‘পথের পাঁচালী’ থেকে বহুদূরে বিহারের গয়া জেলার দক্ষিণ ভাগলপুরের এক আদিম অরণ্যভূমি ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের প্রাণকেন্দ্র। ভাগলপুরের পাথুরিয়াঘাটার জমিদারি এস্টেটে ১৯২৪ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত বিভূতিভূষণ সেখানে এ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ প্রবাসের একাকিত্ব, প্রকৃতির অপরূপ সান্নিধ্য ও আত্মমগ্নতায় বিভূতিভূষণের মন-মানস ধীরে-ধীরে বিস্তৃতি লাভ করেছে এইখানে। লবটুলিয়া বইহার, নাঢ়া বইহারের দিগন্ত বিস্তৃত অরণ্যানি, স্বরস্বতিকুণ্ডির স্নিগ্ধজল ও তার মনোরম বনভূমি, দূর-দিগ্বলয়ে মোহনপুর রিজার্ভ ফরেস্টের ধূসর সীমারেখা, মহালিখারূপের পাহাড়, কুশি নদী ও সাঁওতাল রাজ্যের ধনঝরি পাহাড়ের শৈলশ্রেণি, বিভূতিমানসে যে অতিন্দ্রিয় প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল ‘আরণ্যক’-এ তারই প্রকাশ ঘটেছে। এর বিস্তার বর্ণনায় লেখকের যেন তদ্গত, অধ্যাত্মভাব। ‘আরণ্যক’ ম্যানেজার সত্যচরণের জবানিতে উত্তম পুরুষে রচিত হলেও একে বিভূতিভূষণের প্রবাসবাসের শুষ্ক দিনলিপি বা প্রতিবেদন বলা যায় না— এটি একটি পুরোপুরি উপন্যাস। এ প্রসংগে লেখক নিজেই বলেছেন, ‘মানুষের বসতির পাশে কোথাও নিবিড় অরণ্য নাই। অরণ্য আছে দূর দেশে, যেখানে পতিত-পক্ব জম্বুফুলের গন্ধে গোদাবরী তীরের বাতাস ভারাক্রান্ত হইয়া ওঠে। ‘আরণ্যক’ সেই কল্পনালোকের বিবরণ। ভ্রমণবৃত্তান্ত বা ডায়েরি নহে— উপন্যাস’।
অনেকে মনে করেন ‘আরণ্যক’ তাঁর সকল উপন্যাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। কিন্তু এ কথাও সত্য যে ‘পথের পাঁচালী’র যে অবিস্মরণীয় জনপ্রিয়তা, সর্বব্যাপী খ্যাতি তার পেছনে রয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের জীবন রূপসৃষ্টি ও জীবন-রস পরিবেশনে এক বিশেষ শৈল্পিক দৃষ্টিভংগী। প্রকৃতির এক বিশাল ক্যানভাসে এই শিল্পি তাঁর মানস প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। যে কিশোর অপুকে কেন্দ্র করে ‘পথের পাঁচালী’ আবর্তিত হয়েছে তার পশ্চাতে নিরন্তর রস-সঞ্চালন করেছে অজ্ঞাত অখ্যাত দরিদ্র গ্রাম নিশ্চিন্দিপুর। এই গ্রাম বিভূতিভূষণের নিজের গ্রাম। অপুর চোখ দিয়ে এই দৈনন্দিন দেখা গ্রাম তার ফুল-পাখি, বৃক্ষলতা নিয়ে এক অভিনব পন্থায় আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে। প্রাত্যহিক পুরাতন জগৎ নতুন আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে অপুর অনুসন্ধিৎসু বিস্ময় বিমুগ্ধ শিশুচেতনায় মিলে মিশে সমস্ত গ্রন্থখানিকে এক অনির্বচনিয় সৌন্দর্য ও মাধুর্য দান করেছে। এ যেন স্বয়ং লেখক তাঁর আত্মকথায় মগ্ন। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের জীবনবোধের বৈশিষ্ট্য এখানে সার্থক রূপ লাভ করেছে। প্রকৃতির রূপ বর্ণনায় এবং রূপবৈচিত্র্যে তাঁর যে নিজস্ব স্টাইল এবং গীতিময়তা রয়েছে সেই ঐন্দ্রজালিক শক্তিই নিশ্চিন্দিপুর গ্রামকে সাহিত্যিক মহিমা দান করেছে। সুন্দরের এই মায়াপুরী অপুর শিশুমনকে রসে জ্ঞানে নিয়ত জারিত করেছে। যা রয়ে গেল বাংলা সাহিত্যে চিরকালব্যাপী। প্রকৃতির এই ভাব-তন্ময়জগৎ অবস্থা বারে বারে ঘটেছে তাঁর রচনায়। তাই উত্তর কৈশোর ও যৌবনের নির্মম সংগ্রামমুখর দিনগুলোতে ‘অপরাজিত’র উদাসীন সংসারত্যাগী অপু যখন তার ছেলেকে শৈশবের গ্রাম নিশ্চিন্দিপুরে আবাল্য পরিচিতা স্নেহময়ি রানুদির হাতে তুলে দেয় সেখানেও শিশু কাজলের মনোরাজ্যের যে বিস্ময়কর খেলা চলে তা যেন ছোটবেলার অপুরই প্রতিচ্ছবি। ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’র এই প্রকৃতি জননির মত স্নেহময়ি, মাধুর্যময়ি। এখানে প্রকৃতি আর মানুষ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আবার এই প্রকৃতি ‘আরণ্যক’-এ হয়ে উঠেছে শান্ত অথচ রহস্যময়ি, লেখকের কাছে অনেকটা ঈশ্বর-সান্নিধ্যের রূপান্তর। প্রকৃতির অন্তর্নিহিত পরমাত্মার সাথে মানবমনের গূঢ়-রহস্য মিলে এক অনির্বচনীয় ভাবজগতের সৃষ্টি হয়েছে।
সমগ্র বাংলাসাহিত্যে ‘আরণ্যক’র মতো উপন্যাস নিঃসন্দেহে আর একটিও নেই। বিভূতিভূষণের মন-মানস যে প্রকৃতি প্রেমে আবদ্ধ তারই পরিচয় আছে এর ছত্রে ছত্রে। উপন্যাস হলেও ‘আরণ্যক’-এ ধারাবাহিক কোনো কাহিনি নেই। এ যেন একান্তই লেখকের মনোজগতের সাথে প্রকৃতির অন্তর্নিহিত বাণীটির অধ্যাত্ম মিলন ঘটেছে। আর তারই ফাঁকে ফাঁকে সঞ্চরমান মানব-মানবীর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার খণ্ড খণ্ড ছবির প্রতিফলন। ভাগলপুরের আজমাবাদ, লবটুলিয়া, ইসমাইলপুর, মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের বিশাল ক্যানভাসের পটভূমিতে কোনো নায়ক নেই। নায়িকা এখানে স্বয়ং প্রকৃতি, পটভূমির আবরণ ছেড়ে মঞ্চে আবির্ভূতা। ভাগলপুরের এই বিশাল অরণ্য দর্শনে কোলকাতার যুবক সত্যচরণের নাগরিক মন প্রথম দিকে বিরক্ত ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তারপর যতই দিন যেতে থাকে দেখা যায় যে প্রকৃতির সম্মোহনি শক্তির নাগপাশে আস্তে আস্তে যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বাধা পড়ছে। লবটুলিয়ার দিগন্ত বিস্তৃত বনরাজির অপরূপ সোন্দর্য, ফুলুকিয়া বইহারের জ্যোৎস্নালোকিত রাতের মায়াময় পরিবেশ, স্বরস্বতীকুণ্ডীর ঘন পুষ্পপল্লবী, পাখির কলকাকলি মুখরিত স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ যেন ঐন্দ্রজালিকের সৃষ্টি করত। সত্যচরণের মনে হত সত্যিই এটি পরীরাজ্য, পরীদের আস্তানা। কখনও শুধুমাত্র বনের ভিতর ঘুরে বেড়ানোর জন্য ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে-নির্জন নিঃশব্দ রাত্রি, দু’দিকে ঘোর জঙ্গল, উপরে চন্দ্রাতপ বিছানো— তারই আলোকে দেখেছে কুণ্ডীর জলে মুখ ডুবিয়ে জলপানরত বাচ্চাসহ নীলগাই ও হায়নার দল। কোনো কোনো দিন স্বরস্বতীকুণ্ডীর নদীর ধারে বিশাল তরুতলে চুপচাপ শুয়ে দূর আকাশে দৃষ্টি মেলে দিয়েছে। কুণ্ডীর তিনদিক ঘনবনে বেষ্টিত। যেদিকে ফাঁকা সেদিকে তাকিয়ে বহুদূর প্রসারিত নীল আকাশ ও দূরের অস্পষ্ট শৈলমালা অরণ্য প্রেমিক সত্যচরণের মনকে যেন ‘বেলুনের মতো ফুলাইয়া পৃথিবীর মাটিতে উড়াইয়া লইয়া চলে’।
‘আরণ্যকে’র বিষয়বস্তু প্রকৃতি ও মানুষ। এই প্রকৃতি ‘পথের পাঁচালী’র প্রকৃতির চেয়ে ভিন্নতর স্থানিকভাবে ও মেজাজে। বাংলার প্রকৃতির রূপ শান্ত ও সুশীতল। কিন্তু বিহারের নিবিড় অরণ্যের প্রকৃতি শান্ত সুন্দর, কোমল মাধুর্যের পাশাপাশি ভয়াল ও নিষ্ঠুর। এই অরণ্যে বাঘ-ভালুকের যেমন নির্ভয় চারণা তেমনি মাঝে মাঝে দাবানল তার লেলিহান শিখা বিস্তার করে ছুটে আসে লোকালয়ে, গ্রাস করে নেয় জনপদ। দিগন্ত বিস্তৃত রুক্ষ্ম মাঠের মাঝখানে বা একঘেঁয়ে বনপাহাড়ের মধ্যে গ্রীষ্মের দাবদাহে দিকভ্রান্ত পথিকের মৃত্যু যেন অনিবার্য। অরণ্যের বন্যরূপ এবং দূরের অনুচ্চ শৈলশ্রেণির অপার্থিব মৌনতা জন্ম দেয় অতি মানবিয় কল্প-কাহিনির। স্বরস্বতীকুণ্ডীর অপরূপ বন রঘুবিরের কাছে তাই মায়ার কুণ্ডী। যেখানে জ্যোৎস্নারাতে পরীরা ডাঙ্গায় পাথরে কাপড় খুলে রেখে জলে নামে। আর জলের উপর পদ্মফুলের মতো জেগে থাকে তাদের মুখ। একসময় বনের সার্ভেয়ার ফতে সিংকে প্রাণ দিতে হয় এই জলে। সে-কি তাদের মায়ার টানে? কখনোবা গনু মাহাতোর সেই বহুবর্ণিত বুনো-মহিষের দেবতা ভয়ংকর দর্শন টাঁড়বারো অরণ্য পথের গহনে এসে আবির্ভূত হয়। অথবা বোমাইবুরুর জঙ্গলে বৃদ্ধ ইজারাদারের তরুণ ছেলেটি মারা গেছে কোন অশরীরী প্রাণির হাতে— এ-ও যেন বিশ্বাস হয় সত্যচরণের। মনে অজানা আশংকা ছায়াপাত করে।
‘…কাছারিতে একলা নিজের ঘরটিতে শুইয়া বাহিরের ধপধপে সাদা, ছায়াহীন উদাস, নির্জন জ্যোৎস্নারাত্রির দিকে চাহিয়া কেমন একটা অজানা আতংকে প্রাণ কাঁপিয়া উঠিত। মনে হইত, কলিকাতায় পালাই। এসব জায়গা ভাল নয়, এর জ্যোৎস্না ভরা প্রকৃতি রূপকথার রাক্ষসি রানীর মত, তোমাকে ভুলাইয়া বেঘোরে লইয়া গিয়া মারিয়া ফেলিবে। যেন এসব স্থান মানুষের বাসভূমি নয় বটে, কিন্তু ভিন্ন লোকের রহস্যময়, অশরীরী প্রাণিদের রাজ্য।’
আবার প্রকৃতির এইসব বৈপরিত্যকে মেনে নেবার শক্তিও সত্যচরণের অপরিমেয়। তাই জমিদারির কাজে পূর্ণিয়া যাওয়ার পথে গভীর রাত্রে ঘোড়া ছুটিয়ে চলতে গিয়ে মাইলের পর মাইল বনজ্যোৎস্না দেখে তার মনে আধ্যাত্মিক অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতি ধরা দিয়েছে এক অপরূপ সম্ভারে, ‘আর কি সে জ্যোৎস্না! কৃষ্ণপক্ষের স্তিমিতালোক চন্দ্রের জ্যোৎস্না বনে-পাহাড়ে যেন এক শান্ত, স্নিগ্ধ অথচ এক আশ্চর্র্যরূপে অপরিচিত স্বপ্নজগতের রচনা করিয়াছে— সেই খাটো খাটো কাশজঙ্গল, সেই পাহাড়ের সানুদেশে পীতবর্ণ গোলগোলি ফুল, সেই উঁচু নিচু পথ সব মিলিয়া যেন কোন বহুদূরের নক্ষত্রলোক— মৃত্যুর পরে অজানা কোন অদৃশ্যালোকে অশরীরী হইয়া উড়িয়া চলিয়াছে।’
প্রকৃতির এই মিস্টিক বা রোমান্টিক রহস্যময়তা, এই সর্বব্যাপী প্রসন্নতাই আরণ্যকের মূল সুর। এখানে ঈশ্বর যেন সর্বত্রব্যাপী। অতিসূক্ষ্ম অনুভূতির মাধ্যমে তাকে পাওয়া যায়। ‘আরণ্যক’ এই রহস্যময় অধ্যাত্মানুভূতির শাস্ত্র। আর তার কথক সত্যচরণ যেন ধ্যানগম্ভীর মন্ত্র-পুরোহিত। এই পুরোহিত বিভূতিভূষণ স্বয়ং নিজে। যেখানে তিনি বলেছেন— ‘আমার মনে যে দেবতার স্বপ্ন জাগিত তিনি যে শুধু প্রধান বিচারক, ন্যায় ও দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, বিজ্ঞ ও বহুদর্শী কিংবা অব্যয়, অক্ষয় প্রভৃতি দুরূহ দার্শনিকতার আবরণে আবৃত ব্যাপার তাহা নয়— নাঢ়া বইহারের কি আজমাবাদের মুক্ত প্রান্তরে কত গোধূলিবেলায় রক্ত-মেঘস্তূপের, কত দিগন্তহারা জনহীন জ্যোৎস্নালোকিত প্রান্তরের দিকে চাহিয়া মনে হইত তিনিই প্রেম ও রোমান্স, কবিতা ও সৌন্দর্য, শিল্প ও ভাবুকতা— তিনি প্রাণ দিয়া ভালবাসেন, সুকুমার কলাবৃত্তি দিয়া সৃষ্টি করেন, নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলাইয়া দিয়া থাকেন নিঃশেষে প্রিয়জনের প্রীতির জন্য— আবার বিরাট বৈজ্ঞানিকের শক্তি ও দৃষ্টি দিয়া গ্রহ-নক্ষত্র নীহারিকার সৃষ্টি করেন।’
প্রকৃতিকে অনুধাবন করার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হল মানুষ। প্রকৃতির এই অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য অনুধাবনে অজ্ঞেয়-অসীম অধ্যাত্মসত্তাই বিভূতিভূষণের আত্মার দর্শন ঘটিয়েছে। এরই সাথে সংগতি রেখে আরণ্যকের ভাষা হয়ে উঠেছে সহজ, সরল, কিছুটা রোমান্টিক, কিছুটা মিস্টিক। ‘পথের পাঁচালী’র আবেশবিহ্বল গীতিময়তা এখানে নেই বরং আছে এক উদাত্ত গম্ভীর উচ্চাঙ্গসুরে বর্ণিত বস্তুনিষ্ঠ ও নিরাভরণ আটপৌরে ভাষার চমক যা ‘আরণ্যকে’র প্রকৃতির মতোই অর্ধেক অরণ্য অর্ধেক মানবী।
আরণ্যকের প্রকৃতিতে মানুষ আছে। তারা প্রকৃতির ওপরে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেনি তবে এই মামুলি স্থানীয় দেহাতী মানুষ, রাজপুত মহাজন, ফসল কাটার মৌসুমে আগত কাটুনি মজুরেরা, সাঁওতাল রাজা তার নাতনী-দুহিতা কেউ কাহিনিতে উপেক্ষিত যেমন নয় তেমনি অতি মানবীয় গুণে তাদেরকে সাধারণের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রাখার চেষ্টাও করা হয়নি। অশিক্ষিত নিরীহ, দরিদ্র গাঙ্গোতা প্রজা নিয়ে লবটুলিয়ার জমিদারি। এখানকার মাটি রুক্ষ্ম। ধান হয় না নাবাল জমি নেই বলে। মকাই বা চিনার দানা খেয়ে এদের জীবন কাটে। এখানকার প্রকৃতি- হ্রদ নদী, টিলা, পাহাড়, চারণভূমি, মকাইয়ের ক্ষেত, আবাদি জমির সর্ষে ফুলের হলুদ গালিচা নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ আর মানুষগুলো তারই ওপর নির্ভর করে আছে। এদের প্রতি সত্যচরণের অকৃপণ স্নেহ, ভালবাসা, দায়িত্ববোধ তার প্রকৃতি প্রেমিক মনকে তার কর্তব্য থেকে কোথাও বিচ্যুত করতে পারেনি। মানুষের প্রতি এই ভালবাসা ও দায়িত্ববোধ ‘আরণ্যক’ উপন্যাসকে তাই বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বিভূতিভূষণের মানুষগুলো প্রায়ই এসেছে গ্রামের সহজ সরল পরিমণ্ডল থেকে। আর এদের প্রতি তার স্বাভাবিক মমত্ববোধ শহরের শিক্ষিত ভদ্রজনের তুলনায় একটু বেশি পক্ষপাতদুষ্টই দেখা যায়। মানুষগুলো এসেছে অরণ্যের এক একটা অনিবার্য উপাদানরূপে। ধাওতাল সাহু, রাজু পাঁড়ে, গনু মাহাতো, গনোরি তেওয়ারি, যুগলপ্রসাদ, দোবরু পান্না, ভানুমতী এরা যেন অর্ধেক অরণ্য অর্ধেক মানুষ। এদের কথার রহস্য যেন অরণ্যেরই ভাষা। অরণ্যের বাইরের কুন্তা, মঞ্চী, ধাতুরিয়া, মটুকনাথ পাঁড়ে, রাজপুত রাসবিহারী সিং প্রত্যেকেই স্বকিয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। প্রকৃতির বিশালতা মানুষের মনকে প্রভাবিত করে, উদার করে।
তাই সুদখোর মহাজন হয়েও ধাওতাল সাহু তার পাওনা টাকার কথা খাতককে বলতে পারে না। ম্যানেজার সত্যচরণ সত্যিই তাকে সুদখোর মনে করবে এই ভয়ে বরং সে তার যাতায়াতের পথ পরিবর্তন করেছে। একবেলা খাবার জোটে না যে মটুকনাথ পাঁড়ের, সেও তার বংশকৌলিন্য রক্ষার জন্য জমির বদলে একটা ছোট্ট ‘টেলি’ পেলেই খুশি হয় যেখানে খাবার লোভে বাপ-মা তাড়ানো মহিষ চড়িয়ে রাখাল বালকেরা জুটে আর তাদেরকে মুগ্ধবোধ পড়িয়েই মটুকনাথ তৃপ্ত হয়। এই বনাঞ্চলের মানুষগুলোর না আছে চাহিদা না কোনো বৈষয়িক বুদ্ধি। সাত্বিক রাজু পাঁড়ের কাছে তাই দুই বিঘা জমির পরিবর্তে সংস্কৃত চর্চা করা বা জরি বুটির টোটকা চালানো অধিক পুণ্যের বলে মনে হয়। সে বলে ‘টাকার লোভ, পাওনা দেনার কাজ যেখানে চলে, সেখানকার বাতাস বিষিয়ে উঠে। সেখানে ওরা থাকেন না, কাজেই এখানে দা কুড়ুল হাতে করলেই দেবতারা এসে হাত থেকে কেড়ে নেন, কানে চুপিচুপি এমন কথা বলেন যাতে বিষয়-সম্পত্তি থেকে মন অনেক দূরে চলে যায়।’ অরণ্য মানুষকে একধরনের নিরাসক্ত কিন্তু কষ্ট সহ্য করার আসুরিক শক্তি দান করে। পাথরে খোদাই করা কৃষ্ণমূর্তির মতো কুচকুচে কালো রঙ, সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর, সুন্দর চেহারার যাত্রাদলের নাটুয়া বালক ধাতুরিয়া। শুধু নুন দিয়ে চিনার দানা খেয়ে জায়গায় জায়গায় নাচ দেখিয়ে বেড়ানোতেই তার আনন্দ। অথচ ‘ছক্কর’ নাচ শেখার সেই আসুরিক কষ্ট সহ্য করার মানসিকতায় তার শিল্পিসত্তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। ম্যানেজার সত্যচরণ তাকে চাকুরির লোভ দেখিয়েও আটকাতে পারেনি এবং এই নাচের নেশাই শেষ পর্যন্ত তার অকাল মৃত্যু ঘটায়। মঞ্চী সত্যচরণের আর একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার। ফুলকিয়ার আবাদি জমির ফসল কাটার জন্য আগত কাটুনি মজুর বুড়ো নকছেদী ভকতের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী মঞ্চী, তার চমৎকার স্বাস্থ্য। যৌবনের সাধ-আহ্লাদ পূরণে একতিল ফাঁক নেই তার। কাজেকর্মে পটু, প্রেম-প্রীতিতে লাস্যময়ী মঞ্চী ফসল বেচে সস্তা প্রসাধন সামগ্রি কিনে। তার সরলতার সুযোগে চতুর ফেরিওয়ালা তাকে ঠকিয়ে যায়। সামান্য হিংলাজের মালা কিনে সব পেয়েছি দেশের সুখ অনুভব করে মঞ্চী। বন্য মেয়ে বাঘ-ভালুক, বুনো হাতি কোনো কিছুরই পরোয়া করে না অথচ একমাত্র সন্তানের মৃত্যুশোক তার সকল বন্ধন যেন ছিন্ন করে দিল। এতদিনের সাজানো সংসার পুতুল খেলার মতোই ভেঙে দিয়ে, যৌবনের সকল সাধ-আহ্লাদ মাড়িয়ে দিয়ে মঞ্চী হল নিরুদ্দেশ। অরণ্য তার মানুষগুলোকে কি এইভাবেই গড়ে তোলে? শুধু ভালবাসার বিশ্বাসের ওপরই তাদের দান-প্রতিদান। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবা তাদের কাজ নয়। সত্যচরণের তাই দুঃখ হয় এই ভেবে যে হয়তো এই সহজ সরল বন্য মেয়ে কোনো একদিন আসামের কুলিগিরিতে চালান হয়ে যাবে। এইভাবে অসীম সম্ভাবনাময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে।
আমরা আরও দেখি সাঁওতাল রাজা দোবরু পান্নাকে, যার রাজত্বের চিহ্নমাত্র নেই, দারিদ্র্যই যেন নিত্যসঙ্গী সেই বিরানব্বই বছরের বৃদ্ধ সাঁওতাল রাজা শ্রদ্ধা জাগিয়েছে সত্যচরণের মনে, তাঁর নাতীর মেয়ে ভানুমতীর কাল রঙ, অপূর্ব দেহকান্তি, লাবণ্যময় মুখশ্রী দেখে সত্যচরণের মনে হয় ‘এদেশের প্রান্তর যেমন উদার, অরণ্যানি, মেঘমালা শৈলশ্রেণী যেমন মুক্ত ও দূরচ্ছন্দা ভানুমতীর ব্যবহার তেমনি সঙ্কোচহীন সরল, বাধাহীন। মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারের মতো স্বাভাবিক।’ হেমন্তের অপরাহ্নে ধনঝরি পাহাড়ের চূড়ায় পুষ্পিত সপ্তপর্ণের বনে দাঁড়িয়ে অনার্য রাজকুমারি ভানুমতী যেন সাক্ষাৎ বনদেবি সত্যচরণের মনে দুরাশার স্বপ্ন জাগিয়ে তোলে ‘এখানেই, যদি থাকিতে পারিতাম! ভানুমতীকে বিবাহ করিতাম। এই ঘরে জ্যোৎস্না ওঠা দাওয়ায় সরলা বন্যবালা রাঁধিতে রাঁধিতে এমনি করিয়া ছেলেমানুষী গল্প করিত— আমি বসিয়া বসিয়া শুনিতাম, আর শুনিতাম বেশি রাত্রে ঐ বনে হুড়ালের ডাক, বনমোরগের ডাক, বন্যহস্তির বৃংহতি, হায়েনার হাসি। ভানুমতী কাল বটে, কিন্তু… ওর ওই সতেজ সরল মন! দয়া আছে, মায়া আছে, স্নেহ আছে— তার কত প্রমাণ পাইয়াছি। ভাবিতেও বেশ লাগে। কি সুন্দর স্বপ্ন!’ ভানুমতীর মতো কুন্তাও বিভূতিভূষণের আর একটি সৃষ্টি। বাঈজীর মেয়ে বলে মুসম্মত কুন্তা রাজপুতের ঘরনি হয়েও সমাজে সম্মান ও স্বীকৃতি পায়নি। স্বামীর মৃত্যুর পর আত্মমর্যাদার শক্ত আবরণে থেকে স্বামীর স্মৃতিকে বুকে ধরে বন্যফলমূল কুড়িয়ে কখনো-বা জমিদারের ম্যানেজারের ভুক্তাবশিষ্ট চেয়ে নিয়ে অবোধ সন্তানদের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে, তথাপি ভিক্ষের হাত প্রসারিত করেনি কারো কাছে। ভদ্র, শান্ত কুন্তা বনের ঋজু কঠিন শাল বৃক্ষের মতো আত্মপ্রত্যয়ি ও মহিয়সী। তাই রাসবিহারী সিং-এর কুপ্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে ফিরে আসে সে লবটুলিয়ায়। তার ‘জান দেগা বাবুজি, ধরম দেগা নেহি’— এই প্রেমে অবিচল, সততায় পরিপূর্ণ গৌরবের বাক্য সত্যচরণকে শ্রদ্ধাবনত করেছে। কুন্তার শক্তির উৎস এই পাহাড়ি পরিবেশ। যেন কোনো ছলনা খাটে না এখানে। সত্যচরণের বিস্ময় জাগে ‘এই সে কাশির বাঈজীর মেয়ে, প্রেমবিহ্বলা কুন্তা। প্রেমের উজ্জ্বল বর্তিকা এই দুঃখিনি রমণীর হাতে এখনও সগৌরবে জ্বলিতেছে। তাই ওর এত দুঃখ-দৈন্য, এত হেনস্থা, অপমান— প্রেমের মান রাখিয়াছে কুন্তা।’ সত্যচরণ তাই দশ বিঘা জমি দান করে কুন্তাকে আর গিরধারীলালের রোগশয্যায় সেবাযত্ন করে তাকে সারিয়ে তুলে ম্যানেজার বাবুর সেই ঋণ শোধ করে কুন্তা।
তবে আজমাবাদের কাছারির মুহুরী যুগলপ্রসাদ যেন সত্যচরণের অভিন্ন আত্মা, বিভূতিভূষণের এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম সৃষ্টি এই যুগলপ্রসাদ। কিসের টানে মুহুরীর কাজ ফেলে বহুদূর স্বরস্বতী কুণ্ডীর বন্য-প্রকৃতিকে সাজিয়ে দিতে ছুটে আসে যুগলপ্রসাদ। নানান জায়গা থেকে নানান দুষ্প্রাপ্য ফুল, লতার বীজ এনে বনে পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে লাগায়। সে বীজ থেকে গাছ হয়, ফুল হয় লতার ঝাঁক বেড়ে উঠে দেখে যুগলপ্রসাদের আনন্দ ধরে না, তার সাথে যুক্ত হয় সত্যচরণের সৌন্দর্যপিপাসু মন। স্বরস্বতী কুণ্ডীর বন-পাহাড় হেসে উঠে। খেয়ালি নিসর্গপ্রেমি যুগলপ্রসাদের কোনো বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষণ নেই। সে পাঠ নেয় অরণ্য থেকে আবার অরণ্যকে সাজিয়েই তার আনন্দ। নিছক সৌন্দর্যপ্রেমের এমন স্বার্থহীন পূজারি— এ যেন বিভূতিভূষণের প্রতীকী নির্মাণ। একজনের শিল্প-কাঙ্ক্ষাকে অন্যজন রূপ দিয়ে মূর্ত করে তোলে। তাই মহালিখারূপের পাহাড়ে উঠে দু’জনে অসীম উৎসাহে চিহর ফুলের গাছ খুঁজে বের করে, স্বরস্বতি হ্রদের জলে স্পাইডার লিলির চাষ করে। বিভূতিভূষণের সংবেদনশীল আত্মার জীবনীশক্তি থেকেই ‘আরণ্যকে’র চরিত্রগুলো প্রাণ পেয়েছে। তাই ‘আরণ্যকে’র বন-বনানীর সাথে এই দুঃখী মানুষগুলোকে ভাল-না-বেসে পারা যায় না। সত্যচরণের ভাষণে বিভূতিভূষণ নিজেই তা ব্যক্ত করেছেন ‘শুধু বনপ্রান্তর নয়, কত ধরনের মানুষ দেখিয়াছিলাম। কুন্তা… মুসম্মত কুন্তার কথা মনে হয়… মনে হয় ধাতুরিয়ার কথা… নাটুয়া বালক ধাতুরিয়া।… কত অতি দরিদ্র বালক-বালিকা, নর-নারী, কত দুর্দান্ত প্রকৃতির মহাজন, গায়ক, কাঠুরে, ভিখারীর বিচিত্র জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচয় হইয়াছিল।… ইহাদের কথাই বলিব।’ মানবপ্রীতির নিবিড় রসানুভূতিতে ব্যক্ত প্রতিটি শব্দই যেন কাহিনির শেষে পাঠকের মনে এক বেদনাবিধুর হাহাকারের সৃষ্টি করে।
যে অরণ্য প্রান্তরে বিভূতিভূষণ এদের আবিষ্কার করেছিলেন সেই নাঢ়া-লবটুলিয়া শেষ পর্যন্ত আর তার ঘন-অরণ্যানি নিয়ে অক্ষত থাকতে পারেনি। মানুষের প্রয়োজনে প্রায় দশ হাজার বিঘা প্রসারিত সুউচ্চ তরুশ্রেণি আচ্ছাদিত ঘন বনভূমিকে চাষের জন্য প্রজাবিলি করে দিতে হয়েছে সত্যচরণকে। শত শত বছর ধরে প্রকৃতি নিভৃতে যে নিকুঞ্জ রচনা করেছিল জনমজুরদের নির্মম হাতে এক ফুৎকারে যেন তা উড়ে গেল। চাকরির দায়িত্বে বাঁধা পড়ে এই নিষ্ঠুর কাজে সত্যচরণকে সায় দিতে হলেও তার অন্তরের হাহাকার পাঠকের মনকেও নাড়া দেয়— ‘এখন কোথাও আর সে রহস্যময়, দূর বিসর্পী প্রান্তর নাই, জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রিতে যেখানে মায়াপরীরা নামিত, মহিষের দেবতা দয়ালু টাঁড়বারো হাত তুলিয়া দাঁড়াইয়া বন্য-মহিষদলকে ধ্বংস হইতে রক্ষা করিত। নাঢ়া বইহার নাম ঘুচিয়া গিয়াছে, লবটুলিয়া এখন একটি বস্তিমাত্র। যে দিকে চোখ যায়, শুধু চালে চালে লাগানো অপ্রকৃষ্ট খোলার ঘর। কোথাও-বা কাশের ঘর। ঘন ঘিঞ্জি বসতি… টোলায় টোলায় ভাগ করা। ফাঁকা জায়গায় শুধু ফসলের ক্ষেত।… ধরণীর মুক্তরূপ ইহারা কাটিয়া কাটিয়া টুকরা টুকরা করিয়া নষ্ট করিয়া দিয়াছে।’ সত্যচরণের এই মর্মযাতনা এবং তার ফিরে আসার মধ্যে কাহিনির শেষ হয়েছে। এক অন্তহীন দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে ক্ষমা চেয়েছে ‘হে অরণ্যানীর আদিম দেবতারা, ক্ষমা করিও আমায়।’ এই দীর্ঘশ্বাস এই মর্মযাতনা মানবগোষ্ঠির প্রয়োজনের বিরুদ্ধে বিভূতিভূষণের প্রাণের উৎসারিত বিলাপ। মানুষের প্রয়োজনে প্রকৃতি এভাবেই চিরদিন পরাজয় বরণ করে এসেছে। এই সত্য অবলোকন করেছে সুন্দরের দুই পূজারি সত্যচরণ আর যুগলপ্রসাদ। প্রকৃতির বনবীথিকা টুকরো হয়ে যায় কুঠারের কঠিন ফলায়। জমিদারের লোভের হাত প্রকৃতির মায়ারূপে মুগ্ধ হয় না। তাই তার বুক চিরে গড়ে ওঠে নির্দয় মানুষের লোকালয়। এ শুধু বিভূতিভূষণের নাঢ়া বইহার বা লবটুলিয়া বইহারের ঘন অরণ্যানির কথা নয়— যুগের পর যুগ ধরে প্রকৃতির বুক জুড়ে চলছে এই ধ্বংসের খেলা। মানুষের চাহিদা অসীম। তার প্রয়োজনের বেড়া অসংযত। প্রকৃতির মৌনতাকে সে তার যথেচ্ছাচারের হাতিয়ার মনে করে। পক্ষান্তরে প্রকৃতিকেই ছেড়ে দিতে হয় তার ভাণ্ডার। মানুষ একবারও চিন্তা করে না তার কাজের অবশ্যম্ভাবী পরিণতির কথা।
আজও প্রকৃতিকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে তার মারাত্মক পরিণতি ক্রমে ক্রমে বিষবাষ্প হয়ে মানুষের শ্বাসরোধ করেছে। এই ধ্বংসযজ্ঞে বলি হচ্ছে মানুষের হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সভ্যতা। মানুষের দেশ, জাতি, কৃষ্টি, সমাজ, বুদ্ধি, বিবেক কিছুই আজ আর জাগ্রত নয়। প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ এখানেই। তাই এই অর্ধশতাব্দি পরে বিভূতিভূষণের আরণ্যকের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে ‘হে অরণ্য, হে সুপ্রাচীন, আমাদের ক্ষমা করো।’
বর্ষ ৫, সংখ্যা ৮, ফেব্রুয়ারি ২০০৬