অভিবাসী মেঘ, তুমি কোথা যাও?
জলের ডানায় উড়ে উড়ে যাও কোন্ সে দূরের গাঁয়? …
এইখানে এস।
কাজলা দীঘীর জলে ভাসা
দলকলমীর
পাপড়ির ওপর চুপটী করে বস। …
অভিবাসী মেঘ, তুমি কোথা যাও?
এইখানে এস।
শোন, ধানক্ষেতের আড়ালে
কাঁদছে
সদ্যজাত যিশু!
শঙ্খলা নদীটীর নীড়ে, গণকবরের
সবুজ ঘাসের ফুলে ফুলে দিয়ে যাও জলজ পরশ! …
কাঁটাতার ঘেরা শ্যামল সবুজে,
পৃথিবীর
গাঁয়ের আকাশে,
মন পবনের নায়ে ভেসে ভেসে যাও
কোন্ সে দূরের গাঁয়?
ভাসছি অকূলে, সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের নায়!
অথই সমুদ্রে
আশার ছলনে ভাসে কৌটিল্য নগর, কী ভাবে বাহিব দাঁড় উজানিয়া টানে! …
অভিবাসী মেঘ, আমাকেও নিয়ে যাও! …— অভিবাসী মেঘ ।। আরণ্যক টিটো
মহাকবী কালিদাসের ‘মেঘদূতম্’ কাব্যে বিরহী যক্ষ তার প্রিয়ার কাছে দূত হয়ে যাওয়ার মিনতি করেছিল মেঘকে। … এরপর থেকেই নাকি ভারতীয় কাব্য সাহিত্যে চেতন অবচেতনের ব্যাবধান অনেকটা রহিত হয়েছিল। কালিদাসের ‘মেঘদূতম্’ ছিল শৃঙ্গার রস প্রধান কাব্য। ‘মেঘদূত’ শিরোনামে কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তবে সে কবিতার মূলপ্রেরণা কালিদাসের ‘মেঘদূতম্’ এবং তাতে প্রাধান্য পেয়েছে করুণ রসের। এরপর বাঙলা সাহিত্যে আরও অনেক কবীর অনেক কবিতার নানান উপকরণ হয়েছে মেঘ। ‘অভিবাসী মেঘ’ নামক কবিতায় মেঘকে সম্বোধন করা হয়েছে ‘অভিবাসী’ বলে। …
‘অভিবাসী’ আজকের বিশ্বের বহুল আলোচিত শব্দ। বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ আজকে অভিবাসী হয়ে কঠিন করুণ মর্ম্মান্তিক পরিণতির শিকার হচ্ছে। আবার অনেক রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্ত্তাব্যাক্তিদেরও মাথাব্যাথার শেষ নেই অভিবাসন সমস্যা নিয়ে। যেমন মধ্য এশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের অভিবাসন প্রত্যাশী লোকদের নিয়ে ইউরোপের অনেক রাষ্ট্র এখন দিশেহারা। …
পৃথিবীতে রাষ্ট্র উদ্ভবের পূর্ব্বে অভিবাসী বা অভিবাসন সমস্যাটা হয়ত ছিল না। তখন মানুষ তার সাধ্যমত এ গ্রহের যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে পারত। এতে প্রয়োজন হত না কারোর সম্মতি কিংবা কোন পাসপোর্ট ভিসার। কিন্তু রাষ্ট্র উদ্ভবের পরে মানুষের সে স্বাধীনতা খর্ব্ব হয়ে যায়। পৃথিবীর পথে পথে গড়ে ওঠে নিষেধের প্রাচীর, কাঁটাতারের বেড়া। রুটী রোজগারের জন্য হোক অন্য কোন কারণে হোক, এক রাষ্ট্রের নাগরিক অন্য রাষ্ট্রে বসবাস কিংবা অবস্থান করতে কর্ত্তৃপক্ষের অনুমতির রীতি গড়ে ওঠল। কর্ত্তৃপক্ষের সম্মতিহীন কিংবা সম্মতির মেয়াদোত্তীর্ণ লোকদের বলা হল, অবৈধ অভিবাসী কিংবা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। যাদের ওপর যে কোন মুহূর্ত্তে নেমে আসতে পারে রাষ্ট্রপক্ষের কঠিন কঠোর নির্দ্দয় দমন অভিযান। …
এমনও দেখা যায় যে, কোন আক্রান্ত দেশের নাগরিকদের পার্শ্ববর্ত্তী রাষ্ট্রে আশ্রয় দেওয়া হয় শরণার্থী নামে। শরণার্থী হোক, অভিবাসী হোক কিংবা অভিবাসন প্রত্যাশী হোক পৃথিবী নামক গ্রহে তারা মূলতঃ পরবাসী/পরদেশী/পরগ্রহী। কারণ তাদের জীবন জ্বলন্ত খা-ব আর চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া, আইনের বিষাক্ত বলয়— এপারে থাকা তাদের দুঃসহ, ওপারে যাওয়া দুরাশা। এমনই কাঁটাতারের রীতি, এমনই সীমান্ত আইনের শাসন। …
ভারতীয় পুরাণে নাকি ডানাওয়ালা হাতীর উল্লেখ আছে। আকাশে উড়ন্ত যে হাতী একদিন কোন এক দেবতার অভিশাপে পাখা হারিয়ে মর্ত্তের বর্ত্তমান হাতীতে পরিণত হয়। তাই প্রাচীন ভারতীয় অনেক সাহিত্যগ্রন্থে উড়ন্ত মেঘকে হাতীর সাথে তুলনা করা হয়েছে। মেঘের ডানা কল্পনা করার ব্যাপারটা তখন থেকেই হয়ত ভারতীয়দের মাথায় আসে। বাঙলা সাহিত্যের যত্রতত্রই মেঘের ডানার কথা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু অভিবাসী মেঘের কথা অর্থাৎ মেঘকে অভিবাসী বলে কেউ পূর্ব্বে কল্পনা করেছে কিনা তা আমরা জানি না! মেঘ ‘অভিবাসী’ হলেও অভিবাসী মানুষের মত দুর্দ্দশা/সীমাবদ্ধতা হয়ত তার নেই। পৃথিবীর আকাশে জলের ডানায় উড়ে উড়ে যেতে পারে দূর দূরান্তে। তাই অভিবাসী মেঘের প্রতি কথকের আহ্বান, যেন সে কাজলা দীঘীর জলে ভাসা দলকলমীর পাপড়ির ওপর চুপ্টী করে বসে কথকের কথা শোনে। মেঘ যেন ধানক্ষেতের আড়ালে ক্রন্দনরত সদ্যজাত যিশুর কাছে আসে।
ধানক্ষেতের আড়ালে/ কাঁদছে/ সদ্যজাত যিশু— চরণে অতিশয়োক্তি অলঙ্কারের প্রয়োগ করা হয়েছে। উপমেয় শিশু অনুপস্থিত— উপমান যিশু। এখানে শিশু এবং যিশুর মধ্যে কী রূপ অভেদত্ব নির্ম্মিত হয়েছে তা বোঝার জন্য আমাদের ‘অভিবাসী’ শব্দের সূত্র ধরে সাম্প্রতিক বিশ্বের ঘটনা প্রবাহের দিকে নজর দিতে হবে। সমুদ্র সৈকতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শিশু আইলানের সে মর্ম্মান্তিক ছবিটা এত শীগ্রই বিশ্ববাসীর হৃদয় থেকে মুছে যাবার কথা নয়। মাত্র কয়েক মাস আগে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশকারী রোহিঙ্গা বোটে পাওয়া গিয়েছিল একা দেড়মাস কী তিন মাসের কন্যাশিশুকে। তাছাড়া ইউরোপের বিভিন দেশে অভিবাসন প্রত্যাশী লোকদের সাথে অনেক শিশুকে কাঁটাতারের বেড়া ধরে কাঁদতে দেখা গিয়েছিল অনাহারে অর্দ্ধাহারে। এসব শিশু কি একটা রাষ্ট্রের কাছে পিতৃহীন কুমারী মাতার সন্তান যিশুর সমতুল্য নয়?! হয়ত একটু তফাৎ আছে— যিশু ছিল জন্ম পরিচয়ের অভিবাসী আর এসব শিশুরা রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের অভিবাসী। এ তো গেল চরণটীর সাম্প্রতিক উপযোগিতা। সর্ব্বকালের উপযোগিতা তাহলে কোথায়? …
আমাদের দেশে এমন অনেক ঘটনা জানা যায় যে, পিতৃপরিচয়হীন অনেক কুমারী মায়ের কিংবা বারাঙ্গনাদের সন্তানকে ফেলে যাওয়া হয় ধানক্ষেতের আইলে ঝোপেঝাড়ে নালায় ডাষ্টবিনে। … সে-ও কি যিশুর মত জন্ম পরিচয়ের ‘অভিবাসী’ নয়?!
পরের চরণে মেঘকে আহ্বান করা হচ্ছে, শঙ্খলা নদীটীর নীড়ে গণকবরের সবুজ ঘাসের ফুলে ফুলে জলজ পরশ দিয়ে যাওয়ার জন্য। …
থাইল্যা-ের একটা নদীর নাম শঙ্খলা। অনেকে হয়ত জানেন, এই নদীর তীরবর্ত্তী দূর্গম জঙ্গলে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের অসংখ্য অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষের কবর আবিষ্কৃৃত হয়েছিল। যাদের অনেকের মৃত্যু হয়েছিল সমুদ্রে নৌকায় ভেসে ভেসে ক্ষুধায় পিপাসায় রোগে ভোগে। সেই তৃষ্ণার্ত্ত মানুষগুলোর কবরে জন্মানো ঘাস, ঘাস ফুল সবই কি তৃষ্ণার্ত্ত মনে হয় না?! …
এখানে শঙ্খলা নদীর নাম উল্লিখিত হয়ে যেমন মালেশিয়ায় অ-িভবাসন প্রত্যাশীদের গণকবরের কথা স্মরণ করাচ্ছে তেমনি ঐতিহাসিক কাল ধরে পৃথিবীর বুকে আবিষ্কৃত অনাবিষ্কৃত গণকবরের কথা স্মরণ করাচ্ছে, যেমন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বি-িভন্ন দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা, প্রথম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যা, বর্ত্তমানে মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকায় যুদ্ধাক্রান্ত অঞ্চলগুলিতে সংঘটিত গণহত্যা। … ‘নীড়ে’ শব্দের পরে কমার ব্যাবহার চরণটাকে ‘গণকবর’ বিষয়ক অর্থবিস্তৃতি দিয়েছে।
কাঁটাতার ঘেরা শ্যামল সবুজ পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর গাঁয়ের আকাশে মন পবনের নায়ে ভেসে মেঘ যাচ্ছে কোন এক সুদূর গাঁয়ের পারে। কিন্তু কথকের পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। কথক সপ্তাঙ্গতত্ত্বের নায়ে ভাসছে অকূলে। অথই সমুদ্রে আশার ছলনে ভাসছে কৌটিল্যনগর। আর কথক সন্ধিগ্ধ হয়ে পড়ছে নৌকার প্রতি। …
সপ্তাঙ্গতত্ত্বের নায়ের সাথে কৌটিল্য বা কৌটিল্যনগরের উল্লেখ ব্যাপারটাকে অনেক তাৎপর্য্যময় করে তুলেছে। কৌটিল্যের সাথে সপ্তাঙ্গতত্ত্বের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত কূটনৈতিক ধর্ম্মতাত্ত্বিক প-িত কৌটিল্য। ইতিহাসে তিনি চাণক্য নামে অধিক পরিচিত। রাজনীতি বিষয়ক তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘চাণক্যের অর্থশাস্ত্র’ নামে পরিচিত। এই গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ক প্রধান সাতটা নীতির কথা বলেন। আধুনিক রাষ্ট্রের উপাদান— ভূখ-, জনগণ, সরকার, সার্ব্বভৌমত্ত্ব¡ কিংবা রাষ্ট্রের অঙ্গ— আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্ব্বাহী বিভাগের মতই ‘অর্থশাস্ত্রের সাতটা নীতি’ কৌটিল্য প্রণীত রাষ্ট্রব্যাবস্থার সপ্ত অঙ্গ বা সপ্তাঙ্গ! …
কথকের সপ্তাঙ্গতত্ত্বের নায়ে ভাসা এবং আশার ছলনে ভাসা কৌটিল্যনগর, কথাগুলো আমাদের আরো একটু পরিস্কার করে নিতে হবে। …
একথা সর্ব্বজন সম্মত যে, রাষ্ট্রীয় আইনের মত রাষ্ট্রের সীমান্তপ্রাচীর রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগণের সুরক্ষার জন্য। কিন্তু কোন রাষ্ট্রে যখন নেমে আসে উচ্ছেদ অভিযান, যুদ্ধ, মহামারী, উপার্জ্জনের অনিশ্চয়তা কিংবা কোন প্রাকৃতিক দুর্য্যােগ তখন সে রাষ্ট্র অথবা পার্শ্ববর্ত্তী রাষ্ট্রের কাঁটাতার কিংবা সীমান্ত আইন আক্রান্ত জনগণকে কি অকূলে ভাসিয়ে রাখবে না? যেমনটা আমরা ভাসতে দেখেছি মায়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বঙ্গোপসাগরে, মায়ানমার ও বাঙলাদেশের অনেক মানুষকে মালেশিয়া, থাইল্যা-ের উপকূলে এবং লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, মিসরসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ভূমধ্য সাগরে কিংবা ইউরোপের উপকূলে। অভিবাসন প্রত্যাশী ভাসমান মানুষগুলোও স্বপ্ন দেখে কৌটিল্য প্রণীত রাষ্ট্রব্যাবস্থার মত একটা নিরাপৎ (নিরাপদ) রাষ্ট্রের! …
তাই অভিবাসী মেঘের কাছে কথকের মিনতি— মেঘ যেন কথককেও নিয়ে যায় সাথে …
এখানে সপ্তাঙ্গতত্ত্বের নায়, আশার ছলনা, দাঁড়, উজানিয়া টান প্রভৃতি শব্দবন্ধের দেহবাদী তান্ত্রিক ব্যাখ্যাও হতে পারে। না, ও’দিকে আমরা যাব না। …
মেঘদূতম্ কাব্যে মেঘকে আহ্বান ছিল এক প্রকার রতিসুখের প্ররোচনা এবং কাব্যের অধিকাংশ চিত্রকল্পও ছিলে শৃঙ্গার সমৃদ্ধ। কিন্তু ‘অভিবাসী মেঘ’ কাব্যে বর্ণিত বিভিন্ন বিষয় এবং চিত্রকল্প মর্ম্মান্তিক হৃদয় বিদারক। তাই এখানে করুণ রসই প্রধান হয়েছে। অভিবাসী মেঘে যে ধ্বনি বা সুর মাধুর্য্য গড়ে ওঠেছে তা কবিতার করুণ আবেদনকে দিয়েছে আরও গভীর বিস্তৃতি। …
অভিবাসী মেঘ শুধু সাময়িক কিছু ঘটনার বিবরণ নয়, তা সর্ব্বকালের কিছু দুর্দ্দশাগ্রস্থ মানুষের মর্ম্মান্তিক পরিণতির লেখ্চিত্র। …
দ্বীপ দিদার
জন্ম: ০৭ ডিসেম্বর ১৯৯১, মাতারবাড়ী, মহেশখালী, কক্সবাজার। প্রকাশিত গ্রন্থ: সহপাঠ গুপী গাইন, বাঘা বাইন…
{রোদনের পদাবলী : বঙ্গবন্ধু হত্যা ও বাঙলা-বাঙ্গালীর রাজনৈতিক হাহাকার [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্তী) ও প্রকৃতিপুরুষভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}