নয়- মানুষ জেনেছে-
এলিয়েন রক্ত আছে, তবুও মানুষ।
পার্থ আর অর্জুনের সমান টানের
মধ্যে কেউ জেগে আছে- এখনও মরেনি।
ঘুম নেই কিছু চোখে- অপলক চোখ-
নতুন দিনের রেখা যদি ধরা দেয়-
ঘুম এলে সেই দিন হাতছাড়া হবে।
এখনো বিদ্রোহ হয়- আলোড়ন ঘটে-
শাসকের আধিপত্য থরথর কাঁপে।
ছাত্রদের মধ্যে আজও দাসভাব নেই-
ফুঁসে ওঠে ওরা আজও- যেন ক্ষুদিরাম-
যেন ওরা একঝাঁক একলব্য হয়ে
আঙুলের বলি দিতে অস্বীকার করে-
বরং গুরুর মুখে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে।
ওদের যাপনে আমি জীবনদেবতা-
মহৎ আকাঙ্ক্ষা যদি চরিতার্থ হয়-
যে কোনো প্রকারে হোক, পথের বিচার
বসে বসে করা শুধু নির্বোধের কাজ-
বীরের স্বভাব হল পথ তৈরি করা-
সেই পথ ঠিক কিনা- সে পরের কথা।
প্রয়োজনে মিথ্যে বলে বিদ্যা কেড়ে নিই-
বিনিময়ে অভিশাপ জোটে তো জুটুক-
গুরুকেও পরে আমি অনুতাপ দেব।
দ্রোণাচার্য অস্বীকার করেছেন বলে
বিদ্যায়তনের কাছে হেরে যাব সেটা
আমি তো মানিনি আর ওরাও মানে না-
ওরাও অবাধ্য ঠিক আমার মতোই-
ওরাও তো কটূভাষী- আত্মবিশ্বাসের
চরম সীমাটি নিয়ে খেলা করে যায়।
জঙ্গলে জঙ্গলে যারা পরিবর্তনের
স্বপ্ন নিয়ে লড়ে যায়, জেলে গিয়ে পচে-
রাজনীতির ছকে গিয়ে ক্রীড়নক হয়-
ভাবে বুঝি এনে দেবে নতুন সকাল-
ব্যবহৃত হয়ে যায় নেতাদের হাতে-
যে বদল আসে তাতে ভূমিকা রেখেও
পরে হয়ত মারা পড়ে সরকারের ছলে-
আজও আমি বেঁচে আছি তাদের মধ্যেই।
যারা শুধু ভালো নয়- ভালো-খারাপের
অভেদের মধ্যে তারা এমন বেড়েছে-
যে কোনো শিবিরে তারা বেমানান খুব-
তাদের সরিয়ে ফেলে প্রতিষ্ঠান বাঁচে।
শেষ বিচারের বেলা ঠিক দেখা যাবে-
নিজেদের হয়ে তারা লড়েছে বটেই-
কিন্তু এক আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে।
কোনো প্রতিযোগিতাই কোথাও ছিল না।