ধ্রুব চক্রবর্তী’র কবিতা

0

সম্রাট মার্জনা করো

শাসনক্ষমতার অধিকারকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক ও সামাজিক মেরুকরণ সুদীর্ঘকাল মানবতা ও মানবিক বোধের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে চলেছে; পরিণামস্বরূপ মহাকাব্যিক যুগ থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত অসংখ্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে মানবসমাজ। ধ্বংস হয়েছে শিল্পসুষমা, নিবিড় ব্যক্তিস্বার্থের বলি হয়েছে নান্দনিক অনুভব, জন্ম নিয়েছে মেরুদণ্ডহীন পারস্পরিক প্রেমহীন হিংস্র সরীসৃপ।
মহাভারতখ্যাত কর্ণ চরিত্র এই ধারণার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। কবচ ও কুণ্ডলের প্রতীকি বর্মে আবৃত যে শিশু জন্মাবধি জননীর স্নেহচ্ছায়া থেকে বঞ্চিত প্রত্যাখ্যাত, পরবর্তীতে আমরা তাকেই পাই মহার্ঘ্য পৌরুষ এবং উদার দানশীলতার গুণে ভাস্বর চরিত্ররূপে। যাঁর ভূমিকা হতে পারতো মানবসমাজের পরিত্রাতা সার্থক জনপ্রতিপালকের, তাঁকে পরস্পর যুযুধান রাজনৈতিক ক্ষমতালিপ্সুর দ্বৈরথে অপমৃত্যুর সম্মুখীন হতে হলো।
আজকের মিডিয়াশাসিত তথাকথিত আধুনিক পৃথিবীতেও এই ঘটনার ধারা প্রবহমান। কালের শর্ত মেনেই পুনরাবৃত্ত হচ্ছে ইতিহাস…………….

ধারালো তরোয়াল আজ এনেছি বহন করে
দুইহাতে
আমাকে মার্জনা করো— সম্রাট
এ যুদ্ধ আমার নয়, নেহাতই কর্তব্যের দায়ে
এসেছি আমার গায়ে পরানো
যোদ্ধার সাজ, কটীবন্ধে ছোরা, পিঠে দীর্ঘ তূণীর
খুলে নাও একে একে
নিজেকে মুক্ত করে নিতে তোমার আজ্ঞা হোক্।

সহজাত কবচ ও কুণ্ডলে ঢাকা
শিশুকে ভাসিয়েছিলো জলে, কুমারী
ভেসে যেতে যেতে সেই অস্থির শৈশবে
দেখেছি করাল ছায়া আকাশে শকুন
পৃথিবীর ঘাটে ঘাটে জ্বলন্ত চিতার আগুন
মৃত্যু সত্য বলে জেনেছি, পরিণামে
প্রেমহীন স্থিতিহীন জীবনের প্রতি জমেছে তীব্র ঘৃণা
অঙ্কুরে বীজে বেড়ে ওঠা গাছ সে কি নিজে
জানে, কখন কোথায় শেকড়ে পাথর লেগে
ক্ষয়ে যায় মূলরোম?
আমি অক্ষম, বুঝেছি জীবন শুধু পাশাখেলা নয়
পণ রেখে দারা-পুত্র-পরিবার সর্বস্ব, ক্ষাত্রধর্ম হতে পারে
রাজধর্ম নয়,গভীরে কোথাও আছে ক্ষমা— মহারাজ
গুরু অভিশাপ ভুলে যাইনি এখনও
যুদ্ধক্ষেত্রে কাল রক্তভেজা মাটি, আমার রথের চাকা
করে নেবে গ্রাস, চারপাশে থাকবে না কেউ
আমার একাকী ছায়া কালো, একমুঠো ঘাস ছুঁয়ে
হয়তো বা কিছুক্ষণ ধ্বংসের আগে শেষবার তাকাবে
আত্মজিজ্ঞাসায়।

এ যুদ্ধ আমার নয়— সম্রাট
মার্জনা করো, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’—
বলেছিলো কবি, আমি দেখি
আবিশ্ব মানুষের ঘরে
সাহারার মরীচিকা থেকে শ্বেত মেরুনগরে
বিশ্বসুন্দরীর ভুবনমোহিনী ছবি।
বাণিজ্যরথে পৃথিবী বিজয়ে যায় আজকের নৃপতি
মানবতাবাদী মুখোশের আড়ালে নখ-দাঁত
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ……… ভুখা মিছিলের স্রোতে
ছিপ ফেলে বসে আছে ক্ষমতার গাঢ় লোভ
নাগরিক কাঠামো বেয়ে সার-সার হেঁটে যায় উই।
বাঁদিকে আগুন জেনে ডানদিকে পাশ ফিরে শুই
ওমে ডুবে নিবিড় জড়িয়ে থাকি নগ্ন যুবতী দেহ
কামার্ত এই সমাজের দায়ভাগী আমিও কিছুটা।

পিছুটান ছিলো বলে আসা
ছিলো প্রত্যাশা
          মানুষ যেভাবে বাঁচে
          সংসারে সমাজে, ভিখারীর মতো
          অস্তিত্বের ছাই ঘেঁটে খোঁজে সোনা
          আমি সেই নশ্বরতায় বিশ্বাসী থেকে
          বিদ্রোহ করে যাবো, যুদ্ধভূমিতে নয় নিজের ভেতরে
ক্রমাগত রক্তপাত সহ্য করে, দাঁতে দাঁত চেপে কঠোর প্রতিজ্ঞায়
আজীবন।
ভাগ্যের দোষ দিই না কখনো
ভাগ্যচক্র মানে কাপুরুষ
আমি জানি জীবিতের শুধু কর্মেই অধিকার
ফলের বিচার হয় ভবিষ্যের হাতে।
বন্ধুত্বের ঋণশোধ করেছি আগেই
অযুত সৈনিকের শব মাড়িয়ে
শরীর জড়িয়ে আছে নরকের ঘ্রাণ
সভ্যতার শোক— তবু
উলঙ্গ আমি— হে রাজন্
মৃত মানুষের চোখ আমাকে দেখিও না
স্নায়ুতে মেধায় ক্রমাগত স্থিত হয়ে আসা
আর্ত চিৎকার উন্মাদ করে দেয়
হৃদয় নির্মম হাতে চেপে ধরে
অনামা ঘাতক।

এখন মধ্যরাত, যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে কারা জ্বেলেছে মশাল
অস্থির লাল জিভ চেটে
নিঃশঙ্ক পায়ে ঘোরে একদল হিংস্র শ্বাপদ
মানুষের হাড়-মাস খুঁটে খেয়ে বেড়ে ওঠে তাদের লোমশ দেহ
যুদ্ধজয়ের স্বাদ— আহা কি পরম লোভনীয়
সহস্র হত্যার বিনিময়ে ক্ষমতার দম্ভ
উদ্ধত পায়ের নীচে সমগ্র ভূগোল।

কার জন্য জয়ী?
খেলা থেমে গেলে ময়দানবের স্ফটিকপ্রাসাদে বসে
চেনা আয়ানায় বারবার নিজেই নিজের মুখ দ্যাখে
একরাশ স্তাবকের ভীড়ে স্বেচ্ছাবন্দী রাজা,
মিডাসের ছোঁয়া পেয়ে প্রাণহীন আত্মজেরা
অদৃশ্য কাঁটাতার ঘেরা
সিংহাসনের কোনো উত্তরাধিকার নেই
বৃ্দ্ধ পিতা— নির্বাসিত
সহোদর সকলেই রাজরোষে মৃত
‘বিচারের বাণী কাঁদে নীরবে নিভৃতে’
কোনো অনুতাপ নেই— আমি ধর্মভীরু গরীবের মা-বাপ
জাহানারা— তর্জনী তুলো না
আমি মক্কায় চলে যাবো, শুধু মানুষের সেবা লাগি
এই তখত-ই-তাউসে বসে আছি।

পিতামহ ভীষ্ম বললেন—
‘এখন দক্ষিণায়ন, সূর্য উত্তরদিকে হেলে পড়লেই আমার মৃত্যু হবে
তোমরা অযথা কেউ শোক করো না।

এত ভ্রান্তিময় অন্ধকার গাঢ় হয়ে নামেনি কখনো আগে
শরশয্যায় শুয়ে আছে চেতনার অবশিষ্ট রোদ
স্বয়ংবিদ্ধ সে নপুংসকের প্রতিশোধ
ইচ্ছামৃত্যু ডেকে এনেছে শরীরে, মনে
কোথায় পৃথিবী! রজঃস্বলা রমণীর গর্ভের উন্মুখ ভ্রূণ
অভিশাপে পাথর হয়েছে
এখন জন্ম নেবে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দুঃসময়।
মার্জনা করো, সম্রাট
জন্মপরিচয়হীন ব্রাত্য পথিক আমি
রাজনীতি বুঝিনা তেমন। বন্ধুকৃত্য ভেবে পরেছি মুকুট
তোমার হাতেই অভিষেক, ভেবেছি গভীর মিত্রতায়
বুকে টেনে নিয়েছো আমাকে।
প্রকৃত বুঝেছি আজ, মিথ্যা ছিলো সব
ক্ষমতাপিপাসু যে তার কাছে— মহারাজ
রাজনীতি চেয়ে বড় কিছু নেই, সমস্ত ব্যবহার
প্রেম প্রীতি ভ্রাতৃত্বের উদার আয়োজন
সব স-ব কিছু বিশিষ্ট হাতিয়ার
আসন্ন যুদ্ধের।

সাদার সঙ্গে কালো গোপন চুক্তি হয়, মহাকাশে
করমর্দন করে দুই বিপরীত মেরুবাসী।
প্রথম দ্বিতীয় নয়, এবার তৃতীয় বিকল্পের কথা ভাবো
তারপর চতুর্থ, পঞ্চম…………. সংখ্যাতত্ত্বের গণ্ডী ছাড়িয়ে
শেষ শূন্যের দিকে তাকিয়ে হতাশ প্রহর গোণে
বিপন্ন মানুষ।
আমিও শেকড়ে ফিরি, লক্ষকোটী জন্মের আগে
সৃষ্টির লাভাস্রোতে ভাসমান কণা জুড়ে জুড়ে
বিভাজিত কোষময় প্রাণের শব্দ শুনি
কিছু ধ্বনি অস্পষ্ট মনে হয়
ট্রয়ের ঘোড়ায় চেপে নিষিদ্ধ নগরীর মাঝখানে
নিশ্চুপ অপেক্ষা করে— মহাকাল
শূন্য উদ্যান থেকে হাতছানি দেয় বৃদ্ধ স্থপতি
সিন্ধুনদের তীরে মাটি খুঁড়ে পাওয়া ফসিল করোটী
অথবা ডাইনোসরের হাড়ে
কি দারুণ বাঙ্ময় রক্তের ঘ্রাণ!
বলো মহারাজ, কিভাবে সম্মান করি তোমাকে— তোমাদের?

গলগোথা পাহাড়চূড়োয় পোঁতা ক্রুশ
মাথায় কাঁটার মুকুট, হাতের তালুতে বেঁধা কঠিন পেরেক
হত্যাদৃশ্য দেখে অনেক মানুষ
আনন্দে হাততালি দ্যায়, প্রতিবাদহীন এই সমর্পণের ছবি
ঝুলছে দেওয়ালে ড্রয়িংরুমের শোভা
বোকা বাক্সের রঙীন আলোয়
আপন খেয়ালে নাচে যুবক যুবতী
নগ্ন বিজ্ঞাপনের মোড়কে বিক্রী হয় আধুনিকতার
নয়া ইস্তাহার।
‘ঈশ্বর ক্ষমা করো, এরা জানেনা………….’
এরা জানেনা কিছুই, না জেনেই ভালো থাকে
ভোগে সুখে তৃপ্ত নগদ মূল্যে কেনা
পণ্যের সাথে ওঠানামা করে মূল্যবোধের স্তর
আত্মগর্বী মানুষের।
মুকুট ফিরিয়ে নাও— সম্রাট, আমি
রঙীন ফানুসের স্বপ্নে বিশ্বাসী নই
দু’হাত রক্তে ভিজেছে, গভীরে আচ্ছন্ন পাপবোধ
এই সম্পদ আমাকে মানায় না।

লাক্ষাগৃহের ঘরে আধপোড়া লাশ
নিখুঁত সুড়ঙ্গ কেটে পালায় শিকার
পুরোচন দাসানুদাস
রাজাজ্ঞা করেছে পালন, নিজের আগুনে পুড়ে ছাই।
তবু, বেঁচে থাকা চাই
এই ক্লীব আঙরাখা লৌহবর্ম পরিধেয়
ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করে তাবৎ লেহ্য পেয়
জরা ও ব্যাধির ঘোরে কাতর জরদ্গব
বসে আছে শাসকের ভূমিকায়
তর্জনী ওঠেনা শুধু ভ্রূযুগল নাচে, কেঁপে ওঠে
কামে ও ক্রোধে নর্ম্যসহচরী লাস্যে এগিয়ে ধরে
সুরাপাত্র ঠোঁটে।
দীক্ষা হয়নি আজো— আমাকে মার্জনা করো
ভিক্ষায় রুচি নেই, সরীসৃপের মত হেঁটে যাওয়া
মানুষের ঢল, ত্রেতা থেকে দ্বাপরে নেমেছে
কালচক্রের রীতি এই বলিষ্ঠ হাতে ঘোরাতে পারিনা
অতএব মেনে ও মানিয়ে চলা
পরিবর্তিত পরিস্থিতির খাতে বেনোজল
ভেসে যায় ভেলা, বামন ধরেছে চাঁদ
ঘুমন্ত গালিভার, অজস্র লিলিপুট মই বেয়ে উঠে
দীর্ঘ শরীরময় ঘোরাফেরা করে
মুখোমুখি জ্যোৎস্নায় আমি ও আমার ছায়া
আত্মপ্রতিকৃতি অন্য কারোর মনে হয়।

‘ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি’
(কঠোপনিষদ, ১: ৩: ১৪)

স্বর্গ নরক বলে কোনোকিছু নেই
নেই পাপ ও পুণ্যের কোনো প্রকৃষ্ট ভেদরেখা
দীর্ঘ উপত্যকা বেয়ে হেঁটে যেতে যেতে
ধারালো প্রতিটি বাঁকে একে একে প্রিয়জন মাঝপথে
থেমে যায়— শুধু আমিই সচল থাকি
ধর্মকুকুরের পায়ে পায়ে এক শতাব্দী ফেলে
অন্য শতাব্দীর দিকে বহমান জীবনস্রোতে
একা নাগরিক।
প্রশ্ন উঠেছে আজ ভেতরে বাইরে
এই টুকরো টুকরো কারুকাজ স্থায়ী কতদিন?
অবিনাশী আত্মার নামে এই জৈবিক প্রহসন
বৃষ্টি-ধুলোয়-ঘাসে
যোনিগহ্বর থেকে মাতৃজঠরে আরো কত জন্মান্তর
অপেক্ষা করবে পৃথিবী?
সব প্রাচীনতা ভুলে অর্ঘ্যথালায় তুলে নিয়েছি আগুন
পূতাগ্নি নয় কোনো রাজসূয় যজ্ঞের
অশ্বমেধের ঘোড়া ফেরেনি আস্তাবলে
ভিনদেশী কেউ প্রতিবাদে বেঁধেছে তাকে
দূতমুখে এসেছে সংবাদ— সময় পাল্টাবার।

যতদূর চোখ যায় শ্বেত বরফের মাঠ
যতদূর চোখ যায় কোনো ছায়া নেই
সূর্য ওঠেনা কোনোদিন নিষ্পত্র এই দেশে
শুধু রাত্রি হয় বারবার, অন্ধকার গাঢ় হয়
ভয়াবহ চাঁদ ওঠে, চাঁদ ডুবে যায়, জ্যোৎস্নার তাপে
বরফ গলে না।
সবচেয়ে দেরী হয় পথ খুঁজে নিতে
সবচেয়ে দ্রুতগামী বাহনের পিঠে বল্গাবিহীন
ছুটে যায় দীর্ঘ মিছিল দিকে দিকে
ব্যক্তিত্বের অজুহাতে রাস্তা বদল হয় মানুষের
তবু— মুক্তি হয়নি কারো
          মুক্তি পায়নি কেউ
ভোগবাদী সময়ের মন্থনে শুধু বিষ ওঠে
তীব্র হলাহল ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ে
ভ্রূণ থেকে ভ্রূণে
সঠিক প্রহর গুণে বলা যেতে পারে
আর কতদূরে সমূহ ধ্বংসে দিন।

সম্রাট মার্জনা করো—
কতটা প্রবীণ হলে পোড়াবো অস্থিসার এই
সমাজের দেহ— জানিনা
শরীরে ছদ্মবেশ, হত্যাকারীর কাঁধে
হাত রেখে হেঁটে যাই কোন্ অন্ধকারে— জানিনা
শুকনো পাতায় মাড়িয়ে চলার শব্দ
বাকলে নখের দাগ রেখে
গোপনে কোথাও বেঁকে গেছে অদৃশ্য ঘাতক
তৃষ্ণা মেটেনি তার, পলাতক
শিকারের খোঁজে পিছু পিছু ঘোরে
শহরে ও গ্রামে, প্রতিটি দরজায় থামে
উঁকি দিয়ে দ্যাখে, উঠোনে রক্তচিহ্ন ফেলে চলে যায়।
সাড়ে তিন হাত জমি আর একমুঠো ঈশ্বর
এইটুকু পেয়েছি অধিকার
মধ্যবিত্ত মানসিকতার এর চেয়ে বেশী কোনো
চাহিদাই নেই, স্বপ্নের দেশে দেশে
জড়বুদ্ধি চেতনার সমাহার দান করে নিঃশেষে
রিক্ত হয়েছি।
রুপোর চামচ মুখে জন্মানো শিশু
চেনে না শেকড়, ইঁদুর দৌড় জেতে
আনন্দে উদ্বাহু পিতামাতা
………..‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’,
এ কোন ভবিষ্য তুমি গড়ে দিলে রাজা
আগামী পৃথিবী তবে ভরে যাবে সরীসৃপে
শিল্পের সৌধ বেয়ে অগুন্তি অক্টোপাশ
আর কিছু বুভুক্ষু সারমেয় প্রকাশ্য রাস্তায়
সঙ্গমসুখে মত্ত।

এত দূরে দাঁড়াইনি কখনো
এত কাছ থেকে দেখিনি কখনো
মৃত্যুমগ্ন এই সময়ের ছবি, আজ
আপাতস্বচ্ছ এক কুয়াশার জালে যা কিছু
নিজের বলে ভাবি
সমস্ত ভঙ্গিমায় গাঢ় ত্রুটি ধরা পড়ে
মৃত পশুদের শব ঘাড়ে করে
ভাগাড়ে ভাগাড়ে ঘুরি আমি ক্রীতদাস
বিপন্ন সময়ের।

সম্রাট মার্জনা করো—
আমি ফিরে যাবি বৃক্ষে ও বীজে
ফিরে যাবো শান্ত সবুজে
বৃষ্টিদিনের ডাকে সাড়া দিতে
আর হিংসা নয় দ্রোহ নয়, সমকাল দাঁড়ায় প্রেক্ষিতে
উত্তরহীন প্রশ্নমালার ভীড়ে
মিশে আছে স্বেদরক্তময় জীবনের
অপূর্ণ দিনলিপি।
পুরোনো আগুন নিভে
যায়নি এখনো, স্পষ্ট বুঝতে পারি
ভেতরে কোথাও জ্বলে তুষ
অশ্রুর নোনা স্বাদ জিভে টের পাওয়া যায়
দীর্ঘ অঙ্কুশ নেমে আসা মাথার ওপরে
আর্ত ছুটেছি যন্ত্রণায় বিদ্ধ হতে হতে
জয়রথে আসীন রাজাকে এতকাল
বৃথাই করেছি সেলাম আজ্ঞাবহ অনুচর
কাঁচঘেরা মঞ্চ থেকে বরাভয় মুদ্রা দেখিয়ে রাজা
মানুষের রক্তে ভেজা লাল কার্পেট বেয়ে
উঠে গেছে বায়ুসেনা বিমানে, গালভরা
প্রতিশ্রুতির পালক ছড়িয়ে বিদেশভ্রমণে
সাদা রাজহাঁস
ঘরে ঘরে শোক সন্ত্রাস
‘এমন কতই হয়’ বলে রাজবিদূষক
বিবৃতি দিয়েছে।
সব অক্ষর ভিজে উঠেছে ঘামে,
আজ নিজস্ব নামে কোনো ঘৃণা ছুঁয়ে নেই
সমস্ত উপাধি খুলে ফেলেছি নির্দ্বিধায়
পৃথিবীর তিনভাগ জলে একটাই সেতু
যুগযুগান্তব্যাপী মানুষের আত্মার বন্ধন
সেই যোগাযোগ ধ্বংস করেছে কারা?
কোথায় ফাটল? চিড় খাওয়া আলগা পাথর
খোঁজো, সন্ধান করো শ্যেনদৃষ্টি মেলে— তারপর
শূন্য ভরাট করো রক্তমাংস দিয়ে।

পাথেয় কিছুই নেই, ধু ধু পথ পড়ে আছে
অন্ধগলির আনাচে কানাচে ভীরু চোখ
সংসারে কারা সুখী প্রমাণ হয়নি তবু
ভয়ে জবুথবু শবযাত্রায় সবাই সামিল
ঐ মিছিলের আমি কেউ নই
ভিক্ষুক হতে পারিনি বলেই পরাজিত
আর যুদ্ধক্ষেত্রে যারা চাটুকার
নতজানু রাজউচ্ছিষ্টের স্বাদে লোভাতুর
তারাই এ সমাজের সুসভ্য নাগরিক!

এসো পদাতিক, অশ্বারোহী অমৃতের সন্তান
শোনো— ভাসছে হাওয়ায়
ধারালো ধ্বনি, মহাজীবনের গান
আজ আর প্রার্থনাসঙ্গীত নয়, প্রভু কৃপাময় বলে
আকাশে দু’হাত পেতে কোনো লাভ নেই
অনেক যুদ্ধজয় হয়েছে বা হবে
চণ্ডাশোকেরা কেউ ধর্মাশোক হবে না কখনও
ধ্যানী বুদ্ধের সঙ্ঘারাম ধ্বংসস্তুপ হয়ে পড়ে আছে
বিলাসী পর্যটকের আধখাওয়া সিগারেট বুকে
অতএব, নতুন অভিধা চাই
প্রত্নতত্ত্বের পুরোনো সংজ্ঞা মুছে
প্রকৃত ইতিহাস লিখে নিতে হবে
পরাক্রমী সম্রাটের দিগ্বিজয়কথা নয়
মানুষের ব্যথা ও বিপন্নতার দৃঢ় পরিচয়
সাক্ষ্য দেবে যথার্থ সময়ের।

অপেক্ষায় আছি, আপাততঃ শায়িত নিথর
শবাধারে ক্রমশঃ পচনশীল এই দেহ
মৃত্যুপোষাকে ঢাকা নশ্বর জীবনতা
অপেক্ষায় আছি, সৎকার হবে কোনোদিন
কোনো রৌদ্রজাতক শরীরে ভস্ম মেখে
খুঁজে নেবে অক্ষত নাভি
প্রবল কৌতুকে ছুঁড়ে দেবে উদ্দাম নদীজলে।

**************

98360386_528747167822033_5584766620896591872_n                                                                   ধ্রুব চক্রবর্তী

লেখালেখি— বাংলা ভাষায় কবিতা ও প্রবন্ধ। ইংরাজীতে প্রবন্ধ। নিবাস— কলকাতা, ভারত।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার