বাঘের ঘরে ঘোগ : সেলিম মোরশেদ ও পরম্পরা // শামসুল কিবরিয়া

0

ছোটগল্প বর্তমানে সাহিত্যের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। উৎপত্তির পর থেকে নানা সময়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ছোটগল্প এগিয়ে চলেছে। সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে এর আকৃতি ও প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটেছে। এখন যদি এরকম একটি প্রশ্ন দাঁড় করানো হয় যে— ছোটগল্প কী? তবে, এর উত্তর দেওয়াটা দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, শিল্প সৃষ্টিকে সংজ্ঞা দিয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় না। যদিও ছোটগল্পকে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন কিন্তু ছোটগল্প এর ভেতর সীমাবদ্ধ থাকেনি। নতুন প্রাণ সৃষ্টি করে বেরিয়ে এসেছে। ছোটগল্প সম্পর্কে সাধারণ যে কথাটা বলা যায় সেটা হল— ছোটগল্প মূলত ব্যক্তিকে সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে। ব্যক্তির সমস্যা, সংকট, ক্রম-বিবর্তমান পরিস্থিতিতে তার আচরণ প্রভৃতি স্থান পায় ছোটগল্পে। ছোটগল্প সমগ্র জীবনকে ধারণ না করে এর আংশিক প্রতিবিম্ব তুলে ধরে। জীবনের বিশেষ একটি দিকের ওপর ফোকাস করে সেটাকে ব্যঞ্জনাময় করে তুলে।

সাহিত্যে ছোটগল্পের আবির্ভাব সাহিত্যের অন্যান্য শাখাগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে পরে ঘটেছে। বিশেষত রেনেসাঁস উত্তরকালের সমাজবাস্তবতা ছোটগল্পের ক্ষেত্র নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ সময় সমাজব্যবস্থায় এসেছে পরিবর্তন। সামন্ত প্রথা ভেঙে-ভেঙে বিস্তার ঘটতে থাকে পুঁজিবাদের। পুঁজিবাদ ব্যক্তিকে বৈচিত্র্যের সামনে দাঁড় করায়। এ বিচিত্রমুখিতা ব্যক্তির জীবনে নিয়ে আসে নানামুখী জটিলতা। এসব উঠে আসে ‘ছোটগল্প’ নামক সাহিত্যের নতুন মাধ্যমটিতে। বিভিন্ন লেখক নানাভাবে, নানা প্রেক্ষাপটে মানুষকে দেখতে থাকেন। ইংল্যান্ড-আমেরিকা-রাশিয়া-ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে ছোটগল্পের চর্চা চলতে থাকে। নিয়মিত চর্চায় এটি একটি শিল্পিত মাধ্যম হিসেবে বিকাশ লাভ করতে থাকে।

ছোটগল্পের ঢেউ একসময় বাংলা সাহিত্যেও এসে আছড়ে পড়ে। তবে, এটা ঘটে কিছুটা বিলম্বে। মূলত উনবিংশ শতকের শেষদশকে বাংলাসাহিত্যে আবির্ভাব ঘটে ছোটগল্পের। এই আবির্ভাব প্রক্রিয়াটা হয় রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। প্রথম সার্থক ছোটগল্প তিনিই রচনা করেন। মোটামুটিভাবে বাংলাসাহিত্যে ছোটগল্পকে শিল্পিত আসনে বসালেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ তার গল্পে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনার শিল্পসম্মত প্রকাশ ঘটালেন। গল্পের বিষয়বৈচিত্র্য এবং একই সাথে রূপবৈচিত্র্য তার সমগ্র গল্প-সাহিত্যকে ঔজ্জ্বল্য দান করেছে। তার ছোটগল্পের আরেকটি দিক হল প্রগাঢ় মানবচরিত্রজ্ঞান। বিশেষত কর্মের সুবাদে, গ্রামাঞ্চলে বসবাসের কারণে, এখানকার মানুষগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখতে পেরেছেন এবং তাদেরকে গল্পে তুলে এনেছেন। তবে, বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথ যেহেতু মূলত একজন কবি, তার গল্প-রচনায়ও এর প্রভাব পড়েছে। তার গল্প শেষ পর্যন্ত একটা কাব্যিক রসের দিকে ধাবিত হয়।

বিশশতকের প্রথমভাগে বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রবলভাবে নড়ে ওঠে। সারাবিশ্ব অস্থির হয়ে উঠে এসময়। সমরাস্ত্রের দামামা বাজতে লাগল চতুর্দিকে। সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হল। এর প্রভাবে মানুষের মধ্যে দেখা দিতে লাগল হতাশা, বিচ্ছিন্নতা, নঞর্থক জীবনবোধ। এ সময়খণ্ডের লেখকদের লেখার মধ্যে এসবের প্রতিফলন ঘটে। ‘কল্লোলযুগ’-এর লেখকরা রবীন্দ্রনাথের প্রভাবমুক্ত হয়ে ভিন্ন স্বাদের গল্প লেখা শুরু করেন। রাবীন্দ্রিক ভাবজগতকে তারা প্রত্যাখ্যান করলেন। পাশ্চাত্য সাহিত্য ও ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাসাহিত্যে যৌনকামনার চিত্রায়ন শুরু করলেন। প্রথা এবং শৃঙ্খলের ওপর তারা প্রচণ্ড আঘাত দিলেন। তাদের লেখায় প্রেম, মন হতে বের হয়ে দেহতে চলে আসল। সমকালিন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাও হয়ত তাদেরকে এদিকে ধাবিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। একই সাথে নিষ্ঠুর বাস্তবতার উপস্থাপনও মনের গহীনে অবগাহন তাদের রচনাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। তারাই প্রথম সাহিত্যে তুলে আনলেন কৃষক-শ্রমিক-ডোম-মুচি-মেথর প্রভৃতি অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদেরকে। তবে, সামগ্রিক অর্থে তাদের রচনা এতদঞ্চলে যেসব বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে সম্পর্কিত হতে পারেনি।

বাংলাদেশের সাহিত্যে ষাটেরদশক একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এ সময়ে বাংলাদেশের গল্প-সাহিত্যে নতুনের ঢেউ লেগেছে। যদি আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়, তাহলে এ দশকে গল্প একটি উল্লেখযোগ্য বাঁক নিয়েছে। এ সময় পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থা। একদিকে স্বৈরশাসন, অন্যদিকে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই— এই দ্বৈরথে সময়টা ছিল প্রকৃতপক্ষেই অস্থির। সাহিত্য যেহেতু জীবন ও সময়ের দর্পণ তাই— এ কালের লেখকদের রচনায়ও এর প্রভাব পড়েছে। এ দশকে এসে গল্প পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন হয়। প্রচলিত গল্প-ধারণাকে ভেঙে দিয়ে গাল্পিকরা নতুন আয়োজনে সাজান গল্পকে। এ কারণে গল্পের পক্ষে সম্ভব হয়েছে বিস্তার লাভ করা। যেকোনো নতুন জিনিসের যেমন সাফল্য থাকে তেমনি থাকে এর ব্যর্থতা। ষাটের গল্প সম্বন্ধেও একথা বলা যায়। সাফল্য-ব্যর্থতা মিলিয়ে এ দশকের সার্থকতা হল সেটা উত্তরকালের গল্পচর্চার জন্য একটা বিস্তৃত ক্ষেত্র তৈরি করতে পেরেছে।

ষাটদশকের মতো আশিরদশকেও বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। যদিও প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ সময়টাতেও বাংলাদেশের বুকে জেঁকে বসে স্বৈরশাসন। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো উপেক্ষিত হচ্ছিল। এ পরিস্থিতির ভেতর কয়েকজন নতুন লেখকের আবির্ভাব ঘটে। তাদের অনেকে অগ্রজদের দেখানো পথে সরাসরি না গিয়ে গল্প রচনায় ভিন্নভাবে আত্মনিয়োগ করেন। গল্পের কাঠামোকে তারা নতুনভাবে সাজাতে চেষ্টা করেন। লোভ, লিবিডোচেতনা, স্বৈরাচারতাড়িত মানুষের যন্ত্রণা তাদের রচনায় উঠে আসে। এ দশকের বেশিরভাগ গল্পকারের ক্ষেত্রে যে কথাটা সত্য সেটা হল— তারা গল্পচর্চায় অনিয়মিত। সময়ের হিসেবে বিবেচনা করলে এদের লেখার পরিমাণ খুবই অল্প। তবে, এটা বলা হচ্ছে না যে, বেশি বেশি লিখে তারা ইতর শ্রেণীর সাহিত্য রচনা করবেন। বরং সতর্ক থেকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ি নিজস্ব মান বজায় রেখে গল্পচর্চায় আরো নিয়মিত হওয়াটাই কাম্য। যেহেতু লেখাই একজন লেখকের সর্বপ্রধান কাজ।

সেলিম মোরশেদ গল্প লেখা শুরু করেন আশিরদশকে। লিটলম্যাগভিত্তিক সাহিত্যচর্চার একজন শক্তিশালি অভিযাত্রী তিনি। সেলিম মোরশেদ গল্পে জীবনের অতলস্পর্শী অনুভবকে ধরতে চান। ব্যক্তি চারপাশ থেকে যেভাবে স্ববিরোধিতায় আক্রান্ত, তিনি তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। ফলে তার গল্প-পাঠে পাওয়া যায় ভিন্ন অনুভূতি। প্রচলিত পাঠ-অভিজ্ঞতাকে ভেঙে দিয়ে তিনি পাঠককে দাঁড় করান নতুনত্বের সামনে। পাঠ-পরবর্তী ব্যঞ্জনা পাঠককে গভীর ভাবনায় ডুবে যেতে বাধ্য করে। তার সাম্প্রতিক গল্পগ্রন্থ ‘বাঘের ঘরে ঘোগ’। পাঁচটি গল্প নিয়ে তার এ গ্রন্থের আয়োজন।

আমরা শ্বাস নিচ্ছি আদর্শহীন সমাজব্যবস্থায়। চতুর্দিকে স্বার্থপরতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে নৈতিকভিত্তি। এ অবস্থায় কেউ যদি আদর্শ নিয়ে চলতে চায় তা হলে বিভিন্ন প্রতিকূলতা তাকে চারপাশ থেকে জাপটে ধরে। সেটা ব্যক্তি পর্যায়ে হতে পারে আবার রাষ্ট্রিয় পর্যায়েও। যেই দেখবে তার স্বার্থের ওপর আঘাত পড়ছে সে-ই একটা পাল্টা আক্রমণ চালাবে। রাষ্ট্রিয় কাঠামো যেভাবে গড়ে উঠেছে সেটা মোটেও সুখকর নয়। ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করার বদলে রাষ্ট্র তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

‘রক্তে যতো চিহ্ন’ গল্পটি যাকে নিয়ে গড়ে ওঠেছে তার নাম বিশু বিশ্বাস। বিশুকে আমরা পাই বাম রাজনীতির একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে। সে মনের ভেতর ধারণ করছে বিপ্লবী চেতনা। অরিজিন সামন্ত শ্রেণিতে প্রোথিত হলেও সে এ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। পিতা এবং পিতামহের সামন্ত মন-মানসিকতা সে গ্রহণ করেনি। নিজেকে বরং প্রস্তুত করেছে বিপ্লবের জন্য। একটা আদর্শ ধরে সে এগিয়ে যেতে চায়। আদর্শের প্রতি সে পুরোপুরি কমিটেড। কিন্তু বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ উল্টো। বিশু নিজের অবস্থানে অনড়। এ দৃঢ়তার জন্যই তার বিচ্যুতি ঘটে না। পার্টির প্রতি তার কমিটমেন্ট এত বেশি যে— নেতাদের আচরণ সবসময় ভাল না ঠেকলেও ইন্টারোগেশন সেলে নির্মম অত্যাচারের পরেও সে মুখ খুলে না। তার ‘অস্বাভাবিক জীবনীশক্তি’র কাছে তাদের কৌশলগুলো ব্যর্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু পরিস্থিতি তার অনুকূলে নয়।—

‘ভেতরে রক্তক্ষরণে বিস্তর সত্য উন্মোচিত হলে তাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করে সাম্রাজ্যবাদীর দালাল আর প্রতিক্রিয়াশিল মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করবে তার দল। বিরোধী দল তো তক্কে-তক্কে রয়েছে, সুযোগ পেলেই গুলি করবে।’

তবে সে জানে এ প্রতিকূলতা ডিঙিয়েই তাকে যেতে হবে। আত্মপ্রত্যয়ি মনোভাবে সে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গল্পের পুরোটা জুড়েই রয়েছে তার এ ঋজু মানসিকতার প্রকাশ। একই সঙ্গে সে সাহসী। এ জন্যই তার পক্ষে সম্ভব হয় রিমান্ডে তীব্র অত্যাচারে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি এবং সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু রাষ্ট্রিয় থাবার হাত থেকে শেষ রক্ষা হয় না। গুলির আঘাত তাকে শেষ করে দেয়। আদর্শকে ধরে এগিয়ে যাওয়ার সব সম্ভাবনা এখানেই বিনষ্ট হয়ে গেল। যে উৎকট পরিস্থিতি চারদিকে সৃষ্টি হয়েছে সেখানে এগোনো আসলেই কঠিন। এ পরিস্থিতি বিশুকে বাধ্য করে নির্মম পরিণতি মেনে নিতে।

বিশু যে পার্টি করে এর প্রতি আনুগত্য প্রশ্নাতীত। পার্টির নির্দেশের বাইরে সে কোনোকিছু করে না। কিন্তু তাই বলে সে অন্ধ নয়। পার্টির কার্যক্রমে অনেক ফাঁক-ফোঁকড় রয়েছে। এগুলো তার নজর এড়িয়ে যায় না। যে নীতি ও কৌশলের সাহায্যে বিপ্লব এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা সেখানে রয়েছে অসামঞ্জস্য। এমনকি সে দেখতে পায় তার পার্টির কমেরেডরা যুদ্ধের ক্ষেত্রটা সম্পর্কে পরিষ্কার নয়। যদি এই অবস্থা হয় তাহলে বিপ্লব হবে না। পরিবর্তনের স্বপ্নটা শুধু মুখের বুলিতেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। যথাযথ ভূমিকা পালনে নেতৃত্ব ব্যর্থ। এটা এ কারণে হতে পারে যে, পার্টির নেতৃত্বে রয়েছে সামন্তশ্রেণী থেকে আগত লোকজন। ফলে লক্ষ্য নির্ধারণ ও এর বাস্তবায়নে তারা কতটুকু সক্ষম তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বিপ্লবের পথটাকে তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে কি-না এটাও ভাবার বিষয়।—

‘নেতৃত্ব দিচ্ছে অধিকাংশই সামন্তশ্রেণী থেকে আসা, ফলে মার্কসবাদ-লেলিনবাদের মতো তাদের নিজস্ব ইমেজ তৈরি আর ক্যাডার বাহিনি বানানোটাই মূল্য লক্ষ্য।’ বিশু সবকিছুই অনুভব করে। তার ভেতর রক্তাক্ত হয়। পার্টির কার্যক্রম সম্পর্কে মনে নানা প্রশ্ন জাগলেও সে এগুলো অনুক্ত রাখে পার্টির বিদ্যমান কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এই ভেবে।’

বিশু রাষ্ট্রের নির্যাতনের শিকার। সে যে ধরনের কাজ করে রাষ্ট্রের কাছে সেটা ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে বিবেচ্য। তার ওপর করা হয় রিমান্ড নামক নির্মম অত্যাচার। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে হয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে। কারণ রিমান্ডে নিয়ে যেভাবে অত্যাচার চালানো হয় সেটা রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশিত নয়। রিমান্ড কী রকম নির্মম হতে পারে তা গল্পে দেখে নেয়া যাক—

‘শিরদাঁড়ার এ পাশেই একটা আস্ত পিন ঢুকিয়ে দিলো একজন— আর এরপরেই ডান পায়ের দ্বিতীয় নখটা সরু সাঁড়াশি দিয়ে দুইজন উপড়াতে এগিয়ে এলো।… …পাপড়ি উঁচু করে মণিতে আলো ফেলা হলো। গরম পানি নাকের ভেতর দেয়া— সেটা তো প্রথম থেকেই শুরু। এই তিনবার রিমান্ডে এ হেন নির্যাতন নেই যা তারা করেনি; পায়ুপথে গরম ডিম দেয়া থেকে শুরু করে সিলিংয়ে উল্টো করে ঝুলানো পর্যন্ত।… শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে বের হচ্ছিলো রক্ত; কখনও গলগল করে কখনও-বা ফোঁটা ফোঁটা!!’

গল্প যখন শুরু বিশু তখন পুলিশের হাতে আটক। তৃতীয়বারের মতো রিমান্ডের মুখোমুখি তিন নম্বর কেসের আগামি হিসেবে। এর আগে দুটি মামলা ডিসমিশ হয়েছে। বিশু রিমান্ড থেকে মুক্তি পায়নি। বিশুর অস্বাভাবিক দৃঢ়তার কারণে তার কাছ থেকে কোনো তথ্য জানা যায়নি। শেষে রাষ্ট্রের বাহিনী সমস্ত ক্ষোভ মেটাল তাকে গুলি করে মেরে।

গ্রন্থভুক্ত দ্বিতীয় গল্প ‘আদি অপেরা’য় আমরা পরিচিত হই তিনটি চরিত্রের সাথে। চারিত্রিক ভিন্নতায় তারা বিশিষ্ট। এরা দাঁড়িয়ে আছে ভিন্ন জীবন বাস্তবতায়। এদের একজন হোসেন ডাক্তার— সংস্কৃতিকর্মী, অপরজন টুটুল— আদর্শবাদী কমিউনিস্ট, আরেকজন বারেক— চরম ভোগবাদী। এদেরকে খুঁজে পাওয়া যাবে সাধারণ্যে। জীবন যাপন এবং জীবনবোধে তারা স্বতন্ত্র যদিও বাহ্যিকভাবে একটা আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে।

হোসেন ডাক্তারের মধ্যে জীবনের অনেক সম্ভাবনা ছিল, প্রত্যেক মানুষের যেমন থাকে। রূঢ়-বাস্তবতা অনেক সময় সকল সম্ভাবনা বিনষ্ট করে ফেলে। হোসেন স্বদেশী আন্দোলনে চোঙা ফুঁকেছে। যাত্রাদলে অভিনয় করেছে। অভিনয় এবং গানে তার মেধা ছিল, কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারেনি। সময়ও চলে গেছে একটু একটু করে। এখন বয়স হয়ে গেছে। নতুন করে কিছুই আর তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। নৈমিত্তিক চাহিদা মেটানোর দায়বদ্ধতাও ঘাড় থেকে নামেনি। এই বয়সে এসেও ১০ মাইল দূরে শহরে গিয়ে হোমোপ্যাথিক ঔষধ বিক্রি করে তাকে জীবননির্বাহের উপকরণগুলো যোগাড় করতে হয়। সেখানে যাবার আরেকটি উদ্দেশ্য আছে, টুটুলের সাথে দেখা হওয়া। টুটুলের সাথে তার বেশ হৃদ্যতার সম্পর্ক। তার যেহেতু অভিনয় জানা আছে, পরিচিতজনদের একটা চাহিদা থাকে তার কাছে— অভিনয় দেখা। সে তাদেরকে নিরাশ করে না। কিন্তু ‘অভাব এবং দারিদ্র্যের ভেতরে সজ্ঞান মনকে কেউই উপলব্ধিতে আনে না। হোসেন ডাক্তারের ভারি যন্ত্রণা।’

গল্পের আরেক চরিত্র বারেক। টুটুলের বড় ভাই। গল্পে বারেকের সরাসরি কোনো উপস্থিতি নেই। কোনো ঘটনাপ্রবাহের সাথে সে যুক্ত নয়। যাকে জানা যায় টুটুলের পার্টি অফিসে রাখা ডায়েরির মাধ্যমে এবং তার সম্পর্কে টুটুলের নিজস্ব অনুভূতি থেকে। টুটুল যখন ডায়েরিটা পড়ে তখন ধীরে-ধীরে বারেক উন্মোচিত হয়। তার সাম্প্রতিক সময়ের কিছু অভিজ্ঞতা ডায়েরিতে লেখা। তার কনফেশান। বারেক আপাদমস্তক নেতিবাচক। সে নীতি-নৈতিকতাহীন, ভোগবাদী, স্বেচ্ছাচারী, আদর্শহীন একটা মানুষ। ন্যূনতম দায়িত্বজ্ঞান যে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে থাকা উচিত, সেটা তার নেই। নিজেকে সন্তুষ্ট করতে সর্বদা সচেষ্ট। অবশ্য সমাজে এ রকম মানুষ দুর্লক্ষ নয়। বারেকের সাথে যখন আমাদের পরিচয় হয় তখন সে ‘যৌন শীতলতায়’ ভুগছে। ‘একেবারে ফ্রিজড’ হয়ে গেছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে বান্ধবিদের সঙ্গ কামনা করলেও প্রত্যেকেই রিফিউজ করেছে; তার এ চাওয়া অস্বাভাবিক মনে হয়েছে তাদের কাছে। এ সময় তার অনুভূতি ‘আমি কখনোই আগুনের মতো পবিত্র কিংবা নপুংসকের মতো না।’ নিজের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা তার। সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে অতপর সে পতিতার আশ্রয় নেয়। কিন্তু এখানেও সে পরিতৃপ্ত হতে পারেনি। ‘কনডমটা পুরুষাঙ্গে’র মাঝামাঝি গিয়ে আটকে থাকল। গোড়া পর্যন্ত নামল না। মহিলা ঢুকাতে না ঢুকাতে আমি ভিজে গেলাম।’ বারেক সর্বদা নিজের দিকে চালিত। সে যে একটা পরিবারে বাস করছে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। পারিবারিক কোনো কাজে তার অংশগ্রহণ নেই। বারেকের কাছ থেকে আশা করার মতো কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না।

‘টুটুল’ চরিত্রটি পূর্বোক্ত গল্পের ‘বিশু’ চরিত্রের সাথে কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ। যদিও দু’জনের পটভূমি ভিন্ন। বিশুর মতো টুটুলেরও রয়েছে আদর্শের প্রতি দৃঢ়তা। আরেকটি দিকে মিল আছে, দু’জনেই নৃশংসতার শিকার। বিশু রিমান্ডে গিয়ে যেমন অমানবিক আচরণের শিকার হয়েছে টুটুলও বোমা বহন করতে গিয়ে ডান হাতের কব্জিসহ কিছু অংশ হারিয়েছে। অসম্ভব দৃঢ় মনোবলের কারণে টুটুল শেষ পর্যন্ত টিকে গেল। স্কুলে রাজনীতি শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরেও রাজনীতির সাথে জড়িত। মনের ভেতর একটা আদর্শ সযত্নে লালন করছে। কিন্তু তার চারপাশের পরিবেশ কেমন? সে কমিউনিস্ট। কিন্তু সে দেখছে আদর্শহীন, তথাকথিত কমিউনিস্টদের নগ্নতা। সুবিধাবাদী নীতি গ্রহণের তৎপরতা। ক্ষমতার স্বাদ নেয়ার জন্য মরিয়া। টুটুল এসবের ভেতরেই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ভাবনার গভীরতা প্রকাশ পায় হোসেন ডাক্তারের সাথে কথা বলার সময়। কিন্তু টুটুল কি শেষ পর্যন্ত আদৌ টিকে থাকতে পারবে? নেতিবাচকতায় ভরপুর সমাজে এগিয়ে যাওয়া বড়ই দুষ্কর। বিদ্যমান আবহকে বদলিয়ে বা ভেঙে এগিয়ে যেতে হবে, এটা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্ভব নয়। দরকার সামষ্টিক ইচ্ছা এবং তার সাথে কাজ। টুটুল দৃঢ়স্বরে কথা বলার পর হোসেন ডাক্তারের কাছে ‘খুব শক্তি’ হওয়ার একটা ঔষধ চায়। তার আদর্শকে এগিয়ে নিতে হলে তো অবশ্যই শক্তির দরকার। ডাক্তারের শক্তির ঔষধের চেয়ে বেশি দরকার সমাজের অন্তর্নিহিত শক্তি। কিন্তু সেটার যে অভাব! তাই হয়ত হোসেন ডাক্তার টুটুলের কথায় বিষাদের ছায়া অনুভব করে।

পরবর্তী গল্প ‘মৃগনাভি’ মনকে খুঁড়ে খুঁড়ে একেবারে গভীরে প্রবেশের চেষ্টা রয়েছে। আশপাশের উপাদানগুলো এখানে অনেকটা অনুজ্জ্বল। বরং বাহ্যিক প্রভাব চরিত্রের মনোজগতে কী প্রভাব ফেলছে সেগুলোর অতি সূক্ষ্ম-পর্যবেক্ষণ। তাই দেখা যাচ্ছে চরিত্রগুলো বাইরের সাথে সংযুক্ত থেকেও কেমন যেন বিযুক্ত। আপন সীমারেখার ভেতরে থেকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। গল্পের প্রধান দু’টি চরিত্র ‘জোসেফ’ এবং ‘বিকাশ’। ওয়াচিং টাওয়ারের ১৩ তলায় বসে আছে তারা। একটু উপর থেকে সবকিছু দেখার সুযোগ আছে। কিন্তু এতে তাদের আগ্রহ কম। নিজের অন্তর্লোকে ঘূর্ণিত হতেই বরং তাদের স্বাচ্ছন্দ্য বেশি। জোসেফ এবং বিকাশের কথোপকথনের মাধ্যমে কাহিনী এগিয়ে যায়। কিন্তু তাদের কথাবার্তা যতটা না পারস্পরিক তার চেয়ে বেশি স্বগত। নিজের সত্তাকে অনুধাবন যেন। তারা বন্ধু এবং একসাথে ওয়াচিং টাওয়ারে অবস্থান করছে। কিন্তু তাদের মধ্যে মতৈক্য তেমন একটা নেই। প্রকাশিত বিষয়গুলো বরং মতদ্বৈততায় ভরপুর। একজন একটা বলল তো অপরজন যেন প্রস্তুত থাকে কাউন্টার দিতে। আমরা আমাদের চারপাশে তাকালে এমনটাই দেখতে পাব। কোনো একটা বিষয়ে যে ভিন্নমত থাকতে পারে সেটা মেনে নিতে আমরা প্রস্তুত নই। বরং নিজের মতটাকে প্রচণ্ডভাবে অন্যের ওপর আরোপ করতে চাই। বিভিন্ন বিষয়ে বিকাশ এবং জোসেফ যে অনুভূতির স্তরে পৌঁছে সেগুলো দার্শনিক গভীরতা পায়। কিন্তু তারা নিজেকে বা পরস্পরকে প্রশ্ন করে যে উত্তরগুলো পাচ্ছে সেগুলো ইতিবাচকতার ইংগিত দেয় না। সকল উপলব্ধি শেষ পর্যন্ত নেতিতে পর্যবসিত হয়। এটা বাস্তবতার প্রতিফলন হতে পারে। যেসব ঘটনা চারপাশে ঘটছে একটু গভীরভাবে তাকালে দেখা যাবে নেতিবাচক আবেগগুলো তীব্রভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। বিকাশ ও জোসেফ বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলে। খুঁড়ে খুঁড়ে গভীরে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেন গতিহীন হয়ে পড়ে। তারা স্তব্ধতার মুখোমুখি হয়ে পড়ে। ধীরে-ধীরে সবকিছু পিণ্ডাকৃতি হয়ে পড়ে। শেষে সব সম্ভাবনা শূন্যে মিলিয়ে যায়।— ‘ওয়াচিং টাওয়ারটা নড়লো। জোসেফ পকেট থেকে বস্তুটি বের করে এগুতেই— জোসেফ, বিকাশ বললো, যা তুমি করবে জানি; আমি তোমাকে হত্যা করবো— জোসেফ বললো; কোমর থেকে হাতটা বিকাশ সামনে নিয়ে এলো, আমি একা না তুমিও, আর যা করবে সে ক্যানিস মিরর! কে, সে?— বলে জোসেফ তীব্র লক্ষ্যটা ওই মুহূর্তে অব্যর্থ করলো; বিকাশ ছুঁড়লো ঠিক একই সময়ে, তারপর জোসেফের দিকে তাকিয়ে বললো: অলোকা!’

জীবন চলার পথে মাঝে-মাঝে কোথাও যেন স্তব্ধ হয়ে পড়তে হয়। চারদিক থেকে সবকিছু ভাঙতে থাকে ঝনঝন করে। সমস্ত আয়োজন ভেস্তে যায়। মানুষ হয়ত নিজের তৈরি ফাঁদেই আটকে পড়ে বা কোনো পরিস্থিতির নিষ্ঠুর শিকার হতে হয় তাকে। যতই প্রটেকশন থাক-না-কেন সবকিছুই তখন তুচ্ছ মনে হয়। মানুষ তখন নিজেকে নিয়ে যায় ভিন্ন অবস্থায় যা তার কাছে কাম্য ছিল না কোনোসময়।

‘পরম্পরা’ গল্পে আমরা একটা পরিবারের সাথে পরিচিত হই। তাদের জীবনযাপন ছিল স্বচ্ছল। তাদেরকে ঘিরে ছিল আভিজাত্যের আবরণ। কিন্তু ধীরে-ধীরে অবস্থা পাল্টে যেতে থাকে। যে পরিচয়টা তাদের দাঁড়িয়েছিল সেটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। আভিজাত্যের আবরণ খসে পড়ে একটু-একটু করে।

গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র ‘টুম্পা’। তার বিয়ে হয়েছিল এক মেজরের সাথে। তার সুন্দর সুখী জীবনযাপন করার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। মেজরের সাথে ম্যাচ হয়নি। ফলে সংসারটা ভেঙে গেল। এখন শুধু তার দু’টো জিনিসের দরকার। টাকা আর ঘুম। এ দু’টি ছাড়া অন্য সবকিছু তুচ্ছ। টাকার জন্য ক্রমশ নিচের দিকে নামা। নোংরামি। তার অবনমন এই পর্যায়ে চলে গেছে যে টাকার জন্য মায়ের গায়ে হাত তুলতে তার বাধেনি। মায়ের সাথে এই ব্যবহারে ভেতর থেকে যেন বন্যতা উছলিয়ে পড়ল।—

‘মা তাকে জানালেন যে, সে টাকা পাবে না। তিনি ছাইভস্ম খাওয়ার জন্য আর কখনো প্রশ্রয় দেবেন না। ইতোমধ্যে ক্রোধ তার চোখমুখ স্পর্শ করেছিলো। শক্তিতে বারকয়েক ধাক্কা দিয়ে সে ধরাশায়ী মায়ের গলা টিপে ধরলে মায়ের দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, হাসফাঁস করছিলেন, প্রাথমিকভাবে ঠেকাতে পারলেও পরে তেমনভাবে পারলেন না এবং ঘটনাটা খুব বেশিদূর এগিয়ে না যায় এই আশংকায় তিনি নমিত হয়ে জানিয়ে দিলেন আলমারির টি-পটের ভেতর রেখে দেয়া টাকাগুলোর কথা।’

টুম্পা সংবাদপত্রের খবর হয়ে আসে। ‘ব্ল্যাকমেলিং’ তাকে নিয়ে এসেছে সংবাদপত্রের পাতায়। সে সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিক্ষিত মেয়ে তার এরকম হওয়ার কথা ছিল না। যে আভিজাত্যে সে মোড়া ছিল সেখান থেকে যেন টুপ করে পড়ে গেল। ‘হেলেন অব ট্রয়’ দেখে একসময় নিজেকে সে হেলেন হিসেবে ভেবেছিল। কিন্তু নিজেকে আর সেভাবে ধরে রাখতে পারল না। সে এখন অধঃপতিত, নিন্দিত। নিজের সম্পর্কে এখন তার অনুভব ‘… টুম্পা আউট অব লাইফ! টুম্পার জীবন নেই, মৃত্যুও নেই। টুম্পা জীবন্মৃত!’

টুম্পার বোন শম্পা। সে সবার থেকে একটু ব্যতিক্রম। তার বিয়ে হয়েছিল এক সেনা অফিসারের সাথে। সংসার ভেঙেছে। পরবর্তী সময়ে বড় খালার ছেলেকে বিয়ে করেছে সে। এ পরিস্থিতিতে জীবন নিয়ে সে তৃপ্ত। টুম্পার মা ফেরদৌসি বেগম কাছ থেকে সবকিছু দেখেছেন। তার চোখের সামনেই সবকিছু ভেঙে পড়েছে। চারপাশে সুখহীনতা, আভিজাত্য তাকে সুখ দিতে পারেনি। আভিজাত্য শেষমেষ ঠুনকো বলেই প্রমাণিত হল। এখন—

‘ফেরদৌসী বেগমের ভাবনা— আভিজাত্যের বিষয়গুলো এরকম যে, সাধারণ সত্যের কাছে ধীরে-ধীরে হারে! সম্ভ্রান্ত তর্জনীর সামনে সুদূরপ্রসারী কোনো স্বস্তি দাঁড়ায় না কখনো। তার স্বামী? মৃত্যুর আগে বলা যায়, বন্ধুদের প্রয়োজনে আর বিনোদনে বেচে গেছে সব জমিজমা! সন্তানদের গতি-প্রকৃতি-ভাঙন দেখে গেছে শেষ মুহূর্তে।’

টুম্পার ভাই সুমনের সাথে বন্ধুত্বের সূত্রে ‘জীবন’ এ পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত। এখানে তার আসা-যাওয়া আছে। ফলে পরিবারটির বিপর্যয়ের সে-ও একজন দর্শক। জীবন সুমনের বন্ধু হলেও তার সাথে মতাদর্শগত পার্থক্য রয়েছে। সুমন যে মানসিকতা ধারণ করছে জীবনের মানসিকতার সাথে সবসময় সেটা খাপ খায় না। ‘জীবনে’র জীবনবোধ তীব্র। তার ভাবনা খুব গভীর। অতলে ডুব দিয়ে সে সবকিছু অনুভব করতে চায়। চারদিকে আশাহত হওয়ার মতো উপাদানগুলো প্রবলভাবে বিরাজমান। ফলে তার অনুভূতিগুলো তাকে রক্তাক্ত করে। আমাদের সমাজব্যবস্থা সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। বিকাশের যে স্বাভাবিকতা থাকে এখানে অনেকক্ষেত্রেই সেটা অনুপস্থিত। ফলে নৈরাজ্য খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। যে মানসিক গঠন-কাঠামো আমরা বহন করছি সেটার ভিত্তি দুর্বল। এ পরিস্থিতিতে আমাদের প্রত্যাশা কতদূর ওঠাতে পারব? জীবন নিজেকে খুঁড়ে যেতে থাকে—

‘ড্রয়িং রুম কী? স্ট্যাটাস! কী সেখানে? আলোচনা। আপন মতামতের ভিত্তিতে মহৎ মানুষের প্রতি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত! ড্রয়িংরুম কি কন্সপ্রেসির জায়গা না? ড্রয়িংরুম কি কাশিমবাজার কুঠি না?… সমাজ-সম্প্রদায়-অর্থনীতি-রাজনীতি? বিজ্ঞান-ধর্ম-দর্শন? অরণ্য-সমুদ্র-আকাশ কি আমাদের পক্ষে? সংস্কৃতি কি আমাদের পক্ষে?… সৌন্দর্য? আমাদের পক্ষে কি সত্য? সেখানে কেউ যদি রূপ-রস-গন্ধকে ক্রমাগত ক্ষত-বিক্ষত করে, কোন মূল্যবোধ তাকে অপরাধী বলবে? শিশুর মুখ ছাড়া কোন নৈতিকতা আমাদের শুদ্ধ করবে?’

পরিস্থিতি বিভীষিকাময় হয়ে উঠছে। কে কাকে এখান থেকে টেনে ওঠাবে? সবাই তো নিজের সমস্যা নিয়েই জর্জরিত। আপন ভুবনে সকলেই সীমাবদ্ধ। এভাবেই আমাদের গড়ে তোলা নিজেকে—

‘বিলেতীমোহন ও মেজোভাই, আফিফ আহাম্মেদ আর টুম্পা-শম্পা, সংবাদপত্রের সম্পাদক, ফেরদৌসী বেগম, দুজন মেজর আর শিকারী, জীবন, সুমন, মিলি, টেনিয়া যে যার মতো আছে আবার নেই। বিস্তৃত কিন্তু বিস্তার নেই, বিন্দুতে আছে বৃত্তে নেই, বলনে আছে বৃত্তান্তে নেই, পরম্পরায় আছে, ঐক্যে নেই!’

মানুষের কর্মকাণ্ডের বা আবেগের পরিণতি সবসময় একই হয় না। এটি স্বাভাবিক একটি সত্য। পরিণতির রকমফেরে এর প্রতিক্রিয়াও ভিন্ন হয়ে থাকে। কখনও আনন্দ, কখনও বেদনা, কখনও-বা বিস্ময়। মানুষ নিজেকে কোনদিকে কিভাবে নিয়ে যাচ্ছে এটা একটা ব্যাপার। বইয়ের নামগল্প ‘বাঘের ঘরে ঘোগ’ পাঠশেষে এরকম একটা অনুভূতি হয়।

গল্পের কাহিনীটা এমন যে শেষবিন্দুতে গিয়ে মিলে গেলেও দু’টি কাহিনী যেন স্বতন্ত্রভাবে গড়ে ওঠেছে। যদি সরল দাগে এভাবে ভাগ করা হয় তাহলে একভাগে ফেলা যাবে কমিউনিস্ট আমজাদ হোসেন ও রুমিকে। আরেকভাগে ফেলা যাবে মাখন ও বাঘিকে। আরও অনেক চরিত্র থাকলেও মোটামুটি এদের কেন্দ্র করেই গল্পের কাহিনি গড়ে ওঠেছে।

আমজাদ হোসেন শ্রেণিশত্রু খতমের উদ্দেশ্যে আপন নানার গায়ে হাত ওঠান। কিন্তু ছুরি ব্যবহারে অপটুত্বের কারণে তাকে ব্যর্থ হতে হয়। কিন্তু এই ব্যর্থতা তাকে দমিয়ে দেয়নি। পরবর্তী সময়ে বরং ‘ওয়াজেদ মিয়া আর রুমিকে সঙ্গে নিয়ে প্রত্যয় বাড়ায়।’ তাদের কার্যক্রম গতি পায়। আইয়ুব খানের ‘ডিকেড অব রিফর্মে’র বিরোধিতা, চাঁদ আলীকে হত্যা— যে ‘পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি’র শ্রেণীশত্রু খতমের লাইনের প্রথম ‘অ-লোক’ হওয়া ব্যক্তি। যেকোনো লক্ষের দিকে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সঠিক পজিশন থেকে কাজ করা। ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসও অনেক প্রয়োজন। কিন্তু সার্বিকভাবে পার্টির কার্যক্রমে এর অভাব দৃষ্ট হয়। সঠিক পজিশন থেকে তারা কাজ করতে পারেনি। সময়কে বুঝে সঠিকভাবে এগুলো হয়নি। উপরন্তু পার্টির কার্যক্রমকে অনেকে ব্যবহার করেছে ব্যক্তিস্বার্থের দিকে চোখ রেখে। ফলে যা অর্জনের লক্ষ্য ছিল সেটা অর্জিত হয়নি। তাই রুমি যখন বাবলুর প্রশ্নের মুখোমুখি হন তিনি কিছু বলতে পারেননি। কারণ, সঠিক জবাব দেওয়ার কোনোকিছু তার ছিল না। যদি ঠিকমতো কাজ করা হত তাহলে এভাবে প্রশ্ন উঠত না। বাবলুর প্রশ্নের যৌক্তিকতা রুমিকে মুখ খোলার সুযোগ দেয়নি। পরে তার আত্ম-বিশ্লেষণে ধরা পড়ে—

‘… কোন পরিণতির দিকে তারা কাউকে নিতে পারেননি। না জনগণকে না নিজেদের; বহু খুনের দায় নিয়ে তাকে চলতে হতো সারাজীবন। তার মানে এ পরাজয় কি তার একার? কেন তাও বা হবে? বিষয়টি যৌথ।’

কমিউনিস্ট দলগুলো শক্ত কোনো ভিত্তির উপর দাঁড়াতেই পারেনি। ক্রমাগত ভাঙনই যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল তাদের জন্য। ফলে প্রাপ্তির দিকে তাকালে আশা করার মত তেমন কিছু নজরে পড়ে না। রুমি অনুভব করেন ‘বাস্তবতা ভিত্তিক নৈতিকতা’র বদলে ‘সামন্ত শুদ্ধতা নিয়ে লড়াই করা ভুল’ হয়েছে। এ অনুভূতি পারফেক্ট হিসেবেই মেনে নেয়া যায়। রুমি নিজেও শেষপর্যন্ত ব্যবসা করে লোভি মনের পরিচয় দিয়েছেন। অন্যদিকে আমজাদ হোসেন পরে স্তিমিত হয়ে গেলেন। নানার গায়ে হাত তোলার জন্য এখন তিনি গ্লানি বোধ করেন। এই বোধ তাকে সমষ্টি থেকে গোত্রপ্রীতির দিকে ধাবিত করে। ফলে তার জীবনযাপনও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। পার্টির কার্যক্রমও তার মনে হতাশার জন্ম দেয়—

‘নিজের পরেই যেন বিরক্ত হলেন আমজাদ হোসেন হঠাৎ একটা বিষয় মনে হলে; আশ্চর্য ওরা, পার্টি করবে অথচ ঠিকমতো মুখপত্র বের করে না। দল করবে তার কর্মসূচী নেই, রাজনীতি মানে শুধু মিটিং-মিছিল না, মধ্যবিত্তের মনন যেভাবে বাঁক নিচ্ছে সেগুলো নিয়ে ভাবার সময়ও এসেছে; কারা সামন্ত, কারা লুম্পেন, বুর্জোয়া বলতে মূলত আমরা কী বুঝছি? সত্যিকারভাবে একটা বড়ো আন্দোলন দেখতে পেলে ব্যক্তিগত হতাশাটা কমতো; জীবন এতো দ্রুত আর অনিবার্য হতে হতে এগোচ্ছে যে ভবিষ্যতের বিশ্লেষণই যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ বছর অন্তর-অন্তর পরিবর্তিত হচ্ছে যেন তার সবকিছুই। নিজের যাপনের এই রহস্যের আড়ালে নিজেকেও কি সে ঠকায় না? তার নিজেরও কি এগিয়ে এসে কাজ করার অনাগ্রহ তৈরি হয়নি? আপন অভিজ্ঞতা তিক্ততায় ছেঁড়া জুতোর মতোন বারবার কি গালে পেটায়?’

গল্পের আরেকদিকে রয়েছে ‘মাখন’ ও ‘বাঘির কাহিনী’। মাখনকে ছোট রেখেই তার রাজমিস্ত্রী বাবা মারা যায়। বেশি লেখাপড়া না করা মাখন একটু আবেগপ্রবণ এবং তার চলাফেরাও ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে বাঘি স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে। লেখাপড়া জানা। বাঘির প্রতি মাখনের প্রচণ্ড টান। সে বাঘিকে খুব কাছে নিবিড়ভাবে পেতে চায়। বাঘিও মনে এক কল্পিত তরুণের ছবি ফুটিয়ে তুলেছিল, যার মাঝে থাকবে স্বর্গীয় সুষমা। বাঘির প্রতি মাখনের প্রচণ্ড টান থাকলেও বাঘি মাখনের মধ্যে এরকম কিছু দেখতে পায় না। বরং মাখন তার কল্পনার সম্পূর্ণ বিপরীত। মাখনের আচরণ বাঘির কল্পনাকে আঘাত করে প্রচণ্ডভাবে। মাখন তার সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়ে অতি নগ্নভাবে। গল্পে মাখন যখন প্রথম বাঘির মুখোমুখি হয় তখন সে তার সাথে শুতে চায়। বাঘির এটা কাম্য ছিল না। ফলে সে প্রতিবাদী হয়। প্রতিবাদের তীব্রতা মাখনের আশা পূরণ করতে দেয়নি। মাখনকে সে অপমান করে। বস্তুত বাঘি প্রতিবাদ করে অপমানের মাধ্যমেই। কিন্তু মাখন বাঘিকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করেনি। সে আবারও শোবার ইচ্ছা নিয়ে বাঘির কাছে যায়। এবার  বাঘি তাকে অপমানও করে আবার ভয়ও দেখায়। ‘দাঁড়া বাপের কাছে বলবো— লোক দিয়ে টুকরো টুকরো করবে নে!’

কিন্তু বাঘির দেখানো ভয় মাখনকে দমিয়ে দিতে পারেনি। বরং তার ক্রোধ তীব্রভাবে লাফিয়ে উঠে। ফলে পরে আর বাঘির সম্ভব হয়নি নিজেকে রক্ষা করা। মাখন আর সহ্য করতে পারছে না। সে বাঘির মুখ থেকে একটা কিছু শুনতে চায় ‘… হয় আজ মরবো নাই বাঁচবো, তুই এখন কথা দিবি।’ বাঘি এসময় বুদ্ধি খাটিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। কিন্তু মাখনের আক্রমণ থেকে কোনোমতেই বেরুতে পারে না। কারণ মাখন চায় আজই সব চূড়ান্ত করে নিতে। মাখন তার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছে। বাঘির শরীর সে পেয়েছে। কিন্তু পরিণতি খুবই করুণ হয়ে দাঁড়াল। বাঘির দিক থেকে যেমন, মাখনের দিক থেকেও তেমনি। বাঘি মাখনের পীঠে ছুরি বসিয়ে দেয় আর মাখন চেপে ধরে বাঘির কণ্ঠা। এ পরিণতির জন্য কে দায়ি? মাখন না বাঘি? না তাদের শ্রেণীগত অবস্থান? মাখন বাঘিকে কাছে পাওয়ার জন্য উগ্র হয়ে ওঠেছিল। বাঘি কল্পনায় এক তরুণের ছবি আঁকলেও সে বুঝেছিল মাখনের সাথে তার মিলবে না। তার পরিপার্শ্ব তাকে এটা শিখিয়েছে। বাঘি তার শ্রেণি অবস্থানের দিকে তাকিয়েছে। মাখনের অবস্থান তার চেয়ে অনেক নীচে। এ অবস্থাগত পার্থক্য তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সে ভেবেছে তার বাবা-মা মাখনের সম্পৃক্ততার কথা জানলে ‘কেটে কুচি কুচি করে ফেলবে’। মাখন যখন তার উপর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে তখনও সে পরিপার্শ্বের দিকে তাকিয়েছে। মাখন আর বাঘির ব্যাপারটা আর গোপন থাকল না। কিন্তু যখন প্রকাশ হল সবকিছুই তখন শেষ হয়ে গেছে। আমাদের প্রচলিত মন-মানসিকতা অনুযায়ী বিষয়টি শেষমেষ নগ্ন হয়ে দাঁড়াল। তাই হয়তো— ‘…কেউ মুখ খোলার চেষ্টা করে না। আমজাদ হোসেন মনে মনে ভাবেন, তৈয়ব ভাইয়ের আরো স্ট্রিক্ট হওয়া উচিত ছিলো। বলতে গেলে সমাজকেই দোষ দিতে হয়। কি আর করা!

রুমি বলেন না কিছু-আমি জানতাম। নিজের ভেতরে রাখেন।

খুব সাহসী একজন পুঁথি লেখক সে তার শিষ্যকে বলে, এটা নিয়ে লেখা যাবে না। প্রেমের পুঁথিতে যে নান্দনিক শর্ত থাকে, এই আখ্যান তা সমর্থন করে না।’

সেলিম মোরশেদের গল্পের চরিত্র নানাভাবে পরিস্থিতির নিষ্ঠুর শিকার। এক দ্বান্দ্বিক বাস্তবতায় অন্তর্নিহিত শক্তি ভেঙে পড়ে। উজ্জ্বল সম্ভাবনা নির্মম সম্ভাবনাহীনতায় পর্যবসিত হয়। আদর্শহীনতার খোড়লে ধীরে-ধীরে সবকিছু নগ্নভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক ব্যবস্থায় সুষ্ঠু বিকাশের অভাব মানুষের স্বাভাবিক অগ্রগতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। জীবনের ভিন্ন অভিজ্ঞতার আস্বাদ গ্রহণ করতে মানুষ তখন বাধ্য হয়ে পড়ে। গল্পগুলো জীবন-বাস্তবতা সম্পর্কে ভাববার উৎসাহ যোগায়।

বর্ষ ৯, সংখ্যা ১৩, ফেব্রুয়ারি ২০১০

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার