‘সবুজপত্র’ বাংলাসাহিত্যের উজ্জ্বলতর গদ্য অধ্যায় // মজিব মহমমদ

0

‘ঠাকুরমার ঝুলি’ লিখে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার তখন সারাদেশে ব্যাপক পরিচিত। তিনি একবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কারণ? ‘সবুজপত্র’-এ কবিতা পাঠিয়েছেন। অথচ ছাপা হচ্ছে না। এ-যন্ত্রণায় কাতর লেখক। কবিতাটি ছাপা হলেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। যে লেখক সূক্ষ্ম রসিকতায় সাধারণ পাঠকের চিত্ত আলোড়িত করে এত যশ-খ্যাতি কুড়িয়েছেন, লেখা ছাপানোর আগ্রহ এবং ব্যর্থতায়, তার এ দুঃখবোধ কেন, আর কেনই-বা তার রচনাশৈলি নির্বিবাদে অবহেলা করে যাচ্ছে সবুজপত্র। শক্তির দুঃসাহস, বুদ্ধির দুঃসাহস ও আকাঙ্ক্ষার দুঃসাহস নিয়ে, প্রথম যেদিন পত্রিকাটি আত্মপ্রকাশ করে, সেদিন ছিল ২৫ বৈশাখ ১৩২১। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পত্রিকাটির নাম প্রথমে একবার ‘কনিষ্ঠ’ রাখা যায় কি-না, সবাইকে (প্রমথ চৌধুরী/বীরবল, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়) ভেবে দেখতে বলেছিলেন। কিন্তু এটি গৃহীত হয়নি। সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ভাবী পত্রিকাটি হবে একটি বিশিষ্ট সাহিত্য পত্রিকা, মুনাফার লোভ থাকবে না এতে। এমনকি আয়তনেও ছোট হবে’। আর প্রমথ চৌধুরীকে লেখা অন্য একটি চিঠিতে তিনি আরো জানিয়েছেন, ‘সেই কাগজটার কথা চিন্তা কোরো। যদি সেটা বের করাই স্থির হয় তা হলে শুধু চিন্তা করলে হবে না— কিছু লিখতে শুরু করো। কাগজটার নাম যদি ‘কনিষ্ঠ’ হয় তো কি রকম হয়। আকারে ছোট— বয়সেও’। পত্রিকার নাম শেষমেষ স্থির হল সবুজপত্র। রবীন্দ্রনাথের ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরা দেবী ছিলেন একজন ফরাসি সাহিত্যানুরাগী এবং প্রমথনাথের স্ত্রী। সেই সূত্রে প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বিশেষ স্নেহভাজন। বাংলাসাহিত্যে এরকম মানিকজোড় সত্যিই বিরল। প্রথমজন সবুজপত্রের সম্পাদক এবং দ্বিতীয়জন পরিকল্পক। সবুজপত্রে প্রকাশিত রচনার প্রধান গুণই ছিল কীভাবে ‘বড়কে ছোটর মাঝে ধরে রাখা যায়’। আর এ কারণেই সবুজপত্রের পাতায় লেখা প্রকাশ করে বিদগ্ধ জনসমাজে মর্যাদা লাভ একজন লেখকের কাছে বড় হয়ে উঠেছে।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বঙ্গিয় সাহিত্য পরিষদকে একবার মাতৃমন্দির বলেছিলেন। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন কাব্য-মন্দির। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ‘অচলায়তন’ নাটকে একটি মন্দিরের কল্পনা করেছিলেন, কিন্তু দরজাটি ছিল চারদিক থেকে বন্ধ। আলো-হাওয়ার প্রবেশও ছিল নিষিদ্ধ। পরে নিষেধের এই দরজা ভেঙে সকলেই বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। নাটকের এ সুদূরপরাহত আকাঙ্ক্ষাকে বুকে ধারণ করেই যেন সবুজপত্রের সগৌরব আত্মপ্রকাশ ঘটে। সবুজমলাটের মাঝখানে সবৃন্ত তালপাতার গাঢ় ছবি দেখে সুকুমার সেনের কাছে ‘উদ্যত, অদম্য, চিরহরিৎ বাংলাদেশের চিরপরিচিত, চিরকালিন প্রাণের সরল, সবল, উদ্দণ্ড, উর্ধ্বাভিমুখিতার তালধ্বজ’ মনে হয়েছিল। অর্থাৎ জন্ম থেকেই পত্রিকাটি ‘পল্লবিত না হয়ে পুষ্পিত’ হওয়ার লড়াই করে আসছিল। সবুজপত্রগোষ্ঠীর কাছে সাহিত্য হচ্ছে ‘ক্রিটিসিজম অব লাইফ, ইন্টারপ্রিটেশন অব লাইফ, এক্সপ্রেশন অব লাইফ’। অথচ বাংলাসাহিত্য ঠিক এর বিপরীতে অবস্থান করছে। এমনকি সংস্কৃতি-সাহিত্যও। তাঁদের ধারণা ছিল, সংস্কৃতি-সাহিত্যে যুবক-যুবতী ব্যতীত অন্যকারো স্থান নেই। সূর্যবংশের অগ্নিবর্ণ এ রাজ্যের নৃপতির নাম। আর এখানে যারা ভোগবিলাসে মত্ত, তারা সবাই অষ্টাদশবর্ষীয়া (যৌবনে দাও রাজটীকা- বীরবল, সবুজপত্র, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা)। যৌবনের যে ছবি সংস্কৃত দৃশ্যকাব্যে ফুটে ওঠেছে, পরবর্তীতে বাংলাকাব্যেও তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন লক্ষণীয়। এসকল কবিগণ রমণীদেহের উপমা যোগাতে অপার প্রকৃতির সাহায্য নিয়েছেন এবং যৌবনজোয়ার চলে গেলে আর আসে না বলে যারা হা-হুতাশ করে, এমন পুরুষদের দিয়ে শুধু রমণীদেহের প্রশংসা করিয়েছেন। অর্থাৎ আমাদের সাহিত্যে একদিকে বিলাসিচিত্র, অন্যদিকে সন্ন্যাসী; একদিকে পত্তন, অন্যদিকে বন; একদিকে রঙ্গালয়, অন্যদিকে হিমালয়; এককথায়, একদিকে কামশাস্ত্র, অন্যদিকে মোক্ষশাস্ত্র। ভেতরটা শূন্য। ভূমিকা আর উপসংহার নিয়েই যে জীবন নয়, তা বোধ হয় আমাদের কবিগণ বুঝতেই পারেননি। হয়ত একারণেই স্বল্পায়তনের সবুজপত্রে (সম্পাদকের ভাষায়), উপরোল্লিখিত গোছের লেখাতো নয়ই, এমনকি স্ত্রী-পাঠ্য, শিশু-পাঠ্য, স্কুল-পাঠ্য, শিক্ষাপ্রদ প্রবন্ধও কখনও প্রকাশিত হয়নি। কেননা বাংলাসাহিত্য আজ পুনরাবৃত্তিতে ভরে গেছে। তাদেরই ধর্ম পুনরাবৃত্তি, যারা হয় শিক্ষক, নতুবা সমাজের সঙ্গে যাদের ‘ষোল-আনা’ মনের মিল রয়েছে।
সবুজপত্র যাদের রচনায় ‘শব্দের লালিত্য, বর্ণনার মাধুর্য, ভাষার চাতুর্য’ ছিল এবং যারা নিজেদের রচনায় কখনই ‘পুরাণের মায়া ও কিংবদন্তির মোহ’ ত্যাগ করতে পারেননি, তাদের লেখাও এড়িয়ে যেত। কারণ এসব শখের কবির দল আজীবন যা রচনা করে গেছেন, তা সুকুমার সাহিত্য নয়, বরং হয়ে উঠেছে ‘কুমারসাহিত্য’ অর্থাৎ ছেলেমানুষি লেখা। তাছাড়া এরা উত্তরসূরীদের জন্য যে বিশাল রচনাভাণ্ডার রেখে গেছেন, তা ঠিক বাংলাভাষায় রচিত নয় (সাহিত্য সম্মিলিন: প্রমথ চৌধুরী, সবুজপত্র, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ১৩২১)। এদের কাছে বাংলা একটি আটপৌরে ভাষা এবং তারা মনে করতেন, সাহিত্যের ভদ্রতা রক্ষার জন্য দরকার একটি পোশাকী ভাষার। কারণ ‘বাস্তবের হট্টগোলের মধ্যে পড়িলে কবির কাব্য হাটের কাব্য হয়ে পড়ে’। এরূপ পুঁথির শাসনকালকে ধনি বংশের দরিদ্র উত্তরাধিকারীর বৃথা বংশগৌরবের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। দরিদ্র উত্তরাধিকারীর মনে বলবীর্য না থাকতে পারে; শীর্ণ, রক্তহীন, মলিন আদর্শের অভাব নেই। অলসবুদ্ধি, জড়তা, নৈরাশ্য আমাদের মনকে অবসন্ন করেছে, মাংসপেশিকে শিথিল করেছে। অথচ আমরা কায়দা করে এর নাম দিয়েছি ‘আধ্যাত্মিকতা’। বাংলাসাহিত্যে এ আধ্যাত্মিকতার জয়-জয়কার। আমাদের রাজা মশায় (লক্ষ্মণ সেন) যখন আক্রমণের শিকার হন, তখন তিনি মন্ত্রি কিংবা সেনাপতির দ্বারস্থ না হয়ে, শাস্ত্রে এ সম্পর্কে কি লেখা আছে তা জানবার জন্যে ডেকে পাঠালেন পণ্ডিতদের এবং যখন জানলেন যে, মুসলমানেরই রাজা হবার কথা বলা আছে, তখন তিনি নিরবে, নিশ্চিন্ত মনে রাজধানি ত্যাগ করে চলে গেলেন। বাংলাসাহিত্যে এরকম লেখকের অভাব নেই। এদের কাছে সাধুভাষা ‘রাজদুহিতা’র সম্মান পেয়েছে এবং এ রাজভাষায় যা কিছু লিখিত তা আবার স্বরস্বতী মন্দিরের সঙ্গে তুল্য হয়েছে। আর জীবনযাপনে কথ্যভাষাই ছিল যাদের একমাত্র অবলম্বন, তাদেরকে তারা বর্ণশূদ্র এবং কথ্যভাষা আশ্রিত সাহিত্যকে মনে করতেন ‘বিদ্রোহীসাহিত্য’। অমার্জিত কুৎসিত গালিগালাজে অভ্যস্ত সজনীকান্ত দাসের ‘শনিবারের চিঠি’ (১৯২৭) ছাড়াও প্রথমোক্তদের যে কটি মুখপত্র ছিল তাদের মধ্যে চিত্তরঞ্জন দাসের ‘নারায়ণ’ (১৯১৫), জগদীন্দ্রনাথ রায়ের ‘মানসী’ (১৯১৬), দীনেশরঞ্জন দাসের ‘কল্লোল’ (১৯২৩), প্রেমেন্দ্র মিত্র ও শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘কালিকলম’ (১৯২৬) সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে সবুজপত্রীদের অস্ত্র ছিল বুদ্ধিপ্রবণ মননশীলতা এবং তারা যে ভাষায় বক্রোক্তী করতেন অন্যদের তা ছিল নাগরিকতায় মোড়ানো। শেষোক্তদের দাবি ছিল গদ্যকে তারা জীবনীশক্তি দিয়েছেন এবং পদ্যে এনেছেন ‘গদ্যের মনোভাব’ (প্রমথ চৌধুরী তার পদচারণ কবিতাসংকলনের উপহার পৃষ্ঠায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে লিখেছিলেন)। স্পষ্টত দ্বন্দ্বটা আসলে শুরুই হয়েছে গদ্যভঙ্গির সাহিত্যরূপ নিয়ে।
বঙ্কিমচন্দ্র (নব্য লেখকদের প্রতি নিবেদন, বঙ্কিমচন্দ্র, প্রচার, মাঘ ১২৯১) অবশ্য মনে করতেন, ‘যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গলসাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারেন, তবেই লিখিবেন’। এ ধারণারও বিরোধী ছিল সবুজপত্র। তারা মনে করতেন, ‘সাহিত্য ও শিক্ষা এক বস্তু নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য মানুষের মনকে বিশ্বের খবর জানানো আর সাহিত্যের উদ্দেশ্য মনকে জাগানো’। এর ফলে সবুজপত্র, বিশেষ করে প্রমথ চৌধুরীর কাণ্ডকারখানা, কীর্তিকলাপ নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করতে শুরু করলেন। পত্রিকাটির আধুনিকতাই ছিল এখানে, যে আধুনিকতাকে বিরুদ্ধপক্ষীয়রা হাসির ছলে, সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন। কারণ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত থেকে সাধারণ মানুষ একে অপরের কাছে তখন যে ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করত, তাই-ই ছিল সবুজপত্রের ভাষা। তবে মার্জিত রুচি, শিল্পমনের বৈদগ্ধতা ও সংযমধর্মিতার কোন অভাব ছিল না এতে। হয়ত এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমথ চৌধুরীর ক্ষেত্রে ‘অভিজাত’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কোথায় এ ‘আভিজাত্য’? দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রবাদতুল্য সেই উক্তিতে (একটা নতুন কিছু কর) না-কি ‘বিরোধের স্পর্শে’ জেগে ওঠায়? গোষ্ঠিবদ্ধ এ পত্রিকাটি মূলত গদ্যের ফসলই ফলিয়েছে ‘নতুন’ করে। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সুরেশ সমাজপতি, পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায়, গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী, বিপিনচন্দ্র পাল, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখের গদ্যে ভাবালুতা, পুনরুক্তি অকারণ বিশেষণ আর ক্রিয়াপদের একঘেয়েমি লক্ষ করা যায়, এ আত্মঘাতি জাত্যাভিমান ও শ্রেষ্ঠত্বের অসংযম থেকে বাঙালী পাঠককে মুক্তি দিয়েছে সবুজপত্র। আর এ মুক্তিবার্তার মাঝেই লুকিয়ে আছে পত্রিকাটির সার্থকতা।
সবুজপত্র বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য উচ্চতায় স্থান করে নিয়েছে। অথচ এর আয়ু মাত্র দশ বছর। তবে পাঁচ বছর যেতে না যেতেই সম্পাদক পত্রিকাটি একবার বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তা হতে দেন নি। প্রমথনাথ চৌধুরী প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নিজেকে হয়ত কখনই জড়াননি, কিন্তু রাজনীতিচর্চায় তার আগ্রহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। সম্ভবত এসময়েই সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী পত্রিকাটির হাল ধরেন এবং পরে সম্পাদকও নির্বাচিত হন। পত্রিকাটি যখন যাত্রারম্ভ করে প্রথম মহাযুদ্ধ ততদিনে শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধ শেষ হবার আগেই ঘটে যায় রুশবিপ্লব। আর এদিকে ভারত সরকারের রুদ্রনীতির বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতবর্ষে তখন জোরালো আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ঘটে যায় জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড। বৃটিশসরকার প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ। এর পরেই আসে অসহযোগ আন্দোলন। তার পূর্বেই সবুজপত্র বন্ধ হয়ে যায়। সম্পাদক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেল— এমনতর মনে হলেও কারণটা মূলত অন্যত্র। প্রধান কারণ ব্রাইট স্ট্রিটের বাসভবনটি ইতোমধ্যেই অর্থাভাবে বিক্রি করে দিতে হয়েছে। সম্পাদকের এই পৈত্রিক বাড়িতেই বসত সবুজপত্রের সকল রকমের আড্ডা। আড্ডাহীন সবুজপত্র যেন প্রাণহীন দেহ। তাছাড়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ততদিনে বিশ্বভারতী ও বিশ্বভ্রমণ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পত্রিকায় নিয়মিত লেখা পাঠাতে পারছেন না। তাঁর অভাব পূরণ করা সহজ ব্যাপার নয়। আবার সম্পাদক একাই যে নামে-বেনামে পাতা ভরে তুলবেন, সুযোগও হয়ত ছিল, কিন্তু দারুণ সংকোচ বোধ করতেন তিনি। পত্রিকাটি বন্ধই হয়ে গেল। কিন্তু এই দশ বছরের আয়ু নিয়ে পত্রিকাটি যে রচনাসম্ভার অগণিত উত্তরসূরী পাঠকদের কাছে রেখে গেছে তা আজও অমৃতই।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘সাধনা’ (১৮৯২), মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভারতী’ (১৯১৫), রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী’ (১৯০১) তখনও খ্যাতির শীর্ষে। তাছাড়া বছর খানেক আগেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়ে বাংলাসাহিত্যকে বিশ্বদরবারে দিয়েছেন মর্যাদার আসন। তারপরেও কেন তিনি আরেকটি ‘নতুন’ পত্রিকা করতে মনস্থ করলেন, আর কেনই-বা পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব দিলেন স্নেহাশীষ প্রমথনাথকে এ প্রশ্নের জবাবের মাঝেই স্পষ্ট হয়ে ওঠবে সবুজপত্রের (১৯১৪) গুণগত স্বাতন্ত্র্য। প্রমথ চৌধুরী এ বিশাল দায়িত্বভার কীভাবে সামলে নিয়েছিলেন, পূর্বোল্লিখিত আলোচনা থেকেই কমবেশি অনুমেয়। আর রবীন্দ্রনাথ? তিনি তো সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যা থেকেই ‘নতুন’ কৌশলে গল্প লেখা শুরু করলেন। প্রথম সংখ্যাতেই যে গল্পটি স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের তার নাম ছিল ‘হালদারগোষ্ঠী’। এতে পলায়নপ্রবণ বনোয়ারিলাল তার বাবার সংসার থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। সে-কি আর্তনাদ তার। পারিবারিক অনুশাসন ভাল লাগছে না। একদিন সত্যি-সত্যিই বনোয়ারিলাল পালিয়ে যায়, যেন মুক্তবিহঙ্গ। এরকম একটি কাহিনি নিয়ে গল্প লিখলেন রবীন্দ্রনাথ তা-ও আবার পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই, ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে বৈকি। গল্পটি কি রূপকাশ্রিত ছিল? পারিবারিক অনুশাসন এড়িয়ে বনোয়ারিলাল বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে, এ কিসের ইংগিত? সবুজপত্রের যা উদ্দেশ্য (প্রথম সংখ্যার মুখপত্রে বিবৃত) তা কি লোকটির মুখে শোনা যাচ্ছে? আর গল্পভাষে যে অনুশাসনের কথা আমরা শুনতে পেলাম তা যদি হয় প্রাক-সবুজপত্রি গদ্যসাহিত্যের নমুনা, তবে কি বেশি বলা হবে? ‘স্ত্রীর পত্র’ রবীন্দ্রনাথের আরেকটি উল্লেখযোগ্য গল্প। এটিও প্রকাশিত হয়েছে সবুজপত্রেই। এ পত্রিকায় তিনি যে শুধু গল্পই লিখেছেন তা কিন্তু নয়। বাংলাসাহিত্যের সেরা সংযোজন ‘সবুজের অভিযান’-এর মতো কবিতাও যেমন লিখেছেন, লিখেছেন বেশকিছু চিন্তামূলক প্রবন্ধও। কিন্তু আবারও সেই একই প্রশ্ন-কেন এখানে লিখতে এলেন তিনি? আর তাগিদটাই-বা পেলেন কোথা থেকে? বিশ্বখ্যাত রবীন্দ্রনাথকে কিভাবে ধারণ করেছিল ‘বিরোধালংকিত’ সবুজপত্র অথবা সবুজপত্রকে রবীন্দ্রনাথ। এ প্রশ্নের উত্তরের জন্যই আমাদের দরকার হবে কিছুটা পেছন ফিরে তাকানোর।
রচনাভঙ্গির ক্রমবিকাশ এবং পার্থক্যের দিক বিবেচনা করলে রবীন্দ্রনাথের গদ্যসাহিত্যকে তিনটি কালস্তরে ভাগ করা যায়। যথাক্রমে ‘জ্ঞানাঙ্কুর-ভারতী’ স্তর (১২৮৩-১২৯০ বাংলা), ‘হিতবাদি-সাধনা-ভারতী-বঙ্গদর্শন-প্রবাসী’ স্তর (১২৯১ -১৩২০), ‘সবুজপত্র-প্রবাসী-বিচিত্রা’ স্তর (১৩২১-১৩৪৮)। মধ্যের স্তরটিকে আবার তিনটি উপস্তরে ভাগ করা যেতে পারে। উপস্তর তিনটি হল ‘হিতবাদি-সাধনা’, ‘ভারতী-বঙ্গদর্শন’ এবং ‘প্রবাসী’ (বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য, সুকুমার সেন, পৃ. ১৪৪-১৪৫)। ‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’ নামক মাসিক পত্রিকার ৪র্থ খন্ডে, ১২৮৩ সালের কার্তিক সংখ্যায়, রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যরচনাটি প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন চৌদ্দ কি পনের। ঐ গদ্যে, হোক না রবীন্দ্রনাথের বালক বয়সের রচনা, উপমা-উৎপ্রেক্ষার প্রয়োগ এবং একাধিক অলংকারের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এর পরের বছর অর্থাৎ ১২৮৪ সনের শ্রাবণ মাসে আরেকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। নাম ‘ভারতী’। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ শীর্ষক দীর্ঘতম প্রবন্ধ লিখে হৈচৈ ফেলে দেন। লেখাটির পরবর্তী অংশ ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, পৌষ, ফাল্গুন সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ‘ভারতী’র প্রথম বর্ষের আশ্বিন সংখ্যা (তৃতীয়) থেকে পরবর্তী বছরের ভাদ্র সংখা পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ আরেকটি উপন্যাসও ছাপেন। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘করুণা’। ‘ভারতী’তে রবীন্দ্রনাথের গদ্যভঙ্গির যা বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে তা এই— ভাষা স্বচ্ছন্দ, অনাড়ম্বর। মাঝে মাঝে উত্তম-পুরুষে কথোপকথন। আর এ কথোপকথনে সাধু ও কথ্য ভাষার মিশ্রণ লক্ষণীয়। কখনো কখনো আবার পুরো লেখাতেই কথ্য ভাষার ব্যবহার দেখা গেছে (য়ুরোপ প্রবাসীর পত্রে), তবে বিভিন্ন উপভাষার রূপগুলোতে আবার ব্যতিক্রমও আছে (যেমন— উঠলেম, দেখলেম, করতেম, ভাবতুম, পোড়ালেম, বইচে, দেখাচ্চে, বোল্লেন, কর্বার, হোয়ে ইত্যাদি)। বৌঠাকুরাণীর হাট-এর বাক্যগুলো আবার ছোট ছোট। বর্ণনায় দ্রুত তাল। অনুপ্রাসের প্রয়োগ নেই (যেমন— ঠাহরাবেইন না, ইচ্ছা পুরাইতে, তিষ্ঠিতে, তলাইয়াছিলেন ইত্যাদি)।
সম্ভবত ১৯২১ সাল থেকেই রবীন্দ্রনাথের সার্থক ছোটগল্প লেখার সূত্রপাত ঘটে। তবে এর পরের বছরই তাঁর তৃতীয় উপন্যাস ‘রাজর্ষি’ বের হয়। ৯১-৯৮ পর্যন্ত, এই দীর্ঘ সময়ে রবীন্দ্রনাথের আটটি ছোটগল্প বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গল্পগুলো হল যথাক্রমে ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথা’, ‘দেনা পাওনা’, ‘গিন্নী’, ‘পোষ্টমাষ্টার’, ‘তারাপ্রসন্নের কীর্ত্তি’, ‘ব্যবধান’ এবং ‘রামকানাইয়ের নিব্বুর্দ্ধিতা’। এ সময়েই রবীন্দ্রনাথের ষষ্ঠ উপন্যাস ‘গোরা’ এবং পরে ‘চোখের বালি’ (১৩০৮-১৩০৯) এবং ‘নৌকা ডুবি’ (১৩০৮-১৩০৯) প্রকাশিত হয়। তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ ১৩১৮ সনে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৩১৯-এ গিয়ে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, এ সময়টা ছিল রবীন্দ্রগদ্যের মধ্যস্তর। এ স্তরে ব্যাখ্যাত্মক বর্ণনাভঙ্গি টের পাওয়া যায়। ভাষার বিশেষ অলংকার নেই ঠিকই তবে হৃদয়গ্রাহী এবং সরস। শ্লেষ আছে অনুপ্রাস নেই। ঘটনাবর্ণনা আগের চেয়ে আরো দ্রুততর। তবে ‘পোষ্টমাষ্টার’ গল্পে ভাষা ও ভাবের রসঘন সম্মিলন ঘটে। ছোট-ছোট বাক্য না গেঁথে এ-গল্পেই তিনি বড় বড় জটিল যৌগিক বাক্যের সমাহার ঘটান।
সবুজপত্র অর্থাৎ শেষপর্বে রবীন্দ্র গদ্যরীতির যে গঠনকুশলতা আমরা লক্ষ করি, আদি ও মধ্যস্তরের রচনাবলির সঙ্গে ‘নতুত্বের’ দিক থেকে কোথায় তার পার্থক্য সূচিত হয়েছে, আর কেনই-বা তিনি এখানে লিখতে মনস্থ করেছিলেন, দুয়েকটি উদ্ধৃতি দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠবে।

ক …সেদিন সমস্ত দিন গুমোট করিয়া হঠাৎ রাত্রে ভারি একটা ঝড় আসিল। আমরা তিনজনে তিনটা ঘরে শুই তা’র সামনের বারান্দায় কেরোসিনের একটা ডিবা জ্বলে। সেটা নিভিয়া গেছে। নদী তোলপাড় করিয়া উঠিয়াছে, আকাশ ভাঙিয়া মুষলধারায় বৃষ্টি পড়িতেছে। সেই নদীর ছলছল আর আকাশের জলের ঝরঝর শব্দে উপরে নীচে মিলিয়া প্রলয়ের আসরে ঝমাঝম করতাল বাজাইতে লাগিল। …এই রকম রাতে আমাদের মনের জানালা-দরজার ছিটকিনীগুলো নাড়িয়া যায়, ঝড় ঢুকিয়া পড়ে, ভদ্র আসবাবগুলোকে উলোটপালোট করিয়া দেখে, পর্দ্দাগুলা ফরফর করিয়া কে কোনদিকে যে অদ্ভুত রকম করিয়া উড়িতে থাকে তা’র ঠিকানা পাওয়া যায় না। আমার ঘুম হইতেছিল না… (চতুরঙ্গ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সবুজপত্র)

খ … এক বলিলেন বহু হইব, এমনি করিয়া সৃষ্টি হইল— আমাদের সৃষ্টিতত্ত্বে এই কথা বলে। একের মধ্যে ভেদ ঘটিয়া তবে রূপ আসিয়া পড়িল। তাহা হইলে রূপের মধ্যে দুইটি পরিচয় থাকা চাই, বহুর পরিচয়, যেখানে ভেদ; এবং একের পরিচয়, যেখানে মিল। জগতে রূপের মধ্যে আমরা কেবল সীমা নয়, সংযম দেখি। সীমাটা অন্য সকলের সঙ্গে নিজেকে তফাৎ করিয়া, আর সংযমটা অন্য সকলের সংগে রফা করিয়া। রূপ একদিকে আপনাকে মানিতেছে, আর একদিকে অন্য সমস্তকে মানিতেছে তবেই সে টিকিতেছে।
(ছবির অঙ্গ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সবুজপত্র)
এখানে স্পষ্ট যে, আলংকারিক ঔজ্জ্বল্যতায় ভরপুর রবীন্দ্রনাথের এ পর্বের রচনাভঙ্গি। ভাষায় রয়েছে দীপ্ততা। এবং এ পর্বেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম ‘সে’ (তা) এর পরিবর্তে ‘ও’ নির্দেশক সর্বনাম ব্যবহার করেন। বর্ণনার বাহুল্য প্রায় নেই বললেই চলে। যা তিনি বলতে চেয়েছেন, তা লঘু এবং কাব্যরসাশ্রিত বাক্যে সরাসরিই বলেছেন। বর্ণনাভঙ্গিতে আগের মতো তাড়াহুড়ো নেই। ফলত অপল্লবিত ভাষা ভাবকে ছায়াচ্ছন্ন না করে, বরং পুরো রচনাটিকে করেছে আরো প্রসন্ন, আরো হৃদ্য। এ যেন ভাব-ভাষার টানাপোড়েনে নবনব ইন্দ্রজাল। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের এ নব-সাহিত্যকেই চন্দ্রনাথ বসু ‘মডার্ন’ বলে অভিনন্দিত করেছিলেন।


সবুজপত্র বাংলা ভাষায় কথ্যভাষাকে শুধু প্রাধান্যই দেয়নি, নতুন লেখকদের ‘কি লেখব’, ‘কেমন করে লিখব’ এটা যেমন শিখিয়েছে, তেমনি প্রাচীন ভারতের সঙ্গে আধুনিক ইউরোপকে মিলিয়ে বাংলাসাহিত্যে ‘নতুন’ করে পরিবেশনও করেছে। পত্রিকা-সম্পাদকের লেখায় এ বিষয়গুলো কিভাবে ধরা দিয়েছে অর্থাৎ ‘লেখাটা আর্ট হয়েছে কি-না’ চেষ্টা থাকবে এ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা দেবার। প্রমথ চৌধুরীর বাল্যকাল কেটেছে কৃষ্ণনগরে, পাবনা ও বিহারে, প্রথম যৌবন কৃষ্ণনগর ও কলকাতায়, মধ্য-যৌবন কলকাতা ও বিলেতে এবং শেষ জীবন শান্তিনিকেতনে। এই ব্যঙ্গপ্রবণ সংযতবাক জীবনশিল্পী আমাদের জীবনকে, যৌবনকে, বস্তুরূপকে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, করুণরসে ভারতবর্ষ স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে উঠেছে। তিনি তার বিভিন্ন লেখায় জাতির এ অধঃপতনে দুঃখিত ও ক্ষুব্ধ যেমন হয়েছেন, তেমনি বিদ্রুপায়িত চাবুক মন্তব্যে আঘাতও করেছেন। ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘হাসি ও কান্না’, ‘ব্যর্থ জীবন’ এবং ‘আত্মকথা’ সনেটে (সবুজপত্রে প্রকাশিত) আমরা তার উদাহরণ পাব।
                 সত্য কথা বলি, আমি ভাল নাহি বাসি
                 দিবানিশি যে নয়ন করে ছলছল,
                 কথায় কথায় যাহে ভরে আসে জল,—
                 আমি খুঁজি চোখে চোখে আনন্দের হাসি।
                 (হাসি ও কান্না, বীরবল)

                 পয়সা করিনি আমি, পাই নি খেতাব।
                 পাঠকের মুখ চেয়ে লিখি নি কেতাব।
                 অন্যে কভু দিই নাই নীতি-উপদেশ
                 চরিত্রে দৃষ্টান্ত নহি, দেশে কি বিদেশ।
                 (ব্যর্থ জীবন, বীরবল)

                 কবিতার যত সব লাল নীল ফুল
                 মনের আকাশে আমি সযত্নে ফোটাই
                 তাদের সবারি বদ্ধ পৃথিবীতে মূল
                 মনোঘুড়ি বুঁদ হলে ছাড়িনে লাটাই!
                 (আত্মকথা, বীরবল)

এ রকম বহু সনেট (যেমন খেয়ালের জন্ম, তেপাটি, ছোট কালীবাবু ইত্যাদি) তিনি লিখেছেন এবং কখনো কখনো সবুজপত্রেও তা ছাপিয়েছেন। তবে প্রমথনাথের এসব সনেটের কাব্যময়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা নতুন কিছু নয়। কারণ এতে সনেটের নির্দিষ্ট মাপজোক এবং ছন্দবিন্যাস ছাড়া কাব্যের প্রাণ বলতে যা বোঝায় তা প্রায় নেই বললেই চলে। বিষয়টা তিনি নিজেও হয়ত উপলব্ধি করেছিলেন, ‘আমার সনেটের অন্তরে আর্টের চেয়ে আর্টিফিশিয়ালি বেশি’ (অমিয় চক্রবর্তীকে লিখিত পত্র, ৬/১১/১৯৪১ খ্রি.)। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সনেট পঞ্চায়েৎ’ পাঠ প্রতিক্রিয়ায় ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে লিখিত এক পত্রে (৬ মে, ১৯১৩) বলেছিলেন, এ বইয়ের সবকটি কবিতাই প্রায় নির্মমভাবে নিখুঁত। তবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কণ্ঠে অবশ্য প্রশংসা ঝরেছে (এ পদ্যগুলি কবিতা হোক বা না হোক, প্রহেলিকা নয়। এ গ্রন্থের কোন কবিতা পড়ে তার মানে দশরকম বের করে তাদের নিজেদের মধ্যে বিবাদ করার প্রয়োজন হবে না।)।
প্রমথ চৌধুরীর মৌলিক গল্প রচনার শুরু হয় ‘চার ইয়ারী কথা’ দিয়ে। এটি সবুজপত্রে প্রকাশিত হয়। চার বন্ধু কোনো একটি ক্লাবঘরে মদের বোতল হাতে নিয়ে নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া প্রেমের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিল। প্রথম বক্তা (গল্পে ‘সেন’ চরিত্র) পূর্ণিমা রাতে গঙ্গার ধারে বেড়াতে গিয়ে এক রমণির দেখা পান। মেয়েটিকে দেখামাত্রই সে প্রেমে পড়ে যায়। মেয়েটি খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ে এতে সম্মতিও দেয়। তারপরই মোহভঙ্গ ঘটে প্রেমিকের। কারণ ততক্ষণে মেয়েটির পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। মেয়েটি আসলে পাগলাগারদ থেকে পালিয়ে এসেছে। এরপরে রক্ষকেরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় বক্তা (গল্পে ‘সীতেশ’) লন্ডনের একটি বইয়ের দোকানে এক ইংরেজ রমণির সঙ্গে পরিচিত হন। এখানেও, সীতেশ প্রেমে পড়ে এবং রমণির কাছে কৌশলে আরেকবার সাক্ষাতের প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন। মহিলাটি নায়কের বুকপকেটে একটি কার্ড দিয়ে চলে যায়। মিনিট পাঁচেক পরেই সীতেশের বোধোদয় ঘটে। মহিলাটি আসলে একজন পকেটমার ছিল। অর্থাৎ সীতেশের পকেটে যে কটা গিনি ছিল, তা নিয়ে পালিয়েছে। তৃতীয় বক্তাকে (‘সোমনাথ’) রিনি তার প্রণয়প্রার্থী জর্জের মনে ঈর্ষা জাগাতেই কেবল ভালবেসেছিল। সোমনাথ ছিল মেয়েটির কাছে ঢালস্বরূপ। এবং চতুর্থ বক্তা (রায় চরিত্র) একটি মৃত মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। গল্পটি এ পর্যন্তই। এর আর কোনো ডালপালা নেই। কিন্তু এর অভিনবত্ব অন্যখানে। এগল্পে প্রেমের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যে রোমান্টিক ধারণা (অভ্যস্ত সংস্কার) ছিল তার পুরোটাই উবে গেছে। এছাড়াও সবুজপত্রে তার আরো বেশ ক’টি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে ‘রাম ও শ্যাম’, ‘ছোটগল্প’, ‘ফরমায়েসী গল্প’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। গল্পকথনে এবং কৌশলে তার নিজস্ব একটা ঢং আছে। চরিত্ররা সবাই অতীতের থেকে উদ্ধৃত করে যেন পরস্পরের মাঝে চলছে স্মৃতিচারণা। প্রমথ চৌধুরীর গল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘তোমার গল্পগুলো আর একবার পড়লাম। ইতিপূর্বেও পড়েছি। ঠিক যেন তোমার সনেটেরই মত— পালিশ করা, ঝকঝকে, তীক্ষ্ন’ (২৫ আগস্ট, ১৯৩৪, চিঠিপত্র-৫)। তবে তাঁর গল্পে বুদ্ধির চমক যতটা আছে, ততটা হৃদয়বৃত্তি নেই। কথার খেলাতেই গল্পগুলো সীমাবদ্ধ। সবচেয়ে বড়কথা, গল্পগুলো পড়লে পাঠকের মনে হবে লেখক তার কয়েকটি প্রিয় তত্ত্বকে উপস্থাপন করতেই বুঝি এরকম কাহিনির অবতারণা করেছেন।
সবুজপত্রকে বলা হয় প্রবন্ধের ফসল। আর এ ফসল ফলানোর পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি প্রমথ চৌধুরী। তাঁর লক্ষ্য ছিল মানসিক যৌবনের প্রতিষ্ঠা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘যৌবনে দাও রাজটীকা’ কবিতাটিকে ব্যাখ্যা করে তিনি এরকম ইংগিতই দিয়েছেন (যৌবনে দাও রাজটীকা, বীরবল, সবুজপত্র, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা)। সবুজপত্রে প্রকাশিত তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধাবলিতেও এর পরিচয় পাওয়া যায়। প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী ফরাসি প্রাবন্ধিক মঁতেন-এর অনুসারি। মঁতেন আবার বিষয়বস্তুর ওপর জোর দিতেন কম। তিনি পাঠকের মনোযোগ দাবি করতেন বলার ভঙ্গির প্রতি। অর্থাৎ কি বলা হল, তারচেয়ে বেশি জরুরি কেমন করে বলা হল। স্বভাবতই প্রমথ চৌধুরীর গদ্যে ‘প্রাচ্যের আভাষ’ পাওয়া যায়।

৪.
গল্প, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র, আলোচনা-সমালোচনা নিয়েই সবুজপত্রের প্রতিটি সংখ্যা সাজানো হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রমথ চৌধুরী অবশ্যই এ পত্রিকার প্রধানতম লেখক ছিলেন, কিন্তু অন্যান্য লেখকগণ যেমন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, অজিতকুমার চক্রবর্তী, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচী, মহীতোষকুমার রায়চৌধুরী, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, সতীশচন্দ্র ঘটক, জনৈক বঙ্গনারী, রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, সরলাবালা দাসগুপ্তা, মাধবীলতা দেবী, প্রিয়নাথ সেন, হারীতকৃষ্ণ দেব, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, ইস্কুল মাষ্টার, প্রিয়ম্বদা দেবী প্রমুখের অবদানও কম নয়। রবীন্দ্রনাথ আবার প্রিয়নাথ সেনকে বলতেন ‘সাহিত্যের সাত সমুদ্রের নাবিক’। সবুজপত্রে একবার সওগাতে প্রকাশিত রচনার পুনর্মুদ্রণও বেরিয়েছিল। কারণ একটাই, লেখার গুণগত মান। আর এ কারণেই সবুজপত্র বাংলাসাহিত্যের গদ্য ইতিহাসে একটি উজ্জ্বলতর নাম।

উৎস
ক. সেরা সবুজপত্র সংগ্রহ, বিজিতকুমার দত্ত সম্পাদিত
খ. বীরবল ও বাংলা সাহিত্য, অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
গ. বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য, সুকুমার সেন
ঘ. বাংলা সাহিত্যে সমালোচনার ধারা, সুদীপ বসু

বর্ষ ২, সংখ্যা ৩, ফেব্রুয়ারি ২০০৩

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার