জিললুর রহমান’র কবিতা

0

সংসার সন্ন্যাস

কেবলি শিখেছি ধ্যান-প্রতিক্ষা-উপোস
শ্রমণের যৌবদিন একাহারে ফলাহারে
আজন্ম জ্ঞানের খোঁজে পৃথিবীর পাঠশালে নিত্য তীর্থ যাত্রা
সূর্যের উদয় লগ্নে প্রশ্নবিদ্ধ তাপদগ্ধ ভূমি ও ফসল
আশৈশব ঘোরাফেরা প্রতিপদে সুশান্ত আশ্রমে।
শ্রমণে সাধুর পাঠ— উপবাস— প্রতিক্ষিত জীবন যাপন
স্থানুর ধ্যানিক মূর্তি— মুক্তির সন্ধান নিরন্তর
জরাগ্রস্ত রোগাক্রান্ত মৃত্যুমুখি দুঃসহ জীবন
নির্বাণের স্পষ্ট পথ আজীবন তীব্র আরাধনা—
সন্ন্যাসে যে ক’টা দিন আচারে বিগত
নারীর কৌপিন বিঁধেনিতো দৃষ্টিসীমা জুড়ে
বোধি লাভে নির্বাণের দ্বারপ্রান্তে আজ এটা কেমন বিভ্রম।
গৌতমও টানে না মন সন্ন্যাস চমকে
তপস্যার ফাঁক গলে সুন্দরির টোল পড়া হাসি
মুহূর্তে ভাসিয়ে আজ আনন্দ সংবাদ বলে—‘ভালবাসি’ হেন-স্পর্ধা!
কালান্তিক ধ্যান আর উপবাস প্রতিক্ষার কাল
আমাকে টেনেছে শেষে পাতকি সংসারে…

পাথর প্রতিমা

দীর্ঘ বালিয়াড়ি খুঁড়ে স্বপ্নাদ্য নগর।
সর্পিনি ফোঁসেনি ফণা
ডাকিনি আঁচড় কোনো আঁকেনি তো গালে
বাতাসের শোঁ শোঁ— শীতার্ত সিম্ফনি
মর্ম ছেঁড়া দোতারা টঙ্কার…
রথাশ্ব ছোটায়ে নন্দ দুলাল কোনো আসেনি কটিবন্ধে তরোয়াল;
দ্বারির বাধায় দরোজাতে থামিনি একরত্তি।
অন্দরের আরাধনা যেমত করেছি বহুকাল
খুশবু বাগের নারী পাথর সরিয়ে আজ হাতছানি ডাকে
আমি অন্ধ হলে সে-ও চোখে দেখে না কখনো
দূর দেশ থেকে তারে এনেছি হৃদয়ে
গান্ধারির দেখা ম্লান ছোট্ট গৃহকোণে
চিন্তার অনলে রচে মহাকাব্য কণা;
প্রেয়সি আমার বুঝি এ যুগের হেলেন কেলার।
বালিয়াড়ি খুঁড়তে এসে খুঁড়েছি হৃদয় লাল—
গোলাপ দেশের ফুল, একতাল নিথর পাথর, নিতান্ত কার্পাস…

বিজু বন্দনা

মহুয়ার ঘ্রাণ— আহা পাহাড়ি মহুয়া—
হী-দল রাঙ্গামাইট্যা…
প্রাচিন বসত ভাসে লেক বুকে চন্দ্রিমা স্বাপ্নিক
বৃষ্টিহীন খাঁ খাঁ বিজু সাংগ্রাই জুড়ে।
মহুয়ার সোঁদা ঘ্রাণে হরিণিরা টানা চোখ মেলে
বুকের পাষাণ ভেঙে ঝরনা নামে ঠোঁটে—
হী-দল রাঙ্গামাইট্যা…
আশংকায় ঠোঁটের কাঁপুনি তবু স্বপ্নালু দু’চোখ
জুম চাষে নিবিষ্টতা হালখাতা রাজ দরবারে
ব্যঞ্জনের নানান ব্যঞ্জনা,
হৃদয়ে অনন্ত স্বাদ মহুয়ার
হী-দল রাঙ্গামাইট্যা—
আমি এই মাটির যুবক !

হৃদয় রাগিনি

যে হাতে বেজেছে বীণা তাকে কি-না আমিও চিনিনে
তুমি ঝাড়খণ্ড থেকে এসেছ কি অখণ্ড আত্মার বেশে
রিনিঝিনি বীণার টংকার—
তোমাকে হৃদয় পাশে আলগোছে এ সময় ভীষণ দরকার
অবলুপ্ত পথ হেঁটে পার হও মরীচিকা নদীটার জল
মেঘের গোপন রথে রঙধনুদের বারোয়ারি ছল যত;
হিজলের লতা তুমি— করলার চাঙ— বেতসের নরম শরীর তুমি
স্বপ্নালু চাঁদরাতে ঠাকুমা’র ঝুলি হাতে হাল ধর রাক্ষুসি তরীর।
শাঁখা কি পলার স্পর্শ হৃদয়ের সিঁদুরের প্রেমরাঙা লাল মেঘ দল
দুর্বাদের কি ছল করেছে আজ গভীর সবুজে বাজে বাউল লাঙ্গল হু হু—
রঙধনু পথে ফের রাখাল বালক ছুটে দুরন্ত বাছুর পিছু
সূর্য লজ্জানত, উৎকণ্ঠিত মেঘদল—
তরুণ প্রেমের রাগ বোঝে না রাগিনি আজ বাজবে ভোরে কি সাঁঝে
যে দিকে দু’চোখ ছুটে মন ছোটে সাথে সাথে—
অনন্ত রাগিনি লাজে হৃদয়ে টংকার তোলে।

অনুরাগ

কোথাও সন্ধ্যার কালে ধ্যানস্থ ইমন এক মনে
আরাধনা মৌনি ভেঙে জেগেছে যৌবন
কটাক্ষ ভ্রুকুটি তোলে শ্রমণের ভান্তেকুল
আমি একা ধ্যানভ্রষ্ট প্রেমের কাঙাল।
আকাশে মেঘমল্লার আর রামধনুকের খেলা
জলাশয় পদ্মপাতা বৃষ্টির সেতার সুর
কুজনে জঙ্গল জুড়ে মাতোয়ারা বংশিধ্বনি
বেহালায় বর্ষার বেহাগ ভাঙে ধ্যান অবসাদ
পিয়ানো টিনের চালা উত্তাল উদ্বাহু
হৃদয়ের নটরাজ নতুন সৃষ্টির মোহে
রাধিকা মুরতি মায়া পরাক্রম কামনার ঢলে
ষোলকলা পূর্ণ শশি শ্রমণ শাসন ভাঙে অবরুদ্ধ মন।

স্বপ্নদিন

কৈশোরে পুঁথির টানে শৃঙ্খলিত দৈবিক জীবন
হরমোন উত্থিত দেহ-প্রেম মোহে পাগল পাগল।
মন্দিরে কাঁসর ঘণ্টা ঢং ঢং দিগন্তে বিস্তার
স্মৃতির মদিরা পানে ব্যর্থ সব প্রেমিক সুজন…
উপনিষদের বেড়া ডিঙ্গোতে ডিঙ্গোতে
বোধিবৃক্ষ আঁকড়ে ধরে গৌতমের ঘ্রাণ
প্রতি দিবসের প্রতি কর্মফল নিষিক্ত নির্বাণ— স্বপ্নগ্রস্থ।
আমাকে আল্লার রঙে কতকাল রাঙিয়েছে পবিত্র কোরান
স্বপ্নজালে বাঁধা হুর— বেহেস্তি উদ্যান জুড়ে অনন্ত যৌবন
সাগর গর্জন কানে ভুলে না পাহাড় সানু সময়ের প্রতিটা আঘাত।
মোহন লেনিন যদি সমতার সমাজ বুননে
স্বপ্নযুদ্ধ কোনকালে টেনেছে বিপ্লবে—
কেবলি ত্যাগের শিক্ষা কেবলি আত্মপীড়ন
বহুকাল বহুযুগ শ্রমণে হৃদয় বন্দি
যুগোত্তীর্ণ ভান্তে দিন স্বপ্নহীন শূন্য দিন
দেখিনি দু’চোখ তুলে আকাশের নীলে কত
ছবিদের আনাগোনা মেঘের কালিতে
শুনিনি দু’কান পেতে নূপুর নিক্কন কোনো
পাখি ফুল নারীদের ঘ্রাণ এসে লাগেনি তো নাকে
নদী তীরে শত ঢেউ ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ তীরের কাদারা
আমার অপেক্ষা গুণে বহুকাল কাটিয়েছে একা…

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার