মাতালনগর
এ-নগর অদ্ভুত মনে হয়, বিস্রস্ত-এলোমেলো-বধির। দৃশ্যের পর দৃশ্য, দৃশ্যান্তর, সেলুলয়েড ফিতায় আটকে থাকা কুহকমায়া। ঊর্ধ্বমুখি মুণ্ডগুলো সব একের পর এক, কাটা পড়ছে। মুণ্ডহীন মানুষ হেঁটে বেড়াচ্ছে দৃপ্তপায়ে। পাল্টানো খোলসে লাল-নীল নীল-লাল। বহুরূপি মেতেছে আনন্দনৃত্যে। শবের মিছিল না-কি পরাজয়ের শকটবাহি সব প্রেত-আত্মা? কোলাহল কিসের এত, সভ্যতার উঞ্ছবৃত্তে নাগরিক আমরা? হারিয়ে যাওয়া লুটিয়ে পড়া মুখগুলো গতি পায় দ্রুত, স্থান বদল করে, আর টপটপ মিশে যায় এর মুণ্ড ওর ধড়ে।
সারারাত ধরে চলে মগজের কোষে নিঃশব্দ মডেলিং, পূর্বিতা ফিরে আসো। এখনো নিঃসীম অন্ধকারে ফেরি করে আলোকদ্যুতিরা-অপূর্ব কণ্ঠস্বর। এতটা ক্লান্তি, এতটা নিঃস্বতা অনুভব করিনি কখনো। আত্মদহন তৃপ্ত হলেই মানুষ স্বরূপে ফেরে?
২৫ জুলাই ২০০৯
পুতুলনাচের ইতিকথা
সময়ের চোখে কে যে নটরাজ তুমি আয়নায় দাঁড়াও একাকি। স্থবির, বধির-অন্ধ-স্থাণু হলেই সম্ভব কেবল হনন। নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে রক্তাক্ত ক্লান্ত করে ফেলা। গ্লোবালবিষের নেশায় প্রহর কাটে, কুচিকুচি ছড়িয়ে দেয়া নিজেকে সামষ্টিক থেকে ব্যক্তি এককে। বৃত্তের পিনবলগুলো লাফাতে লাফাতে সূচকের কাটা দেয় এগিয়ে। অন্তর্জাল আর আকাশ কে তুমি নিয়েছ দখলে মাধুরি, চারদিকে ভোগ আর ভোগ রঙিন বাতিঘর খুলে দিয়েছে সবকটি দেরাজ। রত্নভাণ্ডার উজাড় করে তুমিই কেবল হয়ে যাও নিঃস্ব প্রত্নযুগের একক অর্জুন। সেই কবে বলেছিলে না, তবু কেন বারবার একই বৃত্তে ঘুরপাক ঘুরপাক খেলা। অন্তঃসারশূন্য লুব্ধক এক পেঁচা চেতনায় কশাঘাত হানে। শরীর তবুতো কিছু পাওনা এখানেই, দ্বিধা এতেও, কাছে এসে ছুটে যায় কতগুলো পুতুল; অনিশ্চয়তা ঘোরে আমিও মাতাল, পুতুলনাচ নাচছি।
অশ্বখুঁড়ে বালি ওড়ে দূরে আকাশে।
১৪ আগস্ট ২০০৯
নীল-পেয়ালা
ঘুঙুর খসানোর পরই কেবল পৌঁছাই তোমার গৃহে; কিছুটা ক্লান্তি কিছুটা অবসন্ন এলিয়ে দাও শরীর শরাহত যেন, পানপাত্রও খালি, চারদিকে ইতস্তত ছড়ানো ছিটানো ধ্বংসাবশেষ, বিজেতা যেন নুয়ে পড়েছে ভাঙ্চুর ভাঙ্চুর খেলায়। কৈফিয়ত কোথায় বলো, তবু কোন রাগে মাতাল আসর ভাঙার পরই জমায়েত হই, মশগুল হই, দেখি সারাটা দেয়াল শবনৃত্যঝংকারে আচ্ছন্ন মগ্ন। ছুঁড়ে দিয়ে করুণা হাসি অভ্যাগত আমাকেই তুলে নাও বুকে, নগ্নতিল সৌন্দর্যে বিমোহিত ভুলে যাই কিছুক্ষণ আগেও তুমুল ঝড় উঠেছিল এখানে, নাটমঞ্চের বাইরেই ছিলাম আমি, কেন যে পিছিয়ে পড়ি বারবার… বারবার…
অদ্বিতীয়া পিয়ারি বাই আমার… বুকের মাঝে… ঘুঙুর এখনো বাজে… ঘুঙিয়ে ঘুঙিয়ে কাঁদে এখনো, তোমাতেই কেন যে আনন্দবিষাদ আর পরাজয় খেলা করে… পৌঁছাই কেবল ঘুঙুর খসানোর পরই…
১৩-০৯-২০০৮
জগতের আনন্দযজ্ঞে
বুঝেছি জগতে সকলেই কবি, কেউ কেউ নয়, ভাবুকতা করেছি আলিঙ্গন; দিনভর তাদেরই সুদিন, পাওনা আছে ঢের হৃদয়ে জমা, তাদের দুয়েকজন হানা দেয় নিঃশব্দ চলমানতায়। জমেছে কঠিনতা দূর থেকে, কাছে এলেই হয় কত সহজ মিটে যায় পাওনা জলের দরে। ভুলে থাকাটাই মেকি, না-কি ভুলে থাকতে হয় ইচ্ছে করেই। অভ্যাসে দায়ভার, পৃথিবীর যাত্রাপথে গন্তব্যটা জানে না অনেকেই। দেনা জমে, সঞ্চয় কিই-বা বল, তবু কখনো কখনো বাঁধা পড়ে যাই ভুল করে। লাভ-ক্ষতিই কি সব না আরো আছে কিছু-লাভ কাকে বলে অথবা ক্ষতিই হয় কিভাবে পরিমাপ? জানি না আমি। বৈষয়িক আছে যারা আপাতত তোলা থাক তাদের পেয়ালায়। কতিপয় দ্বিপদ চিনি যাদের লাভের অংকে জমেছে শ্যাওলা, অথবা নিজেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সঙ সাজা নিজেরই কাছে। সেইসব সঙ্দের কবিই মনে হয়, যারা লিখবে না কখনো কবিতা কাগজে কলমে, তাদের কবিতা অহরহ জমা হয় মগজের ভাঁড়ারে, গোপন মণিকোঠায়। ভুলে থাকাতেই আনন্দ, অথবা কখনো কখনো নিজের জগতে নিজেরাই সাজে রাজা-মহারাজা, অভিনয়-নিপুণতায় পারঙ্গম ইহারা সাতিশয়, পেয়েছি তাদের হৃদয়ের খানিকটা হদিস, অথবা দুঃখ ঝরাপাতা। প্রাত্যহিকতায় ছেলে-মেয়ে বউ কি আনন্দযজ্ঞ! কেউ কেউ কাছে আসে অজান্তেই, আবার কেউ কেউ দূরে সরে যায়।
জলের মতো দুরন্ত গতিবেগ, বাধ না মানা, সকলেই কবি, কেউ কেউ নয়।
০৭ এপ্রিল ২০০৭
কান্নাঘর
গতির প্রতিরোধ জাগে হৃদয়ে, কমরেড কতদূর যাবে তুমি, তোমার স্বপ্নগুলোও ততদূরই যাবে। টুকরো হাসি, কান্না, বিষাদ, স্মৃতির অবশেষ মাড়াতে মাড়াতে পৌঁছে যাওয়া কোথাও। আমরা কি আদৌ পৌঁছাই? বললে, বয়সিস্বপ্ন মানুষেরই সমান। মানুষ কি জানে পথের শেষপ্রান্ত, নাকি হোঁচট খেতে খেতে খাবি খায় বৃথাই, চৈতন্যে মগ্নতা গ্রাস করে। বুদবুদ উঠে, আর ভাসে কান্নাঘর। শৈশবের ধ্যান আসে; শুধু ছড়িয়ে যাচ্ছি, ছিটিয়ে দিচ্ছি পথেপ্রান্তরে ধান। দাঁড়িয়েই থাকা, মানুষ কেন যে শুধু শুধু দৌড়ায়, ব্যবিলন থেকে আছড়ে পড়া শব্দ আহত করে। কান্নাঘর খুলে দিয়েছে সব দুয়ার, পৃথিবী এখন নিঃসঙ্গ আততায়ি।
ভেতরটা বরফ জমে যায়, জমে জমে স্তূপ, চ্যানেলে বিজ্ঞাপন ঢেউ যেন খড়কুটো ভেসে যাওয়া।
২০ জুন ২০০৭
বুধবার, মৌলভীবাজার
পুতুলগুলো নাচছে
কে যে নাচায় কাকে?
মুক্তক তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক ইঁদুর শেখায় পর্নোগ্রাফি।
লাল মানুষ, নীল মানুষ, হলুদ মানুষ অগণন মানুষের মিছিল
পুতুলগুলো নাচছে সব…
নাচনেওয়ালি নাচ দেখায়, আমরা নাচি পণ্যপুঁজি
উন্নতবিশ্ব, ধ্যান আসে পাখনায়
সাধুবাবা সাধুবাবা-হরিবোল বোল হরি…
চৈতন্যে বিষবাঁশি, মগজে আন্দোলন
শেখানো বুলি আওড়ায় তোতা
ভোক্তা মানেই জিগির… জোরসে
আমাদের হাইব্রিড ধান, হাইব্রিড স্বপ্ন
সবুজ রমণি উদোম হয়ে যায়
ঝুলে থাকা থোকা থোকা কৃষ্ণগহ্বর
আকাশে ভাসে, ছড়িয়ে দেয় শিশির
মুদ্রা ছিটিয়ে দেন ক্যানভাসে ঈশ্বর
রক্তবীজ পৃথিবী ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে অসুর…
২৮ জুন ২০০৭
নেশা
পল্টন মোড়ে নগ্ন বিলবোর্ডগুলো নাচতে নাচতে শূন্যতায় যখন উগরে দেয়
ষোড়শি লোপেজ
জ্যান্ত ভার্গার-ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে-তুমুল পদ্মা-মেঘনা
সেইসব নারীদের উষ্ণ করমর্দনে কঙ্কালসার স্বদেশ আমার
বিদ্রƒপ আর তেষ্টায় : প্রস্তুত হতে থাকে প্রতিদিনের প্রাতঃরাশ।
মরীচিকা
বিভ্রান্তি কমলো কই শুধু এবেলা ওবেলা ফেরি করে ফেরা
কিছুটা দাসত্ব কিছুটা মেকিত্ব আর কিছুটা কষ্ট মিলেমিশে একাকার
সব কি বলা যায়?-স্রোতে স্রোতে শেওলা বাড়ে
পড়ন্ত দিন থেকে টেনে আনা কিছু রমণিয়-সুর
স্মৃতি-ভাণ্ড পূর্ণ হয় ; হিসাব নিকাশ রাতভর
যোগ-বিয়োগ হপ্তা পার ফুরায় না দৈর্ঘ্য
তবু কোন বাঁশি তাহার কণ্ঠে অকৃপণ
মলয়-রাগে…
তাহাদের দলে নই কখনো, ছিলাম না
ফিরে যাও কিংবা ফিরাও কিচ্ছু যায় আসে না
ভাগ্যবিড়ম্বিতদের কথা কে কবে শুনেছ বল!
সন্ধ্যারাগে কোন এক নর্তকি নাচে, তন্ময় সেই নাচ মগ্ন হয়ে দেখি।
১৯-০৫-২০০৩
রঙ ও তুলি
ক্যানভাস ছেড়ে উঠে আসে সোনালি কবুতর-উড়ে যায়, খেলা করে।
বিমুগ্ধ তুলি উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম।
একজন কামার ষোড়শি বধূর নরম উষ্ণতায় তাবৎ পৃথিবী কোলে তুলে নেয়।
শিল্পিত ধূসর চোখ অবাক বিস্ময়ে দেখে যায় তুলির সেই অপূর্ব রক্তপাত…
২২ এপ্রিল ২০০৩
দরোজার ওপারে স্বপ্ন
আগল খুলে দাও-চল্লিশোর্ধ্ব সময় খুব বেশি সুখের নয়।
দরোজার ওপাশে যদি থাকে নিঃসঙ্গতার বুনট হাওয়া
কাঁচা-পেয়ারা ষোড়শি-স্তন রাত্রির ঘুম কেড়ে নিল-
কি এমন ক্ষতি?
টেনিস গ্রাউন্ডে মনিকা সেলেস জিতে নেয় এক একটি সিরিজ
চোখে তোমার কারুণ্যের শীতল হাওয়া
গায়ে মেখে দিও অন্যের বাসনা।
চল্লিশোর্ধ্ব রাত্রি খুব বেশি কান্নার নয়
একটি পিঁপড়ে আড়মোড়া ভেঙে কষ্ট-জলে ম্লান
আয়ত-চোখে সেবাদাসি ভূ-চক্কর।
স্বপ্ন দীর্ঘ নয়, দরোজার ওপারে স্বপ্নই
সিংহির সেলুলয়েড চোখে
অবসন্ন বিকেল হরিৎ-পত্রে
মেলে ধরে প্রজাপতি ডানা।
চল্লিশ স্বপ্নও নয়, মৃত্যু নয়-কষ্ট চাবুকে রক্তাক্ত আখ্যান
একজন সঙ্গির মর্মান্তিক স্মৃতি-বেদনা
নিজেকে অন্যচোখে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
১৪ মার্চ ২০০৪
মনসান্টোপর্ব-২
মায়ের চোখ কৌটোর গুঁড়োদুধ
রিখটার স্কেলে অতর্কিত সীমান্ত-রেড-ফ্লাগ
দ্রুতগতি শেয়ার-সূচক অকস্মাৎ মাই হয়
শিশু-চোখে গ্যালন গ্যালন জলিয়-বাষ্প জমে-
আহ্! কতদিন তৃষ্ণা মেটেনি এমন,
(নিপল-ক্ষুধা বিশ্ব-সাম্রাজ্যে…)
শিশু-মমত্বে মাল্টি-কোম্পানি আঙিনা-আয়, আয়, আয়
দানো হয় ক্রমে; আর
দুধ-তেষ্টায় উজ্জীবিত হলে
টিভি-সিরিয়াল অষ্টাদশি ষোড়শি-স্তন
রাশি রাশি দুগ্ধ-ফেনা বমন করে অবিরাম…