ব্যক্তিগত ৤ পারভেজ হোসেন

0

মনিকা বলে, তার মনে হচ্ছে সে ন্যূড ছবিতে অভিনয় করছে।
— ন্যূড ছবি মানে?
বলে কি মেয়েটা! আমি অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকি।
মনিকা আমার বুকের তল থেকে সাপের খোসা খোলার মতো বেরিয়ে গিয়ে বালিশে আধশোয়া হয়। অনাবৃত বুকের উপর চাদরটা টানতে টানতে বিরক্ত সে।
— দ্যাখো যখন মনে হয় গিলছ আর ন্যূড ছবি চেনো না!
— আরে বোকা ও ন্যূড না, পর্নো।
মনিকা কি পর্নো ছবির নায়িকা হতে চায়? তা সে হতেই পারে, মনিকার এ্যালবাম খুললে বোঝা যায় ছবিতে ওর চেহারা খোলে খুব। একটা টসটসে ভাব ওর আপাতসরল লাবণ্যে ধরা পড়ে আর ছিপছিপে দীঘল শরীর ছেয়ে কামকাতরতা আপনিই জীবন পায়। মোদ্দাকথা মনিকা যেন অনারাধ্য জীবন্ত এক কামনা। প্রকৃতির অপার দানে দীপ্ত। এত কথা বলার হয়ত একটাই কারণ, আমি ওর ঐসব খুঁটে খুঁটে দেখেছি আমার স্বভাবজাত অনুসন্ধিৎসু চোখে। যে চোখ আর মনের সমান্তরালে ওর প্রতি খুবই অনুরাগি হয়ে উঠছিলাম।
সম্পর্কটার শুরু শরীর দিয়ে হলেও তা গড়াতে গড়াতে দেহজ-উন্মাদনার বাঁধ ভেঙে কেমন মমতা মাখানো নির্ভরতায় গিয়ে ঠেকছিল। টের পাচ্ছিলাম বার বার ভালবাসি বললেও তা ছিল নিছক ওর মাধুর্যে ডুবে ডুবে চোখ লাল করা
জ্বর-গ্রস্ততা আর যে মায়ার ঘোরে এ সংসারের পাকচক্রে লতায় পাতায় জড়ায় মানুষ ঠিক তেমন করে মনিকাগ্রহের ঘোরে পদে পদে জড়িয়ে পড়ছিলাম আমি।
যৌনতাড়নার নিবৃত্তে নয়, বলব যৌনসম্ভোগের লোভেই এমন কিছু খুঁজছিলাম যা আমার বিগত তেত্রিশ বছরের জীবনে পাইনি। তেত্রিশ বছর বলাটা কি ঠিক হল? মোটেই না, ওটা হবে সতের বছর কেননা তখন আমি সবে এসএসসি দিয়ে মফস্বলে আত্মিয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছি। সমবয়সি হলেও রেহনুমা আমার খালা হয়। ওর জন্যেই যাওয়া। আমাদের যে সখ্য, যে অনুভবে জড়িয়ে আমাদের খুব ভাব, তা উতরে ওরকম একটা ঘটনা যে ঘটবে কে জানত!
একই উপন্যাস দু’জনে মিলে পড়েছি, একই কবিতা দুজনেরই ভাল লাগে, একই গানে সুর মেলাই আর যখন খুব ফ্রি হয়ে উঠলাম তখন অন্য একটা জীবন যা ও বয়সে ভীষণ গোপন আর রহস্যে ঘেরা, সে জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্পে মেতে উঠি। সেই গল্পের পথ বেয়ে কত অজানার অনুসন্ধান; কত উদ্বেগ নানাভাবে বোঝার, খুব করে দেখার। আর সে দেখার মানে যে কি তখন তা কি জানতাম! যেন আগুন লেগে গেল কাঁচা বনে। পুরো বনভূমি পুড়ে ছাই হলেও বহ্নিশিখার আত্মবিনাশি সে হাহাকার যে থামার নয়! কিন্তু কিভাবে মিটবে এই হুতাশ?
কোনো পরিপূর্ণ নারীর কোথায় কোন্ অমৃত ফলে আছে তার কিছুই জানা ছিল না তখন তাই দেখার মগ্নতায় ছোঁয়ার নেশা জাগল। দোতলায় ওর ঘরে ঝিরঝিরে শীতের আবহে লেপের তলায় নিজেদের অর্ধেক ডুবিয়ে গল্প করছি তো করছিই।
বাদাম আর রেইনট্রির কোলের মধ্যে ওদের বাড়িটা বাড়ন্ত রাতের সাথে আরও ভয়-গভীর হয়ে উঠছিল। এতরাত করে পিঠাটিঠা বানিয়ে অন্যেরা তখন ক্লান্তির ঘুমে অচেতন। বাইরের লেবুবাগানে জোনাক পোকার ভিড় আর দূরে বহু দূরে কুকুর কান্নার ক্ষীণ আওয়াজ।
দু’টো কিসমিস দানায় আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে দেখছি, দেখতে দেখতে থিরথির কাপন জাগে প্রাণে। ধীরে-ধীরে রেহনুমাও অনুচ্চারিত এক অবোধ্য শব্দে গোঙাতে গোঙাতে আমাকে যে কোন্ জগতের আলো-অন্ধকারে টেনে নিল! ভরা চুলের গুচ্ছে আমার সারা মুখ ঢেকে গেছে। কেমন একটা অদ্ভুত-অচেনা গন্ধের মাতলামোয় দম আটকে এলেও ভরা জোয়ারে আমাদের গ্রামের বাড়ির পেছনের খালে ডুবিয়ে ডুবিয়ে জলতলার খানাখন্দ থেকে বেলেমাছ শিকারের আনন্দময় উন্মাদনা তখন।
এতকাল পরেও অনেক অভিজ্ঞতার সিঁড়ি টপকে আজও কি বুঝেছি সেদিন রেহনুমা এক অনভিজ্ঞ অবোধ তাড়নাতুরকে সব দেখাবার ছলে, সব খোয়াবার বাসনায় (?) লব্ধ অভিজ্ঞতার (যা সে স্বীকার করেনি) অনলে সেঁকেছিল কি-না?
পরদিন রেহনুমা কেমন অপরিচিত হয়ে উঠল। কেউ বুঝল না কিছু কিন্তু আমি বুঝলাম এদিকে আমার জিহ্বায় রক্তের লোনা স্বাদ ঘেমে উঠছে, তুলতুলে নরম থাবার আড়ালে টের পাচ্ছি তীক্ষ্ম নখের অস্তিত্ব আর প্রাণের কোণায় চিনচিনে ব্যথা। সব সয়ে গেলেও সে ব্যথাটা এখনো বাজে। সেদিন দুপুরে পুকুরঘাটে একটা ছেলের সাথে কথা বলছিল রেহনুমা। আমি ওদিকে এগোতেই সে চলে গেল আর রেহনুমা গম্ভীর হয়ে পুকুরের জলে ইটের টুকরো ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলল,
— তুই ঢাকায় চলে যা পারভেজ।
— আজই?
— হ্যাঁ পারলে আজই।
— তুই না যাবি বলছিলি।
এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে শত অর্থে আমার দিকে তাকিয়ে ঘরের পথে পা রাখে রেহনুমা। রাগ, ক্ষোভ আর অপমানে চড়চড় করছিল শরীর। একটা অকথ্য অবদমন চাপতে গিয়ে আমার কলজে মুচড়ে উঠছিল বার বার। আমি চলে এলাম।
এই উত্তর-চল্লিশে এসে তেত্রিশে পাওয়া মনিকাকে যেমন মনে পড়ে ছেলেবেলার রেহনুমাও তেমনি স্মরণীয় হয়ে আছে তার দেয়া স্বল্পকালের ক্ষণিক আলোর প্রথম ওমে। আমার প্রথম নারী চেনার মধ্যে।
যাকে প্রেমেপড়া বলে তা আমার কখনো হয়েছিল কি-না কে জানে। কেননা প্রেম একমুখি, স্বার্থপর। সে শুধুই নিভৃতি চায় আর আত্মমুখি হয়ে ওঠে নিষ্ঠুরভাবে, যে প্রবণতা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। আমি প্রবলভাবে পরমুখি পুরুষ হলেও কাউকে নিয়ে ঐ ভাবের মধ্যে বেশিদূর এগোতে পারিনি বরং এক ধরনের বন্ধুতাকে কেন্দ্র করে একটা জটলার মধ্যে সবাই মিলে সেইসব সরল সময়গুলো কিভাবে পার হয়ে এলাম ভেবে আশ্চর্য হই।
কিন্তু যাকে বলে সংসারের চক্কর তা শুরু হল ঘর বোনার পর। বিয়ের ন’মাসের মাথায় এ্যাডজাস্ট না হবার অভিযোগে রাগারাগি করে যদি কারো বউ বিদেশে পাড়ি দেয় এবং আর কখনো না ফেরে তাহলে ঐ পুরুষের প্রাত্যহিক জীবন কোন্ অনলে জ্বলতে পারে তা বোধহয় কারো অনুধাবনের অসাধ্য নয়। তার সুযোগ ছিল সে গেছে কিন্তু পশ্চাৎধাবনের কোনো সুবিধা বা শক্তি কোনোটাই আমার ছিল না। তবুও সামর্থানুযায়ি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কম করিনি, কিন্তু ও এল না। আজ আর আমি তার নাম বা সে সম্পর্কিত কোনো কিছু কলমের ডগায় তুলতে চাই না। যে গেছে সে তার ভাল নিয়েই গেছে। তাতেই আমার মুক্তি মিলেছে।
এতসব কেলেংকারির ধকল কাঁধে করে নানান দ্বিধা-সংকোচ উতরে বছর হল মনটা পোক্ত হয়েছে কেবল। আড়মোরা ভেঙে শরীরটাও সচলতা পেয়েছে। কিন্তু কি আর করা, পুরোনো বন্ধুরাও আমার যাপিত-জীবনের ঝড়-ঝাপটায় দূরে দূরে সটকেছিল এতোদিন। নতুন করে তাদের আর সেভাবে পেতে মন সায় দিল না, শুধু রিয়াদ-এর সঙ্গ আর ছাড়তে পারিনি কখনো। কি জানি কেন রিয়াদ আমার সবটাতেই, চাই কি না চাই, বলি কি না বলি, নিজ থেকে প্রাণের সে কোন্ গোপন টানে আমাকে আগলে রাখে। আর এই যে এতকথা বলছি আর যা কিছু বলতে পারছি না তার কিই-বা রিয়াদ না জানে! ওর কাছে আমার গোপন বলে কিছু নেই। আমার প্রতিটি ভঙ্গি দেখে ও আমাকে সনাক্ত করে। আমার সকল প্রবণতায় ওর দৃষ্টি ঢুকে পড়লেও আমি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরি না বরং আমার পরমুখি মন যেন আশ্রয় পায়, নির্ভরতা পায়। সম্পর্কটা ছেলে-মেয়েতে হলে বেশ হত।
বন্ধু রিয়াদই আমাকে একদিন নিয়ে গেল এক অভাবিত আড্ডায়। সেখানে মদ-জুয়া-নারী কিছুরই অভাব নেই। অসাধারণ ভব্যতায় খেলা চলছে। জিতে যাওয়া টাকা পকেটস্থ করবে সে উপায় কারো নেই। ও দিয়েই আসছে খাবার-দাবার, কঠিন কিংবা কোমল পানিয়। যারা ধোঁয়ায় বিশ্বাসি তাদের জন্য তা-ও আসছে। আর যারা খেলছে না বা সাময়িক বিরতি নিচ্ছে কিংবা পকেট খালি হয়ে গেছে তারা নির্বিঘেœ গল্পে মশগুল। কিন্তু বিষয়ের উচ্চতায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম-আর্ট-কালচারের নিচে কোনো আলাপই নাই। গল্প কবিতায় আসক্তি আছে বলে যেন ঠাঁই হল।
গল্পের আসর থেকে উঠে ওদের খেলা দেখছিলাম। রিয়াদ তাসগুলো গুছিয়ে আমাকে পাশে ডেকে বলল,
— ও হচ্ছে মনিকা, তোমারে কওয়া হয় নাই। আমার খুবই ক্লোজ। ও খেললেই আমি খালি হারি। হারাটাই আমার পেশা হইয়া গেছে পারভেজ।
ওর ঘরে ঝামেলা আছে জানি, তাই বলে মদ-জুয়ার সাথে মনিকা, তা-ও আবার খুব ক্লোজ! কেমন বিব্রত হলাম আমি। রিয়াদের কথার ঝাঁকে তাই আমল দিতে না পেরে মনিকার দিকে তাকাতেই মৃদু হেসে একটু সরে গিয়ে তার পাশে জায়গা দিলেন,
— আপনের কথা অনেক শুনছি ভাই। নাইন কার্ড পারেন? দানটা শ্যাষ হউক, আপনেরেও দেবে।
— আমি তো কার্ড চিনি না, খেলিনাইতো আগে।
— তাতে কি, কার্ড চিনতে কতক্ষণ।
বাকিরা যার যার তাস নিয়ে মোনাজাতের ভঙ্গিতে বিভোর। যেটুকু খেয়েছি নেশাটা চেপে বসেনি তখনো; মনিকার পাশ ঘেঁষে ওর তাস মেলানো দেখছি। ওর গায়ের গন্ধ পাচ্ছি। মেয়েদের সিগারেট খাওয়াটা আমাকে ভীষণ টানে। হয়ত সেটাও একটা কারণ, মনিকাকে আমার বেশ ভাল লেগে গেল।
এরপর থেকে রিয়াদের উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতিতে ক্রমান্বয়ে ওখানে আমার যাওয়া-আসাটা বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে যেন রিয়াদ না থাকলেই ভাল লাগে আমার। ভেদবিচারহীনভাবে আরও মুক্ত হয়ে উঠতে পারি যেন। আমি খেলতে পারি না বলে মনিকা আমার অর্থে খেলে, মানে আমার খেলাটা মনিকা খেলে দেয়। এই করে করে আমরাও বেশ ক্লোজ হয়ে উঠলাম। ফলে রিয়াদকে এড়িয়ে মনিকার সাথে একটা গোপন সম্পর্ক ধীরে-ধীরে মাথা তুলতে থাকল। মনিকার মোবাইল চুরি হয়ে গেলে এই প্রথম আমি যেচেই ওকে ফোন কিনে দিই। কথা বলা তো মাস্ট, কথা ছাড়া কি কাজ হয়! আর মনিকাও বটে!
মেয়েটাকে এই যেন বুঝি, আবার এই মনে হয় ও যা বলে, যা করে তার কিছুতেই যেন স্থির হয়ে পা রাখা যায় না, নিরুদ্বিগ্ন হবার আরাম আসে না। কিন্তু যে ভরসাটা চাই তা কিসের? আমি কেনই-বা ওকে ওভাবে দেখতে চাই? কি আশ্চর্য দোদুল্যমানতায় সেইসব দিনগুলো কাটত!
যেমন, সেদিন ওর বাড়িতে কেউ নেই। দ্বিতীয়বারের মতো গিয়েছি ওখানে। ওর ছোট ভাই, মাকে নিয়ে গেছে গাজিপুরে ওর এক বোনের বাড়ি। মনিকাও ছুটি নিয়েছে। সারাদিন কি অপার স্বাধীনতা সেই ছোট্ট বাড়িটায়। ও রাঁধতে চাইল,
— সব তো ঘরে আছে, তোমারে একটা নতুন আইটেম খাওয়াই।
— ধুর! খাওয়া দাওয়ায় আমার কোনো উৎসাহ নাই, একটা কিছু হইলেই হয়।
ওকে জড়িয়ে ধরে রাঁধার প্রবল ইচ্ছা থেকে সরিয়ে এনে শুইয়ে ফেলি। কতদিন পর আমার রক্তে সে কি তরঙ্গ খেলে গেল কে জানে!
বিকেলে পড়ন্ত রোদ পশ্চিমের গ্রিলে ঝুলে আছে অনেকক্ষণ। পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকতে দেয়া হলে চায়ের কাপ নিয়ে সেই রোদের মৃদু ওমে আমরা গা ঢেলে আছি। মনিকা এ কথা সে কথার ফাঁকে আমার প্রিভিয়াস প্রবলেমে ঢুকে পড়ে। যদিও অস্বস্তি হচ্ছিল কিন্তু যে বিষয়টায় ওর আলোকপাত তাতে আমি আর চেপে থাকার কোনো ফুসরতই পেলাম না।

রিয়াদ কি করে এমনটা করতে পারল? কিছুতেই আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে, রিয়াদ বিয়ার খেতে খেতে কত করে আমাকে বুঝাচ্ছে,
— শুরুতেই যা হইতাছে হামাগুড়ি দিয়া দিয়া আগে বাড়াটা বোকামি। আমার অবস্থাটা তো দেখলি, লাইফটা এক্কেরে ঝুইলা গেল। তোর ভাবি তো এক ঘণ্টা পিরিতে থাকে আর এক ঘণ্টায় সব পিরিত খুইলা নেয়। এহন এমন হইছে এইসব না হইলেই বরং অস্থির লাগে, মনে হয় যেন বাইচ্চা নাই। তুই লেইখ্খা রাখ, আমি কইয়া রাখলাম, আইজ হউক কাইল হউক তোর এ বিয়া ভাঙবোই। ও মেয়ে তোরে দাস বানাইতে চায় পারভেজ। আর দাস হওয়ার একটা প্রবণতা তো তোর মধ্যে আছে, তুই নরোম মানুষ। আমি কথা কইছি, বহুত কইরা বুঝাইছি। বাপরে বাপ, অর যুক্তি বুদ্ধির লগে তুই-আমি ফেল।
আমি নিশ্চুপ হয়ে থাকি। রিয়াদ যখন বলে আর থামতে চায় না, ওর বর্ণনায় একটা তামাম উপন্যাস নেমে যায়। খুব গভীরভাবে দেখতে পারে রিয়াদ, বলে,
— আর খামাখ্খা অরে দুইষাই-বা লাভ কি ক? অর বুঝ অর। ঐডা আর এক কিসিমের থট-অর লুক থেইকা অর কথাগুলান তো রাইট বাট তর-আমার থট প্রসেসে হয়তো রং। আরে ব্যাটা যেই প্রবলেমের আইকনে ঢুকছস সেইখানে রং-রাইটের দেওয়াল তুলবো কোন হালায়? ফালাইয়া থো, বউ যায় যাউকগা।
আমি কি করে বোঝাই রিয়াদকে যে, আমার বত্রিশটা বছর ঘোলা জলে ডুবতেছে। ফাইট দেয়ার মতো শক্তি আমার নাই।
কিন্তু আজ এ-কি শুনলাম আমি! আমার প্রচণ্ড ঘোর লাগে। প্রায় নিঃশব্দে রিয়াদই ওকে চলে যাওয়ার সব প্লান ঠিক করে দিয়েছে। কিন্তু কেন? কি লাভ হল তাতে রিয়াদের?
এসব কথাবার্তার অন্তরালে আমার সকল দুর্বলতার কোন্ গোপন ফোঁকর দিয়ে আমার সবকিছু কেড়ে নিল মনিকা। অকস্মাৎ শতচ্ছিন্ন হওয়া একটা মানুষের অভাবিত ভরসা হয়ে উঠল সে। কিন্তু সেটাই-বা বলি কি করে?
দু’একদিন পর যখন খুব করে মনিকাকে আবার চাইলাম ও নিজেকে ঘিরে এক রহস্য তৈরি করল। ফোনে অনেক বিতর্কের পর বলল, ওরকম একটা ঘটনা তো ঘটতেই পারে। এর পুনরাবৃত্তি বা একে জাপটে ধরে একটা আসক্তি বা অভ্যাস রচনা করা একদম পছন্দ নয় তার।
বললাম,
— তুমি কি আমার বন্ধুই শুধু, তার অতিরিক্ত কিছু না? আমার পছন্দ-অপছন্দটাও তো তোমার গুরুত্ব পাইতে পারে, না-কি?
— তাই বইলা তোমার চাওয়াটা আমার উপরে চাপাইবা পারভেজ? যা হওয়ার এমনি এমনিই হবে, না হইলে না হবে।
— না, চাপাচ্ছি না। তবে আমার প্রাণ থেকে যেটা চাইছে তা বলব না? বলাটার মধ্যে তো কোনো ভান-ভনিতা নাই। বিশ্বাস করো?
আসলে আমি নিরুপায় হয়ে উঠছিলাম। আর উপায়হীনের দুর্বলতা তো পায়ে পায়ে। সে তো সব সময়েই নুয়ে পড়ে। কাতর হয়, করুণাকামি হয়ে ওঠে। ফলে এই আমি ওকে প্রায় ত্যাগ করতে বসি, আবার হুট করে ও এমনভাবে আমাকে আগলায় যে, আবারও আমার কাঙালপনা ঘাই মেরে ওঠে। হয়ত পনের দিনেও কোনো যোগাযোগ নেই, ফোন করলেও ধরে না অথচ ঠাস করে আমার অফিসে হাজির হয়।
একদিন এভাবেই এসে বলল,
— আইজ উড়তে খুব মোন চাইছে পারভেজ, চলো না যাই কোথাও।
— কই যাব?
— নৌকা নিয়া ঘুরি বুড়িগঙ্গায়।
আমরা নোংরা জল পেরিয়ে ব্রিজ পেরিয়ে অনেক অনেক দূরের ভয় পাওয়ার মতো নির্জনতায় গিয়ে পড়ি। বাসা থেকে বেড়নোর সময় পানির বোতলে লেবু, লবণ আর ¯প্রাইট দিয়ে ভোদকা গুলে নিয়েছিলাম। বাতাসে নেশাটা পেকে উঠলে মাঝিকে বলি ব্রিজের দিকে আমাদের নামিয়ে দিতে। বুড়ো মাঝি হয়তো আমাদের কাপল ভেবেছিল।
খুব বিনয়ের সাথে বলল,
— মা জননী একটা কথা কই, কিছু মনে কইরেন না। এই বয়সে সিগারেট খাওনটা ভাল না মা, পোলাপান হওনে সমস্যা হয়।
মনে মনে বলি, তুমি মিয়া খালি সিগারেটটাই দেখলা। কিন্তু মনিকার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল বলে খুব ভয় হল। ট্যাক্সি নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে তখন রাত। যে বাড়ির চিলেকোঠায় মনিকাকে চেপে ধরেও আনা যায় না সেখানে কি অবলীলায়, যেন ওর বাড়ি যাচ্ছি, আমাকে নিয়ে হাসতে হাসতে ঢুকে পড়ল মনিকা, জাপটে ধরল মাতালের মতো— লাভ মি প্লিজ। ইউ আর গ্রেট পারভেজ, লক্ষ্মিসোনা, আমারে খেয়ে ফেল না, প্লিজ।
যত অভিমান কিংবা ক্ষোভ অথবা রিরংসা যা কিছু মনিকার জন্য জমা ছিল, যতখানি দূরত্ব আমাদের বন্ধুত্বকে আলগা করে ফেলছিল তা নিয়ে কিছু ভাবার আর কোনো ফাঁকই থাকতে দিল না সে। এই প্রথম আমি অনুভব করলাম, একজন নারীর কাছ থেকে কতখানি পেলে একজন পুরুষেরও সব খোয়ানো হয়। ওর জিহ্বার ডগা আমার কানের ছিদ্রে, বুকের বোঁটায় গভীর স্পর্শ তুলল, এ্যান্ড মনিকা রিপিটেডলি টোল্ড, ইউ নো দা আর্ট ম্যান, ইউ আর গ্রেট। আহ্, লাভ মি প্লিজ।
আমার শ্রবণেন্দ্রিয় জুড়ে সেই সুখশব্দ আজও মোছেনি। কিন্তু কি অদ্ভুত! এতকিছুর মধ্যেও যে নিটোল, নির্মল, অবোধ্য অনলে পুড়ে পুড়ে দু’টো মানুষ খাক হয়ে ওঠে; যে কলায় গড়া যুগলের যেকোনো আহম্মকিই গ্রহণযোগ্যতা পায় আর লোকে বলতে পারে ওরা প্রেমিক, তা সৃষ্টি হচ্ছে কই বা কেনই-বা হচ্ছে না সেই কঠিন প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
কিন্তু মনিকার ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় শুধু আমার প্রবল প্ররোচনায় আমরা বহুবার বহুভাবে মিলিত হয়েছি আর বহুবারই মনে জেগেছে মনিকা তার অলৌকিক নিপুণতায় আমার সকল দুর্বলতাগুলোর সুযোগে আমাকে ব্যবহারিক করে তুলছে যেন! আবার ওর সবকিছুই এত স্বাভাবিক যে, মনে হত এ আমার একপেশে ভাবনা শুধু, কেননা ওকে পাবার জন্য, ওর মধ্যে মুখ থুবড়ে থাকার জন্য কত কায়দাই না তৈরি করেছি আমি। যে সারল্যে গভীর আঁধারও আলোর অধিক হয়ে ওঠে তার সন্ধান কে না চায়?
মনিকা একদিন ঝট্ করে বলে ফেলল,
— জান আমার মধ্যে কেমন বেশ্যামোর আসর আছে। এমন ঘেন্না লাগে! ওর এ কথায় আমি কেমন নুয়ে পড়ি। বলি,
— পৃথিবীতে এমন অনেক ভাবনা আছে যা সুস্থ নয়। সে-রকম ভাবনা ভাবতে নাই মনিকা।
আমি আমার দায়বদ্ধতার কথা তুলি। বলি,
— আমরা তো বিয়ে করতে পারি, না-কি? আমার বিবেচনা দীর্ণ করে মনিকা মুচকি হাসে। বলে,
— প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তোমারে কম ব্যবহার করি নাই। সেসব অল্প-বিস্তর তুমি বোঝ না তা-না। আমার উপ্রে তোমার মোহ আছে পারভেজ, শ্রদ্ধা ত্যামোন নাই। এক ছাদের নিচে কি দরকার বল?
বুকের মধ্যে বোম ফাটার আওয়াজ পেলাম। মনে হচ্ছিল আমি হেরে যাচ্ছি। তলে তলে এরকম একটা প্রতিযোগিতা কিংবা পুরুষানুক্রমে পেয়ে-আসা চরিত্রের পুরুষভাব আমাকে বড়ই বেদনার্ত করে তুলল।
বড়ই বিপন্ন এই আমি এখন কি করি? কিভাবে ওকে আমার চাওয়ার মতো করে তোলা যায় সে জন্যে মরিয়া হয়ে উঠলাম আমি।
যার ওপর ভর করে সেই স্কুল থেকে এই অবধি এসেছি, একটা মেয়ের কথায় এতদিন কেন তাকে এভাবে এড়িয়ে চলছি? নতুন করে আমার এই বোধ জন্মালো যে, রিয়াদের সাথে কথা বলা দরকার। জানা দরকার ও কেন মরিয়া হয়ে উঠেছিল আমার স্ত্রীকে আমার থেকে সরিয়ে নিতে।
কোথায় আমার বন্ধু আমাকে ধৈর্যের অংক শেখাবে, সব সয়ে সংসারটা টেকানোর শক্তি যোগাবে তা-না, বরং উল্টো ঘটনার রহস্য উন্মোচনে আমি অধির হয়ে উঠি।
একটা বারের প্রায়ান্ধকার কোণে আকণ্ঠ গিলে রিয়াদ আবেগ সামলাতে পারে না। আমিও বেজায় কুণ্ঠিত, আর্ত। রিয়াদ জড়ান গলায় বলে,
— আমার ভুল হইতে পারে কিন্তু যা করছি তা তোর ভালোর কথা ভাইব্বাই। সম্পর্ক যদি একগাছা সুতায়ও বান্ধা থাকে তা ছিন্ন করা ঠিক কি বেঠিক সে জ্ঞান লইয়াই বলি, যা করছি তোর ভালোর কথা ভাইব্বাই।
এতকথার মধ্যে এমনভাবে রাত-দুপুর হয়ে এল যে, আমিও তখন চুরচুর কিন্তু একটিবারের জন্যও রিয়াদ মনিকা বিষয়ে কোনো বাক্য তোলেনি। যাওয়ার বেলায় শুধু কাছে ডেকে আমার কাঁধে হাত রেখে টলতে টলতে বলল,
— তোর কপালডা খুব খারাপ দোস্ত। পারলে মনিকারেও ছাইর‌্যা দে।
আমার হুঁশ ছিল না যে, ওকে কিছু বলি। ফিরে এসে নেশাগ্রস্ত আমার কিছুতেই ঘুম এল না। এত একা লাগছে, এমন বিপন্ন হয়ে আছি, আঁচলহারা ছেলেবেলার মতো। এতকাল পর কেন যেন ছায়াচ্ছন্ন, ধুলোর আস্তরে ঢাকা, ভুলতে বসা আমার মৃত মায়ের মুখখানা চোখের কোণায় জমা জলবিন্দুতে ভেসে উঠতে চাইল। খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করে আমার, কিন্তু চাইলেই কি কাঁদা যায়?

বর্ষ ৫, সংখ্যা ৮, ফেব্রুয়ারি ২০০৬

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার