আধুনিক ঔপনিবেশিকতার প্রধান বিজয়গুলোর মূল ভিত্তি ছিল এক ধরনের নতুন সেক্যুলার সামাজিক স্তরবিন্যাস নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য। এই নতুন সামাজিক স্তরবিন্যাসের গড়ে উঠার প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করার ক্ষমতা পরম্পরাগত সামাজিক কাঠামোর মধ্যে ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে অবশ্য আধুনিক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ব্যাপ্ত হয়ে উঠার পশ্চাতে রয়েছে সামরিক শৌর্য ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের ভূমিকা। পরম্পরাগত সামাজিক কাঠামোর অভ্যন্তরে যে সব সামাজিক স্তর বা অংশের মানুষেরা শোষিত ও কোণঠাসা অবস্থায় ছিলেন, তাঁরা স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবেই, নতুন সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রতি মনস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে একথাও মনে করতেন, এই নতুন স্তরবিন্যাস সামাজিকভাবে যথার্থ ও বৈশ্বিক সমতার দিকে প্রথম পদক্ষেপ। এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, হিংস্রতা ও সাংস্কৃতিক গ্রন্থিচ্যুতির প্রক্রিয়া এমন এক নতুন সামাজিক চৈতন্য ও মনস্তত্ত্বের জন্ম দিয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে নতুন ইতিহাস নির্মাণের প্রক্রিয়াকে নির্ধারণ করতে শুরু করেছিল। উত্তর-কার্থেসিয় ইউরোপকে যুক্তিযুক্ত বলে স্বীকার করে নিয়ে ঔপনিবেশিকতাকে সমালোচনার এক নতুন ডিসকোর্স গড়ে তোলা হচ্ছিল। নতুন সামাজিক স্তরবিন্যাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে গড়ে তোলা এই নতুন ডিসকোর্স মনস্তাত্ত্বিক স্তরে যে মতাদর্শগত আধিপত্য গড়ে তুলতে চেয়েছিল তার মূল উদ্দেশ্য ছিল, ঔপনিবেশিক অনিবার্যতা ও সাম্রাজ্যবাদীদের অধঃস্তনতাকে মানসিক স্তরে স্বীকার করিয়ে নেওয়া।
ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো ব্যাপ্ত হয়ে পড়ার অনেকগুলো দশক পরে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের দিনগুলোতে মানবসভ্যতাকে আধুনিক প্রযুক্তির যে বিস্ময়কর অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মানুষের ওপর মানুষের কর্তৃত্ব ফলাবার আকাঙ্ক্ষা শুধুমাত্র ভ্রান্ত পলিটিক্যাল-ইকনোমির উপজাত কিছু নয়। পক্ষান্তরে এই আকাঙ্ক্ষা এক ধরনের বিশ্ববীক্ষাজাত। এই বিশ্ববীক্ষার সূত্রে অর্ধমানবিকের তুলনায় মানবিকের, নারীর তুলনায় পুরুষের, শিশুর তুলনায় বয়স্ক মানুষের, অনৈতিহাসিকের তুলনায় ঐতিহাসিকের, পরম্পরাগত ও প্রাচীনের তুলনায় প্রগতিশীল ও আধুনিকের শ্রেষ্ঠত— উৎকর্ষতা— উত্তমর্ণতাকে অবিতর্কিত ও প্রশ্নহীন বলে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো হয়। কাল ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, উপনিবেশগুলোতে ব্যাপক গণহত্যার মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে ধ্বংস সাধনের প্রচেষ্টা, পরিবেশ ও স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রকে বিনষ্ট করার প্রক্রিয়া, এবং উপনিবেশগুলোর বিভিন্ন কৌমের সংঘাতের ধারাবাহিকতা হচ্ছে বিকৃত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহ, জন্মগতভাবে মানসিক অস্থিরতার ব্যাধিতে আক্রান্ত প্রযুক্তিগত সাফল্য ও নতুন সেক্যুলার সামাজিক স্তরবিন্যাসের মিথষ্ক্রিয়ার পরিণতি। তার ফলে প্রধান ও প্রাচীন মানব সভ্যতাগুলোকে চিত্রিত করবার সময়ে তাদের প্রধানত ধর্মীয় ও শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানের স্তরে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। মানুষের লোভ ও হিংস্রতার আদিম প্রবৃত্তিগুলোকে নতুনভাবে যুক্তিসম্মত রূপদানের চেষ্টা করা হচ্ছিল প্রথমত, সেক্যুলার মোক্ষ লাভের স্বার্থে রচিত নৃতত্ত্বকেন্দ্রিক তত্ত্বসমূহের সাহায্যে, দ্বিতীয়ত, প্রগতির সহায়ক মতাদর্শ ও পৌরুষের নামে এবং তৃতীয়ত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তত্ত্বসমূহের ধারাবাহিক সঞ্চয় ও বিকাশের সাহায্যে।
এই বিষয়ে উপনিবেশগুলোতে সচেতনতার সূত্রপাত হয়েছিল যখন অনাধুনিক সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ এমন মারাত্মক চেহারা নিল যার ফলে দেশজ-প্রান্তীয় সংস্কৃতিগুলোর অস্তিত্বের সংকট প্রকট হয়ে ওঠল। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো, ধারাবাহিক আক্রমণের মধ্যে দিয়ে, এক হোমোজিনাইসড, প্রযুক্তিগতভাবে নিয়ন্ত্রিত ও অপরিবর্তনীয় স্তরসম্পন্ন সামাজিক কাঠামো নির্মাণের প্রয়াস পেয়েছিল। আর এই সামাজিক কাঠামোর স্তরিভবন ও মেরুকরণ প্রক্রিয়াকে সংজ্ঞায়িত করা হত, আধুনিক ও প্রাচীন, সেক্যুলার ও নন-সেক্যুলার, বৈজ্ঞানিক ও অবৈজ্ঞানিক, বিশেষজ্ঞ ও অদক্ষ, উন্নত ও অনুন্নত, অগ্রগামী ও অনুসরণকারী, স্বাধীন ও পরাধীন-এর মধ্যে বিভাজনকে অনিবার্য ও চিরস্থায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে।
ঔপনিবেশিক বিস্তারের প্রথম পর্বে ‘ব্যান্ডিট-কিং’রা উপনিবেশগুলোকে বল প্রয়োগমূলক পদ্ধতির সাহায্যে দখল করেছিল। তারা সরাসরি অন্য মানুষদের হত্যা করত, তাদের অঙ্গচ্ছেদ করত ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করত। তারা সাধারণভাবে উপনিবেশের মানুষদের সভ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে কাজ করত না। বরঞ্চ তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জাতিগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে নিশ্চিত করা।
ঔপনিবেশিক বিস্তারের দ্বিতীয় পর্বে ঔপনিবেশিক চৈতন্যের বিস্তারের ক্ষেত্রে পরিশ্রমী, দায়বদ্ধ ও মধ্যবিত্ত মিশনারিরা প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন। এইসব মিশনারিদের অনেকেই ছিলেন উদারনৈতিক, আধুনিক এবং প্রগতি, সমতা ও বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। তৃতীয় দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে গত ছয় বা সাত প্রজন্ম ধরে স্বাধীনতা ও মুক্তি বিষয়ে যা কিছু বলা বা ভাবা হয়েছে তার প্রধানতম পূর্বশর্তগুলো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উক্ত মিশনারিদের ভূমিকাটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ঔপনিবেশিক বিস্তারের দ্বিতীয় পর্বে সাম্রাজ্যবাদীরা শরীরের সঙ্গে সঙ্গে চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণের প্রয়াস পেয়েছিল। তার ফলে ঔপনিবেশিক সমাজের অন্তর্গত কাঠামোর অন্তর্লীন স্তর থেকে এমন কিছু শক্তি নির্গত হতে শুরু করেছিল, যার পরিণতিতে সংস্কৃতিবিষয়ক পছন্দের প্রাথমিকতা ও চরিত্রকে স্থায়ীভাবে রূপান্তরিত করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এইভাবে আবিশ্বে মনস্তাত্ত্বিক স্তরে ইউরোকেন্দ্রিকতাকে যুক্তিসম্মত করে তোলা সম্ভব হয়েছিল। তার প্রভাবে ঔপনিবেশকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে যে ডিসকোর্স নির্মাণের প্রয়াস চলছিল তা-ও ঐতিহাসিক কারণেই একধরনের ইউরোকেন্দ্রিক মাত্রা অর্জন করেছিল। আসলে চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণের সূত্রে বিক্ষারও ঔপনিবেশিকরণ ঘটে গিয়েছিল। ঔপনিবেশিক বিস্তারের প্রথম পর্বের কর্মকাণ্ডকে যুক্তিসম্মত করে তুলছিল দ্বিতীয় পর্বের কর্মকাণ্ড। দ্বিতীয় পর্বের কর্মকাণ্ড যে চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল তা উপরিকাঠামোর আপেক্ষিক স্বায়ত্তের কারণেই, এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, নিজস্ব স্বাধীন সামাজিক শিকড় গড়ে তুলতে পেরেছিল। তার ফলে ঔপনিবেশিক বিস্তারের প্রথম পর্বে যাঁরা খুব প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছিলেন, দ্বিতীয় পর্বে তাঁরাই আবার ঔপনিবেশিক কাঠামো ও প্রক্রিয়ার মধ্যে আত্মিকৃত হয়ে গিয়েছিলেন।
নব্বই দশকের শেষ ভাগে ‘পাশ্চাত্যকরণ’ শব্দটি এখন নিন্দার্থেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই পাশ্চাত্যকরণের প্রক্রিয়াটি অন্যভাবে, প্রায় ইন্দ্রিয়ের অগোচরে, অনেক জমকালোভাবে মঞ্চের ওপর আবির্ভূত হয়েছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে পাশ্চাত্যকরণের পোস্ট-মডার্ন আদরা বা মডেলগুলো শুধুমাত্র দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবয়বকেই চিত্রিত করছে না, সেই সঙ্গে ‘সরকারী’ প্রতিবাদের মডেলগুলোকেও নির্মাণ করছে। পোস্ট-মডার্ন ডিসকোর্সগুলো বিশ্ববিক্ষার যে কাঠামোকে যথার্থ, সভ্য, সুস্থ ও যুক্তিসম্মত হিসেবে চিহ্নিত করে ও গড়ে তোলে সেই কাঠামোকে প্রশ্নহীনভাবে মেনে নিলে যেকোনো ব্যক্তিই ঔপনিবেশিকতার র্যাডিক্যাল বিরোধী হিসেবে মর্যাদা পেয়ে যেতে পারেন। কারণ তার ফলে, বিরোধী ও প্রবল প্রতিবাদী শক্তিও পূর্বাভাষ ও নিয়ন্ত্রণের গণ্ডি অতিক্রম করে যেতে পারে না। ধনতন্ত্রের এই পোস্ট-মডার্ন পর্বে কেউ ‘অ-পাশ্চাত্য’ মডেলকে গ্রহণ করলেও বহুজাতিক পুঁজির বিপদের তেমন কোনো আশংকা থাকে না, কারণ অ-পাশ্চাত্য মডেলও পাশ্চাত্যেরই অবদান। তার ফলে নব্বইদশকের শেষ পর্বে কেউ কার্ল হ্বিটফগল ও এডওয়ার্ড সাঈদ-এর তত্ত্বকে সংশ্লেষের মধ্যে দিয়ে ওরিয়েন্টালিস্ট ডেসপটিজম-এর পক্ষাবলম্বন করতে পারেন, আবার ইচ্ছে করলেই বিপ্লবীদের পক্ষাবলম্বন করে কামু ও অরওয়েলের তত্ত্বকে সংমিশ্রণের মাধ্যমে এক নতুন তত্ত্বের অবতারণা করতে পারেন। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, পাশ্চাত্যকে সব থেকে প্রবলভাবে যিনি প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করেছিলেন, ‘দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ’ এর লেখক, সেই ফ্রানজ ফানোনও কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে জাঁ পল সার্ত্রের আড়ম্বরপূর্ণ স্টাইলকেই অনুসরণ করতেন। শুধু ঔপনিবেশিকতাই পাশ্চাত্যের উৎপাদন নয়, সেই সঙ্গে ঔপনিবেশিকতা বিষয়ক ব্যাখ্যাগুলোও পাশ্চাত্যেরই উৎপাদন। উক্ত ব্যাখ্যাগুলোকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করা হবে তার রংকেও অনেক সময় পাশ্চাত্য থেকেই নির্ধারণ করা হয়।
২
উপরের আলোচনা থেকে একথা বোধ হয় স্পষ্ট বোঝানো গেছে যে, গত দুইশত বছর ধরে ঔপনিবেশিকতাকে আমরা যেভাবে অনুধাবন ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি তা পুরোপুরি যথার্থ নয়। ঔপনিবেশিকতাকে শুধুমাত্র আর্থিক লাভ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে অন্বিত করে ভাবা যায় না। ঔপনিবেশিকতা হচ্ছে আগ্রাসী শক্তি ও আক্রান্ত গোষ্ঠীর এক বিশেষ ধরনের চৈতন্যের কাঠামো ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা। উপনিবেশগুলো থেকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুনাফা অর্জনের প্রক্রিয়া অবশ্যই ঔপনিবেশিক চৈতন্যের কাঠামোর সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে আরও অনেক উপাদান ঔপনিবেশিক চৈতন্যের কাঠামোকে নির্মাণ ও নির্ধারণ করেছিল। ঔপনিবেশিকতার পলিটিক্যাল ইকোনমি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু ঔপনিবেশিকতার সব থেকে স্থূল ও নিরস বহিঃপ্রকাশ ঘটে মনস্তাত্ত্বিক স্তরে। আর এই সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর নির্মাতা আগ্রাসি ও শাসিত উভয় ধরনের শক্তিই। ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শ পরিপূর্ণভাবে প্রকট হয়ে ওঠার সত্তর বছর আগে থেকেই ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক রাজনীতি সক্রিয় হয়ে ওঠেছিল এবং সেই সঙ্গে একথাও স্পষ্ট যে, উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে ভারতিয় সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে ও কোণে ঔপনিবেশিক মতাদর্শের প্রভাব খুব স্পষ্টভাবেই দৃশ্যমান।
এক বিশেষ ধরনের মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোকে নির্মাণের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিকতা এমন কিছু সামাজিক কোড (code) নির্মাণ করত যেগুলো ছিল শাসক ও শাসিত উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য। এই কোডের সূত্রে শাসক ও শাসিত উভয়েরই চেতনার অন্তর্গত পূর্ববর্তী সাংস্কৃতিক ধারাকে রূপান্তরিত করে দেওয়ার চেষ্টা চলত এবং উভয়েরই কাছে অধঃস্তন এক ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিকে সামনে আনার ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা চালানো হত।
ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি প্রতিবাদের ধারাকে মোকাবিলা করার কৌশল হিসেবে নতুন ধরনের স্টাইল তৈরি করেছিল। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা তার নিজের স্বার্থেই সামাজিক শাস্তি ও পুরস্কারের মাধ্যমে শাসিতদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করত। জাতিয়তাবাদী আন্দোলন এই ধরনের শাস্তি ও পুরস্কারের বিরোধিতা করত ঔপনিবেশিক শাসন ও নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের দ্বিতীয় পর্বে, চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণের সূত্রে, মনস্তাত্ত্বিক শাস্তি ও পুরস্কার দানের প্রক্রিয়া শাসিতদের মস্তিষ্কে স্থায়ী ও বিপদজনক প্রভাব রেখে গিয়েছিল, যার ফলে তারা সহজেই সিস্টেমের সামনে নতজানু হয়ে পড়েছিল।
৩
যৌনতা ও ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক কর্তৃত্বের নিবিড় সম্পর্কের কথা উত্তর-ঔপনিবেশিক আলোচনায় প্রায়শই শোনা যায়। উত্তর-সামন্ত যুগে ইউরোপীয় মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোতে নারী ও পুরুষের যৌন সম্পর্কের আদলটি যেভাবে গড়ে উঠেছিল সেদিকে সচেতন দৃষ্টিনিক্ষেপ করলে আমরা বুঝতে পারি, নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্বকে স্বাভাবিক বলে প্রতিষ্ঠা করবার মধ্য দিয়ে, ঔপনিবেশিকতা আসলে কর্তৃত্ব, শোষণ ও নিষ্ঠুরতাকেই স্বাভাবিক বলে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করত।
আবার মানুষের শৈশব অবস্থা ও উপনিবেশের মানুষদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার তুলনা করে ঔপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়াকে মানসিক স্তরে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হত। গত দুইশত বছর ধরে আমরা সাম্রাজ্যবাদী দেশের মানুষদের দেখে এসেছি এক জটিল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে, যে সমাজের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত পরম্পরাটি বহুস্তরযুক্ত ও খণ্ডায়িত। আবার বেন্থাম ও মিলের মতো ইউটিলিটারিয়ানরাও মনে করতেন, ঔপনিবেশিকতা প্রগতির দিকে একটি পদক্ষেপ ও তা সামন্ততন্ত্রের যথার্থ ঔষধ। সামন্ততন্ত্র, ওরিয়েন্টাল ডিসপটিজম ও মানসিক শৈশব অবস্থা বিষয়ক ধারণাকে এক সাধারণ ডিসকোর্সের সূত্রে একসঙ্গে গেঁথে তুলতে পারলে ঔপনিবেশিকতার যাথার্থ অবশ্যই পায়ের নীচে শক্ত জমি পেয়ে যায়।
৪
উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন সাম্প্রতিকতম আবিষ্কারগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে ও সুচতুরভাবে ব্যবহার করে স্যাটেলাইট চ্যানেলের আবিশ্ব পরিব্যাপ্ত যে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে তা বিশাল জনসংখ্যার মধ্যে সমান মানসিকতা ও চাহিদাসম্পন্ন এক বাজার বানিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। মানবচৈতন্যের এই হোমোজিনোইজেসেন প্রক্রিয়া তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোতে যে নতুন সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলতে চাইছে তা সমস্ত ধরনের জাতিগত-কৌমগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞানকে মারাত্মকভাবে আক্রমণ ও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তার ফলে বিশ্বায়ণের যুগে প্রতিটি দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে নেশন-স্টেট ও বহুজাতিক পুঁজির দ্বন্দ্ব তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ভারতবর্ষে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের সাম্প্রতিক বিস্তার, চাহিদার চরিত্রকে অভিন্ন করে তোলার মাধ্যমে যে অখণ্ড চাহিদাসম্পন্ন বাজার বানিয়ে তোলার চেষ্টা করছে, তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবেও নেশন-স্টেট এবং বহুজাতিক অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠছে। এইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গ্লোবালাইজেসন ও লোকালাইজেসন-এর দ্বন্দ্ব ক্রমাগত ব্যাপ্ত ও ধারালো হয়ে ওঠছে। এই দ্বন্দ্বের সূত্রে চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যানের প্রয়োজন আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে।
আবার এই অনুভবের সূত্রেই আমরা উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আরও একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছি। ফ্রানজ ফানোন-এর ‘ম্যানচিয়ান অ্যান্টাগনিজম’-এর বিপক্ষে দাঁড়ালে আমরা দেখতে পাই, মাস্টার ডিসকোর্সের আগ্রাসী ভূমিকাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশজ ডিসকোর্সগুলো ধারাবাহিকভাবে ইন্টেরোগেট করছে, তাদের নিজস্ব উচ্চারণের ওপর দাঁড়িয়েই। কিন্তু তার ফলে যে নতুন ডিসকোর্স গড়ে উঠছে তা-ও যে মাস্টার ডিসকোর্সের আধিপত্য থেকে পুরোপুরি মুক্ত তা বলা যাবে না। এই ডিসকোর্সগুলো এডওয়ার্ড সাঈদ-এর ছাঁচে ‘Us’ ও ‘Them’-এ ভাগ করা যায়। তার ফলে এক ধরনের র্যাডিক্যাল জেসচার থাকলেও ইউরোকেন্দ্রিকতা ও আধুনিকতার ধারণাসমূহকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যানের অক্ষমতা থেকেই, এই নতুন ডিসকোর্সগুলো যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত হলেও, কোনো কাউন্টার-ডিসকোর্স নির্মাণ করতে পারছে না।
৫
ঔপনিবেশিকতাকে একটি বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে দেখলে একথা বোঝা যায় যে, ভলতেয়ারের চিন একজন আধুনিক নৃতাত্ত্বিকের দেখা প্রাচ্য নয়। বরং তাকে পাশ্চাত্যের এক উদারনৈতিক মানবতাবাদীর অল্টার-ইগো হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে। মধ্যযুগে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক ইউরোপীয়ই যেতেন এ্যারিস্টটল পড়তে। আবার ওয়ারেন হেস্টিংস-এর মতো প্রথম প্রজন্মের ঔপনিবেশিক প্রতিনিধিরাও মনে করেছেন, ভারতবর্ষকে তারা যা শেখাতে চান তার তুলনায় তাদের নিজেদেরই অনেক বেশি কিছু শেখার আছে এদেশ থেকে। এর থেকে বোঝা যায় এক বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে ঔপনিবেশিকতা শুধু প্রাচ্যকেই রূপান্তরিত করেনি। সেই সঙ্গে পাশ্চাত্যকেও পরিবর্তিত করে দিয়েছিল।
কিন্তু এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ার পরিসীমার বাইরে, ভারতীয় সিভিল সোসাইটির গভীরে, বহু মানুষ ছিলেন যাঁরা ভারতবর্ষকে অ-পাশ্চাত্য হিসেবে নয়, বরং শুধু মাত্র ভারতবর্ষ হিসেবেই ভাবতেন। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষেরা নিজেকে কখনোই নিজেদের পাশ্চাত্য মানুষের কাউন্টার-প্লেয়ার বা অ্যান্টি-থিসিস হিসেবে ভাবতেন না। তাঁদের পক্ষে এভাবে ভাবার কোনো কারণও ছিল না। তাঁদের কাছে ভারতবর্ষ প্রো-মডার্ন বা অ্যান্টি-মডার্ন কিছুই ছিল না। ভারতবর্ষ তাদের কাছে ছিল নিখাদ নন-মডার্ন। আর সেই সূত্রেই প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কসমূহের সমগ্রতার যে অবয়বটি সাধারণ চৈতন্যে বেঁচে ছিল তার চরিত্রটি ছিল সম্পূর্ণই দেশজ ও ঔপনিবেশিকতার প্রভাবমুক্ত। আর এই দেশজ চৈতন্যের বিশুদ্ধতার শেকড় ছিল দেশজ প্রকৃতির মধ্যে। ভারতবর্ষের সিভিল সোসাইটির আপাত-স্থানুত্ব-নিশ্চলতাসত্ত্বেও, তার স্ব-কাঠামোর গভীরে যে অন্তর্লীন অমেয় শক্তি ছিল, তার জোরেই সে পলিটিক্যাল সোসাইটির সমস্ত উদ্যোগ ও চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণ প্রতিহত করতে পেরেছিল। সিভিল সোসাইটি প্রতিবাদের এলাকা হিসেবে যে স্বায়ত্ত বজায় রেখেছিল তার বর্মে সজ্জিত হয়েই ভারতবর্ষের সাধারণ নাগরিকদের চৈতন্যে দেশজ শেকড় বেঁচে ছিল প্রকৃতির মতো, সমস্ত ঝড়-জল-ঝঞ্ঝা-তুফানকে উপেক্ষা করতে করতে। উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বেও তৃতীয় দুনিয়ার বাস্তবে দাঁড়িয়ে চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করা সম্ভব, তৃতীয় দুনিয়ার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ডিসকোর্সের স্বাধীন অস্তিত্ব ও স্ব-অভিজ্ঞানকে মাথা উঁচু করে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব, শুধুমাত্র স্বদেশের সিভিল সোসাইটির অমেয় শক্তিকে যথাযথভাবে অনুধাবনের মধ্যে দিয়েই। তৃতীয় দুনিয়ার সিভিল সোসাইটির অন্তর্লীন শক্তি এতটাই প্রবল যে গ্যাট ও আইএমএফ নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাপ্ত জালও তাকে পরাস্ত করতে পারে না। তৃতীয় দুনিয়ার সিভিল সোসাইটির এই অমেয় শক্তিকে অনুভবের মাধ্যমে ও প্রান্তীয় মানুষগুলোর অশেষ সৃষ্টিশিলতাকে শ্রদ্ধার মধ্যে দিয়েই, উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে, আমরা পায়ের নীচে শক্ত জমি পেতে পারি। আর তার উপরে দাঁড়িয়েই আমরা দেখতে পারি ঔপনিবেশিকতাকে সামগ্রিকভাবে প্রত্যাখ্যানের স্বপ্ন আর উচ্চারণ করতে পারি বিশ্বাসের শব্দগুলোকে।
বর্ষ ৫, সংখ্যা ৯, আগস্ট ২০০৬