প্রাচীন রক্তের সুবাস ৤ ফজলুল কবিরী

0

মুসলমান ভাইভাই এ কথাটি স্মরণ করিয়ে মাউলানা জমিরুদ্দিন আসমান ও জমিনকে সাক্ষি রাখে। খয়ের খাঁর ইহজীবনের সকল গুনাহখাতার মাফের জন্য স্বয়ং আল্লাহপাকের দরবারে ফরিয়াদ জানাতে সকলকে হাত তুলতে বলে। তার দৃষ্টি মৃত খয়ের খাঁর লাশের খাটের উপর সরে যায়। খয়ের খাঁ তখন চোখদু’টো ঈষৎ মেলে মাউলানা জমিরুদ্দিনের দিকে সোজাসুজি থাকায়। তারপর দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে ওঠে আসা হতাশার বেগটা দমন করার প্রাণপন চেষ্টা করে। সে একাজটা করে কারণ সে সত্যিই গত হয়েছে, এবং গত হবার পূর্বে তার পীড়িত হবার সংবাদে ছুটে আসা পালিত মেয়ের ডান হাতে ধরা চামচের জলটুকু স্পর্শ করে। ইটের গাঁথুনি দেয়া চার দেয়ালের ঘরের চালার উপর প্রায়শ কচকচ করা পঙ্খিরাজ কবুতর জোড়ার ব্যস্ত পায়ের শব্দকে হটিয়ে মৃত্যুর গন্ধ অবশেষে তার ওপর ভর করে। খয়ের খাঁ কুমারখালি বিলের ভয়ংকর নির্জনতা বুকে নিয়ে দেখে তার মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছে দেয়ার কেউ নাই। তখন কোলাহল আর কান্নার ঢেউয়ে নিজেকে শান্ত রেখে ইমাম জমিরুদ্দিনের খোঁজে পাশের ঘরের মনু মিয়াকে বের হতে দেখে।

ধীর পায়ে নাকি খানিকটা তড়িঘড়ি করে ইমাম ছুটে এসেছিল যদিও সে সঠিকভাবে খেয়াল করে উঠতে পারেনি, তথাপি তার আগমনের সংবাদে চারপাশে হৈ চৈ করা মানুষগুলো সতর্ক হয়। কোটরে চিৎ করে চোখদু’টো ছাদের দিকে স্থির করে রাখাটা ইমামের পছন্দ হয়নি। ইমাম তার সরু ও বাঁকানো আঙুল দিয়ে তা বন্ধ করে। তার চেহারায় ঈষৎ বিরক্তি দেখে খয়ের খাঁ অনুতপ্ত হয়! ইমাম সহজাত গাম্ভীর্য অটুট রেখে ডানদিকে হেলে থাকা শরীরটা পুরোপুরি চিৎ করে শোয়ায়। গুটিয়ে থাকা বামহাত সহ পা দু’টো সোজা করে। জিজ্ঞাসা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাকে যেন মুর্দার গোছলের এন্তেজামের কথা অবগত করে। মুর্দার গোছল ফরজে কেফায়া, অথচ এখনো পর্যন্ত গরম পানি ফুটতে না দেখে ইমাম বিরক্ত হয়, এবং জানায় হযরত আদম আলাইহিস সালামের এন্তেকালের পর স্বয়ং জিব্রাইল ফেরেস্তা বেহেস্তের অন্যসব ফেরেস্তাদের নিয়ে সিদ্ধ পানি দিয়ে বাবা আদমকে তিনবার গোছল দিয়েছিলেন। আদমের অনুসারিদের এই দায় কেয়ামত পর্যন্ত ফরজ। উঁচুস্থানে খাট বা তক্তার উপর রেখে মুর্দাকে গোছল দেয়া মোস্তাহাব। তবু বারান্দায় বিছানো খাট থেকে তেল চিটচিটে বালিশ ও ময়লা পাটির উপর জড়ো করে রাখা কাঁথাটা সরিয়ে সেটি বাইরে বের করা হলে খয়ের খাঁর ছিনার ভেতর হঠাৎ ধুকপুক করে ওঠে, যেন-বা, উঠোনের আমড়াভর্তি গাছটির আমড়াগুলো তার বুকের উপর দুপদুপ শব্দে পড়তে থাকে! প্রাণপনে সে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে বাতাসে ছাড়ে, বুকটা শূন্য ও খালি হয়ে যায়। ইমাম জমিরুদ্দিন তখন মৃতের দেহটা পর্দা দিয়ে আড়াল করার কথা বলে। তারপর হাতে কাপড় জড়িয়ে জুনুর বাপ ও মিল্লাত আলিকে তলব করে। শোক, সংকোচ ও জড়তা নিয়ে তারা গোছলের আয়োজনে শরিক হয়। একটু আগে ধুকপুক করা বুক থেকে মরা বাতাস তাড়িয়ে দিলেও খয়ের খাঁর শূন্য ও খালি হওয়া বুকে পুনরায় তা জড়ো হতে শুরু করে! তার দৃষ্টি ইমামের সচল হাত আর মিল্লাত আলির পানির মগ ধরা ডান হাতে পায়চারি করে। মুর্দার ছতরে দৃষ্টি যদিও দুরন্ত ইমামের সতর্ক হাত দিয়ে কুলুখরত ছতর থেকে তারা দৃষ্টি সরাতে পারে না। তখন খয়ের খাঁর নিরক্ষর কলবে যে আকাক্সক্ষা সোরগোল তোলে, তা কুমারখালি বিলে মাঝেমধ্যে চরতে আসা কানি বগাগুলোর সরু গলার মতো একবার গোটায়ত পরক্ষণে লম্বা হয়। ছতরে তিন যুগের দীর্ঘ বেইজ্জতির চিহ্ন তার চোখে পষ্ট হয়ে ওঠে! বনিলাল দত্তের অন্দর-উঠানে যে অনিষ্ট দাবানল হয়ে ওঠেছিল, তিন দশকের তেজ নিয়ে সে আগুন তার উলঙ্গ দেহে ফটফট করে ফুটতে থাকে। খয়ের খাঁ তখন ভাবে সেটি একটি খুনোখুনির ঘটনা যা এখন ¯পষ্ট মনে পড়ে না। হয়ত আচমকা নাফরমানরা পুরো বছর জুড়ে ষড়যন্ত্র করে দেশটাকে দুফালা করে ফেলে। সে বছরই নতুন পতাকা হালদার বাতাসে পতপত করে ওড়ে। তার মাত্র ক’দিন পরে তারা তাকে ঘর থেকে বের করে এনে, প্রকাশ্য দিবালোকে, রামদাশ হাটের শতশত লোকের কোলাহলে লুঙ্গিটা টান মেরে বেপর্দা করে। তার চেয়েও মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যায় দিবাগত রাতে। আচমকা দৈবে যে নুনুটা উন্মুক্ত হয়েছিল রামদাশ হাটে, বাকেরের আসকারায় সে একই বজ্জাতের দল শেষ রাতে তার অরক্ষিত অন্দরে ঢোকে! মরা ঘুম থেকে আকাশ ফাটানো শব্দে জেগে উঠলে পাড়া প্রতিবেশি ছুটে এসে দেখতে পায় রক্তের লাল স্রোতে শোবার স্যাঁতস্যাতে পাটিটা ভেসে ওঠে। পাটিতে ঢেউয়ের মতো গড়াগড়ি করতে করতে কর্তিত লিঙ্গের রক্ত যেন মানচিত্রের আদল নেয়।

হয়ত যে কারণে মধ্য ত্রিশেই নপুংসক হতে হয়েছিল, তাতে সত্যমিথ্যা পরখ করার হুঁশ-জ্ঞান তার ছিল না। বর্ষা ঝাপিয়ে আসার পর কুমারখালি বিলের ঘাসগুলো রসে টইটুম্বুর হয়ে যেভাবে ভেজা জমিতে মাথাচাড়া ওঠে, তার ক্ষোভ ও ক্রোধ তেমনি লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে। জনগণ, ইপিআর ও আনসার-পুলিশ দিয়া দেশ স্বাধীন বানাইবে, আর সংগ্রাম কমিটি দিয়া দেশটারে দু’টুকরো করিবে! যেই না মরারোদ নামা এক নিস্তেজ বিকেলে রামদাশ হাটের প্রশস্ত ও জনাকীর্ণ খোলা ময়দানে পাকবাহিনির বিরাট কনভয় নোঙর করে, হালদার জলরাশিও তখন আর কেঁপে না ওঠে পারেনি। ক্ষুদ্র তরঙ্গগুলো গড়াতে গড়াতে দু’পাড়ের বাড়িঘোনা, উরকিরচর, আজিমার ঘাট, আনতোয়া কিংবা একেবারে কাছের জনপদ রোসাইঙ্গাঘোনার বোবা শরীর ভিজিয়ে দিলে সে পুলকিত হয়। ঢেউয়ের ছাট তার অন্তরে গুণগুণ সুর তোলে। বদিহাট, তেমুহনি, কালাগাজির বাড়ি কিংবা শাহ মজিদিয়া সড়কের চেনা পথগুলো সন্ধ্যার দু®প্রাপ্য আলোতে অ¯পষ্ট হতে শুরু করে। ভীত ও ক্লান্ত মানুষদের বেড়ার ঘরগুলোর দরজার খিল চড়াবার শব্দের সাথে সন্ধি করে সে নয়া অভিসন্ধির পাঁয়তারা করে। তখন তাকে নিজ ঘরের জরাজীর্ণ দরজার খিল আলতো করে আলগা করতে দেখা যায়। উঠান পার হয়ে কালাগাজি বাড়ির রাস্তা মাড়িয়ে, শাহ মজিদিয়া সড়কও অতিক্রম করে, খুব সন্তর্পণে পাকবাহিনির মোবারকবাদ গ্রহণ করলে সামরিক কর্তা রাজ্জাক মোবারক উচ্ছ্বসিত হয়, ইদার আও। হাম লোক তোমারা দোস্ত!
বুকের আজাব অর্ধেক নেমে গেলে তার অনেক দিনকার অবদমিত স্বস্তি মাথাচাড়া দেয়। তার নিরীহ ও তাৎপর্যহীন জীবন বিপদগামি নাফরমানের কল্যাণে অর্থপূর্ণ হয়, আর অগুণতি হাকিকত লোকের ভিড়ে সেইসব গুটিকয় জালিমদের চরম দেশদ্রোহিতা তাকে যে অস্থিরতায় ডোবায়, তাতে সে ভেবেছিল হালদার জলরাশি কিংবা তার গা-ঘেঁষা গ্রামগুলো কব্জায় এলেই মুক্তি। গায়ের এঁটোকুঁড়ে মানুষের উৎসাহি সমিহে উজান আসে। তার হৃৎপিণ্ডে যে পুলক জমা হয় তাতে সবুর মেম্বার কিংবা শরাফত মোল্লা রসদ জোগায়, তার বিশ্বাস আরো পোক্ত হয়। শেষমেশ গাঁয়ের গুটিকয় বেপর্দা মুসলমানের হিন্দু হবার খায়েশ পষ্ট হয়ে উঠলে মির্জাবাড়ির তেন্দর ছেলে বাকেরের ওপর ক্ষোভ জমে। সবুর মেম্বার বুঝাতে সমর্থ হয় আটার-কুড়ির এসব বাইঞ্চোতদের লাই দিয়ে মাথা খেয়েছে বাকের, আর এসবের মধ্যে প্রকাশ্য সায় দিয়ে নাটাই ঘোরায় স্বয়ং চেয়ারম্যান! হিন্দুপাড়ার বনিলাল দত্তও তার জ্ঞাতিগোষ্ঠি নিয়ে ইন্ধন যোগায় শুনে উষ্মায় ফেটে না পড়ে তার আর উপায় থাকে না। কেননা সবুর মেম্বর মারফত অবগত হয় গভীর রাতে বনিলালের ছায়া চেয়ারম্যানের কাছারি মাড়াতে দেখেছে স্বয়ং মেম্বরের কাজের ছেলেটি। আর এই ফাঁকে সে আপাত এক জটিলতার মুখোমুখি হয়। মূলত শৈশবে যে মুগ্ধতা একদা তাকে জাতধর্মের ঊর্ধ্বে তুলেছিল সেই নিষ্কলংক পাখিটি দৃষ্টিসীমায় পায়চারি করায়, তাকে এই জটিলতর চিন্তার ঘূর্ণিপাকে পড়তে হয়। সহসা সে ক্ষোভ জমা করতে পারে না, কেননা নিরক্ষর বিবেকে যা একটু আলো থেমে থেমে জ্বলে ওঠে, সে আলোতে স্বর্গিয় আভায় তৈরি একটি ফুটফুটে পাখির ধারালো ঠোঁট হেসে ওঠে। কৈশোরে লালচে গোঁফের রেখা সাফ করে যখন একটু একটু যুবক হবার অনুভূতি বুকে নড়াচড়া করতো, পিতা বাহার খাঁর পিছু পিছু ধানের পোজা কাঁধে নিয়ে সেই বাড়ির উঠানে জড়ো করতে করতে তার চোখ শুধু ভেতরের ঘরে উঁকি-ঝুঁকি মারত। দত্তপাড়ায় প্রবেশের মুখে বিশাল পুকুরটার চারপাড় ঘেরা কড়ই গাছগুলোতে আস্তানা গাড়া পাখির কিচিরমিচির শুনে যে পাখিটাকে পোষ মানানোর দুর্দান্ত ইচ্ছা মনের ভেতর জিইয়ে রাখত, ধানের পোজার ¯ূ—প মারার ব্যস্ততায় ডুবে না গেলে সে ইচ্ছাটা আরো দীর্ঘ হত! বনিলালের ধানিজমিতে পিতার বর্গা চাষের খাতিরে কোন ফাঁকে যেন পাখিটির লোভ তাকে প্যাঁচিয়ে ফেলে। সে বের হয়ে আসতে পারে না। এই ফাঁকে কৈশোর পেরিয়ে যুবক হয়। সেদিনের সেই ফুটফুটে বালিকা একদিন যুবতি হয়ে মাথায় সিঁদুর লাগায়। যে পাখিটা পোষ মানানোর বাসনায় একদিন গলায় তাবিজ বাঁধার খায়েস হয়েছিল তার কপালের সিঁদুর খয়ের খাঁর যৌবনে দাগা বসাতে না বসাতে পুনরায় একই লোভ বুকে উজান আনে। নিষ্কলংক বালিকার কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট জোড়ায় যে রহস্যময় হাসি লেগে থাকত, সাতপাকের মাথায় ডানা ছিঁড়লে সেই হাসিটা হারিয়ে যায়। তারপর বৃষ্টিতে নেয়ে ভেজা ঠোঁট শুকালে তার রূপে নতুন পালক গজায়। যে পথে কচি পা চালিয়ে নিষ্পাপ কিশোরি স্কুলে পাঠ নিতে যেত সে পথেই আবার অসংখ্য কচিশিশুর বিদ্যাশিক্ষার ভার তার বিধবা হাতের উপর বন্দোবস্ত হয়। খয়ের খাঁর লোভে নতুন আলো আসে। স্কুলঘরে কিংবা আঙিনায় শিশুদের মহড়ায় সাক্ষি থাকাও কোন ফাঁকে তার অভ্যাস হয়ে যায়। তখন ধীর পায়ে ফিরে আসার পথে, শিক্ষয়িত্রিটি দুরন্ত বালিকার চোখ দিয়ে খয়ের খাঁকে রাস্তার পাশে অকারণে মাটি খুঁড়তে দেখত। সেই দৃশ্য তখন আর নতুন কোনো কৌতুহলের বীজ বুনতে পারত না।

খয়ের খাঁর অভ্যাসেও অতঃপর ধীরে-ধীরে মরিচা ধরলে, আরো অনেক আটপৌরে মানুষের মতো তাকে একসময় সংসারি হতে হয়। উরকির চরের নোনা বাতাসে বরযাত্রি হয়ে যারা সেদিন সা¤পানে চড়ে ঘাট পার হয়েছিল, তারা দেখে লাল টুকটুকে একটা কিশোরি চোখের জলে সারাপথ ভাসিয়ে খয়ের খাঁর বউ হয়ে আসে। পরীবিবির চাঁদনি ওঠা মুখ দেখে তার পরনারী মোহে ছেদ পড়ে। স্কুল পথের দুর্বা ঘাসগুলো পাহারা দিয়ে তাকে আর কোদাল হাতে রাস্তার কিনারায় মাটি খোঁড়ার ছল করতে হয় না। নব-বধূর ওমে শীত তাড়াতে তাড়াতে হালদায় এভাবে অনেক জল গড়িয়ে যায়, আর সময়ের এই দীর্ঘ বিভ্রান্তিতে শৈশবের সেইসব স্মৃতি তার কাছে স্বাদহীন জলের মতো বর্ণহীন হয়ে ধরা দেয়। তাই গণিউকিল চেয়ারম্যানের কাছারিতে বনিলালের ছায়া দেখা যাওয়ার সংবাদে তার অস্থির চিন্তায় জট পাকে। গ্রামের বিপথগামিরা বর্ডারের তথ্য পায়, আর আমিরুল্লাহ মির্জার ছেলে বাকের আজিমার ঘাটে আস্তানা গেড়ে তাদের মাথা ধোলাই করে, এমন সব চিন্তায় তার বৈষয়িক বুদ্ধিতে আমূল নড়চড় উপস্থিত হলে সহসা ভিন্ন এক মহিমায় নিজেকে সে আবিষ্কার করে। মেম্বারের ক্ষোভ তাকেও প্রলুব্ধ করে, সে ক্ষুদ্ধ ও হিংস্র হয়। বর্গাজমির নেমক খাওয়ার অলস স্মৃতি তার হৃৎপিণ্ডে কাঁপন তুলতে ব্যর্থ হয়। তার চোখের কোটরে নতুন স্বপ্ন গড়াগড়ি খায়। গুটিকয় বিপথগামি মুসলমানের দোসর হয়ে বিধর্মীরা জাত-ধর্ম খাওয়ার যে ফন্দি আঁটে তাতে সিকিভাগ ছাড় দিতেও তার মনে সায় থাকে না। দিনকয়েক পরে আচমকা পাকবাহিনির বুলেটে সবুর মেম্বরকে লাশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ঈদগাহ মাঠের পাশে কৌতূহলি মানুষের ভিড়ে সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারে না। তার বাকহীন হিংস্র মূর্তি ঔচিত্যের সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে। ছুতিয়া বাঙালদের কিছু হারামি লোক পাকিস্তানের দরদি সেজে এমনি করে পাকিস্তানি সমর্থক লোকদের তাদেরই দোসরদের দিয়ে হত্যা করিয়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি করলে তার ব্যথিত ও বিদ্রোহি মনকে পাকসেনারা সান্ত্বনা দেয়, ইয়ে বহুত গলতি হুয়া!

এরপর দিনকয়েকের মাথায় চেয়ারম্যানের অন্দর-উঠান জুড়ে আগুনের শিখা লকলক করে বেড়ে উঠলে কাচারি ঘরসহ ইটের দেয়াল দিয়ে তোলা বড় ঘরটা কয়েক ঘণ্টায় উজালা ভস্মে পরিণত হয়। কন্যাপক্ষের সাত বছর বয়সি একমাত্র নাতিটা দৈববলে বের হয়ে আসতে পারায়, প্রত্যুষে আতংকিত গ্রামবাসি চেয়ারম্যানের স্ত্রী-কন্যা ও কাজের মেয়েসহ জীবন্ত পুড়ে মরার ঘটনা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। তারপর দুপুরের সূর্য ঠিক মাথায় উঠার আগে ইমাম জমিরুদ্দিনের তদারকিতে হাতেগোণা কয়েকজন গ্রামবাসি এগিয়ে এসে আধপোড়া মাংসপিণ্ডগুলো তুলে এনে তড়িঘড়ি করে মাটি চাপা দেয়। জানাযা সেরে দ্রুত দাফন সেরে ফিরে আসার পথে দত্তপাড়ার পুরুষদের স্কুল বোর্ডিংয়ে ধরে আনার সংবাদ তাদের কানে পৌঁছালে তারা ধারণা করে শান্তি কমিটির প্রধান খয়ের খাঁ পাকবাহিনির কর্তাদের সাথে রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে, চার চাকার গাড়ির ডিজেল পুড়িয়ে তিনগ্রাম ছুটাছুটিতে মগ্ন। স্কুলের ঘরগুলো দেশের শৃংখলা ভঙ্গকারি মুক্তিবাহিনির দোসরদের সংখ্যায় সংকুচিত হয়ে যায়। শেষ দুপুরের গা-সহা উত্তাপে স্কুলঘরের পুব-কোণায় আচমকা কয়েকদফা গুলির শব্দ উচ্চরোলে বাতাসে ধাক্কা মারে, আর ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া গাঁয়ের মানুষের জিহ্বা শুকিয়ে চৈত্রের গরমে ফাটাজমির মতো হয়! তারপর সন্ধ্যার আঁধারে একডজন মৃতদেহ ফাঁড়ির মুখ দিয়ে হালদার স্বচ্ছজলে নিঃশব্দে ভেসে যায়। তথাপি বনিলালের বিধবা মেয়ে মালা সে রাতের অন্ধকারে পিতার মুক্তির জন্য স্কুল বোর্ডিংয়ে ছুটে যায়। চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে, হাতজোড় করে এবং শেষে পা জড়িয়ে ধরে পিতার প্রাণভিক্ষা চায়। বিচলিত খয়ের খাঁর পা জড়িয়ে পিতার প্রাণভিক্ষা চাওয়া যুবতির আর্তিতে পাক-মিলিটারির চোখ উজ্জ্বল হলে যুবতির আলুতালু বেশভূষার প্রতিটি বাঁকে সে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়ে। বাঙাল সহযোগির মিনমিনে গলার অ¯পষ্ট আওয়াজে কান না দিয়ে যুবতির আর্তিতে গলা চড়ায়, ক্যায়া বোল জয় বাংলা হ্যা?
   না, আমি স্কুলে পড়াই।
   ক্যায়া তোম জয় বাংলা নেহি পড়াও?
   না, আমি কোনো রাজনীতি করি না। ছাত্র পড়াই।
   তব বোম ক্যায়া পড়াও?
   আমি এসব পড়াই না। স্কুলের ছাত্ররা খুব ছোট।
   ক্যায়া, ইস মে জয় বাংলা হায়-উ-না ?
   জয় বাংলা তাতে নেই। পুস্তকে এসব নেই।
তখন যুবতির আর্তি ও কান্নার শব্দ স্কুল বোর্ডিংয়ের ইট-সুরকিতে ঠোকর খায়। তার ভাঙা গলার অনুনয়ের সুর রাজ্জাক মোবারকের ঠোঁটে তৃষ্ণা জাগায়। তার জলের নেশা তীব্রতর হয়, ক্যায়া পাকিস্তান হায়?
   হ্যাঁ, বইতে পাকিস্তান আছে।
   তব তুম পাকিস্তান পড়াওগে?
   পড়াই। ছেলেরা পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে।
   তোমারা বাপ জয় বাংলা?
   নেহি। তিনি খুব নিরীহ শিক্ষক। চোখে কম দেখেন। তিনি এসব বুঝেন না।
তখন খয়ের খাঁকে খানিকটা বিনয়ি হতে দেখা যায়, আর সে সুবাদে পাকসেনার মুখে একটা নতুন বিনয় ভর করে। যুবতির বুকফাটা অনুনয়ের কৃপায় তাকে পিতার ভাগ্যবরণ করে হালদার মিঠা জলে নিঃশব্দে ভেসে যেতে হয় না। তারপর থেকে প্রতি সকালের নিঃসত্ত্ব রোদে ফরজ গোসলের ভেজা শাড়ি দীর্ঘদিন বোর্ডিংয়ের ছাদে শুকোতে দেখা যায়। পরে বেলুচি সেনাকর্তা রাজ্জাক মোবারকের গলিত লাশের তালাশ পাবার দিনকয়েক পর নতুন পতাকা রামদাশ হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে পতপত করে উড়লে গাঁয়ের আবাল-বৃদ্ধ-জোয়ানরাও একটি নয়া স্বপ্ন হালদার বাতাসে ওড়ায়! নয়া সুবাসের ক্রিয়ায় তারা বুঁদ হয়। মিঠে বাতাসের ঘ্রাণে কাঁধের দুই ফেরেস্তা ‘কেরামান’ ও ‘কাতেবিন’ তাদের আমলনামায় বিবিধ বিভ্রম লেপ্টালেও তারা আমলে নেয়ার ফুসরত পায় না। এভাবে সকালের আসমান ফুঁড়ে ওঠা ডিমের কুসুমটা ধীরস্থিরে ফেটে পড়ে ক্রমশ, আর সেই তাপের তেজে ফসলের ক্ষেত পুড়ে খাক হয়। তখন হালদার চোখে জল গড়ায়। সে জলে নগর-জনপদ তলিয়ে যায়, আর ফুলে ওঠা জলে ঘরের চুলায় জল ঢোকে। এরপর তারা ইত্যাকার সব কথা বিস্মৃত হয়। ততদিনে বাতাসে ধোঁয়াটে রংয়ের কুয়াশা জমে, আর কুয়াশায় বাতাস ভারি হয়ে উঠলে পথঘাট নেয়ে ওঠে। ফলে পথের অলিগলির পূর্বাপর সকল কালিঝুলি ধুয়েমুছে সাফসুতরো হয়।

সেই শঙ্খসাদা পথে মুর্দাশায়িত খাটের চারকোণা ধরে হাঁটা সহগামি লোকেরা কালেমা শাহাদাত পড়তে পড়তে গোরের নিকটে পৌঁছে। খাটের আগামাথা সযতেœ আগলে ধরে খালি পায়ে হেঁটে এসে তারা ক্লান্তিতে হাঁপায়। ক্লান্তি ও শোকে খয়ের খাঁর চোখে অকস্মাৎ জল জমলে ঝাপসা দৃষ্টিতে সে সহসা কবরটা চিনে উঠতে পারে না। গুমোট কান্না বুকে চেপে মাথা উত্তর দিকে ও মুখ পশ্চিম-রোখ করে, বাকি তিন কাঁধের সাথে সমতা রেখে, কাত করে তারা তাকে কবরে শোয়ায়। কবর খুঁড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়া কয়েকজন যুবক তখনো গোরের কিনারায় গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকে। শিরিকি কায়দায় এভাবে তাদের শুয়ে থাকতে দেখে পেছন থেকে কে একজন উষ্মা ও বিরক্তি প্রকাশ করে। তারপর তারা তড়িঘড়ি করে ছুটে আসা, হাঙ্গামাকালে প্রয়াত সবুর মেম্বারের জ্যেষ্ঠ পুত্র শমসেরকে মুর্দা কবরে নামানোর কাজে হাত লাগাতে দেখে। শমসের কবরের পিঠকে রুই মাছের শিরদাঁড়ার মতো উঁচু করে মৃতের কবরটাতে একটি খেজুর গাছের ডাল গুঁজে দিলে গোরের মিষ্টি বাতাসে সেটি পতাকার মতো পতপত করে উড়তে থাকে। খয়ের খাঁ ঠিক সে মুহূর্তে কাফনের সাদা কাপড়ের ভেতর মুদিত চোখদুটো খোলে। আতর ভেজানো তুলা নাকের ফুটোয় আটকে থাকে, আর তা থেকে ভুরভুর করে সুগন্ধ বের হয়। মুর্দা দাফন করতে জমায়েত হওয়া মানুষগুলো বুঝতেই পারে না খয়ের খাঁ মরে নাই।

মৃত্যুর ঊনচল্লিশ দিনের মাথায়, যখন তার চল্লিশার মাত্রই একদিন বাকি, খয়ের খাঁকে প্রত্যুষে মিজ্জির আযানের পরপর মসজিদের পুকুরঘাটে ওজু করতে দেখে ফজর নামাজের মুসল্লিরা ভয়ে ও বিস্ময়ে আচমকা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। জুনুরবাপসহ সেদিন মুসল্লির সংখ্যা ছিল মাত্র নয় জন, আর তাদের মধ্যে গুটিকয়েক মুসল্লিই কেবল খয়ের খাঁকে চিনতে পারে। তার চোখগুলো ছিল হলুদ বর্ণের এবং পরনে ছিল অদ্ভুত রকমের সাদা পোশাক। তার কুশল বিনিময়ের প্রত্যুত্তরে কেউ কথা বলতে পারে না। মাউলানা জমিরুদ্দিন প্রাথমিকভাবে বিষয়টা বুঝতে না পেরে জোরে জোরে দোয়া ইউনুছ সুর করে পড়তে শুরু করলে বাকি মুসল্লিদেরও তৎক্ষণাৎ গলদটা ধরা পড়ে এবং তারাও চিৎকার করে একইরকম সুর তুললে ভয়ংকর এক আবহ তৈরি হয়। তাদের অগোচরে ফজরের ওয়াক্ত ফসকে গেলেও তারা টের পায় না। ভোরের আলো খানিকটা পষ্ট হলে যেসব শিশু মক্তবের দোড়গোড়ায় কায়দা-সিপারা নিয়ে হাজির হয় তারাই এই ঘটনা পাড়াজুড়ে ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু মসজিদ নির্মিত হবার পর এই প্রথমবারের মতো ফজরের নামাজ জামায়াতে না হওয়ার বেদনা কাউকে স্পর্শ করে না। তারা ঘটনার আকস্মিকতায় যতটা-না ব্যস্ত হয় তার চেয়ে বেশি তৎপর হয় খয়ের খাঁর ভাবনায়। মাউলানা জমিরুদ্দিনসহ যে নয় জন মুসল্লি জামায়াতে শরিক হতে এসেছিল তাদেরকে কোনোভাবে শান্ত করা যায় না। মাঝেমধ্যে সারাশরীরে খিঁচুনি উঠলে আরো জোরে দোয়া ইউনুছ পড়তে থাকে। তাদের মুখ দিয়ে অনবরত ফেনা উঠে এবং সেসব ফেনায় মসজিদের বারান্দা ধীরে-ধীরে ফুলে উঠে। খয়ের খাঁ আপন মনে নিজের এবাদত বন্দেগি সেরে ধীরপায়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে পড়লে সবাই খানিকটা ঔৎসুক্য নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। তাদের ভেতর ভয়ংকর রকমের তোলপাড় শুরু হয়। বয়স্কদের প্রায় সবাই অগোচরে সরে যায়, আর যুবকদের একটা বড় অংশ তার বিষয়ে একটা সমাধানের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সবাই ধারণা করে হয়ত সে ঘরে ফিরবে। কৌতূহলী শিশুরাই কেবল তার পিছু নেবে ভাবা হলেও যুবকদেরও প্রায় সকলে খয়ের খাঁর পিছু নিলে মসজিদ লাগোয়া বাড়ির রাস্তাটা একটা মিছিল হয়ে উঠে। তারা কেউ আর নিজেদের ঘরে ফিরে যায় না। তারা কেবল পুনরুত্থিত খয়ের খাঁর পেছনে ছোটে। কিন্তু খয়ের খাঁ নিজ ঘরে ফেরে না। তিনযুগ আগের হারিয়ে যাওয়া একটি রাস্তা দিয়ে ধীরে-ধীরে চলতে শুরু করে। তার পিছু পিছু ছুটে চলে পুরোদস্তুর একটি প্রজন্ম। খয়ের খাঁ যে জায়গাটায় গিয়ে থামে তারপরে আর কোনো রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় না। কেবল একটি মৃত ও পরিত্যক্ত খাসভিটে। কয়েকটি প্রাচীন কড়ই গাছ ও বিশাল একটি পুকুর ছাড়া আর কোনো বাস্তব দৃশ্য তারা স্মরণে আনতে পারে না। তবুও তাদের প্রায় প্রত্যেকে একই রকম কৌতূহল নিয়ে খয়ের খাঁকে অনুসরণ করতে থাকে। খয়ের খাঁ সেই মৃত মাটিতে কি যেন খুঁজতে থাকে। তারপর পোড়া ও পাথরের মতো মাটিগুলো থেকে প্রাচীন একটি কোদাল খুঁজে নেয়। অনেক্ষণ ধরে কোদাল চালিয়ে গর্তের পর গর্ত খুঁড়ে চলে। গর্তগুলো কোমর সমান হতে না হতে পোড়াভিটার আয়তন কেবল দীর্ঘ হয়। এতগুলো গর্ত তাদের কেউই একসাথে কখনো দেখেনি। তারা একটার পর একটা গর্ত গুণতে থাকে আর গর্তগুলো সংখ্যায় অনবরত বাড়তে থাকে। একসময় ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে শত শত মৃত ব্যক্তি গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। মৃতদের শরীর থেকে জপজপ করে ঝরতে থাকে তেলতেলে নীলাভ রক্ত।

বর্ষ ৬, সংখ্যা ১১, ডিসেম্বর ২০০৭

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার