লিসেনারদের দায় তাদের বয়স বেড়ে যাচ্ছে |সাক্ষাৎকার

0

ভূমিকা: গালীব আজিম। কবি ও কণ্ঠযোদ্ধা। প্রথম ব্যান্ড ‘শহরতলী’, তারপর ‘থিয়েট্রিকাল’। কবিতাকে অনুষঙ্গ করে তার সমস্ত পথচলা। সম্প্রতি নেয়া এই সাক্ষাৎকারে তিনি গান, মিউজিক ভিডিও, লিরিক ও নানা প্রসঙ্গ নিয়ে উঠে এসেছেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন নাজমুস সাকিব রহমান। আসুন, তাদের কথায় ঢুকে পড়ি—

—ইদানিং কার গান শুনছেন?

—সঞ্জীব দা, বাচ্চু ভাই, জেমস্‌ ভাইয়ের গানগুলো রিভিশন দিচ্ছি। আসলে এরা তো অনেকটা কোর কোর্সের মত।

—এই সময়ে এসেও তারা গুরুত্ব পাওয়ার কারণ কী হতে পারে?

—প্রথম এবং প্রধান কারণ অনুভূতি। এখন সে-গান যে-বিষয়ের হোক, অনুভূতি ছাড়া লিরিক, বাজানো বা গাওয়াটা আসলে পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যেই থাকে। সেখানে শিল্প খুঁজে পাওয়া দুস্কর। আরেকটা কারণ হতে পারে তারুণ্যে মানুষের অনুভূতি প্রখর ও তীব্র থাকে। শ্রোতা হিসেবে যে অনুভূতি তারুণ্যের ওই সময় পেয়েছিলাম —তা অনবদ্য। এখন যে আমরা তরুণ নই, তা নয়। তারুণ্য বলতে বয়ঃসন্ধি কাল হতে ধরব। আসলে অনুভূতিটাই তো থেকে যায়। এমনিতে মানুষ তো অনভূতিপ্রবণ।

—অনুভূতি থেকে যায় কিন্তু পরিবর্তন আসে। তারায় তারায় রটিয়ে দেয়ার মতো অনুভূতি মনে হয় এখনকার প্রেমে নেই।

—আসলেই কী তাই? প্রেম তো শাশ্বত। অনুভূতিও। পরিভাষাটাই তো শুধু পরিবর্তন হয়। আজও মানুষ প্রেম করে, ছেঁকা খায়, কাঁদে। এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভাবে যে তার ওই মানুষটা ছাড়া পৃথিবী থেমে যাবে। তাহলে অনুভূতির পরিবর্তন কোথায়?

সারগাম; বিলুপ্ত কোম্পানি।

সারগাম; বিলুপ্ত কোম্পানি।

—বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় লিখতেন, —‘গতিই জীবন, গতির দৈন্যই মৃত্যু।’

—জীবন গতিশীল তো অবশ্যই। বহতা নদীর মত। কিন্তু অনুভূতিগুলো পরিবর্তনশীল। প্রকাশগুলো পরিবর্তনশীল। বেসিক মেটারিয়াল সেইম।

—হ্যাঁ, আমি এটাই বলছিলাম। এবার বাংলা গানের রিয়েলিটির অভাব নিয়ে বলেন।

—বুঝলাম না। কোন রিয়েলিটি? জীবনমুখী? নাকি জীবনঘেঁষা?

—জীবন থেকে নেয়া। এই যে গান বানায়, ‘তোমায় নিয়ে ঘর বানাব ওই আকাশে …’ এটা তো ফ্যান্টাসি—

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এমন গান বানিয়েছেন। তুমি সন্ধ্যারও মেঘমালা। এটা আসলে লিরিকের ওপর নির্ভরশীল। আর লিরিক বা কবিতা সবসময় জীবনযাত্রার বা সমাজ-ব্যবস্থার মোটিভ’কে রিপ্রেসেন্ট করে। বাংলাদেশের মানুষ নদীর মানুষ। অববাহিকার মানুষ। পায়ের তলায় ভেজা মাটি, সবুজ ধানক্ষেত। বর্ষাকালে শাপলাফোঁটা ঝিলের মানুষ। এদের কাছ থেকে কাঠখোট্টা জীবনবোধ বা যুদ্ধনীতি-টাইপ কবিতা বা লিরিকের গান প্রত্যাশা না-করাই ভাল। বাংলাদেশের মানুষ অনেক বেশি আবেগী।

—অথবা গীতিকার’রা সহজ করে ভাবতে পছন্দ করেন—

—এটা গীতিকার বা কবির বিষয়। তবে সাবলীলতা ব্যাপারটা কবিতার ক্ষেত্রে না হলেও, গানের ক্ষেত্রে অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। মূলত এটাই গান আর কবিতাকে আলাদা করে দেয়। তাই আমার মনে হয়,—প্রত্যেক গীতিকারের উচিত গানকে যতদূর সম্ভব সহজ ভাষায় উপস্থাপন করা। এ ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু যত জটিলই হোক।

—বিষয়বস্তুর বড় অভাব। অনেকেই বোধ হয় পত্রিকাও পড়েন না।

—পত্রিকা না পড়লে হয়তো গেজেটে দেখে নেন। ইটস অলমোস্ট সেম। এখন আমরা জোর করতে পারি না। এখানে বাধ্যবাধকতার কিছু নেই।

—বাংলাদেশে গান লেখার নিয়ম-কানুন নিয়ে বেশ কিছু বই আছে। পড়েছেন কখনও?

—না। প্রয়োজন মনে করি নি।

—ইউরোপিয়ান লিরিক আর আমাদের লিরিকের তফাৎ কোন জায়গায়?

—মূল পার্থক্য জীবনধারা আর দৃষ্টিভঙ্গিতে। তারপর বলার ভঙ্গিতে। মেটাফর সিমিলার ব্যবহারেও কিছু পার্থক্য আছে।

I'm Your Man is the eighth studio album by Leonard Cohen, released in 1988.

I’m Your Man is the eighth studio album by Leonard Cohen, released in 1988.

—এখন তো ইন্টারন্যাশনাল বাজার। সমান-সমান হওয়া উচিত না?

—হ্যাঁ। উচিত তো অবশ্যই। আমার তো মনে হয়, কেউ না কেউ ইন্টারন্যাশনাল বাজারে খুব শিঘ্রই নাম করবে। সে যে কোনও বাঙালি’ই হোক। কিন্তু, বড় সমুদ্রে তো আর কলা গাছের ভেলা নিয়ে হয় না। ওইখানে জাহাজ লাগে। তাছাড়া, ইংরেজি’তে গান গেয়ে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে পায়ের নিচে সিঁড়ি পেতেও অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে।

আমি লিরিক-প্লেয়িং-সিঙ্গিং—এগুলোকে বেসিক রেখেই বলছি। ধরে নিলাম, এগুলো আছে। রেকর্ডেড সাউন্ডও ভাল। এবার আসি ইন্টারন্যাশনাল ভাষা বা কম্পিউটারের ভাষা ইংলিশ-এ। একসেন্ট একটা বড় বিষয়। ইন্ডিয়ান, ইউরোপিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, ব্রিটিশ এবং আমেরিকান একসেন্ট। এগুলোর যে কোনও একটা একসেন্টে গাইলেও হয়। শুধু আমেরিকার একসেন্ট’ই আছে দশ রকমের। কিন্তু আমরা সব গুলিয়ে ফেলি। যার ফলে শুনতে হাস্যকর লাগে।

সো, আঞ্চলিকতার সংমিশ্রণ ভাল। তবে, বহু-আঞ্চলিকতা একসাথে মিশলে কী হবে! একবার ভাবুন তো সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, নোয়াখালী’র ভাষা সব এক গানে!

—আমাদের ইংলিশ গান শেষ পর্যন্ত ইংরেজি হয়ে যায়?

—আমি তা বলছি না। শুধু বলছি,—গান যেমনই হোক, শুনতে যেন ভাল লাগে। সে ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় বাঙ্গালীরা অনেক ভাল একসেন্ট ব্যবহার করে।

—সে ক্ষেত্রে ইন্সট্রুমেন্টালই ভাল।

—হা হা। ইন্সট্রুমেন্টাল তো ইউনিভার্সেল। এটার ভাষা ও নিজেই। এক ভাষা তবে ওই যে বাজার! আমার মতে সব মিউজিকের চর্চাই বাড়ানো উচিত। প্রত্যেক ঘরে-ঘরে কবিতার বই আর মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট থাকা উচিত।

—আপনি পাশের দেশের কথা বললেন। ওদের মিউজিক অনেকখানি সিনেমা-নির্ভর। আমাদের এখানে তা না—তবে এখন মিউজিক ভিডিও নির্ভর হয়ে গেছে।

—যে কোনও নির্ভরতা ভয়ঙ্কর। এটা আত্মনির্ভরশীলতা নষ্ট করে দেয়। আসলে পাশের দেশ, তার পাশের দেশ, আমাদের দেশ—সব তো একই। মিউজিক্যালি, খাবার-দাবার, আচার-আচরণ, ব্যবহারের বেসিক সবই তো এক।

The photo for the Grammy award-winning album cover of Bob Dylan's Greatest Hits was taken at the Washington Coliseum on November 28, 1965. (Source: Wikipedia)

The photo for the Grammy award-winning album cover of Bob Dylan’s Greatest Hits was taken at the Washington Coliseum on November 28, 1965. (Source: Wikipedia)

—এমনও তো হতে পারে, গানের চেয়ে সুন্দরী মডেলের সঙ্গই বেশি কাঙিক্ষত।

—হা হা হা। কী জানি ভাই! ওটা বরং ক্রিটিকদের জন্য ছেড়ে দিই।

—আজকাল ইউটিউবে ভিউ হলেই নিউজ হয়, হয়তো ডিসলাইক নিয়েও হবে।

—ওই ক্ষেত্রে ডিসলাইক থেকেও শিখতে হবে যে ইম্প্রুভ করা যেত বা যায়।

—ইম্প্রুভ কী আসলেই করা যায়?

—এটা আসলে যার যার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও দর্শনের জায়গা। আমি কেবল আমারটাই বলতে পারব। যে যে ভাবে নেয় আর কী! কিন্তু একটা কথা কী জানো?

একটা গান দিয়ে তুমি সবাইকে খুশী করতে পারবা না । সবার ভাল লাগবে না। এটাই স্বাভাবিক। যেমন বব ডিলান যখন গাইতেন তখন সবাই তাঁকে ডিসটিউন সিঙ্গার বলেছে। তারপরেও বব ডিলান বব ডিলানই। তাই কে কী বলল? কার ভাল লাগল না—ওইটা খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।

—তাহলে বলা যায়, আমাদের দেশের এই সময়ের অনেক গায়ক বব ডিলান দ্বারা ইন্সপায়ার্ড।

—আমি কিন্তু লিওনার্দ কোহেন দ্বারা। ববকে ভালবাসি কিন্তু ধারণ করি কোহেনকেই।

—খেয়াল করলে দেখবেন, জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ার পর যেই নতুন গানগুলো করা হয়, তার বেশীরভাগই শ্রোতারা গ্রহণ করেন না।

—সত্যি বলতে এটা ভেরি করে। এটার দু’তরফা এক্সটেন্ডেড রুপ আছে। শুধু আর্টিস্ট না, এখানে লিসেনারসও দায়ী। লিসেনারদের দায় তাদের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের পছন্দেরও পরিবর্তন হচ্ছে। সে জন্য আগের মত গতকালের আর্টিস্টের গান নাড়া দেয় না। প্রেমিকা ও প্রেক্ষাপট। সব পরিবর্তিত।

সাক্ষাৎকার গ্রহীতা: নাজমুস সাকিব রহমান।

সাক্ষাৎকার গ্রহীতা: নাজমুস সাকিব রহমান।

—বয়স হলে অনেকে ভজন কিংবা রাগসঙ্গীত শুনতে পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যান্ড আর্টিস্ট’রা কী তা গাইতে পারবেন?

—হা হা। সেটা আর্টিস্টদের সীমাবদ্ধতা। মেটালিকাও এখন আর মেটালিকা নাই। বয়স, সময়, একটা ওজন—একটা ভার। এটা একেকজন একেকভাবে বলতে চায়।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার