অনুবাদকের বয়ান :
তামিল ভাষার প্রাচীনতম সম্পদ থিরুক্কুরাল প্রায় দুই হাজার বৎসর আগে রচিত। মানবজীবনের বিভিন্ন দিক থিরুক্কুরালগুলোর প্রধান আলোচ্য। অর্থাৎ নৈতিকতা শিক্ষা দেয়াই মূল উদ্দেশ্য। এগুলো রচনা করেন থিরুভাল্লুভার। তাঁর যথার্থ পরিচিতি নিয়ে সংশয় আছে। খুব একটা তথ্য না পাওয়ার কারণে কেউ তাঁকে রাজা, কেউ তাঁতী, কেউ বা ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হিসেবে বর্ণনা করেন। তার ধর্ম পরিচয় নিয়েও সন্দেহ আছে। কারণ থিরুক্কুরালগুলোর প্রধান প্রবণতা অহিংসা ও মানবতা শিক্ষা। এই দুটো নীতিবোধ সনাতন ও জৈন ধর্মের প্রধান ভিত্তি। এই দুটো ধর্ম ছাড়াও ভারতবর্ষীয় বেশ কিছু প্রাচীন সাধনতন্ত্র ও উদারনৈতিক দর্শনবোধের প্রভাব থিরুক্কুরালগুলোতে স্পষ্ট। থিরুক্কুরাল শব্দটি দুটি ভিন্ন তামিল শব্দ একত্র করে তৈরি হয়েছে। তিরু এবং কুরাল। ‘তিরু’ শব্দটি সংস্কৃত ‘শ্রী শব্দটির প্রতিশব্দ স্বরূপ। আর ‘শ্রী’ শব্দের অর্থ সুন্দর, পবিত্র, কল্যাণময়, আনন্দদায়ক। তামিল ‘তিরু’ শব্দটি এসব অর্থ সহ ১৯টি ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর ‘কুরাল ‘ অর্থ যা কিছু সংক্ষিপ্ত, যথাযথ, মার্জিত এরকম।
কুরালগুলো মূলত ছোট ছোট শ্লোক। যা একটি মৌলিক সত্য বক্তব্যকে যথাযথ শব্দ ব্যবহার করে সংক্ষিপ্তভাবে ব্যঞ্জনাময় করে প্রকাশ করে। এগুলো নৈতিকতা, দর্শনতত্ত্ব, জীবনবোধ, কর্ম প্রভৃতি বিষয়ে মানুষকে শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে রচিত। ভাল্লুভার তাঁর নিজস্ব দর্শনবোধে কূপমণ্ডুক ছিলেন না। তাই প্রচলিত নীতিশাস্ত্রগুলোর প্রত্যেকটি থেকে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত, মার্জিত, পরিশীলিত মনোভঙ্গিটিকে গ্রহণ করেছেন।
তাঁর সময়ে ভারতবর্ষে এই ধরণের আরও বেশ কিছু নীতিশাস্ত্র বিষয়ক বই প্রচলিত ছিল। যেমন মনুস্মৃতি, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, পঞ্চতন্ত্র, জাতক কাহিনী প্রভৃতি। উচ্চমানের নীতিবোধের প্রশংসা সবগুলোতে প্রায় একই রকম। যদিও মনোভঙ্গী ও প্রবণতার দিক থেকে সকলের চাইতে ঋষি ভাল্লুভার আলাদা।
দুই হাজার বছর আগে থেকেই থিরুক্কুরালগুলো বেশ সাজানো গোছানো। প্রধানত তিনটি ভাগের অধীনে মোট ১৩৩টি প্রসঙ্গে উপদেশবাণী রয়েছে। এই তিনটি ভাগ পূর্বে তিনটি আলাদা বইয়ে বিভক্ত ছিল। বিষয়ভিত্তিক বইগুলো হলঃ বই-১= পুণ্য, বই-২ = সম্পদ, বই-৩= ভালবাসা। প্রত্যেকটি ভাগ অনেকগুলি প্রসঙ্গে বিভক্ত। প্রতিটি প্রসঙ্গে রয়েছে সবচেয়ে উপযুক্ত, সবচেয়ে শাণিত, সবচেয়ে মার্জিত শব্দ, সরল ও সংক্ষিপ্ত ভাষায় দশটি বাণী বা উপদেশ। এভাবে মোট ১৩৩০টি বিষয়ে মানবজীবনের বহুরৈখিক দিকগুলোকে ঋষি ভাল্লুভার ছুঁয়ে দিয়েছেন।
প্রথম সংকলিত হবার কালে এর কোন নাম ছিল না। লেখকের নামটাও কেউ উচ্চারণ করে নি। তাই ফরাসী ভাষার অনুবাদক মশিয়ে এরিয়েল বলেছিলেন ” এটা নামহীন লেখকের নামহীন বই।” তবে এই বই বিশ্বের সমঝদার পণ্ডিতদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট ৪০টি ভাষায় এগুলো অনুদিত হয়েছে। প্রথম অনুবাদ হয় মালয়ালম ভাষায় ১৫৯৫ সালে। ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে আগমনের পর থিরুক্কুরালগুলো বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় অনুদিত হতে থাকে। বিশ্বের বিদগ্ধ মানুষদের কাছে এই প্রাচীন তামিল শ্লোকগুলো এক গভীর আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে। আর তাই ২০ শতকের শেষ হলে দেখা যায় থিরুক্কুরালগুলো শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষাতে মোট ২৪জন রূপান্তর করেছেন।
বিশ্বের প্রখ্যাত শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক, চিন্তাবিদ সকলে থিরুক্কুরালগুলো দ্বারা কোন না কোনভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। লিও তলস্টয় মহাত্মা গান্ধীর কাছে এইগুলোর অহিংস মনোভাবের প্রভূত প্রশংসা করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে এর পরপরই মূল ভাষায় থিরুক্কুরাল পড়ার জন্য মহাত্মা গান্ধী তামিল ভাষা শিখতে আরম্ভ করেন। কাউকে হত্যা না করা, মাংস না খাওয়া, ভালবাসার জন্য আলাদা একটি বই ইত্যাদি বিষয় গান্ধীকে পরবর্তীতে অহিংস মতবাদে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।
ঋষি ভাল্লুভার সনাতন বা জৈন যে ধর্মের অনুসারীই হোন না কেন, তিনি সত্য বাছাই করতে ভুল করেন নি। প্রাচীন ভারতীয় সনাতন ধর্মের প্রধান দিক ধর্ম, অর্থ, কর্ম ও মোক্ষ, জৈন ধর্মের কঠোর অহিংসবোধ, হত্যা না করা ও মাংস না খাওয়া প্রভৃতি প্রসঙ্গকে থিরুক্কুরালগুলোতে উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে। আসলে কুরালগুলোতে যে নৈতিকতা ও বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে তা এতই মহৎ ও ঐশ্বর্যময় যে সকল ধর্মের লোক এগুলোকে সানন্দে গ্রহণ করবে। ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের উচ্চকণ্ঠ ঋষি ভাল্লুভার সারা পৃথিবীর মনস্বী ব্যক্তিদের সাথে একই কাতারে প্রশংসিত হন। তিনি এরিস্টটল, প্লেটো, গৌতম বুদ্ধ, কনফুসিয়াস, লাওৎজে প্রমুখের মত অশেষ শ্রদ্ধার আসনে রয়েছেন। তামিল সরকার ও তামিলভাষী মানুষের হৃদয়ের সর্বোচ্চ সম্মান ও ভালবাসার স্থানে ভাল্লুভারের বাস। তার মূর্তি ভারত ছাড়াও সিঙ্গাপুর ও লন্ডনে যথাযথ মর্যাদার সাথে প্রদর্শিত হচ্ছে।
কাব্যশিল্প ও বুদ্ধিবৃত্তিক সৌকর্যের দিক থেকে থিরুক্কুরালগুলো প্রাচীন সাহিত্যগুলোর মধ্যে অনন্য। কাব্য হিসেবে সতেজ, সরল, জোরালো ও বাহুল্যবর্জিত, এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে এগুলো ধর্মনিরপেক্ষ, বৈশ্বিক উদারতা, নৈতিক ও জীবনের বাস্তব দিকে প্রতিফলিত। ধর্মীয় মতাদর্শের মতো করে কুরালগুলো আশা জাগানিয়া পরকালের কথা বলেনা, বরং বর্তমান জীবনে বর্ণনাতীত আশীর্বাদ অর্জন করার জন্য মনকে প্রস্তুত হবার কথা বলে। পার্থিব জীবনকে সমৃদ্ধ করার প্রত্যাশাকে ঋষি ভাল্লুভার বেশি গুরুত্ব দেন। তিনি মরণাতীত জীবনে যা পাওয়া যাবে, তার চাইতে এই মানবীয় জীবনে যা পাওয়া যেতে পারে, তার দিকে বেশী মনোযোগী হবার উপদেশ দেন।
বাংলাভাষায় থিরুক্কুরালগুলো রূপান্তর করা হয়েছে এম. রাজারাম কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে। অক্ষম রূপান্তর করার ক্ষেত্রে শব্দের চাইতে অর্থনিষ্ঠ থাকার চেষ্টা বেশি করা হয়েছে। প্রত্যাশা করি বাংলা ভাষার পাঠক এগুলোর সরলতায় অভিভূত হবেন এবং অর্জিত জ্ঞান উপভোগ শেষে আনন্দ পাবেন।
—— সুশান্ত বর্মন
কয়েকটি থিরুক্কুরাল :
১. পৃথিবীতে যদি বৃষ্টি না থাকত তাহলে মহত্ত্ব বা প্রায়শ্চিত্ত কিছুই থাকত না।
২. যদি বৃষ্টি না পড়ে তাহলে চারপাশের বিশাল সাগরগুলো বুভুক্ষ ও পীড়িত হবে।
৩. যে শিশুর আধো বোল শোনেনি শুধুমাত্র সেই বাঁশির সুরকে মনোহর বলে।
৪. পিতার কর্তব্যবোধ সন্তানকে পণ্ডিতদের মধ্যে অগ্রগণ্য করে তোলে।
৫. ভালবাসাপূর্ণ জীবন মর্ত্যে আনন্দ ও স্বর্গে আশীর্বাদ হয়ে ফল দেয়।
৬. মানুষের হৃদয় যদি ভালবাসায় পূর্ণ না থাকে তাহলে অন্য অঙ্গগুলো কোন কাজে লাগে না।
৭. অতিথিকে ভাগ না গিয়ে স্বর্গের অমৃত গ্রহণ করা প্রত্যাশিত নয়।
৮. অতিথি আপ্যায়নের আন্তরিকতা বোঝা যায় অতিথির আগমন প্রত্যাশা দিয়ে।
৯. মূল্যবান উপহারের চাইতে হাস্যোজ্জ্বল মুখের সুন্দর কথা অনেক শ্রেয়।
১০. হাস্যোজ্জ্বল মুখ, ভালবাসাময় চোখ এবং মিষ্টি কথা পুন্যবাণের চিহ্ন।
১১. যথাযথ, সবিনয় এবং তৃপ্তিকর বাক্য সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে নিয়ে আসে।
১২. যখন জানেন যে মিষ্টি বাক্য সুখানুভূতি দেয়, তখন কেন কটুবাক্য প্রয়োগ করেন?
১৩. যে কখনও সাহায্য পায় নি, তার কাছ থেকে পৃথিবী বা স্বর্গের কেউ কোন সাহায্য আশাও করে না।
১৪. সময়মত অল্প একটু সাহায্য, অসময়ে পাওয়া সারা পৃথিবীর বিনিময়ের চাইতেও বড়।
১৫. ন্যায্যতা হল পক্ষপাতহীনতা, যা একটি উদার ও পক্ষপাতহীন মন থেকে আসে।
১৬. সমস্ত ভালত্বকে নষ্ট করতে একটি ক্ষতিকর শব্দই যথেষ্ট।
১৭. আগুনে পোড়া ক্ষতের উপশম হবে; কিন্তু ধারালো শব্দবাণের ব্যাথা কখনও সারবার নয়।
১৮. শিক্ষিত, আত্মনিয়ন্ত্রিত এবং রাগহীন মানুষকে পুণ্যের ঈশ্বর আশীর্বাদ করবে।
১৯. পণ্ডিতেরা যদি তাঁদের অধীতবিদ্যা ভুলে যান, তাহলে তাঁরা তা আবার অর্জন করতে পারবেন। কিন্তু শৃঙ্খলা হারিয়ে গেলে তা সবকিছু ধ্বংস করে।
২০. পরশ্রীকাতর কখনও সফলতা পাবে না। একইভাবে বিশৃঙ্খলা কখনও প্রশংসিত হবে না।
২১. সবসময় সহিষ্ণুতার চর্চা করুন, যাতে নিজের নিরপেক্ষতা বজায় থাকে।
২২. বিদ্বেষমুক্ত থাকা একটি মূল্যবান অধিকার।
২৩. প্রজ্ঞা ও যুক্তিবোধসম্পন্ন মানুষ কখনও অকাজের কথা বলেন না।
২৪. জলভর্তি গ্রাম্য পাত্রের মত মানবতাপ্রেমী জ্ঞানী ব্যক্তির সম্পদ সকলের উপকারে লাগে।
২৫. একজন মহৎ মানুষ যখন অন্যকে সাহায্য করতে পারেন না, তখন নিজেকে গরীব বলেন।
২৬. মাংস খাওয়া বাদ দিলে প্রাণ বাঁচে। মাংসখেকো কখনও নরকে প্রবেশ থেকে বাঁচতে পারবে না।
২৭. চুরি করার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা অশেষ ভোগান্তি নিয়ে আসে।
২৮. সত্য কিছুই না, শুধুমাত্র অন্যের প্রতি সামান্যতম খারাপ মনোভঙ্গি ছাড়া কথা বলা।
২৯. সম্পদভাগ্য উৎসাহময় কর্মোদ্যোগ নিয়ে আসে, সম্পদহীন দুর্ভাগ্য যেমন নিয়ে আসে অলসতা।
৩০. সুন্দর চিন্তা ও আনন্দ উপভোগের সাথে বারবার মিলিত হওয়া শিক্ষিত মানুষের অভ্যাস।