মাথার মধ্যে কবিতার অন্ত্যমিল বসন্তের ঝুনঝুনি পোকার মতো ঝুনঝুন করে। কাঠ চেরাইয়ের শব্দের মতো গুঁতা দেয়। কাঠের গুঁড়ির কণার মতো লাইনগুলো উড়ে। তারপরও বুকের মধ্যে কফ জমে যাওয়ার মতো কষ্টগুলো সারাদিন বয়ে বেড়ায়। আসন্ন সন্ধ্যা তাঁর গলায় আলো-আঁধারের মালা পরায়। তিনি নত মুখে বসে থাকেন। গত রোববারেই এসেছিল তারা তিনজন। আজ বুধবার। দু’জনের চোখে কপট ভক্তির হাসি ছিল। বলছিল, দর্শক যা চায় তাই মাইরা দিয়েন। টাকাও কিছু দিয়ে গেছে। এদিকে ছেলের ডায়রিয়া। বউ সন্তানসম্ভবা। অসুস্থ।
বায়নার টাকায় আজ চাল কেনা হয়েছে। বউয়ের ওষুধও। শরীর সরলেও মন সরতে চায় না। মনে যেন কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে।
বউ অনুচ্চ কণ্ঠে বলে, য, ন অলি…
কথা কেড়ে নিয়ে চক্রপানি বলেন, আসলে… থেমে যান। কি?
তোঁয়ার নাক কাডি ঘরত রাখি য। মুখ ফিরিয়ে বউ অনুচ্চ বলে, আগে বাঁচন দরকার।
তাঁর মনে হয় বউয়ের মুখ দিয়ে কথা নয়, ডায়রিয়ার নরম-পায়খানার মতো কিছু বের হচ্ছে। তিনি বলেন, আঁর পেট নরম অইয়ি। উঠে বদনা হাতে নেন। ভাবেন, টাকাগুলো কাল ফেরত দিয়ে আসব।
এদিকে আরেক কবিয়ালের মন ঘামছে। এক ঘণ্টা লেট। অনুষ্ঠান শুরু করা যাচ্ছে না। ঢোলক ঢোল বাজায়। দোহারদের কয়েকজন মৃদঙ্গ, দোতারা ও হারমোনিয়াম বাজায়। আর মুখে তাইরে নাইরে গায়। কবিগান শুনতে এসে লোকেরা রাগে ঘামছে। চৈত্রের খরতাপের মতো ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ শুনে মঞ্চে ওঠেন কবিয়াল। তার প্রতিপক্ষ নেই। লোকেরা ক্রমশ অসহিষ্ণু। কবিয়ালের মনও অস্থির। ভাবেন, কাব্য লড়াই না করে আজ রূপকথার পৃৃথিবীতে বেড়াবেন। তিনি ঠিকানাবিহীন কোনো সময়ের দিকে চলে যেতে চান বাল্যের রূপকথার মতো। দর্শকদের ভিতর ঢুকে গেলে কেমন হয়! তাকান ঢোলকের দিকে। বিনয় এদিকেই তাকিয়ে ছিল। সংকেত পেয়ে বিনয়ের ঢোল বেজে ওঠে। ঢোলের এই আওয়াজ মহিষের শিঙ হয়ে দর্শকদের গুঁতা মারে। কবিয়াল দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ভাবেন, মানুষের মন কোথায় যে চলে যাচ্ছে। বলেন, আমার মাথার ভিতর গানের দেশ।
দর্শকের গা যেন ঘামাচিতে ভরা। কবিয়াল বলেন, পৃথিবী গিলে খাবে একেকজনা/ সুরের কথা কেউ ভাবে না।
দোহাররা কণ্ঠ ঝালাই করে, পৃথিবী নামক একটা গ্রহে ব-এর মতো একটা দ্বীপ ছিল। সেই ব-দ্বীপে কবিগান নামে এক ধরনের গান গাইত কতিপয় লোক। একসময় হিসকো-বিসকো ধুমধাড়াক্কা এসে কবিয়ালের কণ্ঠে ছাই মাখিয়ে দিল। গান গাওয়ার লোকগুলো ভাঙনের নদীর পাড়ের ভেজা মাটির মতো জনতার জলে ডুবে যাচ্ছে।
এ কণ্ঠের প্রতিবাদেই যেন বিনয়ের ঢোলে একেকটি শব্দ জেগে ওঠে। কবিয়াল বলেন, ভাবা যাক একটি আসরের কথা।
এক দর্শক বলে, রঙ তামাশা পাইয়ুছ?
আরেকজন বলে, এ্যাই মার মার।
একজন তেড়ে আসতে চায়, ধর হালার পোয়াঅলরে।
কবিয়াল তখন বলেন, আমি মারব। সুর করে গান ধরেন, মারব ওরে আমার মন পাখিরে।
দোহাররা গায়, মন আমার কেন পাখি হয়ে যায়।
কবিয়াল প্রশ্ন করেন, তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা?
দোহারদের একজন বলে, রক্ত আছে লাল নেই।
আরেকজন বলে, রাক্ষসের রক্ত জন্ডিসের রঙের মতো।
তখন বেজে উঠে ঢোল। এক দোহার চোখ বড় করে বলে, এই ঢোল বাজাতে পারে কেবল একজনা। এখন তার কথা তোমরা ভেবো না। এখন নাইকার গ্যাসের মতো, ইউনোকলের আগুনের মতো জ্বলছে ঢোলের আওয়াজ। জ্বলছে পাহাড়, গাছপালা, মানুষের মন, বিনয়ের হাত। জ্বলছে কানসাটের মানুষের হাত। জ্বলছে নাচোলের কৃষকের কাস্তে। আরে ভাইয়েরা কথা বলো আস্তে।
কবিয়ালের চোখের কোণে যে বাষ্প জমে তার থেকে মেঘ হয়। মেঘ কবিয়াল হেসে নিজেকে উড়িয়ে দিতে চান। মেঘডম্বুর কণ্ঠে কবিয়াল বলেন, এক দেশে এক রাজা ছিল। রাজার ছিল ছয় কন্যা। তারা সবাই ছিল রূপসি। তারপরেও রাজার মনে শান্তি ছিল না। পুত্র চাই, পুত্র চাই। পুত্র ছাড়া গতি নাই। রাজা রানিকে নিয়ে এর কাছে যায়, ওর থেকে ধায়। ডাক্তারের কাছে যায়। বদ্যি চিবিয়ে খায়। পীরের পানিপড়া আনে। পুত্র তাকে পেতেই হবে। শেষে খবর আসে, শুনে প্রাণ হাসে। যায় গভীর জঙ্গলে, আশা এক মঙ্গলের। সাধুর কাছে গেল, বোধ হয় কিছু পেল।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বলল সাধু, তোমার হবে এক বানরপুত্র।
রাজা-রানি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। একদিন রানির কোল জুড়ে এক বানরপুত্র এল। বড় হতে লাগল রাজপুত্র। সে খুব দুষ্ট। এদিক লাফায়, ওদিক গুঁতায়, বোনকে দেয় কষ্ট। দুষ্টুমি করলেও সে তার বোনদের খুব ভালোবাসে। কিন্তু ছয় রাজকুমারি বানর ভাইকে দু’চোখে দেখতে পারে না।
একদিন ছয় রাজকন্যা বাবার কাছে গেল। রাজা বলে, ব্যাপার কি বলো?
রাজকন্যারা বলে, শুধু ঘরে বসে থাকি, মনকে কেবল দিই ফাঁকি।
রাজা চিন্তায় পড়ে।
রাজকন্যারা বলে, আমরা সাত সমুদ্র তের নদী বেড়াতে যাব।
রাজা বলে, ওখানে অনেক বিপদ আপদ।
তারা বলে, আমরা এর বিরুদ্ধে হব শ্বাপদ।
রাজা বলে শেষে, তবে ভয় আর কিসে। রাজা তের নদীর ব্যাপারে তার মেয়েদের সাবধান করে দেয়। বলে, রাক্ষসপুরি আছে দক্ষিণে, খবরদার ওদিকে যাবিনে।
কন্যারা বলে, তের নদীর পানি যদি হয় লাল, তবে মহারাজ ছাড়িয়া দিও হাল।
রাজকন্যারা ভাইকে নিতে চায় না। বলে, তুই করবি দুষ্টুমি।
বানরপুত্র বলে, করব না তো করব না।
তবুও নিতে চায় না তারা। তাদের যাত্রায় আছে তাড়া। কাঠের জাহাজে চড়ে, বানর ভাই জোর করে। তারা যাত্রা করে। সাত সাগর বারো নদী পার হয়। কত কি দেখল! কত কি শুনল! সেই সব বলে শেষ করা যাবে না। এবার তের নদী পার হচ্ছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এ সময় এল ঝড়। ধরার নেই কোনো কুটাখড়। ঝড়ে তাদের কোথায় নিয়ে গেল তারা জানে না। একসময় জাহাজ তীরে আছড়ে পড়ল।
তারা হাঁফায়। এদিক তাকায়, ওদিক তাকায়, কোথাও প্রাণের লক্ষণ নাই। হঠাৎ বলে বানর ভাই, ঐ যে আলো দেখা যায়।
তারা আলোর দিকে চলল। যেতে যেতে একসময় পৌঁছল। সেটা ছিল কাঠের একটা ঘর। সেখানে সুন্দরি নারীর রূপ ধরে বাস করে এক রাক্ষসি। আর এটা যে রাক্ষসের দেশ তা তাদের জানার কথা নয়।
ছয় রাজকুমারি বলল, আমরা বিপদে পড়েছি।
সুন্দরি নারী বলে, আহারে বাছা! এসো, আমার কাছে থাকো। তোমাদের নেই কোনো অসুবিধা।
রাক্ষসি তাদের খেতে দিল, পরতে দিল, অনেক খাতির করল। ভাল ভাল কথা বলল। মজার মজার গল্প শোনাল। বিছানা দিল। বলল, ঘুমিয়ে পড় বাছারা।
রাজকন্যা ও তাদের বানর ভাই যখন কাঁথা মুড়ি দিতে গেল, রাক্ষসি হায় হায় করল। করো কি! করো কি! পারবে না ঢাকতে মাথা, বুক পর্যন্ত দেবে কাঁথা।
রাজকন্যারা বলে, আমাদের শীত করে।
রাক্ষসি বলে, এখানে শীত সরে।
এক দর্শক অকস্মাৎ ঠাট্টা ও শিস দেওয়া কণ্ঠে বলে, আইরে! হিতে ত কবিয়াল ন, হিতে গবিয়াল। কিস্তে কই আঁরারে ভারার।
বুড়ো হামদু বলে, ওয়া গপ ন মাইয্যু। কবিগান গও।
তখন কবিয়ালের মনের মধ্যে রমেশ শীল, গঙ্গাচরণ, মোহন বাঁশি সুর তুলতে চায়।
ঐ দর্শক গায়, খাইরুন তোর লম্বা মাথার চুল। সবাই বেপরোয়া হাসে।
লোকটার বন্ধু সাহাব মিয়া মোটা গলা টানে, ও মেরে পে-য়া-য়া-র।
তাদের পাশের বাড়ির রাজমিস্ত্রি বলে, বল রাধা বলরে, কোথায় যাইয়া খামুরে। এটাকে রাজমিস্ত্রির হেলপার টেনে বলে, ও মামুরে …
মুখ লুকিয়ে একটা কণ্ঠ কাঁদো স্বরে গায়, হাম্মা হাম্মা। হাম্বা-আ-আ-আ স্বরে ডাকে তোফেলের পাগল ছেলে। আরেকজন গায়, বলদ মহিষ খাইলরে/কান আমার ধাইলরে। তাকে শেষ করতে না দিয়ে পশ্চিম পাড়ার সুলতান বাংলা মদ খেয়ে আসা কণ্ঠ দিয়ে গায়, দিলছে দিল মিল গিয়া/ তু হে মেরা দিলরুবা।
সুলতানের বন্ধু বেঁটে হাফিজ বলে, ও মেরে জান, জান লিয়া!
ভ্যাবাচ্যাকা কবিয়াল এতক্ষণ পর দৃঢ় স্বরে বলেন, আমার আছে একটি নাও।
ঢোলের আওয়াজ কথা কয়, দিলাম তোমারে। ঢোলের শব্দ এবার বলে, নাও চালাইয়া যাইব মনের বাড়ি/ খাইব মুড়ি ঝুড়ি ঝুড়ি।
কবিয়াল গায়, আয়রে জোনাকিরও আলো দেখিব/ ব্যাঙের ডাক শুনিব/ মেঘের কথা কহিব।
এখন এই রাতে হ্যাজাক নয়, টিউব জ্বলছে। টিউবের আশপাশে পোকারা মৃত্যুর খেলা খেলছে।
বুকটা ফাইট্টা যায়— এই সুরে মিজানের গলা দর্শকদের বাড়ির সামনে দিয়ে বউ নিয়ে হেঁটে যাওয়ার গল্প শুনালে লোকেরা হৈ কুউ শিউ টিউ কুকু কু সুসময়ের কোকিল হয়ে খ্যাকখ্যাক হাসে। তাই তরুণটা গলা ফাটিয়ে বলে, গেলামরে মর্জিনার বাপ, মর্জিনার লগে করমু পিরিত। উহু হু, লা লালা লা, হুক্কা হুয়া কেয়া মজা…
মাঝের পাড়ার লোকমানের চোখে-মুখে, কণ্ঠে রস, পোয়া খায় চনাবুট/ বুড়া খায় হুড়–ম/ পাদে য্যা দুড়–ম দুড়–ম। সবাই মরা পাদের শব্দের মতো ফুস ফুস হাসে।
তখন কবিয়াল বলেন, জীবনে অনেক ছন্দ আছে।
আড়াল থেকে মর্জিনার বাপ বলে, চাঁদের অনেক মন্দ আছে।
কবিয়াল হাসেন। ঢুলিকে ইশারা করে বলেন, এ কথায় সন্দেহ আছে। বলেন, সন্দেহতে মন কেন দাও/বাওরে বাও কইও না তো ফাও/কেন বেদিক পানে চাও/নিজেরে আলুর ভর্তা বানাও!
ঢোলের শব্দ এখন মানুষের দৃঢ়তার মতো। ঢোল এখন মানুষের মতো দাঁড়িয়েছে।
মনভাঙা কবিয়াল বলেন, শোনেন সবাই মনন দিয়া শোনেন: রাজকন্যারা চুপ করে থাকে। বানরপুত্রের কেমন যেন সন্দেহ হয়। রাক্ষসি চলে গেলে সে এক লাফে যায় ছাদে। ছাদের অবস্থা দেখে কাঁদে। মুখ দিয়ে কথা সরে না। ধীরে-ধীরে নেমে আসে। ভয়ে বোনেরা চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। তাদের ডাকে। বলে, সর্বনাশ!
বোনেরা ফিশফিশিয়ে বলে, একটু ঝেড়ে কাশ!
ছাদে মাথার খুলি, হাড়, পচা মাংস, মাছের আঁশ।
এ্যাঁ! বোনেরা ভয়ে জড়োসড়ো। ভাইকে বলে, কিছু একটা করো।
বানরপুত্র কানে কানে বলে, আমার মনে হয় এটা রাক্ষস।
এখন আমাদের কি হবে? রাজকন্যারা জিজ্ঞেস করে।
তখন দরজায় শব্দ হয়। তারা দৌড়ে যার যার বিছানায় যায়। চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে শুয়ে থাকে। বানরপুত্র এক লাফে ছাদে উঠে যায়।
রাক্ষসি ঘরে ঢোকে। এদিক ওদিক চোখ বুলায়। রাজকন্যাদের কাছে আসে। তাদের মাথা মুখে হাত বুলায়। বলে, আহা বাছাদের কষ্ট হচ্ছে। কাল ভাল বিছানা করে দেব। আরাম করে থাকবে। মনে মনে বলে, কাল তোদের একেকটাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাব। তোদের খেতে খুব মজা হবে।
রাজকন্যারা তো তখন ভয়ে কাঁপছে। মনে হল রাক্ষসি তাদেরকে গপাগপ খাবে। খাওয়ার আগে ভাল করে দেখে নিচ্ছে। তারা মনে মনে কাঁদে। আফসোস করে, কেন বাবার কথা শুনলাম না! ঝড়ের কান টানলাম না।
রাক্ষসি এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, বানরপুত্র গেল কোথায়? তারে কেন দেখি নাই?
বানরপুত্র তখন ছাদ থেকে মুতে দেয়। গড়িয়ে তা রাক্ষসির গায়ে পড়ে। রাক্ষসি বলে, এ্যাঁ! পানি পড়ে কেন? বৃষ্টি হচ্ছে না-কি! তারপর জিজ্ঞেস করে, বানরপুত্র তুমি কোথায়?
বানরপুত্র অনুচ্চ কণ্ঠে বলে, আমি মাথায়।
ওখানে কি করছ? আস নেমে। একটু অবাক হয় রাক্ষসি।
বানরপুত্র নেমে এসে বলে, আমার পেশাব ধরেছিল।
বলিস কিরে হারামজাদা গফরগাদা! রাক্ষসি তার চোখ নাড়ে, সুন্দর কাপড় ঝাড়ে। শোঁকে গন্ধ। বানরপুত্র দেখে রাগে সে অন্ধ। কঠিন স্বরে বলে, যা দুষ্ট যা ঘুমাতে। মনে মনে বলে, হাড় মাংস পিষব, এই শয়তান আগে খাব।
রাক্ষসি যায় চলে। দরজা বন্ধ হয়। সাথে সাথে তারা জড়ো হয়ে কয়, হায় হায়! কি উপায়! বানরপুত্র বলে, আমি রাক্ষসির গায়, মুতিয়া দিয়াছি তাই।
রাজকন্যারা হাসে। বানরপুত্র কাশে, তোমরা চুপচাপ থাক বসে, দেখি আমি মগজ ঘষে।
বাইরে বেরিয়ে দেখে চারদিকে আঁধার। অদূরে একটা ঘরে আলো জ্বলছে। ভাবে, এটা নিশ্চয় রাক্ষসির ঘর। এত রাতে কি করছে? যাই, দেখে আসি। চুপে চুপে যায়। কাঠের বেড়ায় জোড়ার ফাঁক দিয়ে দেখে এক পাশে আগুন জ্বলছে। তাপ তার মুখে এসে লাগছে। আর রাক্ষসির হাতে ইয়া লম্বা একটা ছুরি। ধার দিতেই আছে। তার মুখটা এখন কদাকার। সামনের দাঁতগুলো লম্বা লম্বা।
বানরপুত্র আরেকটু হলেই চিৎকার দেয় আর কি। তার কলজে কাঁপে। নিচে মাটিতে বসে পড়ে। তখন শুনে রাক্ষসি হি হি করে হাসছে। সে কান পাতে। শোনে, রাক্ষসি আপনমনে সুর করে বলছে, ছুরি ধার হইছে। আগুনে লাল করমু। ঐ ঘরে যামু। পোশাক পাল্টামু। চেহারা পাল্টামু। যাদুর ছুরি হাতে নিমু। তারপরে খা—আ-মু। খামু তো খামু। হি হি হি।
বানরপুত্র আবার উঁকি দিয়ে দেখে রাক্ষসির মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। পড়েই লালাগুলো আগুন হয়ে যাচ্ছে। সে দিল এক দৌড়। গেল তের নদীর পাড়। দেখল নদীতে জোয়ার। জাহাজটা আছে ঠিক। ভাবল, পেতে হবে দিক। উঠল জাহাজে। জ্বালাল বাতি।
সব ঠিক করে রেখে আবার দৌড়। কত জায়গায় যে হোঁচট খেয়েছে তার ঠিক নেই। একসময় বোনদের কাছে পৌঁছল। হাঁফাতে হাঁফাতে তাদের সব ঘটনা বলল। তারা চিৎকার করে কাঁদবে-এমন অবস্থা।
বানরপুত্র তখনই বোনদের জাহাজে চলে যেতে বলল। সে কি করবে তা-ও জানাল। চুপে চুপে গেল রাক্ষসির ঘরের সামনে। দেখল ধারালো ছুরিটা রেখে রাক্ষসি উঠছে। বুঝল পোশাক পাল্টাতে যাচ্ছে।
সে সাবধানে গিয়ে ছুরিটা নিল। তারপর জীবনের সেরা দৌড় দিল।
রাক্ষসি সুন্দরি নারী হয়ে এসে দেখে ছুরি নাই। সাথে সাথে চেহারা পাল্টে ভাবে, কিভাবে যাই? দৌড়ে গেল রাজকন্যাদের রাখা ঘরে। শূন্য ঘর দেখে বুঝল সব বানরপুত্রের কাজ। বলে, এবার তোদের পরতে হবে মৃত্যুর সাজ।
ওরা জাহাজ ছেড়ে দিল। পানি হচ্ছে এই রাক্ষসির যম। তার সব বাহাদুরি স্থলে। রাক্ষসির পা তো, দুই লাফে জাহাজের নোঙর ধরে ফেলে। নোঙর বেয়ে উঠছে।
বানরপুত্র ও রাজকন্যারা তৈরি হয়েই ছিল। কবিয়াল হেসে বলেন, একবার বানরপুত্র মায়ের কাছে গল্প শুনেছিল, রাক্ষসির প্রাণ থাকে নাকের মধ্যে। কথাটা মনে পড়ল। সে করল কি, ছুরিটা রাক্ষসিকে দিয়ে দিচ্ছে, এমন ভঙ্গিতে কাছে এগিয়ে গেল। তারপর? তারপর সে এক কোপে কেটে ফেলল রাক্ষসির নাক। ওরে বাতা, ওরে মাতা শব্দ করে রাক্ষসি পড়ে গেল। তারা ধরাধরি করে রাক্ষসিকে নদীতে ফেলে দিল। পানি সাথে সাথে লাল হয়ে গেল। রাক্ষসি মরে গেল।
এদিকে সৈন্যরা এসে রাজাকে খবর দিল, তের নদীর পানি হয়ে গেছে লাল। রাজবাড়ির সবাই পরল কান্নার জাল। রাজা বলল, সেনাপতি যাত্রার আয়োজন করো। রানি বলল, কয়েকটা দিন সবুর কর।
রাজা জিজ্ঞেস করে, কেন?
রানি বলল, আমার মন কিছু একটা বলছে।
সেই রাতে রাজা স্বপ্নের ভিতর নিজের মরা দেহ নিজে কবর দেয়।
সাতদিন পর ছয় রাজকন্যার লম্বা কেশ, বানরপুত্রের আনন্দ বেশ, দেখে রাজার দুঃখ শেষ। রাজবাড়িতে আনন্দবন্যা। রাজকন্যারা রাজাকে সব কথা বলল খুলে। রাজা বলল, একটা কথা যাইও না ভুলে। শুধু রূপ থাকলে হয় না। বুদ্ধিও থাকতে হয়। বুদ্ধি ছাড়া মানুষ তো আর মানুষ নয়।
একদিন সকালে রাজকন্যারা অবাক হয়ে দেখে, তাদের বানর ভাই খুব সুন্দর এক রাজকুমার হয়ে গেছে। তাদের আনন্দ আর দেখে কে!
দর্শক চিৎকার করে বলে, আমরা দেখব।
আবার মোষের মতো তেড়ে আসে বিনয়ের ঢোলের শব্দ। কবিয়াল বলেন, শোনেন বর্তমানের রূপকথা। রাজকুমার এখন বড় হয়েছে। সে বাবার আদরে ছিল। মায়ের আদরে ছিল। বোনদের আদরে ছিল। সে নিজের আদরেও ছিল। ফলে মাথায় ছিল আদরের কেক। কেক খেয়েছে আর খেতে খেতে সে ধরেছে ভেক। ছিল না কোনো চেক। আস্তে আস্তে সে হয়ে উঠল অনেককিছুর নিয়ন্ত্রণকর্তা। আহ ক্ষমতার ভর্তা। তাই সে সর্তা খাল দিয়ে তার ভ্রমণ শুরু করে। সে দেশের নদীগুলোতে কর্ণফুলির সাম্পান নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এ খবর আবু তাহেরের জানা নাই।
দর্শক জিজ্ঞেস করে, আবু তাহের কেডা?
কবিয়াল দর্শকের দিকে তাকিয়ে হাসেন। অনেকক্ষণ পর বলেন, তোরার চগুত মেডা।
একটু পর বলেন, বোয়ালখালির ঢুলিরা, খাতুনগঞ্জের কুলিরা, রাজনীতির বুলবুলিরা বাবুল জলদাশের ঢোলের ভিতর ঢুকিয়া যা। ঢোল বাজাইতে বাজাইতে চুল পাকিল। ৫ ও ৬ এপ্রিল কবিগান হইবে। ঢোল বাজিবে, মাইক বাজিবে, বাজিবে মানুষেরও মন। ফাটিয়া যাইবে সৌন্দর্য, তোর আমার মন বড়ই কদর্য, সবকিছু অসহ্য। ফাটা মন হইতে বাহির হইয়া আসিল রাজকুমারেরও গল্প।
এবার ঢোলে কয়েকটা জোর টোকা দেয় বিনয়। তার মুখ ঢোলের কাছাকাছি। মুখে তীব্রতা। যেন ঢোল ফাটিয়ে ফেলবে।
তখন কবিয়াল সুর করে বলেন, শোন, মন দিয়ে শোন, প্রাণ দিয়ে শোন, শোনরে সকল কিছু দিয়া।
দোহারগণ ধুয়া ধরে, সকল কিছু দিয়া।
কবিয়াল বলেন, এখন নতুন কাল। রূপকথার নতুন জগৎ। সেই রাজকুমার এক রাক্ষসিকে বিয়ে করেছে। রাক্ষসি জন্মেছে রক্তের ফোঁটা এবং তের নদীর পানির মিশ্রণ থেকে। এই রাক্ষসি গোপনে ডিম পাড়ে রাজ্যের মানুষের মনে। মানুষের মনের ভিতর অনেক অনেক রাক্ষস জন্মেছে।
তিনি বলেন, বেশি ভাল কথা যে বলে/ থাকে সে ভাই ভেজালে। শোনেন ভাইয়েরা, ছয় রাজকন্যার গায়ে রাক্ষসের রক্ত লেগেছিল। মহাধুমধাম করে তাদের বিয়ে দেওয়া হয় রাজ্যের ছয় লুটেরার ছেলের সাথে। তারা ছয়টি রাক্ষস ছেলের জন্ম দেয়। রাক্ষসের সাথে তাদের গলায় গলায় ভাব, তাই তোমাদের বেঁচে থাকা পাপ।
দর্শকেরা হতবাক।
ঢোলের শব্দে জেগে উঠে মনপাখিকে বাঁচানো যায়। ঢোলক এ বাজনা শোনায়। বাজনার সুরের ভেতর কবিয়ালের কণ্ঠ পাখি হয়ে বাঁচতে চায়। দর্শকের মনে জেগে ওঠে আশা। তারা বলে, ওরে ঐ ভাসারে ভেলা ভাসা।
বর্ষ ৬, সংখ্যা ১১, ফেব্র“য়ারি ২০০৭