[কিছুদিন আগে চলে গেলো (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাবিজ্ঞানের পরম কাণ্ডারী) শ্রদ্ধেয় প্রিয় শ্রীময় রবি চক্রবর্ত্তী’র একানব্বইতম জন্মদিন (৬ই কার্ত্তিক, ইংরেজী ২৪শে অক্টোবর, ১৯২৯)। স্মরণীয় ও শুভ এই দিনটিকে উপলক্ষ করে সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারটি পরিবেশন করা হল।
২০১৯ এর একেবারে গোড়ার দিকে ফেব্রুয়ারী-মার্চ্চ মাসে আমাদেরই সতীর্থ শ্রীময় গঙ্গোত্রী চন্দ বেশ কয়েকবার রবি চক্রবর্ত্তী’র বাড়ীতে শিক্ষার্থী হিসেবে ভাষাতত্ত্ব চর্চ্চার ঐকান্তিক আগ্রহ নিয়ে নাড়া বেঁধেছিলেন। তারই পরিণতি মূর্ত্ত হয়েছে এই সাক্ষাৎকারে… প্রশ্নোত্তরের সংলাপে…]
পর্ব্বঃ ১
গঙ্গোত্রীঃ
রবীন্দ্রউক্তি – ‘মাতৃভাষা-মাতৃদুগ্ধ’, মানে আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য যেমন মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই, তেমন সদ্যোজাত শিশুর পুষ্টির জন্য মাতৃদুগ্ধের কোনো বিকল্প নেই, সেরকমই খুব স্বাভাবিক নিজের অনুভুতি উপলব্ধি বা প্রতিক্রিয়া প্রকাশে নিজের মাতৃভাষাতেই সবাই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। মানে, এটা কি সত্যি যে মাতৃভাষায় মানুষ সবচেয়ে ভালো নিজেকে প্রকাশ করতে পারে? আবার, প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর মত উন্নত প্রযুক্তিতে নতুন নতুন আবিষ্কার যেভাবে যেভাবে এগিয়ে চলছে, তাই বিশ্বায়নের যুগে উচ্চশিক্ষায় পাশ্চাত্য ভাষার প্রয়োগেই সুবিধা বেশী, তাও মনের ভাবপ্রকাশের সুবিধায় মাতৃভাষার মাধ্যমেই কি শিক্ষা দেওয়া উচিত? মানে, আমাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে যারা শিক্ষা পাচ্ছে, তাদের পাশ্চাত্য ভাষা শেখা শুরু করার বয়স কত হওয়া উচিত? বা, কোন ক্লাস থেকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজী শেখানো উচিত?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
শিশু বয়সেই বেশী ভাষা শেখার ক্ষমতা থাকে। যে কারণে, যে সমস্ত শহরে বহুভাষী লোক থাকে, সেখানে দেখা যাবে যে, বাচ্চারা একই সাথে তেলেগু বলছে মারাঠী বলছে, হিন্দী বলছে। যেরকম হায়দ্রাবাদ আর ব্যাঙ্গালোরের মত শহরে হয়। বয়স হলে পরে শেখবার ক্ষমতাটা কমে যায়। মুশকিলটা হচ্ছে যে, ভাষাকে তার ঠিক মর্য্যাদায় লোক নিতে পারে না অজ্ঞতার জন্যে। যেমন আমাদের বাংলা ভাষার যে ঐশ্বর্য্যের দিকটা, সেটা দেখাতে পারেননি তাঁরা যাঁরা আমাদের বাংলা ভাষার পঠন পাঠনের দায়িত্বে ছিলেন। সে কাজটা আমরা, মানে কলিম খান আর আমি তো অনেকটা করেছি। বাংলা ভাষার গৌরবটা জানলে পর তখন আরও ইংরেজী শেখার সুবিধে হবে বরং।
গঙ্গোত্রীঃ
হ্যাঁ, আপনাদের লেখাপত্র পড়ে তো আমি অনেক মিল পেয়েছি। যেমন, আমাদের ‘গ’ মানে গমন আর পাশ্চাত্যে go উচ্চারণও ‘গ’ দিয়ে, আমাদের ‘র’ মানে আবর্ত্তন আর পাশ্চাত্যে rotation উচ্চারণও ‘র’ দিয়ে, আমাদের ‘চ’ মানে চয়ন আর পাশ্চাত্যে choice উচ্চারণও ‘চ’ দিয়ে, আমাদের ‘ট’ মানে যেমন টোকা দেওয়া আর পাশ্চাত্যে touch উচ্চারণও ‘ট’ দিয়ে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
গঙ্গোত্রীঃ
বাংলা ভাষার সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গীটা পাল্টে দেওয়া দরকার। ক্রিয়াভিত্তিক চরিত্রটা বাংলায় অনেক বেশী। সেইটা শিক্ষকমশাইরা যে নিজেরা শিখতে চান না। আমাদের বাংলা অ্যাকাডেমীর ওপরে যারা বসে আছেন, তারা হীনমন্যতায় ভোগেন। তাই জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে তারা কলিম খান কী কাজ করেছেন, তার খবর রাখেন, প্রকাশ্যে স্বীকার করতে পারেন না।
গঙ্গোত্রীঃ
তাহলে একটা বাচ্চা যখন বাংলা ভাষাটা মোটামুটি শিখে গেছে, তখনই দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পাশ্চাত্য ভাষাটা সে শুরু করতে পারে? মানে, ইংরেজীটা।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
একেবারে গোড়া থেকে
গঙ্গোত্রীঃ
মানে, একেবারে ছোটবেলা থেকে?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ একেবারে ছোটবেলা থেকে। তাকে গোড়াতেই যে বলা হয় ইংরেজীটা ভাল আর বাংলাটা খারাপ, সেটাই হ’ল ক্ষতিকর।
গঙ্গোত্রীঃ
এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গীটা ঠিক রেখে তারপর পাশাপাশি দুটো ভাষাই শেখানো উচিত ছোটবেলায় গোড়া থেকেই।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। আর একটা জিনিস কি জান, কলিমের মাতৃভাষা বাংলা নয়?
গঙ্গোত্রীঃ
হ্যাঁ।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
কলিমের মাতৃভাষাটা হল, ওখানে যাকে বলে ‘খেড়িয়া’ ভাষা।
গঙ্গোত্রীঃ
আঞ্চলিক ভাষা?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
শুধু আঞ্চলিক নয়, ওখানকার ওই অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে, খেড়িয়া মুসলিম যারা, তাদের মধ্যে এই ভাষাটা প্রচলিত, যেটা অনেকটা হিন্দীর কাছাকাছি। তা সত্ত্বেও, কলিম বাংলাতেও তো স্বচ্ছন্দ। কলিম মেলামেশা করেছে বাংলাভাষী ছেলেমেয়েদের সাথে ।
গঙ্গোত্রীঃ
বাংলায় রামায়ণ মহাভারত পড়েছেন, সেই সূত্রেই তো আপনার সাথে…
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ, ওর মত বাংলাভাষার শক্তিশালী লেখক এযুগে আমি আর পাইনি।
গঙ্গোত্রীঃ
আর, আপনার সহায়তা ছাড়া তো কলিম স্যার এতোটা এগোতে পারতেন না…
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ পারতেন। তোমাকে বলি, বঙ্গযানে বেরিয়েছে, বরিষণ রায়ের ইণ্টারভিউ, আর ‘আমার চোখে কলিম খান, যে দিল আমায় মায়ের খবর’ এই দুটো পড়ে নিও।
গঙ্গোত্রীঃ
বরিষণ রায়ের ইন্টার্ভিউটা পড়েছি। আর, ‘আমার চোখে কলিম খান, যে দিল আমায় মায়ের খবর’ এটা পড়ে নেবো।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
কলিমের মুল তত্ত্ব আমার সাথে দেখা হওয়ার আগেই তৈরী হয়ে গেছে। কিন্তু কলিম খান এতো এগিয়ে ছিলেন আমাদের দেশের অন্যদের কাছে, যে কলিম খানকে তারা ধরে নিত যে, লোকটা বেশ মজার মজার কথা বলছে। কিন্তু লোকটা যা বলছে, সেটা যে গ্রহণ করার মত কথা, সে বিশ্বাস তাদের হত না; আর কলিম খান সেভাবে দিতেও পারতেন না। আমি একটা ব্রিজের মত কাজ করেছিলাম। যে কারণে কলিমের সাথে আমার একটা ঠিক ছিল যে, কলিম খান রান্না করবে আর পরিবেশন করবো আমি। আর পুরাণ কলিম খানের খুব ভালো পড়া, রবীন্দ্রনাথও পড়া, আরও অনেক কিছুই পড়া। কিন্তু ইংরেজী সাহিত্যের দিকটা ওর পড়া নেই তেমন, পাশ্চাত্যের ইতিহাস ওর তেমন ভালো জানা নয়। এবং তার ফলে অনেক জায়গায় ওর প্রতিপক্ষ ইংরেজী দেখিয়ে ওকে দাবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো। সে জায়গায় কলিম যা বলছে, সেটা যে ওইক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, এ সমস্ত আমি দেখিয়েছি। তারপর দুজনে মিলে আমরা খুব ভাল এগোতে পেরেছি।
পর্ব্বঃ ২
গঙ্গোত্রীঃ
মানুষের ভাষা তৈরির আগে গুহামানবরা ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করতো। এখনও দেখা যায়, বাচ্চারা কথা শেখার আগে আঁকিবুকি কেটে নিজের ভাব প্রকাশ করতে চায়। আবার দেখা যায়, যারা মনের ভাব পরিষ্কার ভাবে কথায় বা ভাষায় প্রকাশ করতে পারেনা, অর্থাৎ, বাংলা জানে, কিন্তু নিজের বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গী যদি ভাষায় গুছিয়ে উপস্থাপন করতে না পারে, সেক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের মানসিক পরিপক্বতার অভাব থাকে। কেউ যদি নিজের ভাষাচর্চ্চা ভালো করে করতে থাকে, তাহলে কি তার মনের ভাব প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্য আরও বাড়বে? মানে, মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমটা চর্চ্চা করতে করতে কি তার মনস্তাত্ত্বিক উন্নতি ঘটবে? ভাষা কিভাবে আমাদের মানসিক গঠনে সাহায্য করে?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
তুমি যখন কথা বল, কথা বলার সময় তুমি হাতও তো নাড়ো। মানুষ একই সঙ্গে অনেক রকম ভাবে তার মনের ভাব প্রকাশ করে। প্রথম হাত নাড়া, তারপর মুখভঙ্গী, কোন সুরে কথা বলছে সেটা। এবং এই যে হাত নাড়াটা, এই যে শরীরের অঙ্গসঞ্চালন, এটা চরমে পৌঁছোয় নাচের মাধ্যমে। আমার এক সহকর্মী বন্ধু অধ্যাপক, তিনি জাম্বিয়ায় ছিলেন কয়েক বছর, জাম্বিয়াতে বাড়ীতে কাজ করার জন্য যে মেয়েটিকে পেয়েছিলেন উনি, সে বাড়ীতে কাজ করতো, কাজটাই যেন নাচের মাধ্যমে করতো। আমাদের এই যে শহুরে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে মানুষের ওপর বহুরকমের চাপ আছে। যেখানে অনেকটা স্বাধীনতা দেওয়া আছে, সেখানে নাচ গান বাজনা সব একসাথে আসে।
গঙ্গোত্রীঃ অর্থাৎ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত্ত প্রবৃত্তিটাই তালে তালে সুরের মতো।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। আর যেটা তুমি বলছ, বোবা যে, সে কিন্তু কথা বলতে চায়। সাঁওতাল পল্লীতে আমি থেকেছি। যে গুণটার কথা বলছিলাম তা ছিল ওদের, তারপর নষ্ট হয়ে গেছে। চাঁদনী রাত হ’লে পরেই তাদের মাদল বাজবে আর ছেলেমেয়েরা নাচবে। ওখানে ছেলেমেয়েরা একসাথে নাচবেনা এসব ব্যাপার ছিল না। তারপরে আবার দেখবে, সাঁওতালরা তাদের বাড়ীতে নাানা রকমের ছবি দারুণ আঁকে। মানুষের সবকিছুর মধ্যে দিয়েই মানুষের মনের ভাব প্রকাশ হয়। আমাদের ‘সঙ্গীত’ শব্দটার মধ্যেই আছে, নৃত্য গীত বাদ্য, তবে গিয়ে ‘সঙ্গীত’ (সম+গীত)।
গঙ্গোত্রীঃ
আচ্ছা, তাহলে যে মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে অপরিপক্ব, সে যদি নিজের ভাষাচর্চ্চা করতে থাকে, তার কি মনস্তাত্ত্বিক পরিপক্বতার উন্নতি ঘটবে?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ, উন্নতি ঘটবে। তার কারণ, আমাদের যে ভাবটা, সেই ভাবটাকে তো আমরা ভাষার মধ্যে দিয়ে চিন্তা করি। ভাষা বাদ দিয়ে তো আমরা চিন্তা করতে পারিনা।
গঙ্গোত্রীঃ
হ্যাঁ, আমরা যখন কোনো কিছু নিয়ে ভাবি, কথা বলিনা, কিন্তু মনে মনে ভাবি, ভাষা দিয়েই তো ভাবি।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
যে কারণে আমার বৃদ্ধ বয়সে এখন কি করতে হয় জানো, আমি তো অনবরত ভুলে যাই, ধরো এখান থেকে আমি ওখানে যাবো, একটু যাওয়ার পরই আমি ভুলে যাই, কেন আমি এগিয়েছিলাম। আমি তাই একটা বুদ্ধি করেছি, যেমন খুব অস্থির ছেলেরা অনেক সময় একটা জিনিস বলতে বলতে যায়, আমিও সেইরকম যে কাজটা ভেবেছি, সেটা মনে মনে বলতে থাকি। মনে মনে বলতে থাকলে আর ভুলটা হয়না। মানে, আমি শৈশবে ফিরে যাই। বুঝতে পেরেছি, ভাষাতে চিন্তাটা আরও সমৃদ্ধ হয়। যে কারণে ‘ভাষাই পরম আলো’ বলে বইটা করেছি আমরা।
পর্ব্বঃ ৩
গঙ্গোত্রীঃ
যার তান আমার সাথে মেলে সেই আমার সন্তান, তা সে বংশ পরম্পরাতেই হোক বা সংস্কৃতির পরম্পরাতেই হোক। বংশ পরম্পরায় সম তান বলতে আমার তৈরী প্রোডাকশন বা পুত্ত্রও হতে পারে, অর্থাৎ আমার চিন্তাভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গীর তান অনুযায়ী আমি একটা জিনিস প্রডিউস করলাম, মানে, আমার পুত্ত্র হল, তাতেই আমার সুর তাল উপ্ত হল, আর তা হয়ে উঠল আমার সন্তান। আবার সংস্কৃতি পরম্পরায় আমি আমার ধারণাটা আরেকজনকে দিয়ে তার বিকাশ বা উন্নতিতে সাহায্য করলাম, এইভাবে আমার তান অনুযায়ী যখন তার বিকাশ হয়, সেই সম-তানের ক্ষেত্রে গোত্ত্র বলা হয়। পুত্ত্র আর গোত্ত্র শব্দের সম্পর্ক বা মিল আর পার্থক্য কী কী?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
একটা শব্দের নিছক তার বর্ণের গুণে যত জিনিস বোঝানোর থাকে, সেটা বিরাট একটা এলাকা। সেই ভাবে তো মানুষ কাজ করতে পারেনা। যত জিনিস বোঝাতে পারে, তার মধ্যে কোনো কিছু বিশেষ একটা দুটোর ওপরে সেইটা এসে যায়। আচ্ছা, এখন ধরো ‘গোত্ত্র’টা একেবারে আমাদের বৈয়াকরণরাই ধরেছিল, ‘গো’কে যে ত্রান করে। এখন ‘গ’ মানে গমন, আবার ‘গো’ মানে যত রকমের গমনশীল ‘গামী’ তার সবকিছুকেই ‘গো’ বলা যায়। হরিচরণে যদি দেখ, ‘গো’-এর দেখবে পঞ্চাশটা মানে রয়েছে। শেষ পর্য্যন্ত ওই অতগুলো মানে থাকে না, সেটা কমে আসে। ‘গো’-টা শেষ পর্য্যন্ত গিয়ে গরুতে দাঁড়ালো আমাদের ভাষাতে। কিন্তু ব্যাপক অর্থে ‘গো’-টা রয়েছে। যেমন ধর, যখন বলা হয় গোস্বামী, তখন নিশ্চয়ই তা গরুর মালিক হিসেবে বলা হত না, জ্ঞানী লোককে বলা হত। যেমন, বড় বড় বৈষ্ণব সাধকদের বলা হত গোস্বামী, যথা রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী ইত্যাদি। এমনকি শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তের চতুর্থ পর্ব্বে, গহর নামের একজন মুসলমানকে কমললতা বলছে ‘গহর গোঁসাই’, আর শ্রীকান্তকে ‘বড় গোঁসাই’। এবং ওই সূত্রেই গবেষণাটা তো হল ‘গো’-এর এষণা (গো+এষণা=গবেষণা), মানে ‘গো’ খোঁজা। সেই হিসেবে গবেষণা শব্দটা আমাদের এসেছে, কিন্তু গবেষণায় সফল হওয়ার পর ‘ডক্টর’ কেন? গবেষণায় সফল হওয়ার পর তাকে তো বলা উচিত গোস্বামী। তা, সেদিকে নজর যায়নি আমাদের।
গঙ্গোত্রীঃ
মানে, সময় যে চলছে সময়ও ‘গ’ আর সময়ের সর্ব্বাবস্থা বা সর্ব্বরূপ তাও ‘গো’ অর্থাৎ পৃথিবী চলছে, পুরো মহাজগৎ চলছে এবং এই সব গামীরাই ‘গ’, আর এদের সর্ব্বাবস্থা বা সর্ব্বরূপ সেগুলোও ‘গো’।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
শেষ পর্য্যন্ত কিন্তু কমিয়ে ফেলেছে।
গঙ্গোত্রীঃ
গরু যেহেতু সবথেকে উপকারী প্রাণী, গরু রচনায় যা পড়েছি ছোটবেলায়, জীবিত বা মৃত সব অবস্থাতেই সভ্যতার গমনে গরু আমাদের যা উপকারে লাগে, সেই হিসেবেই গো মানে শুধু গরু হয়ে গেল। কিন্তু আমরা নিজেদের মধ্যে মধ্যম পুরুষের সাথে কথা বলার সময় তার ব্যস্ততার মাঝে, ‘কি গো’ বলে সেই গামীকে সম্বোধন করি।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। আচ্ছা, কোন্নগর নামের ইতিহাস নিয়ে ‘বঙ্গযান’-এ আমার একটা লেখা বেরিয়েছিল, সেটা তুমি পড়েছ?
গঙ্গোত্রীঃ
না, ওটা আমার পড়া হয়নি।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
আচ্ছা, আমার কাছে এক্সট্রা একটা কপি আছে, ওটা তোমাকে দেবো। সেটা হল যে, উৎপন্ন হলেই সে হল পুত্ত্র, কিন্তু যখন তাকে নিয়ে আমি একটা কথা দিলাম যে, আমি এইটা তোমাকে দেবো, ও-ও কথা দিল যে, আমি এইটা তোমার থেকে নেবো এবং ও বলল পরিবর্ত্তে আমি তোমাকে এই দেবো, আর আমি বললাম ‘আচ্ছা’ তাই, তখন সেই পুত্ত্র হয়ে গেল কন্যা। অর্থাৎ কন্যা হল, যে পুত্ত্র পণের দ্বারা আবদ্ধ। আগে তো কন্যাই কেনা হত, বরপণ তো পরে হয়েছে। একটা মেয়ে মানে তো সে ওয়ার্কিং হ্যাণ্ড, একটা মেয়ে মানে তো জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, সুতরাং মেয়েকে তো কিনেই আনতে হবে। সেই হিসেবে উৎপন্ন হলে পরে সে পুত্ত্র, দশরথের পুত্ত্র চাই পুত্ত্র চাই…
গঙ্গোত্রীঃ
মানে, দশরথের প্রোডাকশন চাই।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। তারপর পুত্ত্র হওয়ার পর দশরথের কন্যাও হয়েছিলো। সেই সূত্রেই বলি, কোন্নগর নামের পেছনে আছে কন্যানগর। আর গোত্ত্রটা তুমি দেখবে যে, একই গোত্ত্রের মধ্যে ব্রাহ্মণ কায়স্থ অন্য জাতের লোকও রয়েছে। তাহলে, গোত্ত্র রক্তের সম্পর্ক না, গোত্ত্র হল একটা কমিউনিটি, তাদের যে ‘গো’, সেই ‘গো’-কে ত্রাণ করছে যে সংগঠন সেটা হল ‘গোত্ত্র’, যে সংগঠনটা ওই ‘গো’কে ত্রাণ করছে।
গঙ্গোত্রীঃ
আমি ছোটবেলায় যা শুনেছিলাম, আমার কাশ্যপ গোত্ত্র, মানে কশ্যপ মুনির আণ্ডারে যে কজন ষ্টুডেণ্ট ছিল, তাদের বংশ বা সেই সংস্কৃতির যে পরম্পরা, অর্থাৎ কশ্যপ মুনির সংস্কৃতির যে পরম্পরা সেটাই কাশ্যপ গোত্ত্র।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
তার থেকেও আরও বেশী। কাশ্যপ গোত্ত্র তুমি দেখবে… আচ্ছা, তুমি তো মনে হয় কায়স্থ?
গঙ্গোত্রীঃ
হ্যাঁ, কায়স্থ।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
কায়স্থ’র বাইরে ব্রাহ্মণও আছে কাশ্যপ গোত্রে, অন্য জাতি-উপজাতি বা অন্য রাজ্যের সংস্কৃতিতেও কাশ্যপ দেখা যায়। কী করে সম্ভব?
গঙ্গোত্রীঃ
এরা সবাই কশ্যপের ষ্টুডেণ্ট ছিল।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
ষ্টুডেণ্ট না, এরা সবাই কশ্যপের কমিউনিটিতে ছিল।
গঙ্গোত্রীঃ
হ্যাঁ, মানে, এরা সবাই কশ্যপের সংস্কৃতি পরম্পরায় ছিল।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
সংস্কৃতি পরম্পরায় না, আসলে কমিউনিটি মানে সম্প্রদায়। বলতে গেলে তারা টিঁকে থাকছে এক হয়ে, একটা গ্রামের মত। একটা গ্রাম বলতে গেলে সেখানে বহু বৃত্তির লোক আছে, সেই গ্রামের যিনি মুখিয়া তিনি মোড়ল, এক হিসেবে তিনি গোত্ত্রপতি। আর আমাদের দেশে তো এখনও যে ভোট হয়, এই ভোটগুলো ব্যক্তি দেয়না, এক একটা গোটা সম্প্রদায় ধরে দেয়, অর্থাৎ কোনো নির্দ্দিষ্ট ভোটপ্রার্থী বা রাজনৈতিক দলকে যাদের যাদের পছন্দ, তাদেরকে একত্রে সম্প্রদায় বলা হচ্ছে। ওই যৌথ সমাজের ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে এখনও রয়েছে। দেখবে, সব যাদবরাই মোটামুটি একজনকেই ভোট দেবে। আমাদের দেশের জাতপাতের ব্যাপারটা যারা পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গীতে বুঝতে গেছে তারা তো বুঝতে পারেনি। আর, এই গোত্ত্র আর ‘কুল’ এই দুটো নিয়ে আমার কলিমের সাথে পুরো থ্র্যাশ আউট হয়নি, তবে আমার অনুমান, মাতৃতান্ত্রিক সমাজের যে সংগঠন সেটা হল কুল, আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যে ওই সম্পদ ধরে যে পরম্পরা সেটা হল গোত্ত্র।
গঙ্গোত্রীঃ
অর্থাৎ মাতৃতান্ত্রিকের ক্ষেত্রে কুল, আর পিতৃতান্ত্রিকের ক্ষেত্রে গোত্ত্র বলা হয়।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ।
পর্ব্বঃ ৪
গঙ্গোত্রীঃ
কারোর কাছে তার নিজের শরীর, নিজের ক্ষেত্র, নিজের কর্ম্মচারী, নিজের জমিজমা, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি, সবই তার স্ত্রী। শব্দার্থকোষে প্রকৃতি-পুরুষ সম্পর্ক থেকে স্ত্রীর ধারণা পাওয়া যায়। মালিক যেমন তার অধিকার ছাড়া খোঁড়া, আর অধিকৃত সম্পত্তি তার মালিক ছাড়া অন্ধ। ‘ভাষাই পরম আলো’ বইতে আপনাদের বক্তব্য থেকে জানলাম, পৃথিবীর ইতিহাসে ‘মনুসংহিতা’ আইনের প্রথম বই। মনুসংহিতার আইনে স্ত্রী সম্বন্ধে তথ্যগুলোর যা বিকৃতি ঘটিয়েছে টীকাকাররা। সেই বিভ্রান্তি পরিষ্কার করার জন্য ‘স্ত্রী’-এর শব্দার্থ বিশ্লেষণ জানতে চাই।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
বর্ণ ধরে ধরে যদি করো, তাহলে ‘স’ মানে নিছক অস্তিত্ব।
গঙ্গোত্রীঃ
মানে শক্তির সর্বনিম্ন রূপ।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। তারপর ‘ত’ মানে হল, সেটা একটা footing পাচ্ছে, অর্থাৎ একটা তল পাচ্ছে।
গঙ্গোত্রীঃ
মানে, উদ্ধার হচ্ছে, বা তারণ পাচ্ছে, বা কোনো উপায় পাচ্ছে, অর্থাৎ সাপোর্ট পাচ্ছে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। তারপর আসছে ‘র’। ‘র’ মানে হল, তাতে আবর্ত্তিত হওয়া।
গঙ্গোত্রীঃ
অর্থাৎ সেই উপায়ের দ্বারা রক্ষা পাওয়া।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। এরপর সেইটা যখন চালু হচ্ছে, অর্থাৎ সক্রিয় হচ্ছে, তখন ‘ই’ হল। তারপর সেই সক্রিয়তার আধার হল ‘স্ত্রী’। সেই হিসেবে কোনো কিছুর স্ত্রী মানে, যেখানে তার অস্তিত্ব সংরক্ষিত হচ্ছে।
গঙ্গোত্রীঃ
মানে, মালিক যেহেতু খোঁড়া, মালিকের দাঁড়ানোর জন্য বা মালিকের সাপোর্টের জন্য তার অধিকৃত জিনিসপত্র বা তার অধীনস্থ কর্ম্মচারীদের চাই, তারপর সেই সবের রক্ষায় মালিকের সক্রিয়তা আধার পাবে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
আর সব ক্ষেত্রেই পুরুষ আর প্রকৃতির মধ্যে এই সম্পর্কটা, অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক নীতিটা হল পুরুষ, আর যে আসল কাজটা করছে সে প্রকৃতি।
গঙ্গোত্রীঃ
যেমন, এই ফোন রেকর্ডার আর যে সিষ্টেমে রিপোর্ট লিখবো, সেগুলো ছাড়া আমি খোঁড়া, মানে আপনার সাথে কথাগুলো যদি আমার মনে না থাকে আর যদি টাইপ না করতে পারি, তাই আমার এই ‘স্ত্রী’গুলোর রক্ষায় আমি কাজটা করতে পারছি।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
আর তুমি এখানে পুরুষ।
গঙ্গোত্রীঃ
হ্যাঁ, আমি নির্দ্দেশ দিয়েছি বলেই রেকর্ডার আর মোবাইল অন হয়েছে, আর, ‘কী’-বোর্ডে কোনটার পর কোন ‘কী’-টা প্রেস হয়ে টাইপ হবে সেটাও আমি নির্দ্দেশ দেবো, ‘পুশ’ করবো ‘কী’-গুলো। এই যন্ত্রগুলো ছাড়া আমি খোঁড়া, এরা আমার অধিকৃত ‘স’ম্পত্তি, এরা আমার ‘স্ত্রী’। এরা আমাকে যে সাপোর্ট দিচ্ছে, তাতে আমার সক্রিয়তা রক্ষা পাচ্ছে, আমি কর্ম্মক্ষম থাকছি আমার ‘স্ত্রী’দের সাপোর্টে, অর্থাৎ আমি শক্তির আধার পাচ্ছি।
তাছাড়া আপনি এবং কলিম খান উভয়েই আপনাদের লেখা ‘সরল শব্দার্থকোষ’ গ্রন্থে দেওয়া সম্পদ ও সম্পত্তি শব্দের ব্যাখ্যা থেকে জেনেছি যে, পুরুষের পালন-দানকারী ভূমিকার সমান ‘পদ’-এর পালন(প) দাতা(দ)’র অধিকারীমাত্রই ‘স্ত্রী’ পদবাচ্য। ‘সম্পত্তি’ শব্দের অর্থ সম্পর্কেও একথা আপনারা জানিয়েছেন যে সম্পত্তি হল ‘সম-পদের তারণ সক্রিয় থাকে যে আধারে’ অথবা যাহা দ্বারা সম্পন্ন হয় [ সম্পত্তি’র প্রতীকী অর্থগুলি হল – সম্পদ, লক্ষী, শ্রী, প্রাচুর্য্য…]। সম্পত্তি শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ ভুলে গিয়ে তাকে শুধুমাত্র বস্তুময় বিত্ত-সম্পদে প্রতীকায়িত করে ফেলায় কিংবা একরৈখিক অর্থে ফিক্সড করে দেবার কারণে ‘স্ত্রী’ শব্দের অর্থ শুধুমাত্র ধন-সম্পদের সঙ্গে তুলনা করার ফলে যা হবার তাই ঘটেছে। পুরুষ-স্ত্রীর সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সমমর্য্যাদাসম্পন্ন সম্পর্কটিরও অধঃপতন ঘটেছে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ।
পর্ব্বঃ ৫
গঙ্গোত্রীঃ
সারা বিশ্বে কুকুরদের ভাষা, বাঘেদের ভাষা, পায়রাদের ভাষা এক। মানুষ বাদে প্রতিটা প্রজাতির সারা বিশ্বব্যাপী ভাষা এক, আর, শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই ভাষার বিভিন্নতাটা দেখা যায়। কিন্তু মূল থেকে দেখলে বোঝা যায়, সারা বিশ্বে মানুষের ভাষাও এক, সদ্যোজাত বাচ্চার প্রথম বাকস্ফুটন অংরূপিণী (ঙ)। তারপর সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সংস্কৃতি অনুযায়ী তার কথা বলার অভ্যেসে ভাষায় বিশেষত্ব দেখা যায়। এই বিশেষত্বের মূল ভিত্তি, বিশ্বব্যাপী অঞ্চল ভেদে (ডারউইন তত্ত্ব) বিবর্ত্তনের ফলে মানুষের প্রাকৃতিক অর্জ্জিত গুণাবলীর নিরিখে মুখ বা জিভের সঞ্চালন। কোনো ব্যক্তির প্রথম শব্দ অংরূপিণী (ঙ) থেকে তার উচ্চারিত পরবর্ত্তী শব্দগুলো কি এই জন্যই অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের থেকে আলাদা?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
ব্যাপার হচ্ছে, মানুষকে তো বেঁচে থাকতে হয়। বেঁচে থাকার জন্যে তাড়াতাড়ি একটা, অর্থাৎ আমার যাতে কাজ চলে, এটা তাকে করতে হয়। সে জন্য বসার দিক থেকে সব থেকে আরামের মত চেয়ার আবিষ্কার হওয়ার আগেই মানুষ একটা ‘টুল’ পেয়েই বসে গেল।
গঙ্গোত্রীঃ
যেমন, গাছের গুঁড়ি কেটে, গুঁড়ির ওপরেই বসে গেল।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
তেমনি আওয়াজ, যে আওয়াজে সবথেকে ভাল ওটা বোঝাতো, অত কিছু গবেষণা করার তো সময় নেই। যেই মনে হল কোনো একটা আওয়াজে তার কাজ হয়ে গেল, তখন তারা সেটা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিল। এবার, আমাদের দেশে যারা সংস্কৃত ব্যাকরণ করেছিলেন, তাঁরা ভাষার ব্যাপারটা অনেক বুঝেছিলেন। যার ফলে সংস্কৃত ভাষাতে যা ব্যবহার হয়নি, এমন সব বর্ণকেও তাঁরা বর্ণমালায় স্থান দিয়েছেন। ‘ট’ ‘ঠ’ ‘ড’ ‘ঢ’ এসব দিয়ে শুরু হয়েছে এরকম শব্দ সংস্কৃতে খুব কম, প্রায় পাবেই না। তারপর একেকটা জাতের চলিত ভাষায় ভাষার পরিবর্ত্তন হয়েছে। যেমন ধরো আমাদের যেখানে ‘ত’ আর ‘ট’ আলাদা, ইংরেজীতে সেখানে ‘T’ বর্ণ ‘ট’-এর কাজ করে আবার ‘ত’-এরও কাজ করে। এটা অনেকটা আলোর জগতের মত। যেমন বর্ণালীতে বেগুনী থেকে লাল পর্য্যন্ত তুমি দেখবে এরকম কোথাও নেই যে একটা রঙ থেকে আরেকটা রঙের মাঝে সীমানার মত পার্থক্য।
গঙ্গোত্রীঃ
না, ওখানে একটা রঙ ব্লেণ্ড হয়ে আরেকটা রঙে মিশতে মিশতে রঙ চেঞ্জ হয়।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
তেমনি আমাদের এই বর্ণের ক্ষেত্রে, মানে ধ্বনির ক্ষেত্রেও ‘ক’ থেকে যে আস্তে আস্তে বর্ণান্তর ঘটে যাচ্ছে, সেই ‘ক’-এরও নানান রকম আছে, সব ‘ক’ একরকম নয়। ধরো আমাদের বাংলায় আমরা যে ‘ট’ বলি, আর ইংরেজীর ‘T’ উচ্চারণ কিন্তু একরকম না, তফাৎ আছে।
গঙ্গোত্রীঃ
হ্যাঁ, ওদেশে ‘T’ উচ্চারণ একটু ‘ঠ’-ঘেঁসে করে ওরা।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। যারা ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাবরেটরিতে কাজ করে তারা এগুলো যন্ত্র দিয়ে মেজার করতে পারে। যেমন ইংরেজীর যে ‘F’, তার উচ্চারণ মত ইংরেজির full, আর আমাদের ফুল, এক নয়।
গঙ্গোত্রীঃ
ইংরেজী F উচ্চারণে দুটো ঠোঁট ‘টাচ’ হবেনা, কিন্তু আমাদের ‘ফ’ উচ্চারণে দুটো ঠোঁট ‘টাচ’ হবে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। মুখের সামনে নির্দ্দিষ্ট দুরত্বে মোমবাতি থাকলে, ইংরেজীতে ‘full’ উচ্চারণে শিখা নড়ে উঠতে পারে, কিন্তু আমাদের ‘ফুল’ উচ্চারণে শিখা নড়বে না।
গঙ্গোত্রীঃ
আরেকটা জিনিস আমার মনে হয়েছে, আমি যতদূর অবজার্ভ করেছি, দন্ত্য-’স’-এর আসল উচ্চারণ তো সিনান বা স্নান-এর ‘স’-এর মতো, জিভ আর দাঁতের কাছে এসে ফাঁক দিয়ে হাওয়া বেরোবে। আর, মূর্দ্ধন্য-‘ষ’টার উচ্চারণ ‘ষাট’-এর মতো, জিভ মূর্দ্ধা’র কাছে এসে ফাঁক দিয়ে হাওয়া বেরোবে। তারপর তালব্য-‘শ’, জিভ তালু বা টাকরার কাছে এসে ফাঁক দিয়ে হাওয়া বেরোবে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
তালু আর মূর্দ্ধা মুখের কোন কোন জায়গা আমার ঠিক অতটা মনে নেই, তুমি দেখে নিও।
গঙ্গোত্রীঃ
পরপর দন্ত মূর্দ্ধা তালু, মানে দন্ত আর তালুর মাঝে মূর্দ্ধা।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ।
গঙ্গোত্রীঃ
ইংরেজীতে যে “শন” বানানটা ‘tion’, উচ্চারণ করার সময়, ‘ট’-এর ক্ষেত্রে জিভ যেখানে টাচ হয়, ওই তালু বা টাকরা আর জিভের মধ্যে দিয়ে হাওয়া বেরয় ‘শন’ উচ্চারণ করার সময়। সেই হিসেবে আমার মনে হয়, shooting, shutdown, push, এই শব্দগুলো উচ্চারণ করার সময়, তালু বা টাকরা না, বরং জিভ মূর্দ্ধা’র কাছে এসে ফাঁক দিয়ে হাওয়া বেরোয়। তাই আমার মনে হয় এই shooting, shutdown, push, শব্দগুলোর বাংলা বানান ‘ষুটিং’, ‘ষাটডাউন’, ‘পুষ’, এরকম হওয়া উচিত।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। আবার তুমি দেখবে কিছু কিছু উচ্চারণ, যেমন “আষাঢ়” উচ্চারণ করতে গেলে মূর্দ্ধন্য-‘ষ’ ছাড়া উচ্চারণ করাই যাবেনা, কারণ ‘ঢ়’ বাধ্য করছে মূর্দ্ধন্য-‘ষ’ উচ্চারণ করতে। তুমি দন্ত্য-’স’ দিয়ে এই উচ্চারণ করতে যাও, পারবেনা।
গঙ্গোত্রীঃ
তাহলে এক্ষেত্রে এটা কি শুধু উচ্চারণের ভিত্তিতেই? বর্ণের মানে অনুযায়ী নয়?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
উচ্চারণের ভিত্তি আর বর্ণের মানে তো একই সাথে এসে যায়।
গঙ্গোত্রীঃ
তাহলে বাংলায় যে shooting, shutdown, push, বানানগুলো লেখা হয় তালব্য-‘শ’ দিয়ে, সেটা একেবারেই ভুল, এই বানানগুলো মূর্দ্ধন্য-‘ষ’ দিয়ে লেখা উচিত?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ।
গঙ্গোত্রীঃ
আমি বারবার করে উচ্চারণ করে করে আমার মনে হয়েছে এটা। তাহলে, s=স, sh=ষ, tio=শ।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
গঙ্গোত্রীঃ
আসলে আমার অবজার্ভেশনটা কনফার্ম করানোর দরকার ছিল তাই জিগেস করলাম।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। তুমি ঠিক বলেছো। এই যে ধরো ষড়দর্শন, এটাকে তুমি অন্যভাবে উচ্চারণ করো তো। আমাদের ভারতীয় যে ছটা দর্শন, ষড়দর্শন। কিম্বা ষাঁড়, রাস্তায় যে ষাঁড় ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই শব্দটি।
গঙ্গোত্রীঃ হ্যাঁ, sh
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ, ওখানে মূর্দ্ধন্য-‘ষ’ ছাড়া তুমি উচ্চারণই করতে পারবে না। ‘ইণ্টারন্যাশনাল ফোনেটিক অ্যাসোসিয়েশনের (IPA) যে অ্যালফাবেট সেটা দেখেছো?
গঙ্গোত্রীঃ
না, দেখা হয়নি।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
দেখো, ইণ্টারনেটে পেয়ে যাবে। ইণ্টারন্যাশনাল ফোনেটিক অ্যাসোসিয়েশন আছে, তারাই এই অ্যালফাবেটটা করে দিয়েছে।
গঙ্গোত্রীঃ
আচ্ছা, ‘পুষ'(push)টা কি ‘পুরুষ’ থেকেই এসেছে, মানে যে কিছু contribute করে?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
পায়ী (প) নবরূপে উত্তীর্ণ (উ) হলে সেটা (পু) পাওয়ার পরিবর্ত্তে দেওয়া হয়ে যায়। সেই পু অর্থাৎ দেওয়ার ক্ষেত্রে পায়ীর অস্তিত্ব রক্ষিত (র) হলে, তখন সেটা ‘পুর’।
গঙ্গোত্রীঃ
যেমন, খাবার কিনে (পায়ী খাবার ‘পেয়ে’) কাউকে খাওয়ানোটা ‘দান’ আর নিজে রান্না করে খাওয়ানোটা ‘পুর’ দেওয়া, পুরনো কাগজ (পায়ী কাগজ পেয়ে) দিয়ে দেওয়াটা দান আর সেই কাগজ দিয়ে হাতের কাজ তৈরি করে দেওয়াটা ‘পুর’ দেওয়া, কোনো প্রশ্নের উত্তর (পায়ী উত্তর পেয়ে) কাউকে বলে দেওয়াটা দান আর সেই উত্তর বুঝিয়ে তার মগজে ঢুকিয়ে দেওয়াটা ‘পুর’। অর্থাৎ,‘পুর’ মানে শুধু transfer করে দেওয়া না, সেই দেওয়ার মধ্যে নিজেরও contribution থাকে। যেমন সব্জি-মশলার মিশ্রণ বানিয়ে মোমোতে দিলে সেটা পুর হয়ে যায়। পুর-এর যখন নবরূপে উত্তরণ হয়ে (উ) দিশাগ্রস্তভাবে বিচ্ছুরণ হয় (ষ) অর্থাৎ কেউ নির্দ্দিষ্ট ক্ষেত্রে contribution করে, তখন সে ‘পুরুষ’।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। তাহলে যখন তুমি নির্দ্দিষ্ট দিকে শক্তি (ষ) দিচ্ছ (পু), মানে ঠেলছ, সেটাই ‘পুষ’ (push)।
পর্ব্বঃ ৬
গঙ্গোত্রীঃ
সাধারণ ভাবে আমরা যখন কথা বলি একটানা শুধু বাংলা বলিনা, এই যে আপনার সাথেও কথা বলতে বলতেও কিন্তু আমার স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইংরেজী টার্ম চলে আসছে। মানে, ওই টার্মগুলোর ক্ষেত্রে মনের ভাব প্রকাশ করতে বাংলার তুলনায় ইংরেজীতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি। ভাষা কীভাবে সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে? বা, আমাদের ভাষা কীভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে? কর্পোরেট কালচারে বাংলার মধ্যে ইংরেজী বা হিন্দী বলার প্রবণতা আমাদের সংস্কৃতিতে কীরকম প্রভাব কতটা ফেলতে পারে?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
ভাষার ক্ষেত্রে সমাজে যে অংশটা সমাজের উৎপাদন ব্যাবস্থাটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তারা চাইবে তাদের ভাষাটাই সকলে গ্রহণ করুক।
গঙ্গোত্রীঃ
আচ্ছা, মানে, যে কমিউনিটির লোকেরা বেশী কনজিউম করবে, অর্থনৈতিক দিক টা…
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
অর্থনীতিটা যাদের হাতে, অর্থাৎ আমাদের যজ্ঞটা যাদের হাতে, তারা তাদের ভাষার মাধ্যমেই সব কাজ চালাতে চায়। সুতরাং তারা চাইবেই অন্যরা নিজেদের ভাষা ভুলে গিয়ে তাদের ভাষা ব্যবহার করুক।
গঙ্গোত্রীঃ
অন্যেরা আমাদের সংস্কৃতিতে চলে আসুক, তাহলে আমাদের সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ হবে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
শুধু সমৃদ্ধ না, তাহলে অন্যদের ওপর আমাদের আধিপত্য রাখতে সুবিধে হবে।
গঙ্গোত্রীঃ
তাই দেখা যায়, বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে বাংলার থেকে ইংরেজী বা ননবেঙ্গলী ধাঁচ বেশী।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
ইংরেজী ভাষা তো পৃথিবীর সব ভাষাকে খেয়ে নিচ্ছে এখন।
গঙ্গোত্রীঃ
তাও, ফ্রান্স জার্ম্মানী ওরা কিন্তু…
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
না না, আগে তাই ছিল, ইংরেজীতে ফরাসী ভাষা থেকে শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটত। আর এখন, ইংরেজী থেকে ফরাসীতে শব্দ যাচ্ছে।
গঙ্গোত্রীঃ
ও আচ্ছা, আমাদের মতই চলতি কথায় বলতে বলতে ফরাসীরা ইংরেজী বলতে অভ্যস্ত হচ্ছে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ, ইংরেজীর দাপটটা বাড়ছে। ১৬০০ সালেও ইংরেজীতে যত লোক কথা বলত, তার থেকে ফরাসীতে বেশী লোক কথা বলত, স্প্যানিশে বেশী লোক কথা বলত। ইংরেজী বলা লোকের সংখ্যা ফরাসী বা স্প্যানিশ বলা লোকের থেকে কম ছিল। তারপর ইংরেজী বলা লোক বাড়ল কেন? ইংরেজী ছড়িয়ে পড়ল, এবং ছড়িয়ে পড়ে প্রভুত্ব করল। ওই আমেরিকার যে খিচুড়ি হতে লাগলো, মানে, জনমিশ্রণের যে খিচুড়ি, তাতে সবাই তো ইংরেজিভাষী হয়ে গেল। হল্যাণ্ড থেকেই আসুক, আয়ারল্যাণ্ড থেকেই আসুক, ফ্রান্স থেকে যাক, স্পেন থেকে যাক, সবাই তো ইংরেজিভাষী হয়ে গেল। মানে, আমি বলছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রটা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লোকসংখ্যা সবথেকে বেশী। আর, ওর পাশে যে হিস্পানী বা স্প্যানিশ ভাষা, তারাও অনেকে গেছে। সুতরাং আমেরিকাতে দুটো ভাষা, ইংরেজী আর স্প্যানিশ।
পর্ব্বঃ ৭
গঙ্গোত্রীঃ
আঞ্চলিক ভাষা কি ক্রমশ গুরুত্ব হারাচ্ছে? বাংলার মধ্যেই যেসব অঞ্চলের চলিত ভাষা আলাদা সেগুলোকে ছাপিয়ে কি কলকাতা ধরণের মার্জিত বাংলা বেশী গুরুত্ব পাচ্ছে?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
অবশ্যই তা পাচ্ছে। এবং সেটা পাওয়ার একটা কারণ হচ্ছে যে, কোনো একটা লোক তো মিলতে মিশতে চায়। এখন, বাংলাদেশের ঘটনা দেখলে এটা খুব ভাল বোঝা যায়। ইংরেজীতে যে ষ্ট্যাণ্ডার্ড ভাষা তাকে বলে ‘কুইন্স ইংলিশ’। আমাদের এখানে ষ্ট্যাণ্ডার্ড বাংলা যেটা করা হয়েছে, সেটাকে ওরা বলে প্রমিত বাংলা। আমরা পশ্চিমবঙ্গের বহু লোক এই প্রমিত বাংলাতেই বাড়ীতেও নিজেদের মধ্যে কথা বলি। কিন্তু বাংলাদেশে, ঢাকার একরকম ভাষা, বরিশালের একরকম ভাষা, চট্টগ্রামের একরকম ভাষা। প্রত্যেক আঞ্চলিক ভাষারই একটা দাবী রয়েছে যে, তাদের ভাষাটা প্রাধান্য পাক। সেক্ষেত্রে প্রমিত ভাষা নেওয়ার ফলে সুবিধা হচ্ছে কি, সকলকেই খুশী করা গেছে। আর, আরেকটা খুব বড় কারণ আছে। সেটা হল, বাংলা সংস্কৃতির সম্বন্ধে ওদের দুর্ব্বলতা আছে ; তার থেকে ওরা বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। মৌলবাদী মুসলিমরা যেটা করার চেষ্টা করেছিলো, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, সেটাকে কাটিয়ে উঠলো। কাটিয়ে ওঠার ফলে তারা দেখল, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমরা বাঁচবো কীকরে? যে কারণে এখনও আমি অত্যন্ত ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে হলে শুনি অদিতি মহসীন বা শ্যামা রহমান, তারপর লাইসা আহমেদের মত কণ্ঠশিল্পীদের গাওয়া গান। অদিতি মহসীনের মত গলা তো আমি পশ্চিমবঙ্গে পাইনা।
গঙ্গোত্রীঃ
এই ‘প্রমিত বাংলা’ বলে যে একটা ষ্ট্যাণ্ডার্ড করে দেওয়া হয়েছে…
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
তাহলে আমরা সহজেই যোগাযোগ রাখতে পারব। ধরো আমাদের এখানে বাঁকুড়ার ভাষা তো এই ভাষার মত না, যেমন ‘উ একাজ করতে লারবেক’, একদম শব্দই আলাদা। এবং বহু জায়গায় শব্দের মানে আলাদা। যেমন, কলিম খানের যে দেশের ভাষা, সেখানে ‘পালিয়ে আয়’ মানে ‘চলে আয়’।
গঙ্গোত্রীঃ
হ্যাঁ, এটা আমি শুনেছি। পালানো মানে চলে যাওয়া। যাওয়া থেকে চলে যাওয়ার পার্থক্য বোঝাতে ওরা চলে যাওয়ার পরিবর্ত্তে পালানো বলে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
এখানে পালানো মানে escape না, পালানো মানে go away।
গঙ্গোত্রীঃ
আমার কোর্সের শুরু শুরুতে একজন ব্যাচমেটকে অনেকদিন ধরে লক্ষ্য করতাম, পালানো মানে কি বলতে চাইছে, তারপর বুঝলাম।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
আরও অন্য শব্দেরও। মেদিনীপুরের কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, কেমন খাওয়া হল, তো সে বলল ‘মোটামুটি’, মানে খুব ভাল খাওয়া হয়েছে।
গঙ্গোত্রীঃ
মোটা মানে ভাল। কিন্তু আমাদের এখানে মোটমুটি মানে মাঝামাঝি। প্রমিত অভিধানে আমি একটা নিয়ম দেখলাম, আমার সেটা পছন্দ হলনা বলেই জিজ্ঞেস করছি প্রশ্নটা, বিদেশী ভাষার যখন বাংলা তর্জ্জমা করা হবে, তখন প্রতিটা যুক্তাক্ষরের যে কোনো স/ষ/শ-কে দন্ত্য’স’ লিখতে হবে। master(প্রভু)-টা ওরা বাংলায় ‘মাস্টার’ লিখছে, কিন্তু আমরা তো ছোট থেকে ‘মাষ্টারমশাই’ উচ্চারণই করে আসছি। কিন্তু ওরা এই ‘মাষ্টার’ বানানটা একেবারেই অ্যালাও করছে না। একটা কথা জিজ্ঞেস করছি যে, আঞ্চলিক ভাষাগুলো সংরক্ষণ করা উচিত, আর সেটাই তো ভাষার আসল চর্চ্চা।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
বিশ্বায়ন যেমন হচ্ছে, বিশ্বায়নের বিপরীতে একটা ক্রিয়াও কাজ যদি করে, সেটা হবে কল্যাণের। অর্থাৎ একদিকে গ্লোবালাইজেশন, আবার অপর দিকে লোকালাইজেশন।
গঙ্গোত্রীঃ
লোকালাইজেশন বলতে, আঞ্চলিক ভাষার সংরক্ষণ।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। সবই করতে হবে সচেতন ভাবে।
গঙ্গোত্রীঃ
মানে, সবকিছুরই গুরুত্ব আছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে যে কোনখানে কোনটা কতটা।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
এই যে ক্রিয়াভিত্তিক বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব, এই দিয়ে সব ভাষারই মূলটা ধরিয়ে দিলে পর লোকে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করবে। ধর, হিন্দীতে যেমন বলে যে, ‘গির জায়েগা’, এটাও যে, উদ্গীরণ, অগ্ন্যুদ্গারের মতো। ওখানে পাচ্ছো – ওই ‘গির’। বা, হিন্দীর ‘উতরো’ বা ‘উতারো’, এটাও উত্তরণ। এগুলো যখন সচেতন ভাবে ধরিয়ে দেওয়া যাবে, তখন আবার মানুষে মানুষে যোগাযোগটা সহজ হবে। যে কারণে ক্রিয়াভিত্তিক বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের একটা সম্ভাবনা আছে। কম্পিউটারে সেটা দিলে, যে কোনো একটা ভাষা ইনপুট করলে অন্য সব ভাষায় সেটা অনুবাদ হবে।
গঙ্গোত্রীঃ
রামকৃষ্ণকে অনেকেই পছন্দ করে না যে কথাটার জন্য, “কামিনী নরকস্য দ্বারম”, ‘কামিনী’টাকে একদম জেনারেলি সবাই নারী বলে ধরে নেয়। কামিনী, মাতৃ, রমণী, প্রত্যেকটা যে আলাদা আলাদা মানে, যেমন রমণী মানে যে খেলে, মাতৃ মানে শক্তির উৎস, নারী শক্তি, আর কামিনী তো অবশ্যই খারাপ, যাকে অনুভব করে আমার কামনা তৈরী হয়ে দরকারী কাজগুলো ভণ্ডুল হয়ে যাবে। তাহলে কামিনী তো নরকের দ্বারের মতই দাঁড়াচ্ছে। এটা আমি অনেককেই বোঝাতে পারিনি।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
এই ধর, একই লোকের তো অনেক পরিচয় থাকে, ঘর(গৃহ) সামলাচ্ছে সেই হিসেবে ঘরণী বা গৃহিণী, আমার অর্দ্ধেক (better half) সেই হিসেবে সে অর্দ্ধাঙ্গিনী, সে জনন করছে বলে সন্তানের জননী আর আমার জায়া, এইভাবে তার তো অনেকগুলো দিক রয়েছে, যে দিক দিয়ে বিচার করবো, সেই হিসেবে তাকে উল্লেখ এবং সম্বোধন করবো।
পর্ব্বঃ ৮
গঙ্গোত্রীঃ
একেকটি ভাষার অবলুপ্তি মানুষের সাংস্কৃতিক বিবর্ত্তনে কী রকম কতটা প্রভাব ফেলে?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
যতটা অবলুপ্তি হয়েছে, তাতে তো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন যখন আমাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে গেছে, তখন আমাদের আর উচিত না এটা হতে দেওয়া। আর এখন কম্পিউটার হওয়ার ফলে এতো ক্ষমতা আমাদের এসেছে, মানে, এতো জ্ঞানভাণ্ডারকে ধরে রাখার ক্ষমতা আমাদের হয়েছে।] সুতরাং আমাদের পক্ষে তো এটা সম্ভব।
গঙ্গোত্রীঃ
মানে, আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে কিছুতেই হারাতে দেওয়া যাবেনা।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
এগুলো যে কীভাবে হারিয়ে যায়, তার একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ইংরেজ নাবিক, খুব সম্ভবত টমাস কুক, তিনি অষ্ট্রেলিয়ায় ঘুরেছিলেন। তিনি অষ্ট্রেলিয়া নিউজিল্যাণ্ড অঞ্চলের আদিবাসী পেয়েছিলেন, যারা সমুদ্রের মাঝখানে ঢেউ দেখে বলতে পারতো কতদূরে ডাঙ্গা। মানুষের এরকম ক্ষমতা থাকে।
গঙ্গোত্রীঃ
হ্যাঁ, তারা তো প্রকৃতির কোলে ওখানেই বড় হয়েছে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
আমাদের বিধান রায় যে প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, বিধান রায় রোগীর গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারতেন তার কি রোগ। যেমন তোমার গলার স্বরে বোঝা যায় সর্দ্দি হয়েছে কিনা।
গঙ্গোত্রীঃ
আমার নাক বন্ধ, তাই আমার কথায় অনুনাসিক টান রয়েছে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। তারপর, চোখ দেখে বোঝা যায় সর্দ্দি হয়েছে কিনা। সর্দ্দির চোখ আলাদা।
গঙ্গোত্রীঃ
হ্যাঁ, একটু লাল লাল, একটু ফোলা ফোলা।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
এরকম সবকিছুর মধ্যেই আমরা ধরা পড়ে যাই, লুকোনোর রাস্তা নেই।
গঙ্গোত্রীঃ
বহুদিন ধরে কাউকে দেখতে দেখতে দেখছি, এর পরেই এই প্রতিক্রিয়া, এর পরেই এই করছে, এভাবে কন্সিকয়েন্সে বোঝা যায় অনেককেই।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
তবে ভাষা সম্বন্ধে ভলতেয়ারের ভাবশিষ্য, রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিক চার্লস মরিস দ্য ট্যালির্যাণ্ড-এর একটা বিখ্যাত উক্তি আছে, ফরাসীতে ঠিক বাক্যটা আমি বলতে পারবো না, ‘Speech was given to man to conceal his thoughts’, অর্থাৎ, মুখে আমি বলব, তোমার ভাল করছি, আসলে আমি তোমার পকেট কাটতে যাচ্ছি, ভাষাই এই শক্তি দেয়। মুখের ভাষা না থাকলে যদি শুধু চোখের ভাষাতে হত, তবে মানুষ মানুষকে ঠকাতে পারতো না। কুকুর যেমন চোখ দেখে বোঝে, কুকুরকে তুমি ঠকাতে পারবেনা, তুমি যদি শত্রু হও, কুকুর বুঝে ফেলবে।
পর্ব্বঃ ৯
গঙ্গোত্রীঃ
আজকালকার দিনে ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষায় বিষয় চয়ন যেহেতু অনেকটাই উপার্জ্জনের লক্ষ্যে, ভাষার দিকে অনেকেই যায় না। মানে, জানার ইচ্ছের থেকেও এদের টাকাপয়সা কামানোর ইচ্ছে বেশী। আর, আমরা যেমন পুরাণের গল্প শুনেই বড় হয়েছি, ছবিতে রামায়ণ ছবিতে মহাভারত, এসব বইটই পড়ে, এখনকার প্রজন্ম তো সেসব থেকে বহুদুরে। তারা হাতে মোবাইল নিয়ে বড় হচ্ছে। এই অবস্থায় ভাষাচর্চ্চার ভবিষ্যৎ রক্ষায় আধুনিক প্রজন্মকে কীভাবে উৎসাহিত করা যায়? মানে, তাকে কীভাবে উৎসাহিত করলে সে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ‘ভাষা’ বিষয় চয়ন করবে?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
যদি ধরো তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যায় শব্দগুলোর তাৎপর্য্য – যেমন ধরো, ‘অত্যাচার’; অত্যাচার মানে, আচারকে অতিক্রম করা।
গঙ্গোত্রীঃ
মানে, কোনো কিছুই যেহেতু বেশী হলে ভাল না, সেই অতি আচারটাই অত্যাচার।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
রাত দুটোয় যদি কেউ গান গাওয়া শুরু করে, তাহলে সেটা অত্যাচার হবে। অত্যাচার মানে শুধু মারধোর নয়। প্রত্যেকটা শব্দেরই ভেতরে গেলে পর যদি ক্রিয়াটা দেখতে পাওয়া যায়, দেখতে পাওয়া গেলে তাতে অনেক ভাল করে বুঝতে পারব।
গঙ্গোত্রীঃ
মানে ওদেরকে ভাষার মজাটা ধরিয়ে দিতে হবে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ, ভাষার মজাটা। একদম লোগোসেণ্ট্রিক ভাষা হতে পারেনা। সেটা হয় অঙ্কে। কিন্তু যেই তুমি একটা দলকে বলবে টিচার, টিচারকে তো সুইমার বলবে না। সঙ্গে সঙ্গেই তো ক্রিয়াভিত্তিক হয়ে গেল। যে সুইম করছে তাকেই সুইমার বলবে । কাজে কাজেই বড় শব্দের ক্ষেত্রে ক্রিয়াভিত্তিকতাটা আমরা দেখতে পাই ; কিন্তু যেগুলো মূল শব্দ, air, water, এগুলোও ক্রিয়া ধরেই তৈরী হয়েছিলো, কিন্তু সেটা আমরা ভুলে গেছি।
গঙ্গোত্রীঃ
অসুখ মানে যেমন সুখ নেই, মানে, disease, যখন আমি easy feel করছিনা, সেটাই dis-ease।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। ভাষার মজাটা বোঝানোর জন্য সাধারণ শব্দগুলো আগে দেখাতে হবে। যেমন ধরো পটল তোলা – পট যেখানে লালিত হয় সেটা পটল। তোমার যে অস্তিত্ব সেটাই তো একধরনের পট। তাহলে, পটল তোলা মানে, তোমার অস্তিত্বটাকেই উপড়ে ফেললে। আর ধরো, আমার স্মার্টফোনে আমি গুগল প্লে-ষ্টোর থেকে আমি কিছু ইনষ্টল করেছি, আবার আমি আন-ইনষ্টলও করে দিই। এই আন-ইনষ্টলের বাংলা যদি আমি করি, উপড়ে ফেলা, আর, ইনষ্টলের বাংলা তাহলে রুইয়ে দেওয়া বা রোপণ করা।
গঙ্গোত্রীঃ
ইনষ্টলটা আমি অন্যভাবে দেখেছি, সেটা হচ্ছে, একটা হস্তশিল্পের মেলায় একজন একটা স্কাল্পচার নিয়ে এসেছে, মেলা গোছানোর আগে ওটা এমনি রাখা ছিল, তখন বোঝা যাচ্ছিলো না ওটা কি। তখন একজন বলল, এটা ইনষ্টল, মানে, ওই পার্টগুলো অ্যাটাচ করে একটা স্কাল্পচার তৈরী হবে, কিন্তু ওটা এখানে করে লাভ নেই, ওটা একবারে মেলার ষ্টলে (in stall) অ্যাটাচ হবে। এবার তাহলে ‘stall’টার মূল খুঁজতে হবে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
stall মানে স্থল। স্থান, যাতে স্থিত (stayed) হওয়া যায়, জলের তুলনায় স্থলে বেশী স্থিত হওয়া যায়। আমাদের দুটো কনসেপ্ট একদম একসাথে রয়েছে। একটা হল, সবসময় একটা ধারার কনসেপ্ট, সেই ধারাতে প্রবাহিত হয়ে ভেসে যাওয়া নয়, ধারা থেকে তীরে উঠতে হবে। আরেকটা হচ্ছে, বর্ত্তন, মানে, সবকিছুই আবর্ত্তিত ও চলমান। বর্ত্তনটা কিন্তু আমাদের বিশ্বসংসারেও, ইউনিভার্সেও সবই চলছে।
গঙ্গোত্রীঃ
আবর্ত্তন, পরিবর্ত্তন।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
একটা বিন্দু থেকে বর্ত্তন হতে হতেই বেড়ে যাচ্ছে।
গঙ্গোত্রীঃ
সৃষ্টি স্থিতি লয়, এই সাইক্লটা চলছেই। ইকো-সিষ্টেম। আমাদের ভর-শক্তির যে নিত্যতা সূত্র, কোয়াণ্টিটি তো একই, মোট পরিমাণ তো কম-বেশী হবেনা, শুধু পরিবর্ত্তন, আবর্ত্তন, সেই বর্ত্তনই চলছে। মানে, আগামী প্রজন্মকে এরকম কিছু উদাহরণ দিয়ে ভাষার মজাটা ধরিয়ে দিতে হবে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
দেখিয়ে দিতে হবে, এইটা করলে পর,—— এটা কিন্তু ক্রিয়াভিত্তিক বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব ছাড়া হবেনা, —– তুমি ইংরেজীও ভাল করে পারবে আর বাংলাও ভাল করে পারবে, তোমার কাছে সব ভাষা খেলার মত জিনিস হবে।
গঙ্গোত্রীঃ
একেকটা টপিক ধরে রিসার্চ করে করে ইন্টারেষ্টিং গল্প লেখার উদ্যোগ নিতে হবে, এভাবে ওদেরকে বোঝানোর জন্য।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
এই যেমন দেখো, আমরা যেটাকে বলি ‘ঘট’ ইংরেজীতে সেটাকেই বলে পট। আর, ঘটের সাথে যে পটের সম্পর্ক রয়েছে, সেটা আমাদের চলতি কথাতেই বোঝা যায় “আমার বাপু অত ঘটাপটা নেই”। যখন তুমি বল, ‘অঘটন ঘটন পটীয়সী’, তখন তুমি পট ব্যাবহার করছ।
গঙ্গোত্রীঃ
বাংলার যে পটচিত্র, সরার ওপর আঁকা হয়, ওই সরাটাকেও তো তাহলে বাংলায় পটই বলা হচ্ছে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ হ্যাঁ।
পর্ব্বঃ ১০
গঙ্গোত্রীঃ
বাংলা ভাষার বিবর্ত্তন যে প্রাকৃত ভাষা থেকে হয়েছিলো, কালের নিয়মে সে ভাষা এখন লুপ্তপ্রায় বা লুপ্ত হয়ে গেছে বলা যায়। কালের নিয়মে মানুষের সভ্যতা চলমান বলেই হাজার হাজার বছর আগের ভাষা এখন আর প্রচলিত নেই, সেই ভাষা লুপ্ত হয়ে গেছে বা অন্য ভাষায় বিবর্ত্তন হয়ে গেছে। যেকোনো পুরনো সংস্কৃতির অবলুপ্তির সাক্ষী আছে ইতিহাস, কালের নিয়মে বিভিন্ন সভ্যতার অবলুপ্তি খুবই স্বাভাবিক। কথা বলতে বলতে যে আমরা মাঝে মাঝে বা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ইংরেজী বা হিন্দী বলে ফেলি, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও কালের এই প্রবহমানতা মেনে নিয়ে বাস্তবকে গ্রহণ করা, আর বাংলা ভাষা তথা সংস্কৃতিকে বাঁচানোর চেষ্টা করা, এই দুইয়ের মধ্যে কোনটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
এখানে একটা জিনিস বলি। এমন তো কোনো সময় ছিল না, যে সময় কথা বন্ধ হয়ে গেল। সবসময়ই তো সবাই কথা বলেছে, একটা ধারার মত। আচ্ছা, তুমি এই ‘গঙ্গা’টা কেই ধর? ভাগ ভাগ করে তো ধরতে পারনা, গঙ্গা তো একই চলেছে। আমরা ওই যে বলি, এই সময় ছিল প্রাকৃত, ওই সময়ে ছিল ওই, এটা নেহাত আলোচনার সুবিধার জন্য।
গঙ্গোত্রীঃ
আচ্ছা মানে অনেক দিন পর পর ভাষার পার্থক্য বোঝা যায়, কিন্তু মাঝে ব্লেণ্ডিং- এর মত ট্রানজিশন থাকে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ, অনবরতই একটু একটু করে পাল্টাচ্ছে। অনেকদিন পর খুব বেশী পাল্টে গেলে তখন আমরা আলোচনার সুবিধার জন্য বলি, এবার থেকে একে এই বলব।
গঙ্গোত্রীঃ
আচ্ছা, ওই বিবর্ত্তন তত্ত্বে প্রজাতিগুলোর মত, জিন পাল্টাতে পাল্টাতে অনেকদিন পর নতুন প্রজাতি তৈরী হয়। আলোর স্কেলের মত, সবুজের পর সি-গ্রিন হয়ে আকাশী হয়।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। তাহলে ওই যেটা বলছিলে, আমাদের এই এখনকার যে প্রযুক্তি, এই যজ্ঞই ভুবনের নাভি। এই প্রযুক্তিই আবার আমাদের রাস্তা দিয়ে দিচ্ছে, সমস্ত ভাষা আর সব সংস্কৃতিকে ধরে রাখা, এবং আমাদের উদ্দেশ্য হবে, একটা পরমাভাষা তৈরী করা, যে ভাষা সমস্ত মনুষ্য জাতির।
গঙ্গোত্রীঃ
মানে গ্লোবালি মানুষের একটাই ভাষা।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
তখন ইংরেজীর আধিপত্য, চীনা ভাষার আধিপত্য এ সব ভাবনা আর থাকবে না…। আপাতত যারা করে খাওয়ার রাজনীতি করে তারা ভাবে, আমাদের ইংরেজীটাই থাকুক, বাকী সব লুপ্ত হোক। সে তারা ভাবতে পারে ; কিন্তু যদি সমগ্র মানবজাতির দৃষ্টি থেকে দেখো, সেদিক থেকে উদ্দেশ্য হবে, একটা পরমাভাষা তৈরী করা।
গঙ্গোত্রীঃ
যেটা আর কি বাংলার ক্ষেত্রে প্রমিত ভাষাটা যতটা এগিয়েছে, একটা জেনারেল হিসেবে, সেরকম সারা বিশ্বে একটাই জেনারেল ভাষা তৈরী করা উচিত, প্রবহমানতা মেনে নিয়ে।
স্যারঃ
হ্যাঁ, বর্ণের যথার্থ মর্য্যাদা দিয়ে করা উচিত। এখানে আবার নিঃস্বার্থ ব্রাহ্মণ বুদ্ধি ছাড়া কাজ হবে না, বেণিয়া বুদ্ধিতে হবে না।
গঙ্গোত্রীঃ
হ্যাঁ, তাহলে তো যেই কাজ করবে, সেই নিজের ভাষাটাকে প্রায়োরিটি দেওয়ার চেষ্টা করবে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
আমার একটা আলোচনায় কলিমের সম্বন্ধে আমি বলেছিলাম…
গঙ্গোত্রীঃ
ওই, আপনি কাগজ হাতে নিজের লেখা পড়ছিলেন, ভিডিও করা হয়েছিলো, ওটা?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ । তোমার ইমেল অ্যাড্রেস দিও, আমি তোমাকে পাঠিয়ে দেবো।
গঙ্গোত্রীঃ
তা হলে ,একটা পরম ভাষাও তৈরী করা উচিত, আর, ভাষার যে মূলটা, ক্রিয়াভিত্তিক বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব, সেটাও সংরক্ষণ করা উচিত। অর্থাৎ দুটোই পাশাপাশি সবার জানা উচিত। যোগাযোগের সুবিধায় একটা পরম ভাষা থাকলে ইণ্টারপ্রেটারের দরকার হবেনা, আমার যেমন ইংরেজীতে অসুবিধা আছে, ইংরেজীতে আমি সড়গড় নই, কোনো কিছু পড়তে চাইলে আমি বাংলায় আগে খুঁজি। তো, একটা পরমভাষা হলে সবদিকে যোগাযোগের সুবিধা, আর, ভাষার মূলটাও জানা থাকলে ক্রিয়াভিত্তিক বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বে কোন কথার মানে কি, সেই বিভ্রান্তিও কমবে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
যাতে করে অতীতকেও পাওয়া যায়, আর ভবিষ্যতেও যাওয়া যায়। আমাদের অতীতও চাই, আর ভবিষ্যৎও চাই। যাতে ভবিষ্যৎটাও বন্ধ করে না, আবার, অতীতটাও বন্ধ করে না।
গঙ্গোত্রীঃ
এদিকেও উন্নতি চাই, আর ওদিকেও সংরক্ষণ চাই।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
পর্ব্বঃ ১১
গঙ্গোত্রীঃ
শব্দার্থকোষের যতটা কাজ বাকি এখনও, যারা এই কাজে এগিয়ে আসতে চায়, তাদের সংস্কৃত ভাষাচর্চ্চা একেবারেই কম থাকলে, তাদের কি অসুবিধা হবে?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
সংস্কৃত ভাষাচর্চ্চা একেবারেই কম থাকলে অবশ্য অসুবিধা হবে।
গঙ্গোত্রীঃ
তাদেরকে কীভাবে গাইড করবেন?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
সংস্কৃত শিখবে অনবরত ক্রিয়াভিত্তিকতার নিয়মগুলো জেনে। অর্থাৎ, বহু জিনিস আছে, সংস্কৃত ব্যাকরণে যেভাবে দেওয়া আছে, যেমন ‘এটা করতে হয়’ কিন্তু কেন করতে হয়, সেটা বলছেনা। যেমন ধর, বলা আছে, ণিজন্ত হ’লে পর ধাতুর শেষে ‘প’ আদেশ হয়। কীরকম – ‘স্থা’ মানে থাকা, সেটা যাতে থাকে, ‘প’ আদেশ হয়ে স্থাপ হল, তারপর স্থাপন হল। যাতে জানতে পারে, জ্ঞাপন হল। স্থাপন, জ্ঞাপন, যাপন, ওইটা ওখানে আদেশ হয় বলে দিচ্ছে। কিন্তু আদেশটা হচ্ছে কেন? এই এই কারণে। সংস্কৃত ব্যাকরণেরও প্রতিটি শব্দকে পদকে তুমি এই আলোতে ফেলো, দেখবে সব জ্যান্ত হয়ে উঠছে। যেমন ধরো, শব্দের ধাতুর পরে অনট প্রত্যয় হয়।
গঙ্গোত্রীঃ
তাই অন (অনট) যোগে চলন গমন বলন কথন খাওন এগুলো।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। ‘অনট’ বললে ধাতুর চরিত্রটা বোঝাচ্ছে। অর্থাৎ ‘অন’টা টঙ্কারিত হচ্ছে, সেই হিসেবে ওটা ‘অনট’ কিন্তু আসলে ওটা ‘অন’। ওটার চরিত্র বোঝানোর জন্য অনট বলা হচ্ছে। যেমন ধরো সমাস (সম+অস) মানে, ‘সম’ মানে একত্রে, ‘অস’ মানে থাকা। সংস্কৃত ব্যাকরণেও সংস্কৃত ভাষার যে দৃষ্টিভঙ্গী তার সব ধরে ফেলতে পারেনি, সেটা এখন আমরা ধরতে পারছি, কাজ এগিয়ে যাবে। কে কে কতটা পারবে এখনই জানিনা, আগুন তো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গঙ্গোত্রীঃ
আচ্ছা – মানে, শব্দার্থকোষের কাজ করার সাথে সাথে সংস্কৃত চর্চ্চাটাও ভাল করে করতে হবে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
আর সংস্কৃতর ওপরে লেখা ইংরেজীর একটা গ্রামার বই, সেটা হলে খুব ভাল হয়, Sanskrit Grammar by Whitney। কারণ, আমাদের যে ব্যাকরণ, তাতে আগেই লোককে ঘাবড়ে দেওয়া হয়, মানে, ব্যতিক্রমটা আগেই ব’লে দেওয়া হয়য়। শতকরা পঁচানব্বই ভাগ যে নিয়মে সেটাকে আগে রপ্ত হতে দাও। তা না, যে বাকী পাঁচটার ক্ষেত্রে হবেনা, সেটাই আগে ব’লে দেওয়া। মূলত আমাদের দেশের সংস্কৃতিটা তাদের হাতে চলে গেছিল যারা চাইত না যে, খেটে খাওয়া মানুষরা জ্ঞান পাক।
গঙ্গোত্রীঃ
হীরক রাজার যে উক্তিটা “এরা যত পড়ে, তত বেশী জানে আর তত কম মানে”।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। আর ওই যে, শূদ্রের বেদে অধিকার নেই। সেই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই এই ব্যাকরণটা তৈরী। কিন্তু ওই ইংরেজী বইটা পড়লে বুঝতে খুব সুবিধে হবে।
গঙ্গোত্রীঃ
আচ্ছা, ‘জন’ মানে তো একেকটা ‘সত্তা’? একজন কি দুজন, আবার, ভাল লোক খারাপ লোক, সুজন দুর্জন।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
তারা জনন করতে পারে বলে তারা জন, কোনো জড় সত্তাকে জন বলা হয়না। যে জন্য লোক খাটানোকে বলে ‘জন’ খাটানো, কারণ তারা সম্পদ জনন করছে।
গঙ্গোত্রীঃ
সেই সুত্রে, কোনো তথ্য যখন আমাদের মগজে আসছে, আমাদের ধারণা জনন হচ্ছে (বৃদ্ধি পাচ্ছে), তাই একে ‘জানা’ বলা হয়?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ।
গঙ্গোত্রীঃ
জনক রাজার অধীনে যে কর্ম্মচারীরা ছিল, শব্দার্থতত্ত্ব অনুযায়ী তারা জনকের স্ত্রী। রামায়ণে পড়েছিলাম, জনক লাঙ্গলের ফলায় সীতাকে পেয়েছিলেন , অর্থাৎ উৎপন্ন দ্রব্য বা সম্পদ সীতা। সেই উৎপাদন পণ্য করা হল বলে সীতা জনকের কন্যা? অর্থাৎ রামকে দিয়ে চুক্তি করানো হল?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। চুক্তি করে যাকে বরণ করা হয়, তাকে বর বলে। আর কন্যা থেকে কনে। তাই বলে বিয়ের বর-কনে।
গঙ্গোত্রীঃ
সেই সুত্রে, আশীর্ব্বাদ বরণ করে নিয়েই গুপী-বাঘা ভুতের রাজার থেকে বর পেয়েছিলো?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। একই ভাবে, কেউ তোমাকে আশীর্ব্বাদ করল মানে, সেই আশা বা সম্ভাবনার ক্ষেত্রে সে তোমাকে বরণ করল, অর্থাৎ তোমাকে বর দিল।
গঙ্গোত্রীঃ
আচ্ছা, পালন(প) আর তারণ(ত)-এর সুত্রেই তো পিতা আর পতি। এবার, উৎপাদিত সম্পদ যখন চুক্তিবদ্ধ হল, সেটা কন্যা। তো, চুক্তির আগে কন্যা পিতার কাছে থাকে আর চুক্তির পর কন্যা পতির কাছে যায়। আবার, অনেক ক্ষেত্রে দেখি, সাধু যারা, তাদের অনুগামীরা তাদেরকে স্বামীও বলে, আবার বাবাও বলে। এই বাবা আর স্বামীর ধারনাটা পিতা-পতির সুত্রে যদি একটু বুঝিয়ে দেন…
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
স্বামী মানে তো প্রভু, তাই তাকে বাবাও বলছে আবার স্বামীও বলছে।
গঙ্গোত্রীঃ তাহলে বাবাও কি প্রভু?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। আবার, উল্টোদিক থেকে স্নেহেও বাবা বলে, যেমন আমি আমার কন্যা-স্থানীয়দেরকে ‘মা’ বলি।
গঙ্গোত্রীঃ
হ্যাঁ, মানে, বাবা-বাছা করে সম্বোধন। তাহলে পতি-পিতার মধ্যে, ‘পিতা’তে, পালক(প)-এর সক্রিয়তা(ই) যখন সাপোর্ট (তারণ=ত) পায়, সেই সাপোর্টের আধার(আ) পিতা। অর্থাৎ, পালকের সক্রিয়তা যখন বজায় থাকে (সাপোর্ট পায়) কোনো সম্পদের ওপর, সেই সম্পদের আধার (উক্ত পালক) তার পিতা। আর, পালক(প) যখন সাপোর্ট (তারণ, ত) পায়, সেই সাপোর্টের সক্রিয়তা(ই) পতি। অর্থাৎ, প্রকৃতি না থাকলে পুরুষ যেমন খোঁড়া, তেমন পালক যখন কোনো সম্পদের সাপোর্ট পায় সেই সক্রিয়তা (উক্ত পালক) ওই সম্পদের পতি।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। তুমি তো অনেক কাজ করতে পারো।
গঙ্গোত্রীঃ
মানে?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
শব্দার্থের বিশ্লেষণ তুমি তো বেশ ভালই কর।
গঙ্গোত্রীঃ
ওই একটু একটু পড়াশোনা করি। আমি নিজের মতো একটা ছক বানিয়ে নিয়েছি, যেমন ‘ক’এর স্থিতি ‘খ’ (করে খাই), ‘গ’-এর স্থিতি ‘ঘ’ [ঘরে এলে তো গমন থিতু (স্থিতি) হয়ে যায়, এখানে মানসগমন অপ্রাসঙ্গিক), ‘চ’এর স্থিতি ‘ছ’ (চয়ন করে বাকীগুলো থেকে ছাঁকলাম)…]
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
আর সংস্কৃত ব্যাকরণে যেটা পুরো ধরতে পারেনি, প্রতিটি বর্ণই একেকটা ক্রিয়া বোঝায়, প্রতিটি স্বরবর্ণ, প্রতিটি ব্যঞ্জনবর্ণ। আমরা বলি, ‘আ-কার’, ‘ই-কার’, ‘এ-কার’, ‘ও-কার’, কোনো ক্রিয়া না থাকলে ‘কার’ বলা হবে কেন, যেমন চীৎকার, কর্ম্মকার, প্রতিকার। চীনারা আবার একেকটা ভাব প্রকাশ করে একেকটা প্রতীকী নকশা দিয়ে।
পর্ব্বঃ ১২
গঙ্গোত্রীঃ
যত জায়গায় এই গবেষণা পাঠানো হয়েছে, সেরকম কোনো ইতিবাচক সাড়া আসেনি, এগুলো অ্যাকাডেমিকে আনার জন্য। প্রতিটা বাচ্চার ভাষা শেখার শুরু থেকে যে শব্দমূলের নিয়মগুলো জানা দরকার, তার জন্য তো এই পড়াশোনা অ্যাকাডেমিতে আনা প্রয়োজন। এসব তত্ত্ব অ্যাকাডেমিকে আসতে না দেওয়ার পেছনে কি কোনো অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কারণ আছে? এরা যেভাবে শ্লোকের বিকৃত ব্যাখ্যা প্রচার করে, সেই স্বার্থে ব্যাঘাত হবে? এরকম কোনো স্বার্থ কি কাজ করছে এসব তত্ত্ব অ্যাকাডেমীতে আসতে না দেওয়ার পেছনে?
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
অবশ্যই। বরিষণ রায়ের সাক্ষাৎকারের মধ্যে আমি এর উত্তর দিয়েছি। সমাজে যারা ক্ষমতায় আছে, তাদের কাজে লাগবে যে তত্ত্বটা, বা কাজে লাগানো যাবে, সেই তত্ত্বটাকে তারা সুযোগ দেবে। ডারউইনের তত্ত্বকে সুযোগ দিল ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের পরের যে ইণ্ডাষ্ট্রিয়াল ক্যাপিটালিষ্টরা, কেন দিল? কারণ, একটুখানি পরিবর্ত্তন করে প্রাকৃতিক নির্ব্বাচনের জায়গায় ‘সারভাইভাল অব দি ফিটেষ্ট’ই বিবর্ত্তনের গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলা হল। সুতরাং, আমি এমন দামে কাঁচামাল কিনবো আর তৈরী মাল এমন দামে দেবো, ফলে আমি ব্যাবসায় আরেকজনকে হটিয়ে দেবো, ও যায় যাক, আমি টিকে থাকবো। আমাদের দেশেও এই ব্যাপার ঘটেছে। বুদ্ধদেবের যে তত্ত্ব আর গীতার যে কামনা বাসনা অতিক্রম করার তত্ত্ব, দুটোই কাজে লেগেছিল বলে প্রচার পেয়েছিল। অর্থাৎ, যে চাষবাস করছে তার যেন কামনা বাসনা না থাকে।
গঙ্গোত্রীঃ তাহলে তাকে কম দিয়ে উদ্বৃত্ত শোষণ করা যাবে।
রবি চক্রবর্ত্তীঃ
হ্যাঁ। তার ফসলটাকে কমের বিনিময়ে আমি নিয়ে যেতে পারবো। এসব হলে আর কি করা যায়, মানুষের অস্তিত্বটাই এই রকমের!