সুকুমার রায়ের ‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব’ কাব্যের তাৎপর্য্য // শ্রী শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র

0

কবি সুকুমার রায়কে বাঙালীর ভাষা চিন্তার ইতিহাসে একজন অগ্রদূত বলে বিবেচনা করা চলে। ভাষাদর্শন নিয়ে তাঁর একটি আশ্চর্য্য রচনা হল ‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব’ নামক একটি অসম্পূর্ণ কাব্য, যার কথা এখানে বলব। এটি ছিল বর্ণমালার বর্ণগুলি নিয়ে একটি কাব্য লেখার প্রয়াস। উক্ত কাব্যের ছত্রেছত্রে কবি একই আদ্যক্ষর বিশিষ্ট অনেকগুলি ক’রে শব্দ জড়ো করেছিলেন। স্বল্পায়ু সুকুমার অ বর্ণ থেকে শুরু ক’রে ছ বর্ণ পর্যন্ত লিখতে পেরেছিলেন। তারপর তিনি কাব্যটি শেষ ক’রে যেতে পারেননি। পণ্ডিতেরা এতদিন এই রচনাটিকে কেবল অনুপ্রাস সৃষ্টির প্রয়াস বলে ফেলে রেখেছিলেন। সুকুমারের উক্ত কাব্যটি অনুপ্রাস সৃষ্টির প্রয়াস বলে আমার বিশ্বাস হয়নি। আমি বহু দিন থেকে ওই কাব্যটির প্রকৃত মর্ম্ম উদ্ধার করার এবং সম্ভব হলে সেটিকে সম্পূর্ণ করার স্বপ্ন দেখতাম। অবশেষে ভাষাবিদ কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ হাতে পাওয়ার পর আমি সেই স্বপ্নকে সার্থক করার একটা রাস্তা খুঁজে পাই। তারপর ‘বর্ণসঙ্গীত’ নামে একটি ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক পদ্যাভিধান রচনা করে আমি বর্ণমালার বর্ণগুলির তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করি। শেষোক্ত অভিধানে আমি সুকুমারের ‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব’ কাব্যের তাৎপর্য্য বিশদে বলার চেষ্টা করেছি। এখানে তা সংক্ষেপে বলব।

‘সমগ্র শিশুসাহিত্য: সুকুমার রায়’ বইয়ের ভূমিকায় ‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব’ রচনাটি সম্বন্ধে শ্রীসত্যজিৎ রায় বলেন, “সারা অসুখের মধ্যে একটি বিশেষ রচনার দিকে সুকুমারের মন বার বার ফিরে গেছে। অনেকগুলি খাতায় টুকরো টুকরো ভাবে রচনাটি ছড়িয়ে আছে। সুকুমার রচনাটির নাম দিয়েছিলেন ‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব’। বাংলা কাব্যে অনুপ্রাসের যে ধারা প্রাচীন কাল থেকে চলে এসেছে, তারই একটা চমকপ্রদ পরিণতির সম্ভাবনা ছিল এই রচনায়। দুঃখের বিষয়, সুকুমার এটি শেষ করে যেতে পারেননি।” প্রকৃতপক্ষে অনুপ্রাস নিয়ে মজা করার জন্য সুকুমার রায় এই কাব্যটি লেখেননি, বরং একই আদ্যবর্ণবিশিষ্ট অনেকগুলি ক’রে শব্দকে একত্র এনে সুকুমার ঐ বর্ণটির মানে (বিভিন্ন শব্দে ঐ বর্ণটির অর্থসাদৃশ্য) বুঝতে চেয়েছিলেন। এর ফলে অনুপ্রাস সৃষ্টি হলেও সেটা গৌণ ব্যাপার। বহু বছর ধ’রে তিনি রচনাটিকে পুর্ণাঙ্গ করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। নিছক অনুপ্রাস সৃষ্টির জন্য সুকুমার বছরের পর বছর এতটা খাটেননি, বরং তিনি বর্ণের সঙ্গে বস্তুজগতের সম্পর্ক বুঝতে চেয়েছিলেন।

ভাষাদর্শন নিয় কাব্য লেখার ঐতিহ্য বাঙলায় নাই। সুকুমার এ ব্যাপারে চেষ্টা ক’রে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সংস্কৃতে ভাষাদর্শনের উপর সার্থক গ্রন্থ রয়েছে; যেমন আচার্য শ্রীভর্তৃহরির সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাক্যপদীয়’ (প্রায় ২০০০ শ্লোকবিশিষ্ট)। বাক্যপদীয়ে বাক্য ও পদের দর্শনে সৃষ্টিপ্রপঞ্চ ও চেতনাকে উদ্ভাসিত করা হয়েছে। ভর্তৃহরির পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ আজ পর্যন্ত হয়নি। তাঁর মূল আলোচনা বাক্য আর পদ নিয়ে, বর্ণের অর্থ হতে পারে বলে ভর্তৃহরি ভাবতে পারেননি। কিন্তু সুকুমার আরও মৌলিক চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি সমস্ত ভীরু ভাবনা পরিত্যাগ ক’রে ভাষার মূলে বর্ণে গিয়ে ভাষার রহস্য উদ্ঘাটনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সুকুমারের প্রশ্ন: বর্ণগুলির উদ্ভব কীভাবে, বর্ণমালার পৃথক পৃথক বর্ণগুলির তাৎপর্য্য আছে কি? থাকলে সেই তাৎপর্য্য কী?

সুকুমারের এইসব প্রশ্ন অর্থহীন নয়, বরং তাৎপর্য্যময়। অনুরূপ চিন্তা আরও কেউ কেউ করেছেন। পতঞ্জলির মহাভাষ্যে পৃথক পৃথক বর্ণগুলির অর্থ হতে পারে কিনা তা নিয়ে আলোচনা আছে। তন্ত্রশাস্ত্রে বর্ণমালার বর্ণগুলির তাৎপর্য্য নিয়ে আলোচনা আছে। সাধক রামপ্রসাদ বর্ণমালার বর্ণগুলিকে নিয়ে একটি গান লিখেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ‘জীবন ও বর্ণমালা’ নামে একটি প্রবন্ধধর্মী লেখা লিখেছিলেন যেখানে তিনি সমাজের সঙ্গে, জীবনের ঘটনাবলীর সঙ্গে বর্ণমালার সম্পর্ক থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত করেছেন। উক্ত রচনায় রবীন্দ্রনাথ জনৈক পণ্ডিতমশাইর কথা বলেছেন যিনি মনে করেন বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণের গূঢ় তাৎপর্য্য আছে। রবীন্দ্রনাথের উপরি-উক্ত রচনায় বর্ণমালার প্রতি বর্ণের অর্থ ফুটে ওঠেনি। সুকুমার রায়ও বর্ণমালার কার্য্যকরী তত্তম আবিষ্কারে ব্যর্থ হন, কিন্তু তাঁর প্রয়াস অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত ও কাব্যময় ছিল।

শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ অনেকগুলি বর্ণের অর্থ প্রদান করেছেন। কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তী তাঁদের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ ও `সরল শব্দার্থকোষ’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, শব্দার্থ ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক হয়। তাঁরা বাংলা বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণের অর্থ দিয়েছেন এবং ঐ বর্ণগুলির অর্থ থেকে যেকোনো বাংলা শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ কীভাবে নিষ্কাশন করতে হয় তা দেখিয়েছেন। অবশ্য এ নিয়ে অনেক কাজ এখনও বাকী আছে, কিন্তু কোনো শব্দের মধ্যে তার বর্ণগুলি কীভাবে অর্থকে ধারণ করে তার মূল নিয়মটা পাওয়া গেছে। এর থেকে বুঝা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ও সুকুমার রায়ের কল্পনা অলীক ছিল না। মৎপ্রণীত ‘বর্ণসঙ্গীত’ গ্রন্থে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর তত্তম বিশদে আলোচিত হয়েছে এবং সুকুমারের ভাষাচিন্তার সঙ্গে তার সম্পর্ক দেখানো হয়েছে।

রাসায়নিক মৌলদর পর্যায়সারণীর সঙ্গে বর্ণমালার তুলনা করা যেতে পারে। প্রকৃতিতে ৯২টি মৌলিক পদার্থ আছ যারা পরস্পরের সঙে নির্দিষ্ট নিয়মে যুক্ত হয়ে প্রকৃতির বহু লক্ষ যৌগিক পদার্থ তৈরী করছে, তেমনি বর্ণের সঙে বর্ণ জুড়ে নানা শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। রুশ রসায়নবিদ্ দিমিত্রি মেণ্ডেলিফ (১৮৩৪–১৯০৭) দেখিয়েছেন পরমাণবিক গুরুত্ব অনুযায়ী মৌলিক পদার্থগুলিকে পর পর সাজিয়ে সারণীতে লিখলে তাদের ধর্ম্ম পর্যায়ক্রমে পুনরাবৃত্ত হয়, তেমনি খান-চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’-এ দেখানো হয়েছে যে বর্ণমালার বর্ণগুলির অর্থেরও একটা ছক আছে। ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ অবলম্বন ক’রে আমরা শব্দকে বর্ণে ভেঙে তার অর্থ এবং শব্দার্থের দর্শন উপলব্ধি করতে সক্ষম হব। বর্তমান প্রবন্ধে বিষয়টির সামগ্রিক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। তবু সুকুমারের ‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব’ যে স্রেফ মজার লেখা বা অনুপ্রাস সৃষ্টির প্রয়াসমাত্র নয় সেকথা বোঝাতে আমরা বিষয়টি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।

‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব’-র প্রথম কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করছি:

পড় বিজ্ঞান হবে দিকজ্ঞান ঘুচিবে মনের ধাঁধা
দেখিবে গুণিয়া এ দিন দুনিয়া নিয়ম-নিগডে় বাঁধা।
কহে পণ্ডিতে জড়সন্ধিতে বস্তুপিণ্ড ফাঁকে
অনু-অবকাশে রন্ধ্রে-রন্ধ্রে আকাশ লুকিয়ে থাকে ।
হেথা হোথা সেথা জডে়র পিণ্ড আকাশ প্রলেপে ঢাকা
নয়কো কেবল নিরেট গাঁথন, নয়কো কেবলি ফাঁকা।
জডে়র বাঁধন বদ্ধ আকাশে, আকাশ-বাঁধন জডে় —
পৃথিবী জুড়িয়া সাগর যেমন, প্রাণটি যেমন ধডে়।
‘ইথার’ পাথারে তড়িত বিকারে জডে়র জীবন দোলে,
বিশ্ব-মোহের সুপ্তি ভাঙিছে সৃষ্টির কলরোলে।।

সুকুমার ‘পড় বিজ্ঞান হবে দিক্ জ্ঞান’ বলে কাব্য শুরু করেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য ভাষাতত্তেমর উপর একটি স্পষ্ট, বিজ্ঞানসম্মত ও সার্থক কাব্য রচনা করা। তিনি শূন্য, জড়বস্তু, ইথার, তড়িৎক্ষেত্র— সবকিছুর প্রসঙ্গ তুলেছেন। এদের মিথষ্ক্রিয়া থেকেই তিনি বর্ণগুলির উদ্ভব ও ক্রিয়ার হদিশ পেতে চান। তিনি বলেন:

শুন শুন শুন বার্তা নূতন, কে যেন স্বপন দিলা
ভাষা প্রাঙনে স্বরে ব্যঞ্জনে ছন্দ করেন লীলা।
সৃষ্টি যেথায় জাগে নিরূপায় প্রলয় পয়োধি তীরে
তারি আশেপাশে অন্ধ হুতাশে আকাশ কাঁদিয়া ফিরে।
তাই ক্ষণে ক্ষণে জড়ে ব্যঞ্জনে স্বরের পরশ লাগে
তাই বারে বারে মৃদু হাহাকার কলসঙ্গীতে জাগে।

এক একটি বর্ণ কেমন ক’রে এল? বর্ণগুলির কাজ কী? বর্ণগুলির যাওয়া-আসার ছন্দ কী? কবি বলেছেন:

স্বরব্যঞ্জন যেন দেহমন জড়েতে চেতন বাণী,
এক বিনা আর থাকিতে না পারে, প্রাণ লয়ে টানাটানি।

শুধু্ স্বরবর্ণ দিয়ে আমরা সব কাজ চালাতে পারি না, ব্যঞ্জনবর্ণও চাই। ব্যঞ্জনবর্ণগুলি স্বরবর্ণের সাহায্য ছাড়া উচ্চারিত হতে পারে না। ভাষার উদ্ভবের সময় স্বরবর্ণগুলিই প্রথম দিকে এসেছে। মানুষ তখন সুর দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করত। খান-চক্রবর্তীর মতে আদিম মানুষের সুরেলা কান্না থেকেই ভাষার উৎপত্তির সুর ও স্বর (স্বরবর্ণ) শব্দের মিল লক্ষ্য করুন ল যার রেশ আমরা আজও বহন ক’রে চলেছি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে। কিন্তু বর্ণগুলির উদ্ভব কীভাবে হল এবং তাদের অর্থ কী, তা সুকুমারের কাছে স্পষ্ট হয়নি। তিনি বলেন,

স্তিমিত-স্বপ্ন স্বরের বর্ণ জডে়র বাঁধন ছিঁড়ি
ফিরে দিশাহারা কোথা ধ্রুবতারা কোথা স্বর্গের সিঁড়ি!
অ আ ই ঈ উ ঊ, হা হা হি হি হু হু হালকা শীতের হাওয়া
অলখচরণ প্রেতের চলন, নিঃশ্বাসে আসা যাওয়া।
খেলে কি না খেলে ছায়ার আঙুলে বাতাসে বাজায় বীণা
আবেশ বিভোর আফিঙের ঘোর বস্তুতন্ত্রহীনা।

এখানে যে চিত্ররূপটি ভেসে উঠে তা হল স্বরবর্ণগুলি সৃষ্টিসমুদ্রে ভেসে উঠছে, নিজেদের ক্রিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছে, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না। ওরা যেন দিশাহারা।
তারপর সুকুমার ‘অ’ বর্ণকে বিস্তারিত করেছেন:

অকুল অতলে অন্ধ অচলে অস্ফূট অমানিশি,
অরূপ আঁধারে আঁখি-অগোচরে অনুতে অনুতে মিশি।

এখানে অনেকগুলি ‘অ’-কার যুক্ত শব্দকে বিশ্লেষণ ক’রে কবি যেন বুঝতে চেষ্টা করছেন ‘অ’ বর্ণের কোনো মানে আছে কিনা, কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট ক’রে কিছু বলতে পারেননি। শ্রীহরিচরণ বন্দে্যাপাধ্যায় মহাশয় ‘অ’ বর্ণের কয়েকটি অর্থ দিয়েছেন। তাঁর অভিধানে ‘অ’ মানে যে রক্ষা করে, বিুষ্ণ, ব্রহ্মা, শিব, বায়ু, বৈশ্বানর, ব্রহ্ম ইত্যাদি। আর খান-চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ জানাচ্ছে অ মানে ‘অস্তিত্বের আধার মাত্র যে; যে অস্তিত্বকে ধ’রে রাখে বা বহন করে।’

‘অ’-এর পর সুকুমার ‘আ’-এর কথা বলেন:

আধো আধো ভাষা, আলেয়ার আসা, আপনি আপনহারা
আদিম আলোতে আবছায়া পথে আকাশগঙ্গা-ধারা।

দু’টি অ জুড়ে আ তৈরী হয়। আ হল অ-এর আধার (‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ দ্রষ্টব্য)। খান-চক্রবর্তীর মতে অস্তিত্বের যে দু’টি ভাগ করা হয় তার মধ্যে ‘অ’ প্রধানত আধেয়কে এবং ‘আ’ প্রধানত আধারকেই বোঝায়, কিন্তু সুকুমারের রচনায় এসব পরিস্ফূট নয়।

উ-কার প্রসঙ্গে সুকুমার বলেন,

উডে় ইতিউতি, উতালা আকুতি, উসখুস উঁকিঝুকি,
উডে় উচাটন, উড়ুউড়ু মন, উদাসে ঊর্দ্ধমুখী।

এর মধ্যে উড়ুউড়ু ভাবটা বেশ ফুটে উঠেছে। খান-চক্রবর্তীর মতে উ বর্ণের অর্থ উল্লম্ফন করে যে; যে বৈপ্লবিক পরিবর্ত্তন ঘটায়; নবরূপে উত্তীর্ণ হয়ে দেখা দেয়; অস্তিত্বের পরিধির বাহিরে, ঊর্দ্ধে ইত্যাদি। যেমন কানাই, বন্ধ, কচ প্রভৃতি শব্দে উ-কার যোগ করলে তারা নবরূপে উত্তীর্ণ হয়ে কানু, বন্ধু, এবং কচু হয়ে যায়। উ-কার যোগে শব্দার্থের পরিবর্ত্তন এখানে স্পষ্ট। হরিচরণবাবু উ বর্ণের অর্থ বলতে গিয়ে জানিয়েছেন ‘উ’ বর্ণ শিবকে বুঝায় (‘উকারস্তু মহেশ্বরঃ’)। তিনি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রকে উদ্ধৃত ক’রে বলেছেন, ‘উ শব্দে বুঝহ শিব’। বাস্তবিক শিবগুণসম্পন্ন মানুষেরা সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। ক বর্ণের সঙে উ যোগ করলে কু হয়, কু মানে ভাল ও মন্দ দুইই হতে পারে (কু স্বাভাবিকের সীমা লঙ্ঘন করে)।

এ বর্ণ প্রসঙ্গে সুকুমার বলেন,

এমন একেলা একা একা খেলা একূলে ওকূলে ফের
এপার ওপার এ যে একাকার একেরি একেলা হের।
হের একবার, সবই একাকার, একেরি এলাকা মাঝে
ঐ ওঠে শুনি ওঙ্কার-ধ্বনি, একূলে ওকূলে বাজে।।

উপরি-উক্ত চরণগুলিতে এ-কার যুক্ত শব্দগুলির মধ্যে একাকীত্বের ভাবটি বেশ রয়েছে। এক সময় এ হয়ে যায় ঐ এবং তারপর ও। খান-চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ এ বর্ণের অর্থ দিয়েছে দিশাগ্রস্ত বা একঝোঁকা, ঐ মানে এ-এর আধার (ঐকতান মানে একই রকম তান থাকে যাহাতে), ও মানে ‘অ থেকে উ পর্যন্ত সকল ক্রিয়া থাকে যাহাতে’। সন্ধির সময় অ এবং উ যোগ করলে ও হয়। প্রতিটি স্বরবর্ণের তাৎপর্য্য পরিষ্কার করতে হলে শত শত শব্দ নিয়ে আলোচনা করতে হবে, যা বর্তমান পরিসরে সম্ভব নয়। আগ্রহী পাঠকেরা এই ব্যাপারে ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ দেখুন।

স্বরবণের্র পর সুকুমার ব্যঞ্জনবর্ণগুলির অর্থ বোঝার চেষ্টা করেছেন। ক বর্ণ যুক্ত অনেকগুলি শব্দ একত্র ক’রে তিনি ক বর্ণের মর্ম্ম বুঝতে চেয়েছেন। প্রাসঙ্গিক চরণগুলি উদ্ধৃত করছি:

কহে কটমট কথা কাটাকাটা কেউকেটা কহ কারে
কাহার কদর কোকিল কে•, কুন্দ কুসুম হারে?
কবি কল্পনে কাব্যে কলায় কাহারে করিছ সেবা
কুবের কেতন কুঞ্জকাননে, কাঙালী কুটিরে কেবা।

এই চরণগুলিতে ক বর্ণের কোনো স্পষ্ট অর্থ ফুটে ওঠেনি। ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ মতে ক বর্ণের অর্থ ক্রিয়াকারী। পালক (পালন করে যে), চালক (চালনা করে যে) এবং আরও নানা শব্দে সেই অর্থ ফুটে উঠে।

‘ক’ ছেড়ে সুকুমার ‘খ’ বর্ণে গেছেন:

(খালি) কর্তালে কভু কীর্তন খোলে? খোলে দাও চাঁটিপেটা!
নামাও আসরে ‘ক’-এর দোসরে, ‘খেঁদেলো, খেঁদেলো খেটা।’
কহ মহামুনি কহ খুড় শুনি ‘খ’য়ের খবর খাঁটি
খামারে খোঁয়াড়ে খানায় খন্দে খুঁজিনু ‘খ’য়ের ঘাঁটি।

শুধু ক বর্ণকে নিয়ে আমাদের চলবে না, খ বর্ণকেও চাই। অনেক খাটাখাটি করে খানায়, খন্দে, খামারে, খোঁয়াডে় খোঁজাখুঁজি করলে ‘খ’ বর্ণের অর্থ বুঝতে কিন্তু খুব মুস্কিল হয় না। মুনীরা খ বর্ণের খাঁটি খবর দিতে পারেন।

খান-চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ জানাচ্ছে খ্ বর্ণটি তৈরী হয়েছে ক্-এর সঙে হ্ জুডে় (ক্+হ্=খ্)। তাই খ্-এর অর্থ হল ‘করণ হওয়ন’, অর্থাৎ ‘করা যেখানে থেমে যায়’। আর এক রকম খ্ আছে, তা হল ক্ষ-এর বিবর্ত্তিত রূপ। ক্ষ থেকে জাত খ-এর অর্থ হল মূল অবয়ব থেকে খনন করে বা কেটে নেওয়া। এই কারণে খ শূন্যকে, আকাশকে এমনকি মুখগহ্বরের ফাঁকা স্থানকে বুঝাতে পারে। শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় জানাচ্ছেন খ মানে: “আকাশ, উদরাদ্যবচ্ছিন্ন বা দৈহিক আকাশ, শিরস্থিত ইন্দ্রিয়–চক্ষুকর্ণাদি, বিন্দু, শূন্য, শব্দতন্মাত্র, ইন্দ্রিয় ছিদ্র, ৯ সংখ্যা, অনুস্বার চিহ্ন, স্বর্গ, পুর ক্ষেত্র, অভ্র ধাতু, ব্রহ্মাকাশ, শর্ম্ম, সুখ, কর্ম্ম, সংবেদন, জ্ঞান, লগ্ন হইতে দশম স্থান।”

মনে করা যাক কেউ একটি বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করল। সেই জ্ঞান গিয়ে থামে কোথায়? থামে মনের আকাশে, তাকে আমরা বলব খ। কেউ খক্ খক্ ক’রে কাশলে সে কাশি গিয়ে থামে কোথায়? থামে পার্থিব আকাশে (sky), একেও খ বলা যায়। এখানে আরও বলি যে খক্ খক্ কাশি, বিচ্ছুরিত কাশফুল এবং আরও যা কিছু প্রকাশিত হয় তাদের আধার বলেই আকাশকে আকাশ বলে (আ বর্ণের অর্থ অস্তিত্বের আধার)।

সুকুমার খানায় খন্দে ‘খ’-এর খোঁজ করছেন। ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ মতে খানা মানে ‘যাহার খাত অংশ (অন্যত্র) ক্ষিপ্ত হইয়াছে; অথবা ভূমির যে অংশ থেকে মাটি কাটিয়া লওয়া হইয়াছে।’ দীর্ঘ গর্ত অর্থে খানা শব্দটি ব্যবহার করা যায়। আবার গরীবখানা, পায়খানা ইত্যাদি শব্দে ‘খানা’ একটি প্রত্যয় রূপে যুক্ত হয়েছে খনন করেই এসব বানানো হয় বলে। অনুরূপ কারণেই ইন্দ্রিয়ের ছিদ্রগুলিকে খ বলে। এইভাবে খানায় খন্দে খ-এর ক্রিয়া পাওয়া যায়।

এবার খবর (খবর=খ+বর) শব্দটির কথা বলি। খবর মানে আকাশ (খ) যাকে বরণ করে নেয়। এখানে আকাশ বলতে শুধু sky নয়, সামাজিক আকাশও বটে। আমরা খ-এর খাঁটি খবর জানলাম। বেতার কেন্দ্র ‘আকাশবাণী কলকাতা’ থেকে যখন খবর পড়া হয় তখন আমরা দেশের সংবাদ (যা ঘটেছে তার সমান বাদ) পাই।

গ বর্ণের তাৎপর্য্য যে গতি তা ‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব’-এ অনেকটা ফুটে ওঠেছে:

কবে কে বা জানে গতির গড়ানে গোপন গোমুখী হতে
কোন ভগীরথে গলাল জগতে গতির গঙ্গা-স্রোতে।
দেখ আগাগোড়া, গণিতের গড়া, নিগূঢ় গণন সবি
গতির আবেগে আগুয়ান বেগে অগণিত গ্রহরবি।

‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’-এ গ বর্ণের অর্থ ‘গমন করে যে।’ গঙ্গা (গম্+গ+আ) শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হতে পারে ‘গামীর রহস্যময় গমন যাহাতে’ (গ বর্ণে গমন আর ঙ বর্ণে রহস্যময়তা বুঝতে হয়)। এই গঙ্গা অবশ্য শুধু গঙ্গা নদী নয় — অশ্রুগঙ্গা, পণ্যগঙ্গা ইত্যাদিও হতে পারে। দু’টি গ থাকায় গঙ্গা যে খুব গতিশীল হবে তা বুঝা যায়। যমুনা (যমের বোন) সে তুলনায় সংযত বা নিয়ন্ত্রিত হবে। অবশ্য গ বর্ণের তাৎপর্য্য (ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ) পরিষ্কার বুঝতে হলে গ বর্ণযুক্ত শত শত শব্দ ঘাঁটতে হবে। আগ্রহী পাঠক ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ হাতে নিয়ে নিজে সে চেষ্টা করতে পারেন। তারপর সুকুমার লিখছেন,

শুনি সাবধানে কহি কানে কানে শাস্ত্রবচন ধরি
কৌশলে ঋষি কহে কখগঘ কাহারে স্মরণ করি।
ক’য়ে দেখ জল, খ’য়ে শূন্যতল, গ’য়ে গতি অহরহ
কভু জলে ভাসে কভু সে আকাশে হংস যাহারে কহ।
আঘাতে যে মারে ‘ঘ’ কহি তারে হন্ ধাতু ‘ড’ করি
তেঁই কখগঘ কৃষ্ণে জানহ হংস-অসুর-অরি।

শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থে আছে ক বর্ণের অর্থ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, অগ্নি, বায়ু, সূর্য্য, রাজা, মস্তক, জল, সুখ ইত্যাদি। তাহলে ক বর্ণের অর্থ জল হতে পারে, কৃষ্ণও হতে পারে। খান-চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ মতে ক মানে ‘করনের বুনিয়াদি আধার বা কারক বা কারী’। কারী মানে করে যে। কি করে? ‘কাজ করে, পড়া করে, জ্ঞানার্জন করে, ভাল করে, মন্দ করে, রোজগার করে, খরচ করে, ভ্রমণ করে, গমন করে, খেলা করে… এবং কী না করে!’ ‘ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এই কারী কাল্পনিক কারী থেকে শুরু করে অতিবাস্তব কারীর যেকোনো এক বা একাধিক কারীকে বোঝাতে পারে।’ এর থেকে বঙ্গীয় শব্দকোষে ক বর্ণের এত অর্থ আছে কেন তা বুঝা যায়।

খ মান যে আকাশ তা আমরা জানি। গ’য়ে গতিকেও বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। ‘অসুর’ মানে কী? বেদের প্রাচীন অংশে অসুর শব্দের অর্থ দেবতা। ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে যেখানে অসু (প্রাণ) রয় তাকেই অসুর বলে। অসুরেরা প্রাণবান ও বলবান। প্রসঙ্গত প্রাণ চলে গেলে তাকে ‘গতাসু’ বলে। হরিচরণবাবু জানিয়েছেন আবেস্তায় অহুর শব্দের অর্থ ‘The life giver and omniscient God।’ আবেস্তার অহুর আর আমাদের অসুর একই বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। ‘হংস’ মানে কী? ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ জানাচ্ছে হংস হচ্ছে এক রকম পৌরাণিক পক্ষী যে সোমজল থেকে সোমরস পৃথক করে পান করতে পারে। পরবর্তী কালে সংস্কৃত কবিরা কল্পনা করেছেন যে হংস নীর আর ক্ষীরের (ক্ষীর মানে দুধ) মিশ্রণ থেকে ক্ষীরকে আলাদা ক’রে নিতে পারে। হরিচরণবাবু আরও জানাচ্ছেন যে হংস মানে সূর্য্য, বিষ্ণু, কৃষ্ণ, জ্ঞানী, মহাত্মা এবং হাঁসও হতে পারে। খান-চক্রর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ মতে যে জ্ঞানী ব্যক্তি ‘সো অহং’ (আমিই সেই ঈশ্বর) বলতে পারে সেই হংস (যেমন বর্ণ উল্টাপাল্টা ক’রে হিংসা থেকে সিংহ হয় এও সেই রকম)। হংস মানে জ্ঞানী ব্যক্তি, সাদৃশ্যে তা জলের মধ্যে অবলীলায় চলমান হাঁসকেও বুঝাতে পারে।

হন্ ধাতু ড করল কী হয়? ড একটি কৃৎ প্রত্যয়, এর ড্ ইৎ (লুপ্ত হয়), শুধু অ থাকে। হন্ +ড =হন। হন্ ধাতুর মানে হল হিংসা, প্রহার, তাড়ন, গতি ইত্যাদি; আর হন মানে হন্তা, ঘাতক। আবার ঘ বর্ণেও আঘাত করা বোঝায়, ঘ-এর সঙে আ জুড়ে ‘ঘা’ করলে (ঘ+আ=ঘা) আঘাত করার ব্যাপারটি আরও ভাল বোঝা যেতে পারে। কৃষ্ণকে বোঝাতে অরি শব্দটি কোথায় ব্যবহৃত হয়েছে খুঁজে পাওয়া গেল না; কিন্তু কৃষ্ণ কারও কারও অরি বা শত্রু তো বটেই (যেমন কংসের), তাঁকে আমরা অরিসূদনও (যিনি শত্রুকে নাশ করেন) বলতে পারি। হরিচরণবাবু অমরকোষ টীকা উদ্ধৃত ক’রে জানাচ্ছেন অরি শব্দের একটি অর্থ ‘যে হননার্থ যায়’। এইভাবে নানা বর্ণ ও শব্দের আশ্চর্য্য মিল-অমিল ও বিবর্ত্তন আমরা খুঁজে পাই; ঋষিরা কৌশলে ক খ গ ঘ বলে কী বোঝাতে চান (কৃষ্ণ, হংস, অসুর, অরি) তা পরিষ্কার হয় এবং ‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব’-এর চরণগুলির অর্থ অনেকটা বুঝা যায়।

তারপর নিম্নলিখিত চরণগুলিতে সুকুমার ঙ বর্ণের অর্থ বুঝতে চেষ্টা করেছেন:

ব্যঙ্গে রঙ্গে ভ্রুকুটি-ভঙ্গে সঙ্গীত কলরবে
রণহুঙ্কারে ধনুটঙ্কারে শঙ্কিত কর সবে।
বিকল অঙ্গ ভগ্নজঙ্ঘ এ কোন্ পঙ্গু মুনি?
কেন ভাঙা ঠ্যাঙে ডাঙায় নামিল বাঙালা মুলুকে শুনি।
রাঙা আঁখি জ্বলে চাঙা হয়ে বলে ডিঙাব সাগর গিরি,
কেন ঢঙ ধরি ব্যাঙাচির মতো লাঙ্গুল জুড়িয়া ফিরি?

এখানে ঙ বর্ণের তাৎপর্য্যের ব্যাপারে সুকুমারের প্রশ্ন ও বিস্ময় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ঙ বর্ণের মধ্যে আছে অংরৃপিণীর প্রকাশ। শুধু ঙ নয়; ং, ঁ, ঞ, ণ্, ন্, ম্ (প্রতি বর্গের পঞ্চম বর্ণ) ইত্যাদি বর্ণগুলিতে অংরূপিণী নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করে। অংরুপিনীর অর্থ, শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, “অম্ রূপযুক্তা, অণুরূপা, বিন্দুরূপা (যোগমায়া)।” খান-চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ জানাচ্ছে, “বস্তুত ং, সংস্কৃতে যাকে লেখা হয় বিন্দু(.) রূপে, তা হল এই বিশ্বের সমস্ত শব্দের বিন্দু ও সিন্ধু রূপ।” ইংরেজী ing থেকে i বাদ দিলে যে ng ধ্বনি হয় সেটাই ং। খান-চক্রবর্তী বলেন, “এ হল সকল আকারের, সকল রূপের, সকল সুরের, সকল ধ্বনির, সকল পদের, সকল ক্রিয়ার, সমগ্র জগতের মূলাধার।” অর্থাৎ এর মধ্যে আছে অসীম শক্তি। প্রসঙ্গত, ‘হযবরল’-এর রহস্যময় বেড়ালটাও বলেছিল যে, তাকে চন্দ্রবিন্দুও বলা যেতে পারে।

‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব’-এ সুকুমার ছ বর্ণ পর্যন্ত গেছেন। আমরা তার বিস্তারিত আলোচনা করব না। তারপর তিনি কাব্যটি সমাপ্ত করতে পারেননি। তাঁর অসমাপ্ত কাব্যটিকে সমাপ্ত করার মানসে আমি ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক পদ্যাভিধান ‘বর্ণসঙ্গীত’ রচনা করি। উক্ত পদ্যাভিধানে অ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত সমস্ত বর্ণের এবং বর্ণের আলোকে বহু গুরুত্ত্বপূর্ণ বাংলা শব্দের অর্থ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং শব্দার্থের আলোকে সুকুমারসাহিত্যের নানা দিক উদ্ভাসিত করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত বর্ণ শব্দটির অর্থ এখানে বলা চলে। ‘ক্রিয়ার আধার রূপে বরেণ্য যে’ তাকেই বর্ণ বলে। ক্রিয়াকে বর্ণনা করাই বর্ণের কাজ। ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ গ্রন্থে বর্ণ শব্দের অর্থ বলতে গিয়ে খান-চক্রবর্তী বলেন,“মানুষের মনের ভিতরে একটি ক্রিয়ার ধারণা দেহহীন আত্মার মতো ঘুরতে থাকে, এবং এক সময় তার উপযুক্ত আওয়াজ-চাদর নির্বাচন ক’রে নিয়ে তাকে আবরণ রূপে নিজের গায়ে চাপিয়ে নিজেকে ঢেকে নেয় বা বর্ণবাস গ্রহণ করে। তখনই তাকে বর্ণ বলে।” ওদের ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ অ থেকে শুরু ক’রে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত প্রতিটি বর্ণের এবং বহু হাজার শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ সরবরাহ করেছে। এই তত্তম অভিনব, কিন্তু বিষয়টি রীতিমতো চর্চা না করলে শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ নিষ্কাশন করা সহজ নয়।

এই ধরণের তত্ত্ব সম্পূর্ণ নতুন নয়। যাস্কের নিরুক্তে শব্দকে প্রকৃতি-প্রত্যয়ে ভাঙা না গেলে অন্য শব্দের সঙ্গে বর্ণসাদৃশ্য থেকে এবং প্রয়োজনে যেনতেন প্রকারেণ আখ্যাত (ক্রিয়া) কল্পনা ক’রে শব্দের অর্থ নিষ্কাশনের কথা আছে। সুকুমার রায় থেকে একটা উদাহরণ দিয়ে বলতে হলে বলব এ যেন সজারু শব্দের অর্থ থেকে মজারু শব্দের অর্থ নিষ্কাশনের চেষ্টা (‘কেন হবে না— আলবৎ হয়। সজারু কাঙারু দেবদারু সব হতে পারে, মজারু কেন হবে না?’— হযবরল)। এজন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে যাস্কের কপালে নিন্দা ও প্রশংসা দুই জুটেছে। যারা যাস্কনীতির বিরূপ সমালোচনা করেছেন তাদেরও প্রায় সকলেই কিন্তু ঋগ্বেদের কবিদের মনের মধ্যে প্রবেশ করতে গেলে যে যাস্কই একমাত্র ভরসা, সেকথা মেনে নিয়েছেন।

আমরা আগই বলেছি যে, পর্য্যায়সারণীতে যেমন রাসায়নিক মৌলদের ধর্ম্মগুলি পর্য্যায়ক্রমে আসে, বর্ণমালার বর্গগুলিতেও তেমনি বর্ণগুলির অর্থ পর্যায়ক্রমে আসে। যেমন প্রতিবর্গের প্রথম বর্ণগুলির অর্থের মধ্যে মিল আছে: ক মানে ক্রিয়াকারী, চ মানে চয়নকারী, ট মানে টঙ্কারণকারী। তেমনি প্রতি বর্গের দ্বিতীয় বর্ণগুলির মধ্যেও মিল আছে: খ মানে করণস্থিতি, ছ মানে চয়নস্থিতি, ঠ মানে টঙ্কারণস্থিতি ইত্যাদি। অর্থাৎ এক একটি বর্গ এক একটি পর্যায় (period) এবং প্রতি বর্গের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ইত্যাদি বর্ণগুলি একত্রে এক একটি শ্রেণী (class)। মৎপ্রণীত ‘বর্ণসঙ্গীত’ গ্রন্থে এই বিষয়টি বিস্তারিত করা হয়েছে। সেখানে বর্ণমালার বর্ণগুলির অর্থের তালিকা পাবেন। প্রসঙ্গত, বাংলা বর্ণমালায় বর্ণগুলি যেমন বিজ্ঞানসম্মতভাবে সাজানো আছে ইংরেজী বর্ণমালায় তেমন নাই।

প্রাচীন বৈয়াকরণদের লেখার সঙ্গে সুকুমার রায়ের কতটা পরিচয় ছিল সে বিষয়ে উপযুক্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। শ্রীহরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ সুকুমারের মৃত্যুর অনেক পরে প্রকাশিত হয়েছে। যাস্কের রচনার সঙ্গে সুকুমারের তেমন একটা পরিচয় ছিল বলে মনে হয় না। তবু সুকুমার তাঁর প্রতিভার জোরে শব্দার্থের দর্শনের মূল প্রশ্নগুলিতে ঘা দিয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘায়ু হলে আমরা তাঁর কাছ থেকে ভাষাদর্শনের উপর আরও কিছু প্রবন্ধধর্মী রচনা আশা করতে পারতাম।

‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব’ রচনাটি অনেকের কাছেই প্রহেলিকাপূর্ণ বলে মনে হয়। অ্যাসপার্গার-লক্ষণসন্নিপাতগ্রস্ত ব্যক্তির লেখা এমন প্রহেলিকাপূর্ণ হয়, কিন্তু যারা সুকুমারের এই রচনাটিকে নিছক অনুপ্রাস সৃষ্টির প্রয়াস বলে মনে করেছেন তাঁরা আসলে তাঁর গভীর ভাষাচিন্তার জগতে প্রবেশ করতে পারেননি। সুকুমার শব্দ নিয়ে মজা করেছেন, শব্দ চিন্তায় হাবুডুবু খেয়েছেন— অ্যাসপার্গার-লক্ষণসন্নিপাতে এমন হয়। শব্দের সঙ্গে তার অর্থের সম্পর্ক কী এবং বর্ণগুলির তাৎপর্য্য কী, এইসব প্রশ্ন তাঁর মনে ঘুরে ঘুরে এসেছে। সুকুমার ভাষাসমুদ্রে ডুব দিয়ে বর্ণগুলিকে তাদের অর্থসহ উদ্ধার ক’রে মালা গাঁথার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি ভাষাসমুদ্রে কিছুটা দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলেন এবং সেই কারণে বহু বছর ধ’রে চেষ্টা করেও তিনি তাঁর ‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব’ শেষ করতে পারেননি। শব্দার্থের দর্শন সম্বন্ধে তাঁর উপলব্ধি অসম্পূর্ণ ছিল। ভাষা নিয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিলেও ‘ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি’ তথা বর্ণমালার কার্য্যকরী তত্ত্ব তাঁর অধরা ছিল। আজকের দিনে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ তাঁর স্বপ্নকে সার্থক করেছে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার