আহা কালা,
রাঘবনন্দন তুমি বোয়ালস্বভাবা!….
আহা রে রাঘব,
আহা রে বোয়াল, কী এমন রূপ রস বর্ণের প্রথায়
ধরি রূপ
এসেছো মাৎস্যন্যায়ে,
জলাঙ্গির ঢেউয়ে ভেজা হিজলডাঙগায়;
করাল দাঁতের আগ্রাসনে কাঁপে চা রি ধা র!…
পদ্মদীঘির জলে
মাছের মেয়েরা ভুলেছে সাঁতার, ডুবডুবখেলা,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে
ধিঙ্গি তালে নাচায় না জলের শরীর,
মৌনবিকেলের কোলে
উঠায় না মৃদুঘায়,
বুদবুদকথা, ভাষা, ফুলেল মালঞ্চ ভাসা
দলকলমির সংসারে,
করাল দাঁতের আগ্রাসনে কাঁপে জলধির বিপুলা বাসর!…
আহা রে রাজন্য, আহা রে বোয়াল,
বিশ্বময়
গিলে খাও পুঁটির মায়ের সঙসার, রাজ্যপাট!…
বোয়ালিয়া নদীর কিনারে
সজল মেঘের নাদে নি না দি ত
শ্যামল বর্ষায়
প্রমিলাসাহসে জাগে চা রি ধা র। মহালংকার কোলে,
আহারে বোয়াল,
বাদ্যে ওঠে রনতাণ:
আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে?…
— রাঘব > বোয়াল // আরণ্যক টিটো
রঘুবংশীয় রাজা রামচন্দ্রকে আমরা যেমন জানি বিষ্ণুর অবতার হিসাবে তেমনি জানি রাবণ নামক রাক্ষস নিধনকারী বীর হিসাবে। রঘুবংশজাত বলে রাম যদি রাঘব হয়ে থাকেন, সে হিসাবে তিনি আবার রাঘবনন্দনও। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে রাম/রাঘব লঙ্কারাজ রাবণকে নিধন করে সমকালীন সত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে রাঘবের নাম একটি আগ্রাসী মাছের সাথে যুক্ত হয়ে রামভক্ত এই জনপদেই চেতনে কিংবা অবচেতনে গড়ে ওঠেছে, রাঘব বোয়াল বাগধারা/কথাপ্রবাহ। কথিত রাক্ষস বিনাশী রাম বনে গেলেন নিজেই রাক্ষস!
ভাবতে হবে, রাঘব বোয়াল— এ কি নিছক বাঙালির হেঁয়ালিপনা, নাকি এর ভেতর দিয়েই প্রকাশিত হতে চাইছে বাঙালির উপনিবেশ ও আধিপত্যবাদবিরোধী সত্ত্বা?!…
ইতিহাসকারগণ এ জনপদের ইতিহাসে “মাৎসন্যায়” নামক একটি সময় নির্দেশ করেন। আর তা একেবারেই রাজনৈতিক।… জলাশয়ে আগ্রাসী রাঘব/বোয়াল যেমন অপেক্ষাকৃত ছোটো মাছগুলোকে গিলে খায়, ধাওয়া করে; তেমনি বিশ্বে বলশালী বৃহৎ রাজ্যগুলো অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র দুর্ব্বল রাজ্যগুলোকে দখল করে নেয়।… এই যে বোয়ালরীতিতে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার— এটাই নাকি মাৎসন্যায়। পণ্ডিতগণের ভাষ্যে, বাংলার ইতিহাসে নাকি এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো সম্রাট শশাঙ্কের পরে এবং গোপালদের উত্থানের পূর্ব্বে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, মাৎসন্যায় বিশ্বরাজনীতির নিত্যনৈমিত্যিক ব্যাপার। তবে দখলের ধরণটা হয় নানান কিসিমের। যেমন বাজার দখলসহ বিচিত্র কৌশলের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ।
বিশ্বের অধিকাংশ ইতিহাস যেমন রাজারাজড়ার ইতিহাস তেমনি আবার বিজয়ীদের বীরত্বগাথাও।… বিজয়ীদের আনুকূল্যে রচিত ইতিহাস পড়লে বুঝা যায়, ইতিহাসের নামে তারা যেমন নিজেদের গৌরবজ্জ্বল কাহিনী বর্ণনা করে তেমনি আবার পরাজিত শক্তির ওপর আরোপ করে নানান কলঙ্ক ও অপবাদ। বিজয়ী জাতি পরাজিত জাতির ওপর নিজেদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি চাপিয়ে দেয় নিজেদের ধর্ম্ম, সামাজিক রীতিনীতিসহ সংস্কৃতির নানান উপাদান। আর পরাজিতরা অনেকটা হতাশ হয়ে ধীরে ধীরে আক্রান্ত হতে থাকে বিজয়ীদের বিশ্বাস ও আচার দ্বারা। সাথে সাথে তারা বিজয়ীদের জীবনাচারকেই একমাত্র মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনা করতে থাকে। এভাবে পরাজিত শক্তিগুলো নিজদেরকেই নিজেরা একসময় হীন, দুর্ব্বল, অসভ্য বর্ব্বর নানা রকম দোষে দোষী সাব্যস্ত করতে শুরু করে।…
আর্য্যরা ভারতবর্ষ অধিকার করার পর এখানকার আদি জনগোষ্ঠির ওপর নিজেদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পাশাপাশি চাপিয়ে দিয়েছে নিজেদের জীবনাচারও।… তারা নিজেদের রুচির বাটখারা দিয়ে মেপে এখানকার ভূমিজদের আখ্যা দিয়েছে অসভ্য, অনার্য্য, বর্ব্বর বলে। এভাবেই নাকি এ জনপদের ভূমিপুত্ররা কেউ পরিণত হয়েছে রাক্ষস-কুক্ষসে আবার কেউ পরিণত হয়েছে ডোম হাড়ি ব্যাধসহ বিচিত্র নিম্নবর্গীয় ও অবহেলিত বর্ণে গোত্রে।…
আর্য্যরা এখানে নিজেদের উপনিবেশকে নৈতিকভাবে জায়েজ করার জন্য এখানকার আদি জনগোষ্ঠির চরিত্রের ওপর লেপন করেছে অসুর/রাক্ষস কলঙ্ক আর ইঙ্গরাজরা তাদের আগ্রাসন জায়েজ করার জন্য যুক্ত করেছে অসভ্যতার অপবাদ। বৃটিশদের এসব অপবাদ আজও আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়। তাই আমরা ঔপনিবেশিক/সাম্রাজ্যবাদী জাতিদের পিছনে ছুটি ‘বৃটিশ বৃটিশ’ ভদ্র হওয়ার সাধনায়।… কোম্পানি পিরিয়ডে নাকি বৃটিশরা তাদের দখল জায়েজ করার জন্য সিরাজদ্দৌলার ওপর যে কলঙ্ক আরোপ করেছিলো, তা খুব তৃপ্তি সহকারে চাটত হাজার হাজার ভারতীয় সন্তানও।… বৃটিশরা বলত, তারা এখানে জোর জুলুম করতে নয় বরং এখানকার লোকদের সভ্যতা শিখাতে এসেছে। কারণ ভারতীয়রা অসভ্য আর তারা ঈশ্বরপুত্র।… এখন ভাবতে হবে, রাবণের ভয়ানক রাক্ষসে পরিণত হওয়া আর রামের অবতারে পরিণত হওয়ার পিছনেও কোনো আগ্রাসী ভূমিকা কাজ করেছিলো কিনা!?… অথবা রাবণকে যতোটা অমানুষি চরিত্র হিসাবে (উপ)স্থাপন করা হলো, আসলে ততোটা (অ)মানুষ কিনা!?…
চলুন তবে পাঠ করি, রাঘব> বোয়াল:
আহা কালা,
রাঘবনন্দন তুমি বোয়াল স্বভাবা।…
এখানে কালা কি কোনো বধির আগ্রাসী শক্তি, যে স্বভাবে বোয়ালের মতোই আক্রান্তের মিনতি কানে তোলে না?! না, তা হয়তো নয়। কালা হতে পারে শ্রীমাণ কৃষ্ণ। এমন হলে ভাবতে হবে, রাঘবনন্দন এখানে আর রঘুবংশীয় হিসাবে নয় বরং আধিপত্যবাদী শক্তির প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।… তাহলে কৃষ্ণকালাও কী কোনো বোয়ালস্বভাব আগ্রাসি শক্তি!? এমনিই ঈঙ্গিত মিলে মহাভারত’র যুদ্ধ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক অনেক ভাষ্যে। কেউ কেউ বলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নাকি আসলে সারথী কৃষ্ণ আর পাশাড়ু শকুনি’র মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ।… শুধু কি মতাদর্শ? হতে পারে, সর্ব্বপ্রকার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ।… এখানে আরও মনে রাখতে হবে যে, রামচন্দ্র আর শ্রীকৃষ্ণ দুজনই বিষ্ণুর অবতার এবং দুজন দুটি বিশেষ যুগে আভির্ভূত হয়েছিলেন স্ব স্ব যুগের অবিসংবাদিত শক্তিরূপে। অনেকটা যুগের আবেদনেই একজন ছিলেন পরাক্রমশালী বাহুবল সম্পন্ন আর অপরজন ছিলেন প্রবল মেধাশক্তি সম্পন্ন এবং দুজনই ছিলেন একই শক্তির ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ।… তাহলে বিষ্ণুই কি স্বয়ং রাঘব আর তার অবতারগণ রাঘবনন্দন/আধিপত্যবাদী শক্তির (প্রতি)ভূ?!…
এবার চিত্রকল্পটি পাঠ করা যাক—
আহা রে রাঘব,
আহা রে বোয়াল, কী এমন রূপ রস বর্ণের প্রথায়
ধরি রূপ
এসেছো মাৎসন্যায়ে,
জলাঙ্গির ঢেউয়ে ভেজা হিজলডাঙায়;
করাল দাঁতের আগ্রাসনে কাঁপে চা রি ধা র!…
পদ্মাদীঘির জলে
মাছের মেয়েরা ভুলেছে সাঁতার, ডুবডুবখেলা,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে
ধিঙ্গি তালে নাচায় না জলের শরীর,
মৌনবিকেলের কোলে
উঠায় না মৃদুঘায়,
বুদবুদকথা, ভাষা, ফুলেল মালঞ্চ ভাসা
দলকলমির সংসারে,
করাল দাঁতের আগ্রাসনে কাঁপে জলধির বিপুলা বাসর! …
মাৎসন্যায়কালে রূপ রস বর্ণের প্রথায় আগ্রাসী বোয়াল হানা দিয়েছে জীবনানন্দীয় এ ডাঙায় আর তার ধারালো দাঁতের আগ্রাসনে কাঁপছে জলময় জনপদের চারিধার। বোয়ালের ভয়ানক মহড়ায় দীঘির জলে সন্ত্রস্থ ছোটো ছোটো মাছের মেয়েরা ভুলে গিয়েছে সাঁতার, জীবনোপভোগের কৌশল।… এটি শুধু কোনো বোয়ালিয়া জলাশয়ের চিত্র নয়, যুগ যুগ ধরে আধিপত্যবাদী ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি/রাজনৈতিক বোয়াল দ্বারা এজনপদের রাজনৈতিক জীবন আক্রান্ত হবার চিত্রও।
এখানে মাৎসন্যায় হচ্ছে ঔপনিবেশিক/সাম্রাজ্যবাদী অরাজকতা আর বোয়াল হচ্ছে কোনো পরাশক্তি/পরারাষ্ট্র/ঔপনিবেশিক শক্তি।… রূপ হতে পারে বিচিত্র ধরণের উপনিবেশ/সাম্রাজ্যবাদ, রস হতে পারে আগ্রাসী শক্তির নানা রসদ বা লোকভুলানো চোখধাঁধানো জীবনাচার আর বর্ণ হতে পারে আরোপিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা। আবার এমনও হতে পারে রূপ রস বর্ণ আসলে আগ্রাসি মানবের ধ্বংসাত্বক প্রেরণা। অথবা…
…মাছের মেয়েদের সাঁতার বিস্মৃত হওয়ার বিষয়টি দিয়ে এখানে হয়তো, এ জনপদের নিরীহ মানুষের শঙ্কিত মানস এবং ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের প্রভাবে তাদের নিজস্ব জীবনাচার ও সমাজ ব্যবস্থা বিস্মৃত হওয়ার ইঙ্গিত করা হচ্ছে। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, এ জনপদের মানুষ আবহমান কালধরে জীবন যাপনে রাষ্ট্র অপেক্ষা সমাজের ওপরই নির্ভর করেছে বেশি। সমাজই এখানে পালন করেছে রাষ্ট্র/রাজ্য/সরকারের ভূমিকা; তা সে যে রূপ সমাজই হোক না কেনো। তাই জনসাধারণ দীর্ঘকাল যাবত উদাসিন থেকেছে রাজারাজড়ার বোয়ালনীতির প্রতি। আর সে সুযোগে এখানকার জনজীবনে একের পর এক ঘটে গেছে মাৎসন্যায়, রাজনৈতিক বিপর্য্যয়। আর্য্য থেকে সেন, মোগল থেকে ইঙ্গরাজ, এমন আরো কতো কতো বহির্শক্তি রাঘব হয়ে এ জনপদে নানারূপে রসদে বর্ণে চাপিয়ে দিয়েছে/দিচ্ছে নিজেদের প্রথা , রাজনৈতিক মতাদর্শ।… এখানে একের পর এক ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে, রাজায় রাজায় দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়েছে, বদল হয়েছে/হচ্ছে মন্দিরের পুরোহিত্য, মসজিদের পরিচালনা কমিটি। ফলে সমাজে নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ছে প্রথার প্রকোপ, মতবাদের বিষক্রিয়া।… ১৯০৫/ ১৯৫২ সালের পূর্ব্ব পর্যন্ত কিছুই যেন করার ছিলো না দেশের মানুষের। রাজা রাজড়ার দ্বন্দ্ব-সংঘাতে সাধারণ মানুষ সর্ব্বদা থেকেছে ভীত সন্ত্রস্থ। জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়নে তারা ভুলে গিয়েছে আত্মশক্তি। ফলে বার বার আক্রান্ত হয়েছে তাদের ভাষা-সাহিত্য। এভাবে সাহিত্যের ইতিহাসে যোগ হয়েছে অন্ধকার যুগের মতো বন্ধ্যা সময়, অনেক শেকড়হীন সাহিত্য।…
আহা রে রাজন্য, আহা রে বোয়াল,
বিশ্বময়
গিলে খাও পুঁটির মায়ের সংসার, রাজ্যপাট!…
এখানে প্রেক্ষাপট আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠেছে। এতক্ষণ আমরা রাঘব/বোয়ালের ভারতবর্ষ বা বাংলায় আগ্রাসনের চিত্র দেখেছি আর এখন তা ভাবতে হবে বিশ্বপরিসরে। ভাবতে হবে আধিপত্যবাদী পরারাষ্ট্র/রাজন্য কীভাবে গিলে খাচ্ছে পুঁটির মায়ের সংসার, রাজ্যপাট।… পুঁটির মায়ের সংসার বলতে এখানে হয়তো ছোটো দুর্ব্বল রাষ্ট্রগুলোর বাজার সম্পদ, সর্ব্বোপরি ভূখণ্ডকে বুঝানো হচ্ছে। আর এখানে যুগ যুগ ধরে বলশালী রাষ্ট্র কর্ত্তৃক ক্ষুদ্র, দুর্ব্বল রাষ্ট্রগুলোর ওপর নানান ধরণের ঔপনিবেশিক/সাম্রাজ্যবাদী দখলদারি মনোভাব ও আচরণকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে।…
মহাকবি বাল্মীকি রচিত রামায়ণ আর কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণের কাহিনীতে কিছুটা হেরফের থাকলেও উভয় টেক্সটে রামকে রূপায়ণ করা হয়েছে অবতার রূপে আর রাবণকে রূপায়ণ করা হয়েছে পিশাচ রূপে। রামায়ণের মূলকাহিনী প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন পরাশক্তি অযোধ্যা কর্তৃক সোনার লঙ্কা বিধ্বস্ত হওয়ার ইতিহাস।…
ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে সেই আদি রামায়ণী মূল্যবোধে আঘাত হানলেন মহাকবি মাইকেল মধুসূধন দত্ত। তার সাহিত্যিক মহাকাব্য “মেঘনাদ বধ”এ বিজিত শক্তি রাম-লক্ষণ অপেক্ষা অধিক মহিমাময় হয়ে ওঠলো রাবণ। যে রাবণকে এ জনপদের রামভক্ত মানুষ এতোদিন জেনে এসেছে ঘৃণিত দানব/পিশাচ/রাক্ষস রূপে, “মেঘনাদ বধ” কাব্যে সে রাবণকে দেখলো মানবিকতার আবেগ ও মূল্যবোধের গরিমায়।… তবে কি মাইকেলও বুঝে ফেলেছিলেন বিজিত শক্তির আনুকূল্যে রচিত ইতিহাস ও আরোপিত মূল্যবোধের মারপ্যাঁচ?! রাবণকে এমন মানবিক আদলে (উপ)স্থাপনের পিছনে কি মাইকেলের স্বচেতন বিনির্ম্মাণমূলক কোনো ইচ্ছা ছিলো, নাকি এশুধু মহাকাব্যের ধর্ম্ম রক্ষারই অনিবার্য্যতা?!…
বোয়ালিয়া নদীর কিনারে
সজল মেঘের নাদে নি না দি ত
শ্যামল বর্ষায়
প্রমিলা সাহসে জাগে চা রি ধা র। মহালংকার কোলে,
আহারে বোয়াল,
বাদ্য ওঠে রণতান:
আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে?…
“মেঘনাদ বধ” কাব্যে লক্ষণের ধূর্ত্ত আক্রমণে বীর মেঘনাদ নিহত হওয়ার পর তার স্ত্রী শোকাতুরা বিক্ষুব্ধ প্রমিলা নিজেই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে উদ্যত হয় এবং রামরাঘবের প্রতি উচ্চারণ করে তাচ্ছিল্যভরা জ্বালাময়ী বাক্যবাণ— আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে? না, প্রমিলা সেদিন কোনো প্রতিরোধ-প্রতিশোধে নামেনি। কিন্তু তার এই সাহসি উচ্চারণই যেন আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো মহাকালের যাত্রায় আর উস্কে দিলো আধিপত্যবাদ বিরোধী আগুন— হোক তা কাব্যের পঙক্তি মাত্র!…
এখানে ‘মেঘনাদ’ কে বিনির্ম্মাণের মাধ্যমে কল্পনা করা হয়েছে সজল মেঘের নিনাদ রূপে যা আবার দখলদারি শক্তির জন্য সতর্ক বার্ত্তাও হয়ে ওঠেছে। মেঘের নিনাদ আর প্রমিলা সাহস দুটোই যেন এখানে সঞ্চার করছে বীরত্বের রস(দ)। তাই আন্তর্বয়ানে সরাসরি উচ্চারিত হচ্ছে, আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে?…
আগ্রাসী বোয়াল এবার নিজেই পরিণত হবে আহারে।…
বিশ্ব রাজনীতির সাম্রাজ্যবাদী দখলদারি প্রেক্ষাপট আজ ধীরে ধীরে পরিবর্ত্তিত হচ্ছে। দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শক্তির থাবায় আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে নিজেদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির হস্তক্ষেপ, আরোপিত নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তির তাগিদে। ঔপনিবেশিক মানস ছিন্ন করে তারা নিজেদের শক্তির প্রতি আস্তাবান হচ্ছে, মুছে নিচ্ছে আরোপিত কলঙ্ক ও অপবাদ। তারা বিনির্ম্মাণ করে নিচ্ছে ইতিহাস, জীবনাচার। আর সেই বিনির্ম্মাণ চেতনা-ই তাদের বিজয়ের প্রেরণা হয়ে ওঠেছে।
এটি একটি বিনির্ম্মাণমূলক টেক্সট। এখানে রাম-রাবণ সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাকে সরাসরি উল্টে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসকে দেখা হয়েছে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে আর তাতে একমাত্র ভিত হিসাবে ভূমিকা রেখেছে, রাঘব-বোয়াল কথাপ্রবাহ এবং এটাই বক্তব্যের অনুকূলে মূল উপাদান ও প্রেরণা। দুই পঙক্তি বিশিষ্ট ওপরের চরণ বাদ দিলে পুরোটাই একটা চিত্রকল্প। যদিও কিছুটা দুর্ব্বলতা আছে… কিন্তু দুই ধরণের মাৎসন্যায়কে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য হয়তো তা অনিবার্য্যও ছিলো। ভাবের সাথে মিল রেখেই এগিয়েছে এর মুক্তক অক্ষর বৃত্তীয় গীতলতা এবং যথার্থ সাবলিলভাবেই একাত্ম হয়ে গেছে আন্তর্বয়ানও।…
এখানে ভাবতে হবে, লঙ্কা নিছক শ্রী সুবর্ণ লঙ্কা নয় তা যুগ যুগ ধরে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসনে বিধ্বস্ত সকল জনপদের প্রতীক। সুতরাং চলুন প্রস্তুত হই, স্বয়ং বোয়ালকেই আহার করার প্রত্যয়ে!…