(উদ্)যাপনের কথামালা : সভ্যসংঘের নিষেধাজ্ঞা বনাম একলব্য বিশ্বের জাগরনের বয়ান || দ্বীপ দিদার

0

একটু পিছাতে চাই/ পরাণ কথার নীড়ে/…
গতির লালিত্যে/
ধনুক
যে ভাবে বেঁকে যায়/ পিছনের দিকে/…
কৃষ্ণকালা জানে/
পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রে/
অর্জ্জুনের/
পশ্চাদগমনে লুকায়িত ছিলো/ মহাবীর/ কর্ণবধ /…
একটু পিছাতে চাই/ অন্ত্যজ মাটির কাঁচাসোনায়/ জেনে নিতে কর্ণের বেদনা/…
টা ন টা ন /
ধনুকের ছিলাময়/
বুড়ো আঙুলের ইতিহাসে/ মর্ম্মের পোড়নে জেগে ওঠে একলব্যবিশ্ব/…
প্রাসাদের ভারবহ/
ক্ষমতা কেন্দ্রের খুঁটি/ মধ্যবিন্দু ছেড়ে/
নতুন সৌন্দর্য্যে সরে যায়/ প্রান্তরের দিকে/…
একটু পিছাতে চাই/ পরাণ কথার নীড়ে/
খনার
কর্ত্তিত জিহ্বা জানে/
কথার মালায় রচা / বিনিসুঁতো মালা/ নিবিড় বন্ধনে বাঁধে/
(উদ্)যাপনের কথামালা/…

                     — (উদ্)যাপনের কথামালা // আরণ্যক টিটো

 

কেউ পিছায় নিচক পিছানো কিংবা পলায়নের জন্য। আবার কেউ পিছায় অগ্রগামী হবার জন্য কিংবা দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত শক্তি সঞ্চয়ের জন্য। পিছানো একধরণের ছলনা হতে পারে, হতে পারে যুদ্ধক্ষেত্রের কৌশলও।… তাহলে পশ্চাৎগমন মানে শুধুমাত্র পলায়নপরতা নয়, এর নেতিবাচক উদ্দেশ্যের পাশাপাশি অনেক ইতিবাচক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে।… এমনি একধরনের পিছানোর কথা বলা হয়েছে ‘(উদ্)যাপনের কথামালা’ কবিতায়।…

বেঁকে যাওয়া ধনুকের মতো কথক একটু পিছাতে চায় পরাণ কথার নীড়ে।… গতির লালিত্য সৃষ্টির জন্যই পিছনে বেঁকে যায় ধনুক আর কথক পিছাতে চায় পরাণ কথার নীড়ে।…
পরাণ কথার নীড় বলতে এখানে কী বুঝানো হচ্ছে? পরাণ কথার নীড় কি কথকের উৎসমূল, ইতিহাস-ঐতিহ্য, গৌরবের ভিত্তি কিংবা ব্যর্থতার সূচনাগার? হতে পারে নিজের অতীত মাত্র। যাই হোক না কেন, পরাণ কথার নীড়ে ভর দিয়েই কথক তরান্বিত করবে অগ্রগতি, শুধরাবে পূর্ব্বজ’র ভুল, ছুঁড়বে নিশানা।… কথকের পিছানো, ধনুকের বেঁকে যাওয়া, গতির লালিত্য, এসব তথ্যকে বাঁর্গসীয় গতিতত্ত্বের আলোকেও পাঠ করা যেতে পারে। (…………………….)

কূটনৈতিক সারথি শ্রীমান কৃষ্ণ জানতেন, কৌরব পক্ষের দেবব্রত ভিষ্ম, গুরু দ্রোনাচার্য্য ও মহাবীর কর্ণের মতো যোদ্ধাদের সোজাপথে ধরাশায়ী করা যাবে না। তাই তিনি এসব বীরদের নিহত করতে গিয়ে একেক প্রকার বৈধ ছলনার আশ্রয় নেন। শ্রীমান কৃষ্ণ জানতেন, পশ্চাৎগমনের মতো কৌশলই অর্জ্জুনকে মহাবীর কর্ণ বধে সফলতা দিবে। শেষাবধি কুরুক্ষেত্রে শ্রীমান কৃষ্ণ অন্যান্য মার্গ প্রদর্শনের মতো একাগ্রভক্তকে পশ্চাৎগমনের মার্গও প্রদর্শন করান।…

কবিতায় কথক ধনুকের পিছনে বেঁকে যাওয়ার সাথে নিজের পিছানোর সাদৃশ্য অনুভব করলেও অর্জ্জুনের পশ্চাৎগমনের সাথে নিজের পিছানোর সাদৃশ্য অনুভব করেননি। অর্জ্জুনের পশ্চাৎগমনের উদ্দেশ্য ছিলো কর্ণ বধ। পক্ষান্তরে কথকের পিছানোতে আছে মহাবীর কর্ণের প্রতি সহমর্মিতা, সমবেদনা। এটা স্পষ্ট যে, কৃষ্ণার্জ্জুন নয় বরং সূতপুত্র হওয়ার দরুন লাঞ্চিত বঞ্চিত বিক্ষুব্দ বীর কর্ণের প্রতিই কথকের পক্ষপাত।… এখানে মহাভারতের কুরুক্ষেত্রকে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্ররূপে বর্ণনা করায় পৌরাণিক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ মহাকালীন ব্যাপ্তি পেয়েছে। একটু গভীরভাবে ভাবলেই বুঝা যাবে, যুগ যুগ ধরে স্বার্থ ও আদর্শের নামে পৃথিবীর মানুষগুলো দুটি প্রধান পক্ষে বিভক্ত হয়ে কুরুক্ষেত্রে নামছে এবং তাতে কর্ত্তৃত্ববাদীদের কেউ কর্ণের মতো তৃতীয় বিশ্বের শক্তিকে স্বীকৃতির নামে নিজের পক্ষে ব্যবহার করছে। আবার কেউ নানা বৈধ ছলনার আশ্রয় নিয়ে সে শক্তিকে বধ করছে। প্রথম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে এমন চিত্র হরহামেশাই দেখছে বিশ্ববাসী।

তাই কর্ত্তৃত্ববাদীদের ভুমিকায় কথক এখানে সন্দিহান।…

কথক কর্ণের বেদনা জানার জন্য একটু পিছাতে চায়, অন্ত্যজ মাটির কাঁচাসোনায়।… অন্ত্যজ মাটিকে এখানে অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের প্রতীক এবং কাঁচাসোনাকে অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের সহজিয়া জীবনের রূপক ভাবা যেতে পারে। ভিন্ন পরিচয় থাকলেও মহাভারতের কর্ণ অন্ত্যজ শ্রেণীরই প্রতিনিধি। সূতপুত্র পরিচয়কে কর্ণ কখনো অগৌরবের মনে করেননি, তার সচেতন আক্ষেপ দ্রোহ ছিলো সূতপুত্রের/অন্ত্যজ শ্রেণীর যুদ্ধবিদ্যা গ্রহণ করা যাবে না— এমন আরোপিত সামাজিক রীতির বিরুদ্ধে। যে রীতি তৃতীয় বিশ্বের ওপর আজও নিষেধাজ্ঞা হয়ে আছে। যেমন তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর পারমাণবিক অস্ত্র কিংবা পারমাণবিক কার্য্যক্রমের ওপর আরোপিত শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের নিষেধাজ্ঞা।…

সূতপুত্র হওয়াকে কর্ণ কখনো অগৌরবের মনে করেননি, কিন্তু সূতপুত্র হওয়ার কারণেই সমাজ তাকে দিয়েছে লাঞ্চনা। এখানে কথকের মহাবীর কর্ণের বেদনা জানার মর্ম্ম হয়তো এটাই!— কর্ণের বেদনা অন্ত্যজ মানুষের বেদনা!…

টা ন টা ন/
ধনুকের ছিলাময়/
বুড়ো আঙুলের ইতিহাসে/ মর্ম্মের পোড়নে জেগে ওঠে একলব্যবিশ্ব/…

এটি দারুন উৎসাহ ব্যঞ্জক চরণ।

একদিন কর্তৃত্ববাদী হস্তিনাপুরের স্বার্থের জন্য বিসর্জ্জিত হয়েছিলো প্রতিভাবান ধনুর্বিদ একলব্যের বৃদ্ধ্বাঙ্গুলি— তৎকালীন আর্য্যাবর্তের ক্ষমতা কেন্দ্র’র সূতিকাগার ছিলো হস্তিনাপুর। যে হস্তিনাপুর’কে সুরক্ষা দিতে মানসশিষ্য একলব্য’র বুড়ো আঙ্গুল কেটে নিয়েছিলো গুরু(!) দ্রোনাচার্য্য(ড্রোনাচার্য্য> ড্রোন আচার্য্য?!…)। ভয় ছিলো, নিষাদপুত্র একলব্য’র ধনুকের তীর একদিন ধেয়ে ধেয়ে আসবে হস্তিনাপুরের ক্ষমতা কেন্দ্রের কাঠামোর দিকে।… কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্নতা পেয়েছে। টান টান ধনুকের ছিলাময় বুড়ো আঙুলের ইতিহাসে হস্তিনাপুরের স্বার্থের কাছে বলি হওয়া ব্যাধ রাজ্যের মতো অবহেলিত তৃতীয় বিশ্ব আজ জেগে ওঠছে। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের প্রতি তারা আজ ভক্তিমূলক সমর্থন উঠিয়ে নিচ্ছে। পরাজয় ও উপনিবেশের ইতিহাস আজ একলব্যরূপী তৃতীয় বিশ্বকে মর্ম্মে মর্ম্মে পোড়াচ্ছে এবং জাগিয়ে তোলছে… ক্ষমতাকেন্দ্রের খুঁটি আজ মধ্যবিন্দু ছেড়ে প্রান্তরের দিকে সরে যাচ্ছে নতুন সৌন্দর্য্যে। গুটিকয় রাষ্ট্রের বিশ্বময় কর্ত্তৃত্ব করার রীতি বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। কর্ত্তৃত্ববাদী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ক্ষমতা লোপ পেতে যাচ্ছে, তাদের একচ্ছত্র কর্ত্তৃত্ববাদী ক্ষমতার বিপরীতে তৃতীয় বিশ্বের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো নিজেদের কর্ত্তৃত্বের অধিকার আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠছে। বিশ্বে একক কেন্দ্রের শাসন লোপ পেতে যাচ্ছে। প্রান্তের মানুষগুলি এখন নিজেদের শক্তির প্রতি আস্থাবান হয়ে ওঠছে।…

প্রাসাদের ভারবহ/ ক্ষমতা কেন্দ্রের খুঁটি/ মধ্যবিন্দু ছেড়ে/ নতুন সৌন্দর্য্যে সরে যায়/ প্রান্তরের দিকে/…

এই চিত্রকল্পটি সেই কথাই ঘোষণা করছে।… প্রাসাদের ভারবহ মধ্যবিন্দুর নতুন সৌন্দর্য্যে প্রান্তরের দিকে সরে যাওয়ার ব্যাপারটি মিলতে পারে উত্তর আধুনিক প্রকৌশল বিদ্যার সাথেও। (……)

বাংলা আসাম ও ওড়িষ্যার মতো বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাচ্যের প্রাচীন দার্শনিক খনা’র সম্পর্কে নানান লোকশ্রুতির (প্র)চলন আছে। একটি লোকশ্রুতি মতে, প্রতাপাধিত্যের সভাপণ্ডিত পুরুষতন্ত্রের (প্রতি)নিধি কর্ত্তৃত্ববাদী বরাহ নারীর প্রতিভা ও চর্চ্চায় ইর্ষান্বিত হয়ে পুত্র মিহিরের সহায়তায় কেটে দেয় পুত্রবধু খনার জিহ্বা। কর্ত্তৃত্ববাদী পুরুষতন্ত্রের এমন ঘৃণিত পদক্ষেপ সত্ত্বেও খনা’র বচন ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে। কথার মালায় রচা বিনিসুঁতো মালারূপী খনা’র বচনগুলো হয়ে ওঠে অবিসংবাদীত কৃষিবিজ্ঞান/কৃষিবিধান… এ অঞ্চলে খনা সম্পর্কিত প্রায় সব লোকশ্রুতিই গড়ে ওঠেছে প্রান্তিক/লোকজ মেজাজে। তাই মিহিরের স্ত্রী হোক, দার্শনিক ঋষি অটনাচার্য্য’র কন্যা হোক, রাজকুমারি হোক কিংবা রাক্ষসকন্যা— যাই হোক না কেনো, সর্ব্বত্রই সাধারণ মানুষ খনাকে নিজেদের বলে গ্রহণ করেছে। খনা’র বচন যেভাবে প্রান্তিক কৃষিসমাজকে নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে নিয়েছে তেমনি বচনগুলি আবার হয়ে ওঠেছে প্রান্তিক মানুষের (উদ্)যাপনের কথামালা।…

মুক্তক অক্ষরবৃত্তে রচিত ‘(উদ্)যাপনের কথামালা’য় পর্ব্ববিভাগ দেখানো হয়েছে (/) বিকল্পচিহ্নের মাধ্যমে। এই অভিনব রীতিকে একধরণের আঙ্গিক প্রতিকাব্যরীতি ভাবা যেতে পারে। মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্য ও পুঁথি সাহিত্যে পদ-পর্ব্বান্তে এবং চরণান্তে তারকা চিহ্ন কিংবা দুই দাঁড়ির ব্যবহার হয়েছে। আধুনিক কবিদেরও কেউ কেউ দুই দাঁড়ির ব্যবহার করেছেন। আবার একেবারে ছেদ যতিচিহ্নহীন টেক্সটও লিখেছেন। কেউ কেউ হাইফেন ও ড্যাস চিহ্ন ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এভাবে ছেদ অর্দ্ধযতি পূর্ণযতির পরিবর্তে সর্ব্বত্র বিকল্প চিহ্নের ব্যবহার আগে কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না।

‘(উদ্)যাপনের কথামালা’য় মোট পর্ব্ব সংখ্যা ঊনত্রিশ, মোট পংক্তি বিশ, মোট চরণ সংখ্যা পাঁচ। প্রথম পর্ব্বটি আট মাত্রার আর সর্ব্বশেষ পর্ব্বটি দশমাত্রার। সর্ব্বনিম্ন চার থেকে ছয় আট দশ এগার ও সর্বোচ্চ ষোল মাত্রার পর্ব্ব ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক সময় একমাত্র শব্দ একটি পর্ব্ব ও পংক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রত্যেক চরণ আলাদা আলাদা ভাব সম্বলিত এবং পূর্ব্ব চরণের সাথে পরের চরণের গভীর ভাবগত তাৎপর্য্যময় সম্পর্ক থাকায় সম্পূর্ণ কবিতায় কোথাও ভাবের প্রবাহমানতা লঙ্ঘিত হয়নি। সরল প্রাঞ্জল ভাষা ব্যবহারের ফলে ভাব-প্রবাহমানতার সাথে সাথে আশ্চর্য্যজনকভাবে সুরের প্রবাহমানতাও গড়ে ওঠেছে। পরাণ, কৃষ্ণকালা, পোড়ন, বিনিসুঁতো প্রভৃতি লোকজ শব্দের ব্যবহার কোমল সুর মাধুর্য্য সৃষ্টির সহায়ক হয়েছে।…

পরাণ কথার নীড়, অন্ত্যজ মাটির কাঁচাসোনা, বুড়ো আঙুলের ইতিহাস, একলব্যবিশ্ব, ক্ষমতা কেন্দ্রের খুঁটি, বিনিসুঁতো মালা প্রভৃতি প্রতীক ও রূপক কবিতাটিকে দারুণ ব্যঞ্জনাময় করে তোলেছে। পৌরাণিক ঘটনাও কিংবদন্তির ভিত্তিতে রচিত হলেও কবিতায় এসব ঘটনা মহাকালীন ও সমকালীন রাজনৈতিক সমাজ বাস্তবতার তাৎপর্য্য ধারণে সক্ষম। পুরাণ ও কিংবদন্তি এখানে যেমন কবিতার অঙ্গ হয়েছে তেমনি আবার মহাকালীন ও সমকালীন বাস্তবতায়ও একাকার হয়েছে। কর্ণ একলব্য ও খনা যেমন উপেক্ষিত শক্তি তেমনি তারা উপেক্ষিত অন্তজ্য শ্রেণীর (প্রতি)নিধিও।…

কবিতায় কর্ণ, একলব্য ও খনার প্রতি সহমর্মিতা ও সমবেদনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে চিরকালের অবহেলিত লাঞ্চিত প্রান্তিক জনসমাজেকে জাগরণের প্রেরণাও দেওয়া হয়েছে। এখানে কর্ত্তৃত্ববাদী কথিত কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতি যেমন প্রচ্ছন্ন ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে তেমনি তাদের বিলুপ্তির পূর্বাভাসও ঘোষিত হয়েছে।…

কবিতায় বীররসের পাশাপাশি রুদ্র ও করুণ রসের অবস্থান থাকলেও শেষপর্যন্ত বীররসই প্রকট হয়েছে। তাই ‘(উদ্)যাপনের কথামালা’ প্রান্তিক মানুষের জাগরণের চিত্র লালিত আগামী বিশ্বের (উদ্)যাপনের কথামালা……………

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার