ধানমন্ডি লেক
কে কারে বদলে দেয়?
যারে কোনদিন দেখা হয় নাই, যার সাথে-
ওঠা হয় নাই-বসা হয় নাই।
বসন্তের দ্বিতীয় মাসে যখন ধানমন্ডি লেকে
যুগলদের আনাগোনা বাড়ে। কারো হবে-
কারো হবে না। কারো বন্দুকের গুলিতে রঙিন বেলুনের নিশানা
ঠিক ভেদ হবে পার্কে। কেউ কাকচক্ষু জলে মনোরম
সেতুর পিলারের পাশে নিজের মুখ খুঁজে পাবে না কোথাও।
কোনোদিন অভিমানে চোখের জলে অযথাই ভেজাবে
বিদেশি ঘাস।
কেউ কেউ গন্তব্য জানে না। কেউ কেউ এটাও মানবে না যে,
সবারই গন্তব্য থাকে না। মধ্যাহ্নকালে যখন দীর্ঘ
বৃষ্টিবৃক্ষের ছায়া আরো দীর্ঘ হয়ে পুরো ধানমন্ডি
দখলে নেয়। তখন মাথার উপর সহস্রাব্দের পুরোনো সূর্য
আর সদ্যফোটা নয়নতারা একবার মরে যেতে চায় রোদে।
একবার ভিজে যেতে চায় ঘাসে।
ঋতুদের জ্ঞানগম্যি কম। মানুষের ভাষা ওরা কি বোঝে?
কারো চোখ দেখে ওরা কোনোদিন বোঝে না-কতটা বৃষ্টি হলে
মন পুড়বে তার। কতটা বসন্ত এলে মানুষের ছায়া-
তলিয়ে যায় জলে।
বাদামের খোসার ভেতর বসে বসে অনর্গল ভবিতব্য রচে।
তারপর ঠিক উঠে চলে যায়। ঠিকঠাক। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে
নেমে পড়ে কোথাও। বদলায় না। আবার এজন্য কেউ, অন্য-
সবাই ভুট্টা পোড়ানোর গনগনে অগ্নিতে হৃদয় সেঁকে। আবার
সে গন্ধেও বদলে যায় না কিছুই।
নিদ্রা
তবে ঘুমই ভাল…
অন্তত স্বপ্নের আশাবাদ জাগ্রত থাকে তাতে।
জাগরণের মিথষ্ক্রিয়ায় ক্রমশ এসে উপস্থিত হয় তন্দ্রা।
পরিপার্শ্ব আর কঠোর সূঁচের মতো বাস্তব, ঘাসের ডগায়-
শিশির বিন্দু যেন, দূর থেকে কবিরা যাকে মুক্তো বলে।
সেই সূচের অগ্রভাগে দোদুল্যমান জীবনের একটু নিচে
তন্দ্রার একদম শেষসীমায় পৌঁছে গেলে অবশেষে-
হাসি-কান্নার প্রভেদ লুপ্ত হয়।
সহস্র চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানি আর পাড়ার তান্ত্রিক,
ফকির-দরবেশ কত পথই-না বাতলে দিলেন।
জীবনের ষোলআনা চেটেপুটে খাওয়ার কত আশা ছিল!
হায়! অথচ মরীচিকার মতো চপলতায়
সে জীবনের বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরে যায় চেনা মৃত্তিকায়।
জীবনবৃক্ষের ডালে কোনোদিন পক্ষি বসে না। বসে অনটন।
লালসার বালাই এসে হরণ করে শাশ্বত সবুজ।
এখানে এসে জীবনকে গুডবাই দেই। বরং অগ্রসর হই
অসীম, অঢেল, অনন্ত ঘুমের দিকে।
কেননা ঘুমই ভাল।
অন্তত স্বপ্নের আশাবাদ জাগ্রত থাকে তাতে।
বোশেখ
শুষ্কপাতা যত, ছিন্ন ঘাস-গভীর রোদের সাথে,
যদি ঝড় আসে ঐ কালবোশেখি ঋতুর দীঘল চুলের সাথে
তাজা গন্ধরাজ, এক ঝাপটায় আকাশের যত নীল,
ঘোর কৃষ্ণবর্ণ অন্ধকার, দিগি¦দিক ছোটাছুটি করে
যখন ক্লান্তি হয়। মেঠো রাস্তা অনর্গল শিলাবৃষ্টির মধ্যে
সব পাওনা মিটিয়ে একটি বিকেল দাঁড়িয়ে থাকে। ঠায়।
বোশেখের ঝড়, বাতাস, ভেজা বৃষ্টি-এত প্রগলভ।
মাটির বিস্তর নিচে দেখা মিলে যায় দীঘল চুলের।
শীর্ণ ঠোঁটখানি একটু নড়লেই রাজ্যের যত কথা, যত বাচালতা
কথার বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় ঋতুর কৌমার্য। গাঢ়-
আলো কিংবা গাঢ় অন্ধকারের ভেতর দিয়ে মগজের ডানপাশে
সহসাই জন্ম নেয় দুঃসাহসের ভ্রƒণ।
তখন বোশেখ এসে খুন করে যায় দীর্ঘসময়।
পৃথিবীর ঘড়িরা অসময়ের হিসেব ভুলে যায় তারপর।
হরিদ্রাভ সন্ধ্যা
প্রতিনিয়ত এখানে সম্ভাবনার জন্ম হয়।
প্রতিনিয়ত এখানে সম্ভাবনার মৃত্যু হয়।
গর্ভসঞ্চারের এই নিরন্তর একঘেয়ে ক্লান্তিকর
বিশ্রামের পর নদীর চরের পাশে সোনালি রঙের ডাহুক,
কলমিলতার বিস্তৃত ফুলে বসে থাকে। এদিক-ওদিক।
ঘাসের মধু নিয়ে চৈত্রের অলস দুপুর নদীর জলে খুঁজে ফেরে
নৌকাডুবির স্মৃতি।
জলের গহিন অতল থেকে বর্ষা ডাকে। পাতালের খুব কাছে
ঈষৎ উঁকি দিলেই সেই রূপকথা। না-কি জলকথা।
জলজ স্মৃতিগুলো রঙবেরঙের ঘাসফড়িং হয়ে জলে বসে আছে।
চরে ধূ ধূ বালি। তরমুজ ক্ষেতে লতানো গাছগুলোর মাথায়
মস্ত-অসহ্য সবুজের ভেতর বাসা বেঁধে আছে তীব্র লাল।
অপার্থিব কামড় সহ্য করে।
এই দাবদাহ। রুক্ষ্ম মাটি। তেতে-ওঠা জল। তবু
সেই জল চোখের ভেতর দিয়ে বালুর ভেতর দিয়ে
স্মৃতির ভেতর দিয়ে মাছরাঙা পাখির কাছে
ঘাস হয়ে ঠিক পৌঁছে যায়। কলমিলতার ফুলে বেগুনি
সারস বসে। দুদণ্ড জুড়ায় শরীর। মা মনসা চুলের
ফিতার মতো নিজেকে খোঁপা করে। স্থলপদ্মের সব শোভা
শুষে নেয় জোছনার বিষ। হরিদ্রাভ শরীর নিয়ে
সন্ধ্যা নামে।
আগুনমুখা
অগ্নিযজ্ঞ কর। কপাল জুড়ে রক্তচন্দনের তিলক।
অব্যর্থ আগুনে নিক্ষেপ কর যত দ্বিধা, যত পিছুটান।
যজ্ঞের উৎসর্গনামায় উৎকীর্ণ কর যত সংশয়।
আগুন কত শীতল হতে পারে? শবদেহে স্পর্শ লাগলে
আগুন কি বরফের দেখা পায়? অগম শীতাংকের নিচে
জমে যেতে যেতে ত্বকের বিবর্ণ শাদা পর্দা জুড়ে ফুটে ওঠে
রঙবেরঙের ভাইরাস ফুল।
সংশয় বড় কঠিন জিনিস। চোখরে নীলপদ্ম করা!
বিভ্রান্তিরও তো মাত্রা থাকে। বিরহে বিভ্রান্তি বাড়ে।
আগুন জ্বলে। তারপর মেরুবরফের ভেতর মুখ ঘষে ঘষে
বরফে পরিণত হয়। একদিন গলে যায়।
তারপর পাথুরে পথের উপর দিয়ে এই পদ্মা, এই মেঘনা।
একদিন পদ্মায় আগুন লাগে। তীরগুলো তেতে ওঠে।
লাল আগুনে পদ্মা হয়ে ওঠে আগুনমুখা।