পরমা প্রকৃতি জানে, পরমপুরুষে, লিঙ্গের কাহিনি জানে শিবের লাঙ্গল!
অকর্ষিত মাঠে,
‘এই
থিতি থিতি’ বোলে
হালের বিছাল চষে হলরেখা, মাটির জনন!…
শিল্প হলো অর্দ্ধনারীশ্বর, যাহার অর্দ্ধেক শিব
অর্দ্ধেক পার্ব্বতী!
মন রে,
কৃষিকাজ জান না, আনন্দসাধনে!
মেঘলা মনের চুম্বনে, জল ঝরঝর বরিষনে অভিভূত
চারণ কৃষক কালিদাস
মাটির শরীরে দেয় শস্যজ ইশারা!
ভূঁইয়া
বর্ষায় নেবে ভূমির পরশ, শ্রাবণে নিয়েছে পাঠ লাঙ্গলের ভাষা,
কতোটা গভীরে ফলে শস্যজ শ্যামশ্রী!…
শ্যামলিমা,
দিয়েছে যে মন,
পলির নন্দন মাখা ভূমির দখল, দখলিয়া নদীর কিনারে।…
দূরবনে
পাখিটা ডাকছে থেমে থেমে,
কৃষ+ণ> কৃষ+ই> কৃষ+টি!…
আহা! কৃষ্ণ কোথায় রে? রাধা, ধারাপাত পড়ে, লাঙ্গলের!…
— লাঙ্গল বান্ধব // আরণ্যক টিটো
আরণ্যক টিটো’র কবিতা পাঠ মানে শব্দের বহুরৈখিক ভাবের জগৎ পরিভ্রমণ করা। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি উদ্ভাবন করে কলিম খান দেখিয়েছেন কী ভাবে একটি মাত্র শব্দের হাত ধরে মানব সমাজের অতীত থেকে বর্ত্তমান অবস্থার নানা দিগন্ত উন্মোচন করা যায়।… আর তা আরণ্যক টিটো কবিতায় প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন, একটি কবিতা কী ভাবে বিচিত্র বিষয়কে ধারণ করে একটি জীবন দর্শনে স্থিতি লাভ করে। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি ছাড়াও শব্দকে বহুরৈখিক অর্থে (উপ)স্থাপন করতে অনুসরণ করেন কিছু নিজস্ব রীতিও।… শব্দের বহুরৈখিক ব্যঞ্জনা কবিতাকে দেয় বহুরৈখিক অর্থময়তা। আর বহুরৈখিক চরণ সম্পূর্ণ কবিতাটিকে দেয় বহুরৈখিক ভাবময়তা। শুরু হয় একটি শব্দ দিয়ে, তারপর সে শব্দ আরো অনেক শব্দের সাথে নানাবিধ সম্পর্ক পাতাতে পাতাতে খেলা করে বিচিত্র ভাবের সাথে।… শেষ পর্যন্ত বিচিত্র ভাবের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একটি ভাবকাঠামো। যেমন— ‘লাঙ্গল বান্ধব’ কবিতা।
ভাবতে পারেন, লাঙ্গল তো এখন বিলুপ্ত— কেনো তবে লাঙ্গলের কথা?!…
কৃষকের লাঙ্গল হয়তো লোপ পেয়েছে। কিন্তু লাঙ্গলের সাথে আমাদের শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম্ম, অর্থনীতি, রাজনীতির কতো গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান এবং আগামীতে তা কতোটা অবলুপ্ত থাকবে সে রহস্য উদ্ঘাটন করার জন্য গভীর মনোযোগের সাথে পাঠ করতে হবে ‘লাঙ্গল বান্ধব’…
কবি বলতে চাচ্ছেন— পরমা প্রকৃতি জানে, পরম পুরুষে, লিঙ্গের কাহিনি জানে শিবের লাঙ্গল!…
আদি মৈথুন তত্ত্ব মতে, ‘প্রকৃতি’ মানে ক্ষেত্র আর ‘পুরুষ’ হচ্ছে চিৎ শক্তি/কর্ষক— প্রাচীন ভারতীয় শৈব, শাক্ত উভয় ধর্ম্মতত্ত্বে সে কথা বিবৃত আছে।… প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে পরমা প্রকৃতি হচ্ছে ‘ব্রহ্মযোনি’ আর পরম পুরুষ হচ্ছে ‘কর্ম্মময় চিৎ-শক্তি’, যা জগৎ সৃষ্টির মূল কারণ। পণ্ডিতদের মতে, আদি মৈথুন তত্ত্বের সাথে ধর্ম্মের কিছুটা সম্পর্ক রয়েছে। এজন্যই হয়তো প্রকৃতি-পুরুষের মতো কুন ফায়া কুন, আত্মা-পরমাত্মা প্রভৃতি ধর্ম্ম সম্পর্কিত বিশ্বাসের সাথে একটা মিল পাওয়া যায়। আবার প্রত্যেক পদার্থের/পরমাণুর মধ্যে চিৎ-শক্তি বিদ্যমান— বিজ্ঞানের এমন ধারণা ও ধর্ম্ম দর্শনের সাথে একাকার হয়ে যায়।
আচ্ছা শিবের লাঙ্গল কেনো লিঙ্গের কাহিনি জানে?! শিব, লিঙ্গ, লাঙ্গল এমন শব্দের মধ্যকার সম্পর্কটাই বা কী?!…
ভারতীয় মাত্রই শিব আর লিঙ্গের একপ্রকার সম্পর্ক বুঝে নিতে পারেন। কিন্তু লিঙ্গের সাথে লাঙ্গলের কী সম্পর্ক হতে পারে?!…
হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় রচিত “বঙ্গীয় শব্দকোষ” আমাদের জানাচ্ছে, লিঙ্গ শব্দের একটি অর্থ ‘জ্ঞানসাধন’। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুসারে লীন হওয়ার জন্য যা গমন করে তা-ই ‘লিঙ্গ’। সুতরাং শুধুমাত্র পুংলিঙ্গ নয়, লীন হওয়ার জন্য যা যা গমন করে সবকিছুই লিঙ্গ পদবাচ্য বলে বিবেচিত। সে অর্থে লাঙ্গল শব্দও লিঙ্গ পদবাচ্য। আরো পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, লিঙ্গ হচ্ছে একপ্রকার ‘শক্তি’ বা ‘আধেয়’।… যাস্ক’র মতে, প্রত্যেক শব্দই ধাতু নিষ্পন্ন। পানিণি বলেছিলেন, একই ক্রিয়ামূল উৎসজাত সব শব্দ একই ধরণের পদবাচ্য হবে, যা বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধিরও ভাষ্য।… সুতরাং এদিক থেকেও লাঙ্গল শব্দ লিঙ্গ জাতীয় পদবাচ্য।… সুতরাং এখন বুঝা যাচ্ছে কর্ম্মযোগী শিবের সাথে লিঙ্গ ও লাঙ্গলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যা আবার উৎপাদনজনিত।
এবার আসা যাক, আমাদের কৃষি সংস্কৃতিতে— লক্ষ্য করি চিত্রকল্পনা— কৃষক বোল দিচ্ছে— এই থিতি থিতি। হালের বিছাল চষে যাচ্ছে, ঘটছে মাটির জনন।… হালের বিছাল হয়তো এখন নাই। কিন্তু কৃষক, শিল্পী তো আছে, মাটির/শিল্পের জনন তো ঘটাচ্ছে। এখানে খেলাটা বুঝতে হবে— ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে— পণ্যের দিকে যাবো নাকি উৎপণ্নের দিকে।…
কবির মতে— শিল্প হলো অর্দ্ধনারীশ্বর, যাহার অর্দ্ধেক শিব
অর্দ্ধেক পার্ব্বতী!
ভারতীয় পুরাণ মতে, সৃষ্টি মাত্রই অর্দ্ধনারীশ্বর। সুতরাং সেই অর্থে মানবসমাজ, সমাজের উৎপাদিত সামগ্রী সবকিছুই অর্দ্ধেক শিব হলে অর্দ্ধেক পার্ব্বতী। প্রাচীন ভারতীয় সাম্যবাদী সমাজে নাকি নারী-পুরুষ কিংবা কর্ম্মী-জ্ঞানী’র মধ্যে কোন বৈষম্য ছিলো না। উৎপাদন কাজে যেমন সবারই সমান অংশ গ্রহণ ছিলো তেমনি উৎপাদিত সামগ্রী বণ্টনেও সবাই সমান অংশ পেতো। সম্পূর্ণ ব্যাপারটি অনুধাবণ করার জন্য এখানে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ বিধির শব্দের বহুরৈখিকতার ইঙ্গিতটি মাথায় রাখতে হবে। এখানে নারী যেমন স্ত্রীলিঙ্গ তেমনি কর্ম্মীও। পুরুষ যেমন চিৎশক্তি তেমনি আবার জ্ঞানযোগীও। ঠিক একই ভাবে ভাবতে হবে শিব-পার্ব্বতী শব্দগুলো সম্পর্কেও। তাহলে আমরা প্রাচীন ভারতীয় সাম্যবাদী সমাজের পাশাপাশি উত্তর আধুনিক প্রপঞ্চের নারী-পুরুষ, কর্ম্মযোগী জ্ঞানযোগী’র মধ্যে আধিপত্যহীন কাঙ্খিত সমাজ ব্যবস্থাটাকেই পাবো। সমাজের যেমন নারী-পুরুষ বৈষম্য থাকবে না তেমনি বৈষম্য থাকবে না শ্রমিক-মালিকে, কর্ম্মী-জ্ঞানীতে, শাসিত-শাসকে, প্রান্ত-কেন্দ্রে।… সুতরাং আমাদের শিল্প, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সবকিছুই হবে অর্দ্ধনারীশ্বর! আমাদের শিল্প হবে না কেবলই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি আক্রান্ত।… প্রকৃতি আর পুরুষের মধ্যে থাকে নিজ নিজ যোজনগন্ধ, যা কামনা বা কাজ করার ইচ্ছার মতো। স্ব-স্ব যোজন গন্ধ উভয়ের মাঝে যোগ ঘটালে ঘটে রতিক্রিয়া। আর তাতেই সম্পাদন হয় উৎপাদন কর্ম্ম।… সুতরাং প্রকৃতি পুরুষের সমান অংশগ্রহণ— এতে কারও ওপর কারওর আধিপত্য নাই।…
পাঠ করা যাক—
মন রে,
কৃষিকাজ জান না, আনন্দসাধনে!
মেঘলা মনের চুমবনে, জল ঝরঝর বরিষনে অভিভূত
চারণ কৃষক কালিদাস
মাটির শরীরে দেয় শস্যজ ইশারা!
ভূঁইয়া
বর্ষায় নেবে ভূমির পরশ, শ্রাবণে নিয়েছে পাঠ লাঙ্গলের ভাষা,
কতোটা গভীরে ফলে শস্যজ শ্যামশ্রী!…
কবি কৃষিকাজ এবং শিল্প রচনা বা কাব্য রচনার বিষয়কে আনন্দ সাধনের সাথে সম্পর্কিত মনে করেছেন। আর কালিদাসকে বলেছেন চারণ কৃষক, যে ভূমির পরশ নিচ্ছে, লাঙ্গলের ভাষার পাঠ নিচ্ছে। কৃষিকাজের সাথে কাব্যচর্চ্চার ব্যাপারটাকে আরও অনেকেই হয়তো তুলনা করেছেন। কিন্তু ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি এখানে আমাদের আরও একটি গভীর সম্পর্কের ধারণা দিতে পারে। যেমন— লিঙ্গের লীন হওয়ার জন্য গমন আর কলমের লীন হওয়ার জন্য গমনের ব্যাপারটা একই। সুতরাং লিঙ্গের সাথে শিব কিংবা কৃষকের লাঙ্গল আর লাঙ্গলের সাথে কবি কালিদাসের কলমের সম্পর্কের কী দারুণ সাদৃশ্য!…
কৃষিকাজটা আনন্দ সাধনের সাথে কতোটা সম্পর্কিত হতে পারে?! কয়েকদিন গরুর জায়গায় লাঙ্গল টানার ভার নিয়ে বুঝেছিলাম এ কাজ বড়ই কষ্টের। আবার মাটি ও প্রকৃতির নৈকট্য পেয়ে কেমন এক অব্যক্ত আনন্দও যেন পেয়েছিলাম।…
কিছুটা আন্তর্বয়ানে, কিছুটা বিনির্ম্মাণে উচ্চারিত হয়েছে— মন রে কৃষিকাজ জান না, আনন্দ সাধনে!… ভক্ত কবি ‘রামপ্রসাদ সেন’ কৃষিকাজ না জানার কারণে মানব জমিন পতিত থাকায়, আক্ষেপ করেছিলেন তার গানে। অবশ্যই রামপ্রসাদ কৃষির রূপকে দেহ আচমন বা দেহ সাধনেরই ইঙ্গিত করেছিলেন। এখানে ব্যাপারটি (বি)নির্ম্মিত হয়ে কৃষিচর্চ্চায়/কাব্যচর্চ্চায় আনন্দ সাধনেরই বার্ত্তা দিচ্ছে।…
একসময় আমাদের অর্থনীতি যেমন ছিলো মাটি ও প্রকৃতির নিবিড় বন্ধনের তেমনি আমাদের শিল্প-সাহিত্যও ছিলো মাটি ও প্রকৃতির নিবিড় নিকটবর্ত্তী।…
একদিন আদিম সাম্যবাদী সমাজ শিকারজীবন অতিক্রম করে প্রবেশ করলো কৃষি জীবনে। শস্য-শ্যামলে ভরে তুলল পলির নন্দনমাখা ভূমি। তারপর একদিন সে সাম্যবাদী সমাজ বিভাজিত হলো নানা শ্রেণী ও বর্ণে। ব্যক্তিমালিকানায় আক্রান্ত হয়ে কেউ কেউ পরিণত হলো দখলদারে। একের পর এক দখল করতে লাগলো সে পলির নন্দনমাখা ভূমি। শুধু ভূমি নয়, দখল হলো নদীও। এভাবে কত নদীর নিজস্ব নাম বদলে এখন পরিণত হয়েছে দখলিয়া নদী নামে— তা কম বেশি বিশ্বের অনেক মানুষই জানেন।…
একদিন আমাদের উৎপাদনকারী সমাজ ছিলো সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর সমাজ, তাই আমাদের আরাধ্যও ছিলো কৃষ্ণ বা শ্যাম। আর আমাদের সংস্কৃতি ছিলো কৃষিনির্ভর ‘কৃষ্টি’। দূর বনের পাখিটি ডেকে ডেকে হয়তো সে কথাই স্মরণ করাতে চায়।… পাখিকে এখানে আমরা ইতিহাসের পাঠ বলে ধরে নিতে পারি। কবি আমাদের কৃষ্ণ> কৃষি> কৃষ্টির সেই ঐতিহাসিক সম্পর্কের শাব্দিক দৃষ্টান্ত উন্মোচন করে দিয়েছেন, শব্দ তিনটির মূল ধাতু ‘কৃষ’কে পৃথক করে।…
আমাদের নির্ভরতা যদি কৃষি হয় তাহলে আমাদের জীবনাচার ও কৃষ্টি কৃষিকেন্দ্রিক— এটা স্বাভাবিক! কিন্তু আমাদের আরাধ্য কৃষ্ণ বলেই কি আমাদের নির্ভরতা কৃষি হয়েছে, নাকি নির্ভরতা কৃষি বলেই আরাধ্য কৃষ্ণ হয়েছে— তা ভাববার অবকাশ আছে।… কারণ কৃষ্ণ শব্দটি এখানে প্রথমে নির্দেশ করা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, কবি যদি শুধু শাব্দিক সম্পর্ক নির্দেশ করে থাকেন তা হলে ক্রমিকতায় তেমন কোনো সমস্যার কথা নয়।
আহা! কৃষ্ণ কোথায় রে? রাধা ধারাপাত পড়ে, লাঙ্গলের… রাধাকে ছেড়ে ব্রজবিহারী কৃষ্ণ চিরদিনের জন্য চলে গেছে মথুরায়। তাই কৃষ্ণ নামে আহাজারি ব্যতীত রাধার আর কোনো পথ নাই। কিন্তু কথা হচ্ছে, রাধা লাঙ্গলের ধারাপাত পড়ছে কেনো?!…
আমরা এতক্ষণ কৃষ্ণকে শুধু শ্যাম বলে জেনেছি। কিন্তু কৃষ্ণের নাকি আরো একটি অর্থ আছে— নিষিদ্ধ পথে উপার্জ্জিত সম্পদ/ব্ল্যাক মানি/কালো টাকা। এখন পুরো কবিতাটাকে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হবে। কারণ এতোক্ষণ কৃষ্ণকে আমাদের বলে প্রচার করেছি এবং নিজেদেরকে আমরা উৎপাদনকারী কৃষিনির্ভর সমাজ বলে চিহ্নিত করেছি।…
ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি মতে, গোপসমাজ/গো-পালনকারী সমাজ হচ্ছে পণ্য উৎপাদনকারী এবং পণ্যবাহী সমাজ। রাধা শব্দের আদি রূপ নাকি ধারা বা পণ্য প্রবাহ। রাধার নাকি এমন অর্থও হয়— যে ধার করে।…
আমরা আগেও আলোচনা করেছি, ভারতীয় সমাজ সবসময় একই অবস্থায় ছিলো না। একেক সময়ে একেক প্রকার সামাজিক ব্যবস্থা চালু ছিলো ভারতে। সময়ে সময়ে পুরাতন সমাজ ব্যবস্থার সাথে নানা সংগ্রাম-সংঘাত করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো নতুন সমাজ ব্যবস্থা। এসব সংঘাত-সংগ্রাম করার জন্য নারায়ণ কিংবা বিষ্ণুর দশ অবতারের আবির্ভাব হয়েছিলো দশটি বিশেষ কালের দশ রকম সমাজ ব্যবস্থার বিনাশকারী রূপে। বিষ্ণুর দশ অবতারের এক অবতার হচ্ছে কৃষ্ণ। একসময় নাকি বিষ্ণুর কোনো অস্তিত্বই ছিলো না। পরে নারায়ণ নিজেই বিষ্ণু রূপে পরিচিত হয়ে যায়। আর নারায়ণই (যার অর্থ পুঁজি কিংবা সম্পদ) বিষ্ণুর দশ অবতার হিসাবে আবির্ভূত হয়। অর্থাৎ পুঁজি বা সম্পদই দশটি রূপ পরিগ্রহ করে দশটি বিশেষ কালে উদয় হয়। যেমন— মৎস্য অবতার ব্যক্তি মালিকানা রূপে, বরাহ অবতার বিনিয়োগ রূপে প্রভৃতি।… এভাবে বিষ্ণুর বা সম্পদের কৃষ্ণ-অবতার হয় কালো পুঁজি বা কালো সম্পদ রূপে! এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, কৃষ্ণের জন্ম ও জীবন নিয়ে প্রান্তিক সমাজে অনেক মতভেদ আছে।… অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করে, মহাভারতের বাসুদেব কৃষ্ণ এবং ভাগবত ও সাহিত্য গ্রন্থাদির কৃষ্ণ এক ব্যক্তি নয়। পণ্ডিতদের মাঝে এ ব্যাপারে যতোই মতভেদ থাকুক, ভারতীয় সমাজ কিন্তু দুই কৃষ্ণকে একাকার করে নিজেদের মতো করে কৃষ্ণকে গ্রহণ করে নিয়েছে।… কৃষ্ণের আবির্ভাবের পূর্ব্বেই সমাজে ব্যক্তিমালিকানা ও ব্যক্তিপুঁজির উদ্ভব হয়, গড়ে ওঠে রাষ্ট্রব্যবস্থাও। আর সে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় চালু ছিলো কর আদায়ের রীতি। সমাজে তখন শ্রমবিভাজনও প্রচলিত ছিলো। আবার বিনিময় প্রথাও গড়ে ওঠেছিলো। উৎপাদনকারীদের উৎপন্ন দ্রব্য ব্যবসায়ী সমাজ ক্রয় করে আবার তা ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করতো। আর রাষ্ট্রযন্ত্র সবার উপার্জ্জন থেকে কর আদায় করতো। একসময় কর সংগ্রহকারী রাষ্ট্রযন্ত্রের কর নির্ধারণের হার এতোই বেড়ে যায় যে, ব্যবসায়ী সমাজ সে কর আদায় করতে গিয়ে নিজেদের উপার্জ্জিত সন্তান বা সম্পদের সবটাই হারাচ্ছিলো। তাই বাসুদেব বা ব্যবসায়ীরা জন্ম দেয় কৃষ্ণকে। অর্থাৎ তারা কর ফাঁকি দিয়ে গড়ে তোলে কৃষ্ণধনকে বা কালো সম্পদকে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখ রাঙানির কারণে নিজ পুত্র কৃষ্ণকে বাসুদেবের নিজের কাছে রাখা সম্ভব হলো না। শিশু কৃষ্ণকে পাঠিয়ে দেয়া হলো বন্ধু নন্দগোপের কাছে, যার কাছ থেকে বাসুদেব উৎপাদিত দ্রব্য ক্রয় করে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করতো।
নন্দ যশোদাদের গোপ সমাজে গিয়ে কৃষ্ণ উৎপাদনকার্য্যে ব্যবহৃত হয়ে দিন দিন বড় হতে লাগলো। শিশু অবস্থাতেই কৃষ্ণ নানা লীলা প্রদর্শন করে উৎপাদন বাড়িয়ে গোপ সমাজকে অবাক করে দিলো। যৌবনে কৃষ্ণ কালা ব্রজবিহারী হয়ে রাধার সাথে মাতলো রাস লীলায়। এ সেই রাধা, যে রাধা স্বয়ং লক্ষ্মী, যে লক্ষ্মী স্বয়ং সতী দেবী। গোপ সমাজে জন্ম নিয়ে লক্ষ্মী হলো রাধা, যে রাধার নিজস্ব পুঁজি ও উৎপাদনযন্ত্র না থাকায় অর্থাৎ স্বামী নপুংশক হওয়ায় উৎপাদনকার্য্যের জন্য ধার করতে হতো পুঁজি বা যন্ত্র। এমনও হতে পারে যে, রাধাদের নিজস্ব কোনো উৎপাদন ক্ষেত্রই ছিলো না তাই অন্যের উৎপাদন কার্য্যে শ্রম দিয়ে তাদের উপার্জ্জন করতে হতো। গোপ সমাজে হয়তো কৃষ্ণকে নিজের উৎপাদন কার্য্যে নিযুক্ত করার কোনো অধিকার ছিলো না রাধার, নিজের একেবারে কিছুই না থাকায়— সম্পদ কিংবা ব্যবসাক্ষেত্র অথবা উৎপাদনক্ষেত্র দেখাতে না পারলে আজকে যেমন ঋণ নেওয়ার অধিকার থাকে না। কিন্তু কৃষ্ণ সে রীতিকে ফাঁকি দিয়ে রাধার সাথে লীলা করলো। এক সময় কৃষ্ণ তার কাঙ্খিত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য গোকুল ত্যাগ করলো। এখন লক্ষ্মী/রাধা পুনরায় হয়ে পড়লো লাঙ্গল (উৎপাদন যন্ত্র)হারা, পুঁজি হারা। তাই প্রান্তিক উৎপাদনকারী রাধা এখন কৃষ্ণ কৃষ্ণ করে আত্মহারা, লাঙ্গলের ধারাপাত পড়ছে, উৎপাদন যন্ত্রের জন্য বিলাপ করছে— আহা! কৃষ্ণ কোথায় রে?…