মুখাবয়ব
মুখাবয়বে খেলা করে অন্য মানুষ
চাক চাক করে কেটে ফেললে নিজেকে
অসংখ্য সত্তা দেয়ালে আঁকা হয়
বিন্দু বিন্দু ঘাম আর বীর্য্যের খেলা
বিষের বাঁশি বাজায়; নির্মেদ একখণ্ড জীবনী
জীবন্ত একটা মানুষ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে
কেবলই নেচে যায়
দ্রোহের না অশ্বখুড়ের প্রতিধ্বনি
টের পাওয়া যায় কখনো কখনো
বিপ্লবের চুপসে পড়া ফানুসটা
কেউ একজন আমাকে ধরিয়ে দিয়ে
লাপাত্তা… লাপাত্তা… তারপর
শুনেনি কেউ কখনো সেই সুর-ইন্দ্রজাল
রুদ্রপ্রলয়, ইশ্বরকোরাস
থেমে থাকে না কিছুই
কিছু কিছু শব্দ উলোটপালোট হয় শুধু
শেষ পর্য্যন্ত
এই যা…
প্রজাপতি
শহরময় প্রজাপতির মৃত শরীর
ছড়িয়ে ছিটিয়ে
হাজার নয় লক্ষাধিক
আব্বু— এইখানে…
রঙীন পাখনা
বিস্রস্ত এলোমেলো
বাবুর মায়ামাখা
হাতছানি
যেন প্রজাপতি
কিছুক্ষণ পর অজস্র পিঁপড়ের
মিছিল ওই শরীরে
নিশ্চিহ্ন আপাত সুন্দর
নিজস্ব নিস্তেজ দেহ টেনে নিয়ে যাচ্ছে
লক্ষাধিক পিঁপড়ে
অনিশ্চিত অন্ধকার গুহাগহ্বরে
ফিদেল কাস্ত্রো
যদিও অন্ধকার চারদিকে
সময় ছিল আপনার অধীন অনুগত
কমরেড ক্রমান্বয়ে দিগন্তরেখা সরে যাচ্ছে ইদানিং
মানুষের বলবার কথাগুলো আঁকহীন সাদা স্লেট আর
মার্বেল পাথরে খোদাই বর্ণহীন
কখনো কি মনে হয়েছে আপনার:
বৃথাই নষ্ট হলো যৌবনের বসন্ত রঙীন
সমাজতন্ত্রের পরাভব
ধ্বসে যাচ্ছে: মূল্যবোধ— সাম্য— স্বাধীনতা
সোভিয়েত রাশিয়ার পতন
কতোক্ষণ আর লড়াই চলে একাকী
বন্ধুদের ঘরে ফেরা; ততোক্ষণে স্তব্ধ লাল ঝাণ্ডা মিছিল
তবু সুউন্নত গ্রীবা একাগ্র লড়াইয়ের বাসনা
রণক্ষেত্র আগলে রাখার কৌশল
আশাবাদী করে কাউকে কাউকে
কমরেড চলুন এগিয়ে যাই বৈরী পৃথিবীতে
পরিচিত মুখগুলো হারিয়ে যাচ্ছে শুধু
ঝাপসা হয়ে আসছে পৃথিবী
ছোট হয়ে আসছে সীমানার দেয়াল
পরিচতি মুখগুলো হারিয়ে যাচ্ছে শুধু
ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে…
ক-রো-না: শূন্য থেকে শুরু
বদলে যাবে পৃথিবী কতটা
তাণ্ডব শেষে
প্রকৃতি প্রতিশোধ
না আশীর্বাদ
জানাবে কে কাকে
চিলতে জানালায়
বন্দী ডাহুক
ক্ষণ গণনা শুধু
অবিমৃষ্য সময়
ঘটছে দ্রুত রূপান্তর
ভেতরে বাইরে
ক-রো-না স্বপ্নে
অস্থি মজ্জায়
চলছে
চলুক…
আসন্ন পরিবর্ত্তন
পরিবর্ত্তন আসন্ন পৃথিবীর…
ন্যাংটো করে দিল ভেতরটা
সযত্ন চাকচিক্য আর মরিচীকা
জৌলুস আর উন্নয়ন
বিরামহীন প্রোপাগান্ডা
অসুখ নিরাময়
না-কি পরিশুদ্ধি আত্মার
শূন্যেই নেমে এল সভ্যতা
সূচনা যেখান থেকে
অহর্নিশ উড়ছে লাল পতাকা
আসন্ন পরিবর্ত্তন মানুষেরও
অংশ বৈ কিছু নয়
ভুলেই ছিল অন্ধ আদিম একচক্ষু দৈত্য
আর সরিয়ে ফেলল নিজেকে
প্রকৃতি থেকে
চক্ষুর ভেতর থেকে জন্ম নিচ্ছে অন্য কেউ…
ভঙ্গুর সময়
উদলা করে দিল সবকিছু
মেকিত্ব, মেকাপের আড়াল
তৃতীয় চোখ দেখছে সারি সারি লাশ
বয়ে নিচ্ছে কারা যেন
সভ্যতার কান্না শুনতে কি পাও?
হায় রুদ্ধতা
শেকলের ভেতর দেখছি আরেক শেকল
অন্ধত্ব, ব্যাধির চাইতেও ঘোর তমসা
এ অরণ্য ঢাকা ছিল এদ্দিন
সহস্র প্রদীপ জ্বেলেছে কেউ গূঢ় অন্ধকারে…
বোতলবন্দী বাঘ অথবা আত্ম-প্রতিকৃতি
সম্ভবত নিজেকে ভালবাসে সে সবচে বেশী
ফিরে যায় বারবার আত্ম-প্রতিকৃতিতে
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আঁকে নিজেকে; নিজস্ব মুখায়ব
আয়নায় দেখে আর ভাবে… ভাবে… ভাবে…
মানুষ ভালবেসে নিজেকেই সবচে বেশী
তারপর বন্দী হলে বোতলে
বাঘ বাঘ খেইল…
আদমসুরত
সুশোভন একটি চপ্পল
জানান দিচ্ছে নিজেকে
ঘুরে ঘুরে
কী কাজে লাগে চপ্পল?
নকশাদার সুন্দর
অনেকটা মানবীয়
নৈতিকও বটে!
সময়ের মানদন্ডে গুণছেন কেউ কেউ
অতীতের এক স্ফিনিক্স পাখি ভাসছে দু’চোখে
আশাহত ঐতিহ্যের বেদনাদায়ক পরিসমাপ্তি
চপ্পল ঘুরে মগজের কোষে
আর প্রলম্বিত হয়
তৃতীয় গণতন্ত্র
সুপ্তি জাগরণ
অনিশ্চয়তা
থেমে থাকে না কিছুই যায় থমকে হয়ত
অতঃপর সুনসান নীরবতা
অপূর্ব্ব নীরবতা
প্রতি যাপন শেষে
নিঃশ্বাসের পর
পরবর্ত্তী ধাপ
জানে না কেউ
অদ্ভূত অনিশ্চয়তায়
এক দীর্ঘ জীবন
বোধহীন
খেয়ালের অগোচরে…
দেয়াল
এখন নিজের হাত বিশ্বস্ত নয়
অদৃশ্য দেয়াল গড়ে দিয়েছে কেউ
সে-কি ইশ্বর পরম মমতার প্রকৃতি
না-কি সৃজন মানুষেরই
রক্তে অমানবিকতা
বিশ্বাস হন্তার অপর নাম মানুষ
দূরে সরিয়ে দিচ্ছে নিজেকে
একি অপূর্ব্ব প্রতিশোধ
ফিরে আসুক মানুষ
তার বিশ্বস্ত হাতের কাছে
পুনর্ব্বার
ফেরার মানুষ অচেনা তার নিজের কাছেই…
অন্তর্ধান
স্বপ্ন থেকে আসে যে হন্তারক
অহর্নিশ তাকে আমি
আটকাই মায়াজালে
আছি এখন লকডাউনে
হিজিবিজি হিজিবিজি
মস্তিষ্কের কোষে কোষে
সুদূর বার্ত্তা বয়ে যায়
রটে যায় গৃহবন্দিত্বের
অসময়ে
কার্পণ্য নেই তবু
অন্তর্জ্জাল বয়ে যে স্রোত
বহমান
আপন মুখচ্ছবি
অন্যের আয়নায়
কদাকার
এতটা খারাপ কোন দুঃস্বপ্নও
বুঝি উত্থিত শিশ্মের হঠাৎ
অবদমন পারে না ঠেকাতে
ভাল সেই গুহার রূপক
শূন্যতায় সমর্পন নিজেকে
হয়ে যাওয়া অদৃশ্য
চারপাশ থেকে
চেতনা অন্তর্ধান হও…
লুপ্ত হও…
শুধু কথা বলা বারণ
তবু চুপ করে আছি; চুপ করা মানায়
মিছে মিছে ছিনিমিনি খেলা সাপলুডু
শূন্য থেকে শুরু; গুরু দেখছি না কিছু
চোখের উপর জমেছে পরত
বাইরে পারদে ওঠানামা
পঞ্চাশের এই বাংলাদেশে
এমন স্বপ্ন ক’জন দেখে
থাকলে জীবিত বলতে কী এই কথা তুমিও
‘চেয়েছিলাম আমরা এই বাংলা?’
সারারাত
চলছে বৃষ্টি
কষছি আঁক মাটিতে
হঠাৎই দেখি একদল ঘোড়সওয়ার
ধেয়ে আসে
থাম থাম
মুছো না কালের রেখা
অনেক কথা অনেক ছবি
যায় না ধরা সেলুলয়েডে
শুধু অস্পষ্ট আঁচর জমে থাকে
কতগুলো বানরের মৃতদেহ
ফিরে আসে
চুপ থাকো চুপ থাকো
বড্ড অসহায় হয়ে গেছে
এই অস্থির সময়
.
.
.
.
রিসি দলাই
জন্ম- ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে।
প্রকাশিত গ্রন্থ
মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক
বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ
পক্ষ-প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু-মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক
নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক
নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক
ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক
এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক
আকাশ ডাক: editor.charbak@gmail.com
মুঠোফোন- ০১৫৫২৪১৯৪৪২