ফতোয়া
তাকে; ঘর থেকে টেনে আনার হুলস্থূল শব্দে বাতাসে মিলিয়ে গেল মল্লিকার তাজা ঘ্রাণ, মাথার উপর আকাশটা রেখে যে দূরগামি পাখিসব ডানা ঝাপটাচ্ছিল কলরব তুলে, তা-ও থেমে গেছে। ছলচ্ছল যমুনাও কেমন খেইহারা। সদ্য কাঁটা গজিয়েছে— শিমুলের এমন ডালে এবার বাঁধা হল তাকে। ক্রুর ঘনমেঘে ছেয়ে গেল প্রেমের নীলিমা। পাঁজরের মটমট আর্তনাদে ভেঙে গেল ধনচে পাতার ঘুম, আর কদুর আকার নিয়ে কেঁপে উঠল রাতজাগা চাঁদ।
কাঁপল না শুধু দানবের হাত। শক্ত রজ্জুতে যখন বাঁধা হল তাকে, একদলা থুথুতে নিভিয়ে দিল সে মৌলভির নিরাবেগ মুখ। সাপের ছোবলে অমনি ফোঁস করে ওঠল মধ্যযুগ। ঝাড়–র তুমুল শব্দ শোনা যাচ্ছে এবার। টালমাটাল পুরো গাঁ। মানুষের ফিসফাস। আর তার আরশকাঁপা চিৎকার। আর তার বাঁচার আকুতি। আর তার সারাটা শরীর জুড়ে ফোস্কার উত্থান, যেন টসটসা আঙুর…। একসময় চিৎকার থেমে গেলে শান্ত চারদিক। তবু মাওলানা থামল না।
কারণ, মেয়েটি তার শয্যাশায়ি হয়নি, এই ছিল অপরাধ!
পাশের বাড়ির বেহুলা
কুট্টি বাই, অ কুট্টি বাই, তাড়াতাড়ি বাইরান ঘরেরত্তুন। আফনার মেয়া বাইরে বলে কালে দংশাইছে, জলদি বাইরান। এই বেয়ানসুম বেয়ানে একজনে মরতাছে চোখে-মোখে রক্ত উডাইয়া, আরেকজনে বাজাইতাছে ট্যানডেসটার-রঙ লাগছে, রঙ; তব্ধ লাইগা গ্যালো মনে অয়, অ কুট্টি বাই, বাইরান, তাড়াতাড়ি বাইরান। উঁশছাড়া ব্যাডারে এত কইরা কইলাম, জউরা শরীলে কামে যাওনের দরকার নাই, হুনলো না, কইলজাডা আমার ভাজা মাছের মতন ভাইজা ভাইজা খাইল, মরুকগা, বুঝক অহন, আমারকি। কুট্টি বাই, অ কুট্টি বাই, শাওনের বাপেরে কইলাম না কালে দংশাইছে, উডেন, জলদি ওঝার বাড়িৎ যান।
এ্যাই পোলা, কব্জিটা বাপের গামছা দিয়া পোক্ত কইরা বাইন্ধা ল— ।
বৌদির বেলুন সংসার
ভোরের কমলা রোদে বৌদির লালচে শাড়ি আরও লাল হবে। ভেজানো আঁচল থেকে টুপটাপ আষাঢ় হয়ে ঘরের কাঞ্চিতে পড়বে জলের সুনিপুণ দাগ; আর তফাতে দাঁড়িয়ে ইশারায় কলেজ পড়ুয়া দেবর আওড়ে যাবে হজমযোগ্য খিস্তি— এ রকম একটি চিত্রনাট্যের অপমৃত্যুতে শোকের মাতম উঠেছে আমাদের একঘর পাশের বাড়িতে।
বাড়ির প্রধান কর্ত্রী মা, ছেলে তার বিদেশ ফেরত হয়েছে শুনেই মান্নত করেছেন দরগায় দেবেন চালেডালে শিন্নি, গাছপাকা কলা। ভাবছেন ঝোলখিচুড়ি করাবেন, না-কি ছেলেকে নিজ হাতে রেঁধে খাওয়াবেন রুই মাছের সুস্বাদু ঘন্টো, না-কি দু’টোই।
আর ওদিকে, বিয়ের সামান্য ক’টা গহনা বেচে দিয়ে যে বউ স্বপ্ন দেখেছিল স্বামি মাসে মাসে তার জন্য পাঠাবেন খামে বোঝাই দিনার, বাঘমার্কা কম্বল আর সোনার ঝালর দেয়া হাতঘড়ি… সে আজ ঝিনুকব্যথায় কাতর।
আসলে বারুদে ফেটে গেছে বৌদির বেলুন সংসার।
বিজ্ঞাপন : কর্ণদুল
শকুন্তলা সুন্দরির সেই উদ্ভাসিত মুখাবয়ব, টানা টানা জোড়া-ভ্রু, দিঘির মতন চোখ— মনে পড়ে? ভুলে গেছ রাজা দুশমন্তগাথা? অবকাশ যাপনে বেরিয়ে ছিলেন রাজা; ভরপুর চোখে দেখছিলেন কূল-কিনারাহীন প্রকৃতি। অশত্থপাতার একাংশে রৌদ্র-হাওয়ার মাতামাতি দেখে বিমুগ্ধ তিনি। কোথায় বাজে চুড়ির অমন টুংটাং বেহালা? নির্জনা বন-মধ্যে দেখা যায় এ কার পদচ্ছাপ? উপচে পড়া সুরের তুফানে কে অমন মাতিয়ে রাখছে চারদিক? কে? কে সেই? এগিয়ে যায় দুশমন্ত! মেঘকাল চুলে পিঠ ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক অরণ্য সুন্দরি। কি নাম তোমার কইন্যে? শকুন্তলার সঙ্গে পরিচয় ঘটে রাজার। আরো সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন তিনি।
দুশমন্ত তার জোড়-পাঁজরের সমুজ্জ্বল স্মৃতিস্বরূপ প্রেয়সির কানে পরিয়ে দিয়েছিলেন যে অসামান্য দুলজোড়া, যমুনার ঘোলা জলে শকুন্তলা তা হারিয়ে ফেলেন অসাবধানতাবশত।
এই সেই পৌরাণিক দুল।
কোরকচর
নদী ভাঙনে গেছে চাঁদতারা মার্কা গলুই; বাকিটা বেদখল। পরিত্যক্ত, অকেজো, অব্যবহৃত গায়ে কে যে উদরের বর্জ্য ঢালে অভ্যাসবশত, বুঝতে পারি না।
শুকনো মাটিতে দেবে গেছে এই দেখ আমার এ নায়ের আধেক শরীর, পোকার আস্তানা দেখ কিশোরির সেই বুকের সমান; আর পুরো অবয়ব ফাটন্ত গোড়ালি সুনিশ্চিত। আহা! কতদিন গাবের জলের স্বাদ পায়নি বেচারা।
সাধের নাও, আমি আর তোরে বাইতে পারলাম না।
দুই
সেই নদীতে আজ একহাঁটু জল… লোহার পুল, আর পুলের ওপর দিয়ে ধূধূ এক্সপ্রেসের দিনরাত চলে এক্কাদোক্কা খেলা। দু’পাড়েই বসতি। বাতাসে বাবরিচুল উড়িয়ে ভাড়াবাড়ির ছাদে টুংটাং গিটার বাজায় স্কুলগোয়িং এক ছোকরা— ‘ঝাকানাকা… মিরাবাই…’।
আর ঐ যে ইটের আস্তর উঠে-যাওয়া যে দোতলা বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, তার নিচতলায় থাকে ফ্রক-পরা এক বউ। শুনেছি, বাঁশি শুনে আউলায় তার গ্যাসের চুলার রান্ধন।
মেয়ে, কারখানার ভেঁপুতে কই শোন প্রণয়-আহবান?
বিশ-বাইশের আওয়াজ
দেখ বাবা, নামের বাহার দেখ। কৃষ্ণ ফিরোজ— এটা কোনো নাম হল? কি কমু দুঃখের কথা, ওর জন্মের সময় বড় বড় দুইডা গরু জবাই করে আকিকা করেছি। মসজিদের বড় হুজুররে ডাইকা হাদিস কোরান দেইখা নাম রাখছি ফিরোজ আকবর চৌধুরি। বাদশা আকবরের মতোই চেহারাখান ছিল ওর ছোটকালে। বাজে আড্ডায় পইড়া কি দশা যে হইছে চেহারাডার, খেয়াল করছ। বাবা হইয়া আমি ওর দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারি না। দ্যাখো, রোদে পুইড়া কালা অঙ্গার হইয়া গ্যাছে। রাত্রে বাসায় যায় না। ঘাপটি মাইরা পইড়া থাকে পিজি’র ভেতর। খায় কই জান, বস্তিতে। আরে বাবা, আমার কোনো কিছুর অভাব আছে? না, তার এক কথা, জীবনানন্দ হইব, আবুল হাসান না হোসেন তা হইব। বাল ছিইড়া তাল গাছ বানাইব। লেখাপড়া তো আমরাও কিছু করেছি, না-কি? স্কুলে যখন পড়তাম, অমন কবিতা আমরাও তো কমবেশি লিখেছি। ভোর হল দোর খোল…, আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই… কি সুন্দর কথা। আর ওই বদমাইশটা কচুমাথা যা লেখে তা কি পড়ন যায়? স্তন, পাছা, বীর্য, পোদ— তুমি বাবা আমার ছেলের মতনই তো, কও, এসব পড়া যায়? না মুসলমানিত্ব থাকে?