মঙ্গল খাঁ-র বাড়িতে ঢোকার সময়ে দপদপ করে ওঠে দোলননাহারের চিকনাচাকনা পা-জোড়া, তার পায়ের এই থপাসথপাস শব্দে যারা দহলিজে বসে আকাশবাণীতে শুনছিল কানের লতি পর্যন্ত জুলফি রেখে দেওয়া পাক-আর্মিদের অত্যাচার নির্যাতনের নানা ফিরিস্তি, প্রথমে তারা একটু ভড়কেই যায়, কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরেই সে যখন সবাইকে চমকে দিয়ে ফকফক করে হাসতে থাকে, ছেলাম জানায়, কুশলাদি জিজ্ঞেস করে, তখন তার রিনিরিনি কণ্ঠ উপস্থিত সকলের আঁকাবাঁকা চাহনির তলায় পিষ্ট হতে হতে কেমন জানি নেতিয়ে পড়ে।
অবশ্য দোলননাহার ভাবতাছিল গতকাইলকার কথা। সদরগাটেরত্তুন সে যখন লঞ্চে ওঠে, তখন থেকেই পাড়া-পড়শিদের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াসমূহ তার নাড়িভুড়ি ধরে গুঁতাগুঁতি করতাছিল। দোলননাহারকে একনজর দেখার জন্য মানুষজন চাদ্দিক খেকে ধড়ফড় করে ছুটে আসবে, আর ফোঁড়ন কাটবে না য়েসিনের প্রসঙ্গ পেড়ে, উঠতি বয়সের ছোকরারা বাড়ির সামনে কারণে-অকারণে ভিড় করবে আর তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তামশা মারবে। খনকারবাড়ি থেকে হাসনাআফার দাদি আসবে পোলার ঘরের নাতিরে লইয়া, কোঁচকানো কপালখান আরো কুঁচকিয়ে সে রয়ে রয়ে বলে যাবে একরাজ্যের বিত্তান্ত, আর এখনও যে তাকে পাবার উদগ্র কামনা বুকের ভেতরে পোষণ করে বেঁচেবর্তে আছে বয়োবৃদ্ধ মঙ্গল খা, দেখা যাবে তার ট্যারা চোখের নাচনানাচনিও।
বাড়ি আবার কই পাইল দোলননাহার? পাটখড়ির পুরানো চাইরখান বেড়ার উপরে ছনের একখান ছাউনি বসায়া দিলেই যদি বাড়ি হয়া যায়, তো সেই বাড়িতে যে মহিলা চক্ষের দু’কোণে পিচুটি জমায়ে ঝিমুচ্ছে আর বিড়বিড় করছে আর খুকখুক করে কাশছে সারাক্ষণ একা একা, সেই বুড়া দাদির ভাঙাচোরা মুখাবয়বটা দেখতে পাবার আগাম উত্তেজনায় লঞ্চের ডেকচিতে কিম্বা কেবিনে কিম্বা রেলিং ধরে ঘুরঘুর করতে করতে পুরোটা রাতই কেমন এক ঘোরের মাঝ দিয়া কেটে গেল। কিন্তু কুকুরের পেটে কি আর ঘি-পুলাও টেকে, কলেরা হয়া যায় না? বেয়ানবেলা বাড়িতে পা রেখে দোলননাহার যখন মজা পুস্কনিটার পুব পাড়ে যেখানে আখক্ষেত ছুঁই ছুঁই কদমগাছটা ছিল, তার নিচে একটা কবর দেখতে পেল, আরো দেখল ওই কবরের দলা দলা মাটি ঢেকে দেবার জন্য ইতোমধ্যেই সেখানে গজিয়ে উঠেছে ঘাসের দঙ্গল, এবং এর আরো কিছুক্ষণ পরে যখন বিস্ময়াহত চাচাত বাই আর চাচাত বাইয়ের স্কুলপড়ুয়া পোলার কাছে দাদির মৃত্যুসংবাাদ শুনতে পেল সে, দাপাদাপির সেই যে শুরু হয়েছিল না, তারপর আস্ত একটা দিন গেল, বেলাও এখন পেরায় ডোবে ডোবে, অথচ কল্পিত চিত্রের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিলই সে ঠাহর করতে পারতাছে না। খাঁ বাড়ির দহলিজটাতে এই যে এখন সারা গেরামের মানুষজন কপালে ভাঁজ তুলে ট্রানজিস্টার শুনছে আর নিচুগলায় গমগম করছে— কোথায় তারা একথা সেকথায় দোলননাহারকে অতিষ্ঠ করে তুলবে, কামনার ভাব জাগিয়ে একজনের গায়ে আরেকজন ঢলাঢলি করবে আর ফাঁকে ফোকরে দুয়েকজন আবার রঙ্গরসের কথা তুলবে, তা না, মর্দামি হারিয়ে মানুষগুলানও কেমন চৌদ্দ মইনা বস্তা।
অবশ্য এ রকমই তো হওয়ার কথা ছিল। বাড়িতে আসার এই ক’দিন আগেও তো দোলননাহারের সঙ্গে নুরুসলামের কথা হয়েছে এ ব্যাপারে, ধম্মের বাই কোলাম তুমারে, দুই চক্ষে যা দেইখলা, মরি গেলেও ইকথা য্যানো কেউ না জানে। মাথায় হাত দিও কও, ইকথা তুমি কাউরে কইবা না। কিরা কাইটা কও, যদি কই, তয় য্যানো কবরে আমি মাটি পাই না। কও।
দোলননাহারকে অভয় দিয়ে নুরুসলাম আবার সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, দুলু তুই অবিশ্বাস করছিস আমারে? ঠেকা বেঠেকায় তোর নুন খাইয়া বাঁচি, আর তুই কস, ইসব আমি ফাঁস কইরা দিমু, পাগোল অইছিস? এই তোরে ছুঁইয়া কলাম, কইবো না, মইরা গেলিও না। গেলবছর ঐ যে মোতালেফ কাকা একবার আইছিলো পাড়ায়, মনে আছে? রতœা না বন্নির ঘরে ঢোকার সময়ে ক্যামোন কইরা তোরে জানি দেইখা ফালাইল। আমারে একপাশে ডাইকা নিয়া তখোন কি কইছিলো জানোছ, কইলো, ও নুরু, আমাগো দুলুনের মতোনই টকটকা ফরসা, গোলগাল চেহারার একটারে দেইখলাম কাস্টমারের লগে কি লইয়া জানি বারগেডিং করতাছে, হাছা কইরা ক তো, য়েসিন কি মাইডারে বেঁইচা দিছে কোন নেষদ্ধ জাগায়? এত জাগায় ঘোরোছ-পোরোছ, কুন খোঁজ-খবর পাইছোস? দেখাঠেকা হয় না কুনখানে?
একথা দোলননাহারের এতবার শোনা যে, এর পরের অংশ ইচ্ছে করলে সে নিজেও বলে দিতে পারত। তাই কথা না বাড়িয়ে, লিপিস্টিকে ডুবিয়ে রাখা ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি এনে সে বলেছিল, এ্যাই টাকা ক’টা লও, সাদা দেইখা একটা লুঙ্গি আর একটা পাঞ্জামি লইও আর বাড়ি গিয়া বুড়ারে কইও, আমার একটা চারকি হইছে, সোন্দর একটা চারকি ক্যামোন।
নুরুসলাম বাই বেলাকমেইলিং করতাছে, না পরের টাকায় মোছে ত্যাল দিয়া গেরামছে গেরাম ফুটানি মারতাছে, দোলনাহারের তাতে কিচ্ছুই যায় আসে না। সে যে এখনও গোপন কথাডা ফাঁস করেনি, তাতেই বড় বাঁচা বেঁচে গেছে দোলননাহার। তাইলে কি নুরুসলাম বাই হাছা হাছাই ঘটনাডা চাইপা গেল? এত বালা মানুুষ সে? ট্রানজিস্টারে এখন অবশ্য গতহপ্তায় ইনবারসিটির ছাত্তররা পাকিস্তানি-আর্মিকে ঠেঙ্গানি মেরে কি কইরা ভেলকিবাজি দেখাইয়াছিল, দেশাত্মবোধক গান শোনানোর ফাঁকে ফাঁকে তার ঘোষণা চলতাছে সবিস্তারে। ‘জয়, বাংলার জয়’ গানটা বেজে উঠলে যারা দোলননাহারের সঙ্গে আলাপ জমানোর জন্য উসখুস করতাছিল, তারা এ সুযুগটার সদ্ব্যবহার করে,
পরাণে তোর মায়া দয়া আছে কিছু?
এত সীমার অয় মানুষ?
মাইয়া লুকের এত জিদ বালা না, বুঝলি?
মরবার সুময় বুড়ার ইনাইয়া বিনাইয়া কত কথা, ই মানিকের বাপ, ই ফিরুজের মা, তরা আমার দুলুরে কইছ, অরে তো কোনদিন তেইজ্য করি নাই, যা কইছিলাম, সব তো রাগের মাথায়। আর রাগের সুময় কার চান্দি ঠিক থাকে ক? ই পরশ আলি, তুমারে আমার দুলু খুউব মাইন্য গইন্য করতো, কুনদিন বেদ্দপি করে নাই তুমার লগে। দেখা অইলে অরে তুমি বুঝাইয়া কইয়ো, সব বুইলা গেছি; মাফ কইরা দিছি। যেদিন বুড়া মরবো, তার আগের দিনই তো, হ, ঐ দিনই গাঙ পাড়ে আমার লগে দেখা, ভিক্ষা-ঠিক্ষা করতে কোনখানে জানি গেছিল মনে হয়, কি টনটনা ছিল চাচিজানের শরীলডা, ইস! তিনডা মাস আগে যদি আসতি, না আইসা কি আর পারলি?
ঘরের পুবকোণে অল্পবয়সি দুজন আবার ফিসফাস করতাছিল, দ্যাখ দ্যাখ এক্কেবারে ম্যামসাব। আমার এক খালা আছে, টাউনে থাকে, বিরাট পোরফেসার, দেকতে কি সোন্দর, তারে তো বিদাশি বিদাশি লাগে।
ভিড়ের মাঝখান থেকে অস্ফুট স্বরে হঠাৎ আরেকজন বলে ওঠল, পাছাই একখান, মনে লয়…।
দুলুরে ইঙ্গিত করে তাকে থামিয়ে দিল অন্যজন, জিগাতো, য়েসিনরে মাগি কুনখানে রাইখা আইছে? হুনলাম বরডার পার হওনের সুময় পুলিশ না বিডিআরের কাছে নাকি য়েসিন দরা পড়ছে?
ঘরের উত্তরকোণে কার গলায় যেন আবার দরদ উপচে পড়ল, আমাগো করিম বাই’র মাইয়া দুলু না? কখন আ’লি?
কিন্তু দোলননাহার কি আর তিন বছর আগের সেই দোলনি বেগম আছে, যে, ইসবে তার মন ভেজবে? সে এখন রাতের আন্ধারে একহাতে কড়কড়া টাকা গোণে, আরেকহাতে… হি হি। বলুক না য়েসিনের কথা, তাতে কি গতরে ঠোসা পড়বে তার? টাউনের বাটপার-চোর-গুণ্ডা-বদমাস-সিফিলিস-গনোরিয়া, এমন কি গাল-কাটা পুলিশটা পর্যন্ত, রাতবিরেতে তো তার কাছেই ছুটে আসে, আর বউপোলাফান ফালাইয়া আসেই যখন একটু মহাব্বতের লোভে, কমবেশি তো টাল্টি-বাল্টি করবোই, ডর কও সোম্মান কও, ওই পরথম পরথমই যা একটু ছিল, এখন সব ঠাণ্ডাভাত। চামড়ার মুখ দিয়া যা তা কওন যায়, সব কি ধরে রাখে মানুষ? এই কদিন আগেও তো ব্লাউজের হুক খুলতে না খুলতেই ঘামের উৎকট গন্ধ লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়ল এক চাইর আঙুইলা পোলা, কত আর হবে, বারো কি তেরো, কোমর সমানও হইবো না, কথা তো না, এক্কেবারে পোড়া মরিচের ঝাল, আইজ তোরে বুকের সাথে পিষ্যা মাইরা ফালামু, সারা রাইত থাকুম, খাইয়া ফালামু। আর কোনো কাস্টমার লইতে পারবি না। কত চাস…? পয়সাকড়ির গন্ধ পাইয়া দোলননাহারও ওইদিন অভিজ্ঞতাপূর্ণ ভঙ্গিতে মেলে ধরেছিল নিজেকে, আমি লাইলি, ই লাইনে বহুতবছর, কাম কইরা চইলা যায় যে যার মতন, মজনু আর পাই না। আইজ মনে চাইতাছে তুমারে খুউব সোয়াগ করি; তুমিই আমার মজনু…। পোলাডা আদর পাইয়া মিনিট দুয়েকের মধ্যেই কেমন ফিউজ হইয়া গেলো। দুনিয়া চড়ায়ে যার এত কায়-কারবার, য়েসিনের কথা উঠতে না উঠতেই সে নিজেই অমন ফিউজ হয়া গেলো ক্যান? ক্যান কাঁপতাছে বুকটা তার চরকির মতন? ট্রানজিস্টারটা আবার গলগল করতে শুরু করে দিয়েছে: বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ, রাজপথে হাসপাতালে গলিত দুর্গন্ধযুক্ত লাশের স্তূপ, অ্যাম্বুলেন্সের উও উও হুইসেল, চারপাশে আতংক উত্তেজনা-গতকাল ঢাকার এই ছিল চিত্র। তখন সকাল সাড়ে ৮টা। কেউ কিছু বুঝার আগেই ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের গেটে এসে আছড়ে পড়ে একটি সাদা রঙের অ্যাম্বুলেন্স। মুহূর্তেই বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে সকালের ঢাকা। আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলতে থাকে ওই অ্যাম্বুলেন্স ও এলোমেলোভাবে পার্ক করে রাখা তিন-চারটি গাড়ি। সোনালি আকাশ কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলিতে ছেয়ে যায়। এ হামলায় মারা গেছে অন্তত ১২ জন। নিহতদের মধ্যে দু’টি শিশু ও ৭ জন মহিলা রয়েছে। আহত হয়েছে আরো ২৯ জন। হোটেল সূত্র থেকে জানা যায়, আহতদের মধ্যে ৫ জন অফিসিয়ালও রয়েছে…। ট্রানজিস্টারটা হঠাৎই বলা নাই কওয়া নাই গ্যাছ গ্যাছ করে ওঠে। দাঁত-মুখ খেঁচাইয়া কে যেন বলে ওঠল, মুন্সির ফো, ও মুন্সির ফো, আবার নড়াইয়া দিলা ক্যা?
একজন আবার রসিকতা করে বসল, তুমি মেঞা দেখছি মানুষ চেনো না, মুন্সির ফো কি আর মুন্সির ফো আছে, এনজেনেয়ার পাস দিছে না? এ কথায় সবার মাঝেই কমবেশি হাসির রোল পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই কেউ একজন মুখে আঙ্গুল তুলে ইংগিতে চুপ করতে বলল সবাইকে। চুপ যাও মেঞারা। হাসাহাসি কইরো না। দেকো কার কপালে কি দুর্ভোক লেকা আছে। কোথায় জানি মেঘের মতন খালি গর্জাইতাছে না? কথা শুনে সবার মুখেই চুনকালি পড়ে গেল।
কামানের না বন্দুকের?
কোনদিকে রে?
না না, পুবে মনে হয়।
মুক্তিরা মেশিনগান পাইবো কই, নেশ্চয়ই খাকি?
যা ঘুটঘুইটা রাইত… এত কাদাপানি ভাইঙা ওরা আসপো না ইদিকে। জেবনের মায়াদয়া আছে না?
মুরুব্বিরা তো বটেই, এমন কি দোলননাহারের সঙ্গেও যারা এতক্ষণ চোখ টেপাটেপি ও ফিসফাস করতাছিল, শব্দের ঐ উৎস নিয়ে তারাও কেমন চিন্তিত হয়া পড়ছে। ব্যতিক্রম শুধু দোলননাহারের ভেতরটাই। আঠার মতন সেই পুরানো জাগাতেই আটকাইয়া রইছে। খানকির পুতেরা দেখতাছি বেবাক কিছুই রেকর্ড কইরা রাখছে। নুরুইল্যা কি তয় ফাঁস কইরা দিল কথাডা? ফাঁস যদি হয়াই যায়, তখন? তখন সবাই আঙুল তুইলা কইবো, হাকিম আলাদের নাতি করিম আলাদের মাইয়া দুলুনি, চেনোস না? আরে, ঐ যে, তিন-চার বছর আগে নাপতার ছোড পোলাডার লগে, য়েসিন, হ য়েসিনের লগে বাইরাইয়া গেছল, দ্যাখ দ্যাখ, চুলে আবার পাম মারছে খানকি মাগি…। বাদ্দর গেলো, আশিন গেলো, বিষটি তো পরের কথা, আকাশে যে একফুডা মেগ নাই, মনে করতাছ এমনিই? পাড়ার খারাপ মাইয়া লুক যদি কোনো গেরামে থাকে, হাদিসে আছে না, সেই গেরাম ছাইড়া ফেরেস্তা চইলা যায় অন্য গেরামে। এই যে খাকখাক করছে চাদ্দিক, লক্ষ্মি যদি ঘরে থাকতোই, মেঞারা এমুন হয় কও? গেরামে থাইকা হয় ইসব হজম করো না হয় গাট্টি-বোচকা লইয়া যেই পতে আইছো বান্দা সেই পতে ফির…এইতো ? বিক্রামপুইরা মাইয়া আমি/ ঝিনুক বেঁইচা খাই/ ছামাখান বানাইছি গাঙ/ কুন হালার পুতেরে আবার ডরাই। গেরামে যদি নাই পারি থাকতে, যাবি না আবার টাউনে, লুঙিটা খুইলা চ্যাঙ কইরা পেনিসটা তখন কাইটা ফালামু না? ট্রানজিস্টারের গ্যাছ গ্যাছ শব্দটা এখন আরো বেড়ে গেছে। আগে তা-ও ঘোষকের দুয়েকটা কথা শোনা যেত ফাঁক-ফোকরে, আর অখন ওডতাছে খালি চিল্লিক মাইরা।
এই বাড়ির মেয়াছেলাদের আব্র“ ঢাকার জন্য জোড়াতালি মারা যে বেড়াটি এখনও যথেষ্ট ভূমিকা রাখতাছে, তার ফাঁক গলিয়ে দোলননাহার দেখতে পায় মঙ্গল খাঁর ছোট মেয়ে তাকে একনাগাড়ে ডেকেই চলেছে। কখন থাইকা দেখতাছি বাইরবাড়িত খাড়াইয়া রইছোস, কতদিন পর আইলি, ফুবুর লগে দুইএকটা কতাবারতা কোবি, না আডার মতন লাইগা রইছোস, বিতরে আয়…। নিরুত্তর দোলননাহারের মনে হঠাৎ একটা খায়েস মাথাচারা দিয়ে ওঠে। চারকির মিছা খবরডা যত তাড়াতাড়ি পারন যায়, রটাইয়া দিতে হইবো। রটে গেলো তো গেলোই, তখন নুরুসলাম ক্যান, অর চৌদ্দ গোষ্ঠিরও ক্ষ্যামতা নাই একগাছ বাল ছেঁড়ে দোলননাহারের। কিন্তু তার জন্য তো একটা সুযুগ পাওন লাগবো। না, মাগির আর তর সইছে না; খালি চিল্লাইতাছে। মনে করতাছে, রূপ দেহাইবার জন্য খাড়াইছি। কিন্তু আবারো যদি য়েসিনের কথা ওঠে? গর্ত থাইকা যদি অজগর বাইরাইয়া পড়ে? বাড়ির ভেতর থেকে ফুফু আবারো ডেকে ওঠে। মাইয়ার কাণ্ডুজ্ঞান দেখো, কুন সুময় থাইকা ডাক পাড়তাছি, খ্যাল আছে কোনো?
কিন্তু পেটের মইধ্যে যদি কোন কিছু দলা পাকাইয়া লটরপটর করতে থাকে, তখন কি আর ইসবে ভাল্লাগে, রাগ লাগে না? তার ওপরে কাঠকাঠ চেহারার লোকগুলো আরো ভীত হয়ে পড়েছে। পুব দিকের যে শব্দটাকে এই কিছুক্ষণ আগেও মেঘ গর্জানোর মতন মনে হইতাছিল, তা এখন ফকিরকান্দিতে বোমা ফাটলে যেমন গোৎগোৎ করে শব্দ হয়, তেমন মনে হইতাছে। ভয়ে না আশংকায়, নাকি স্বেচ্ছায়— বোঝা মুশকিল, দহলিজ ছেড়ে দোলননাহারকে উদ্যম নিতে হইতাছে ভেতরবাড়িত যাওনের, ফুবু দেখতাছি আগের মতনই আছো, একটুও বদলাও নাই। আগের মতনই চটাং চটাং কথা…। কিন্ত কথাডা শেষ করার ফুরসৎ পায় না দোলননাহার; তার আগেই ভিড়ের মাঝ থেকে কার গলা যেন বাতাস চিরে বেরিয়ে যেতে থাকে। কুপি নেভাও, এ্যাই কুপি নেভাও,… মিলিটারি… মাইয়াছেইলারা যেন একজনও ঘরের বাইরে না যায়। কাঁতা-চাঁদর দিয়া ফাঁক-ফোকর ডাইকা দ্যাও… নুকাইয়া থাকো, কুপি নেভাও, আল্লাবিল্লা করো।
মুর্হূতের মধ্যেই বাড়িতে সুনসান নিরবতা নেমে আসে।
…
নামলই যুদি, তয় সাত-আসমান ফাটাইয়া ঝরঝরাইয়া নামল না ক্যান, বজ্জাঘাত হইল না ক্যান, না হয় বসে থাকতেই হতো ঘণ্টা দুয়েক চুপচাপ, কি আর হত, মানুষগুলান কি তাকে গিলে ফেলতে পারতো? দুই হাঁটুর মধ্যিখানে মাথাটা কুনরকমে ঢুকাইয়া দিলে দুনিয়ায় যাই-ই ঘটুক সবই হজম করা যায়। ফুবু তো ফুবুই, মাস্টার কাকাও ঠেকাইতে পারত না কুন কিছুতে। জিহ্বার তলায় রেডিমেড উত্তর গোছগাছ তো করাই ছিল। কেউ জানতে চাইলেই হত অমনিই ফটাফট বেরিয়ে পড়ত। ফুবুই হয়ত তার পান খাওয়া ঠোঁটটা কানের কাছে এনে ঘ্যানরঘ্যান করতে চাইত, এ্যাই মাইয়া, আইছস ক্যান আবার, আমরা মইরা গেছি না বাঁইচা আছি দেখতে আইছস? আমরা না হয় তোর শত্তুরই, বুড়া মানুষটাও কি তোর শত্তুর ছিল? তারেও তো একবার দেখতে আ’লি না। ক তো, তুই কি পাষাণ না সিমার? বাড়ি ছাইড়া যাওনের দুদিন কিংবা তিনদিন আগে হবে হয়ত, দুপুরের একটু পরপরই গরম খুন্তি দিয়া খোঁচা মাইরা হাতের কব্জিটা যে মাগি ফসকাইয়া দিয়াছিল দোলননাহারের, সেই ফুবুই যখন মা কিম্বা বোনের আবদার নিয়া ক্ষোভ ঝাড়তে চাইত এসব ছেলানিপনা করে করে, তখন কি আর তার সাথে কে পাষাণ আর কে সিমার এ নিয়ে তক্কো-বিতক্কো চলে? তারচেয়ে ভাল না ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে তার অল্পসল্প প্রয়োগ করা? এতেও যুদি না কুলাত, হয় এক কানে ঢুকাইয়া আরেক কান দিয়া বাইর কইরা দেওন লাগত, না হয় হালকার উপরে রেকর্ডটা একটু ছাইড়া দেওন লাগত, আসতে কি আর চাই না, চাই। ছুটিছাটা পাওন যায় না এক্কেবারে, হাসপাতালের চারকি কইরা অন্তরডা বুঝলা ফুবু পোড়া পোড়া হয়া গেল। দিন নাই রাত নাই খালি খাটুনি আর খাটুনি। আমরা যারা চারকিবারকি করি তাগো তুমরা বান্দিদাসিও বলতে পারো, সেবাদাসিও বলতে পারো…। শেষদিকের কথা ক‘টা শুনে কেউ যুদি জানতে চাইত সেবাদাসির মানেটা কি, তখন? হরহর কইরা কি বেরিয়ে পড়ত না সব? ধ্যাৎ, আন্ডা বাইরাইতো আমার। হাসপাতালের কথা শুইনা মাস্টারকাকা হয়ত জানতে চাইত টাউনের কথা, দোলননাহার, আমরা তো গাওগ্রামে থাইকা দেশের হাবভাব বুঝবার পারতাছি না। বলোতো কি অবস্থা ঢাকার? শুনলাম শ্যাখ সাবে না-কি পলাইয়া ইন্ডিয়ায় গেছে? কিন্তু পাকিস্তান রেডিও তো কয় ভিন কথা। তারা তো কয় শ্যাখ সাবরে নাকি তারা আটক করছে! বুঝলা না, ধমক দিয়া কাম সারনের ফন্দি। কিছুক্ষণ পরে আরেকজনে হয়ত জানতে চাইত অন্যকথা, শুনবার লাগতাছি চায়না না-কি পাকিস্তানরে জোর সাপোর্ট দিতাছে? খাঁ-বাড়ি থেকে দোলননাহারদের বাড়ি আর কত দূর হবে, বড়জোর মিনিট বিশেকের পথ, তারই মধ্যে কেউ যুদি তিন-চারবার পা ফসকে পড়ে যায়, একমাজা কাদার মইধ্যে সরসর সরসর কইরা সাইন্ধা যায় গিরাসুদ্ধা, তখন দুলুননাহার তো দুলুননাহার, রাজা-বাশ্শার মেজাজও কি ঠিক থাকে?
পাশের কোন নালা থেকে ভেসে আসা কোলা ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ আর ঝিঁঝিঁ পোকার বিরামহীন ডাকাডাকি কিংবা ট্যাপর ট্যাপর বিষটির উপরে না যতটা রাগ, তারচেয়ে বেশি বিরক্ত দোলননাহার তার নিজের উপরেই। পেতলের বাসনে দুপুরবেলার ঠাণ্ডাভাতের সাথে কদুভাজি আর দুইডা পোড়া মরিচ আর একমগ পানি লইয়া ফুবু কত জোরাজুরি করল, রাইত অয়া গেছে, বিষটিও মনে অয় থামবো না। যাইয়া আর কি করবি, খাইয়া লইয়া তারচে এইখানেই ঘুমাইয়া থাক। খালাসিবাড়ির জামাইলারে চেনোস না, হে তো আবার পিজকুমিটির নেম্বার হইছে। দিনকাল বালা না বুঝলি?
গায়ে গরম রক্ত, গেরামের সাথে সম্পর্ক চুবেবুকে গেছে তা-ও পেরায় তিন বছর, হঠাৎ কোথা থেকে কেউ উড়ে এল আর হুটহাট সব বুঝে ফেলল, এটা কি কইরা সম্ভব-দোলননাহারের ভাবটা এখন এমুন। আমারে আবার কেডা কি করবো ফুবু? কার পাকা ধানে আবার মই দিছি। যাইগা।
চুপ কর ছেমড়ি। দেশের হাবভাব সুবিধার না, বুঝলি?
চাদ্দিকের হাবভাব যুদি এত সুবিধারই হত, তাইলে কি আর পাকা রাস্তাঘাট রাইখা এই প্যাচপ্যাচে কাদার মধ্যে আছাড়পাছাড় খাইতে হয় দোলননাহারকে? পরশুদিন এমুন সময় কি করতাছিল দোলননাহার? রোকসনাডা কি আইজকাও সেই আলাভোলা কাস্টমারডা পাইয়া জাঙিয়া ধইরা টানাটানি কইরা পয়সা উসুল করতাছে? মমতাজবুরে দেইখলে ভূ-ভারতে এমুন কোনো হোমন্দির পুত নাই যে মাথা আউলায় না, তারই তো শুইনা আইছি তিন-চাইরদিন কাস্টমার নাই, তাইলে রোকসনারে আবার কে ঠাপাইতে আইবো? বহ্নি কি এখন খাড়াইয়া রইছে গুদারাগাটে? কাস্টমারের লগে দরদামও ধরো ঠিক করলো বহ্নি, পাঁচজন না সাতজনের কাম তা-ও না হয় জাইনা লইলো, কিন্তু হঠাৎ করেই যুদি গেণ্ডারিয়ার লোহারপুলটা ঝনন ঝন করে উঠে, কিংবা নবাবপুরের তিনরাস্তার মোড় দিয়ে দেখতে পায় ঠাসঠাস করে পুড়ে যাচ্ছে কাচামালের আড়ৎসমেত পুরো চাংখার পুল, তখন কি আর শান্তি মতন কাম করন যায়? পাছার কাপড় মাথায় তুইলা দৌড়ে পলাইয়া যাইবো না কাস্টমার? তাছাড়া জানই যুদি না বাঁচলো, পয়সা দিয়া কি খাট্টা রাইন্ধা খাইবে?
ফুবুর কথা না শুইনা দোলননাহার মনে হয় ভুলই করেছে। বিষটি পড়ছে তো পড়ছেই; থামাথামির দেখছি কোনো লক্ষণই নাই। নাড়িভুড়ি কি বাইরাইয়া গেল আকাশের? দু’পা না ফেলতেই আবার ঝমঝম করে উঠল। দোলননাহার এখন দৌড়াবে, না পা টিপ্পা টিপ্পা হাঁটবে; দৌড়াতে গেলে মাথার আঁচল ঠিক রাখন মুশকিল হয়া পড়ে, আর সেই সঙ্গে পা পিছলাইয়া পইড়া যাওনের ভয়। আর টিপ্পা টিপ্পা হাঁটার মানেই তো হলো ভিজে ভিজে একসার। চাদ্দিকটা দিনের মতন ঝলকাইয়া দিয়া হঠাৎই বিজলি চমকাইয়া ওঠল। এতে অবশ্য দোলননাহারের একটু সুবিধাই হল, যে পথরেখাটা এতক্ষণ অচেনা অচেনা লাগতাছিল অনেকদিনের অনভ্যস্ততার কারণে, তা এখন পরিষ্কার হয়া ওঠছে। এমনকি অনিল পিসির ঐ যে পুরানো টিনের তেচালা ঘরটা, তার সামনের বাঁ-দিকটায় ভূতের মতন দাঁড়িয়ে থাকা ঝাউগাছ, ঝাউগাছ সংলগ্ন বাঁশঝাড়, আর শনশন করে হেলছে দুলছে দুই-তিনটা নারকেল গাছ… একঝলক দেখা দিয়াই মিলায়ে গেল। এতে একটু-আধটু সুবিধা হয়ত হয়েছে, কিন্তু ক্ষতির পরিমাণটাই বেশি। ঐ ঝাউগাছটার লগেই তো আজিজুন্নেসার একটা ভয়ংকর স্মৃতি লেপটাইয়া আছে এখনও। সন্ধ্যা থাইকাই নিখোঁজ আজিজুন্নেসা। কোথায় গেল কোথায় গেল, না কোথাও তারে পাওন যাইতাছিল না। বেয়ানবেলা পুবপাড়ের সিকিমালি না হাতেমালি যেন উত্তর দিকে যাইতাছিল গরুবাছুর লইয়া, গাছটার কাছাকাছি আসতেই গা-গতর ছমছম কইরা ওঠল তার। গরুর শিংয়ের মতন বাঁকানো যে ডালটা মাটিতে ভর দিয়া আবার তরতর কইরা উইঠা গেছে উপরের দিকে, চোখজোড়া ব্যাটার আটকে গেল উইদিকেই। অমন কইরা কি ঝুইলা রইছে ? আজিজোন না? রহিম তালইর মাইয়া আজিজোন না? এ কি গেডিটা মচকাইছে ক্যামনে? উহহ! এই দুঃসহ স্মৃতিটা এখন ঢাইকা রাখন দরকার দোলননাহারের, আর তার জন্য হয় এখনই অন্যকোনো সুখকর স্মৃতি হাতড়াইতে হইবে তাকে, না হয় গুনগুনাগুন গান করিয়া নীল ভোমরার মতন উড়িয়া উড়িয়া যাইতে হইবে। হাজাররকমের স্মৃতি দোলননাহারের মাথার ভেতরে এখন কিলবিল করতাছে। গাছটার গায়ে কি আজেবাজে খিস্তিখেউড় লেখা থাকত, এই যেমন এফ প্লাস এল, কে প্লাস ডি’র মতন প্রেমপ্রেম সংকেতসমূহ? এর পাশ ঘেঁষেই কি মরা কোনো শুয়াপোকা অথবা চাউলের কোনো দানা নিয়া ব্যস্তসমস্ত ছোটাছুটি করত লালপিঁপড়ের দল? হ, মনে পড়তাছে। গাছটির কোটরের মধ্যে দোলননাহারই কি কম গলিয়ে দিয়েছে পুরানা বইয়ের পাতা থেকে পেন্সিলে টোকা ছন্দোবদ্ধ লাইন, আজীবন পাশে থাকবার প্রতিশ্র“তি, ভুইলা না যাইবার আকুলিবিকুলি— ওহ! যখনই ভয়টা একটু কেটে কেটে যাচ্ছিল, তখনই আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল আজিজুন্নেসার হা করা মুখটা। জিহ্বাটা কি আজিজুনের পুরাটাই বাইরাইয়া গেছিল?
ধকপক করে উঠল দোলননাহারের অন্তরাত্মা। আয়াতুল কুরসির দোয়াটা পড়তে গিয়া দোলননাহার তালগোল পাকাইয়া ফেলল সুরা ইনুছের লগে, আর দুইটার কোনোটাই যখন ঠিকঠাক মনে করতে পারতাছিল না, তখন কি আর করা, কুলহুল্লাই কুনরকমে পইড়া বুকে ফুঁ দিয়া আবার হাঁটতে লাগল সে। এখন যুদি মিলিটারি আইসা টুপ কইরা ধইরা লইয়া যায়? ইসকুল ঘরে লইয়া গিয়া যুদি…, তারপর? ধ্যাৎ, এইটা কি টাউন যে টেরাক লইয়া বডরবডর কইরা চইলা আইবো? তাছাড়া জানমালের কি ডরভয় নাই ওগো? আর আসতোই যুদি তয় তো সন্ধ্যার সুময়ই আসতো। দোলননাহার মিলিটারির প্রসঙ্গটা চালাচালি করে আসলে আজিজোন আর আজিজোনের মৃত্যুরহস্যটা ভুলে যেতে চাইতাছিল। কিন্তু আবারো বিজলি চমকাইয়া ওঠায় খুব একটা জুৎ করতে পারল না সে। স্কুলঘরটার পাশে দিয়া বাওড়ের দিকে চইলা গেছে যে খালটা, উইখানেই তো তিনদিন পরে বাইসা ওঠছিল মফেজ বাইয়ের গলাকাটা লাশটা। ফুইলাফাঁইপা ডোল হয়া গেছিল এক্কেবারে।
হঠাৎ কোথায় জানি কুকুর আর শেয়াল ডেকে উঠল। আর এ কারণে মফিজ বাইর পর্ব তো শেষ হলই, সেই সঙ্গে দোলননাহারের পায়ের পাতারত্তুন মাথার তালু পর্যন্ত যে ভয়টা এতক্ষণ শিরশির করতাছিল, তা-ও অনেকটা কেটে গেল।
এরই মধ্যে অবশ্য অনেকটা পথ চলে এসেছে দোলননাহার।
…
পোটলাডা তো বালিশের তলায়ই ছিল, না-কি? কি কাণ্ড দেখো, বালিশের তলা থেকে আস্ত একটা পোটলা সিঁদ কেটে চোরে নিয়া গেল, আর দোলননাহার এর কোনো কিচ্ছুই টের পেল না, ভাবা যায়! কি মরার ঘুমই না ঘুমায়ে ছিল সে?
বর্ষ ৩, সংখ্যা ৫, ফেব্রুয়ারি ২০০৪