স্বামী স্ত্রীর একান্ত মূহুর্তের ঘন শ্বাস-প্রশ্বাসের ধ্বনি রাতের নির্জনতার ফাঁকে ফাঁকে ভেসে এসে রাহেলার কানের ভেতরও কম্পন তুলছে। তার মানে ইশিতা এখনও ঘুমায়নি, ঘুমায়নি তার স্বামী তমালও। তাদের একমাত্র সন্তান দেড় বছর বয়সী পরাগ- যে সারাদিন রাহেলার কাছে থাকে সে বাবা মায়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়লেও পাশের রুমে শুয়ে থাকা রাহেলার চোখে ঘুম এসে নোঙর ফেলেনি। ইশিতা-তমাল কি জানে সে সজাগ রয়েছে? নাকি তারা নিজেদের ভেতর এত নিমজ্জিত হয়ে গেছে যে তার অবস্থান বিস্মৃত হয়ে গেছে; এটা অস্বাভাবিক নয় যে সুখানুভূতির প্রাচুর্য পরিপার্শ্ব সম্পর্কে অসচেতন করে দিতে পারে। তবে এটা নতুন নয়, কখনো আজকের মতো রুমে থেকেই সে এরকম ধ্বনি শুনেছে , কখনো রাতে তাদের রুমের পাশ দিয়ে বাথরুমে যাওয়ার সময় শুনেছে। তার নিজের কাছেই মাঝে মাঝে লজ্জ্বা লাগে এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে। কিন্তু অবাক হয় না। সে-ও কি তার স্বামীর সাথে মিলিত হয়নি ? তার দেহেও কি সুখের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েনি। আর এর প্রভাবে হয়ত তার মুখ দিয়েও এরকম ধ্বনি বেরিয়ে এসেছে। কেউ গোপনে শুনলেও শুনতে পারে ।
স্বামীর সাথে তার না থাকার সময়টা দুই বছরের কিছু বেশি হয়েছে। এ সময়ের ভেতর অনুভব করেছে অনেক অতৃপ্তি আর অনেক সুখ-দুঃখ বোধের আনন্দ বিষাদ। কই, সময় তো আটকে থাকেনি, তার নিজস্ব নিয়মে এগিয়ে গেছে ভবিষ্যতের দিকে। এখানে, এদের কাছে এসেছে, তা-ও প্রায় একবছর হয়ে গেছে। অর্থাৎ সে আসার পর পরাগের বয়স আরো এক বছর বেড়েছে। সে যখন আসে তখন তার বয়স ছিল ছয় মাস। এই যে সে এখন শহরে থাকছে-কখনো পরাগ বাইরে যেতে চাইলে রাস্তায় একটু হেঁটে আসে শুধু-এছাড়া তো সারাক্ষণ বাসার তিনরুমের ভেতরই বন্দি থাকছে- কোনদিন কল্পনাও করেনি এরকম জীবন তাকে যাপন করতে হবে। কার-ই বা পরিকল্পনা মাফিক জীবন চলে? সময়ের আবর্তে কতকিছুই ওলটপালট হয়ে যায়। নইলে তার তো এখন চুটিয়ে সংসার কথা ছিল। বিয়ের পর চার বছর কেটেছে স্বামীর ঘরে। এটা প্রলম্বিত হয়ে এখন ছয় বছরের উপর গড়াতো। কিন্তু হয়নি।
রাত আবার নির্জন হয়ে গেছে। কোন শব্দ আসছে না পাশের রুম থেকে। ইশিতার চোখ কি তাহলে মুদে এসেছে? মুদে এসেছে তমালের চোখও? দুজনের শরীরেই তো ভিড় করে থাকে সারাদিনের কর্মক্লান্তি। এই যে সকালে অফিসে যাওয়া, সারাদিন কাজ করা, তারপর বাসায় ফেরা- নির্ধারিত সময়ে ফিরতে পারলে সেটা ব্যতিক্রম- অধিকাংশ দিনেই দেরি করে ফিরতে হয়। কি আর করা । চাকরি করলে তো কাজ করতেই হবে। বসের মর্জি মতো অফিস শেষ করতে হবে। আর বসগুলোও কেমন যেন- নাকি এ চেয়ারে বসলে সবাই এমনই হয়ে যায়-দিনের শেষ সময়ে এসে কাজের ভিড় জমায়। কিছু বেশি সময় কর্মীদের ধরে রাখলে যেন অনেককিছু অর্জন হয়ে যায়। পরাগের জন্ম হওয়ার আগে বেশি সমস্যা অনুভব না করলেও এখন অফিস সময় শেষ হওয়ার আগেই বাসায় ফেরার জন্য ইশিতার টান পড়ে যায়। তমালেরও একই অবস্থা। দুটি কর্পোরেট হাউস যেন দুজনকে চুষে নিচ্ছে। যদি রাহেলাকে না পাওয়া যেত তাহলে কেমন হতো অবস্থা? এভাবে তারা চাকরি করকে পারতো? তখন হয়ত পরাগের দেখাশোনা করার জন্য একজনকে চাকরি ছেড়ে দিতে হতো। কিন্তু কে ছাড়তো? ইশিতা নাকি তমাল? তবে অভিজ্ঞতা এই বলে যে এ পরিস্থিতিতির মুখোমুখি হলে নারীরাই চাকরি ছেড়ে দেয়। তারা দুজনেই দেখেছে এরকম। সন্তান পালনের সাথে চাকরি করার সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হলে মাতৃত্বের টানই বড় হয়ে উঠে।
মাঝে মাঝে ইশিতার মনে হয় পরাগকে তারা ঠকাচ্ছে না তো? রাহেলা না হয় সারাদিন দেখাশোনা করল কিন্তু বাবা মায়ের সান্নিধ্য শিশু যেটুকু প্রত্যাশা করে সেটুতো তো পাচ্ছে না। এজন্য তার কখনো কখনো ইচ্ছা হয় চাকরি ছেড়ে দিতে। কিন্তু আবার ভাবে এটাই কি সমাধান তাহলে? সে নিজের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়-সন্তান পালন যেমন জরুরী, চাকরি করাও অনাবশ্যক নয়। উন্নত বিশ্বে মেয়েরা কি কাজ করছে না? তবে তাদের মতো সুবিধা এখানকার নারী কর্মজীবীরা পান না। তবু ইশিতা মনে করে চাকরি করা দরকার। আর্থিক প্রয়োজন তো আছেই, এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই, এছাড়া সে মনে করে লেখাপড়া শিখে একটি মেয়ে বসে থাকবে কেন? তার অর্জিত জ্ঞান যদি কাজে না লাগাতেই পারে তাহলে কি দরকার ছিল পড়ালেখা করার। আর চাকরি উপার্জনের পাশাপাশি মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে সহায়তা করে। তবে সন্তান পালনও যে একটি মূখ্য দায়িত্ব এটা এড়ানোরও কোন সুযোগ নেই। এসব বিবেচনা করে মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ হওয়ার আগেই রাহেলাকে নিয়ে আসে।
রাহেলা যখন খালার মাধ্যমে শহরে এক বাসায় কাজে যাওয়ার প্রস্তাব পায় এর আগেই তার কাছে বিয়ের আগে বাবার বাড়িতে থাকা আর বিয়ের পর বাবার বাড়িতে থাকার পার্থক্য ভয়ানক রূপে দেখা দিয়েছে। বাবা তো অনেক চেষ্টা করেছেন তাকে স্বামীর ঘরে ফেরৎ পাঠিয়ে দিতে। যদি বিয়েই দেওয়া হলো তাহলে এ মেয়েকে আর পালা কেন? তারওপর সম্পর্কটাও সে ভেঙ্গে দেয়নি। যেহেতু তিনি আর্থিকভাবে দূর্বল সেহেতু এ ভাবনা আসা অমূলক নয়। আর এর সাথে মানুষের নানা ধরনের বাঁকা কথা তো আছেই। মেয়ে কেন এখানে পরে আছে? স্বামী তাকে ছেড়ে দিয়েছে কিনা এরকম অনেক প্রশ্নের মুখোমুখে হতে হয় তাকে। তিনি এর প্রতিশোধ নেন রাহেলার উপর। সে নিজেও যে এমন কথার মুখোমুখি হয়নি এমন নয়। তাকেও প্রত্যক্ষে যেমন অনেক কথা শুনতে হয়েছে তেমনি পরোক্ষেও যে তাকে নিয়ে অনেক মুখরোচক কথা হয় তাও তার কানে আসে। ফলে বাবার তীর্যক কথায় মেজাজ কখনো খারাপ হয়ে গেলেও তার কথাকে অসঙ্গত বা অস্বাভাবিক মনে হয় না। তাই কিছুদিন শহরে যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধায় ভুগলেও খালার প্রস্তাবে শেষে রাজি হয়ে যায়। বাবা বা পরিবারের অন্য কেউ এ ব্যাপারে তার সাথে দ্বিমত করেনি।
দুলালের সাথে সংসার করার শেষের চারবছরের দুই বছর ছিল দুর্বহ যন্ত্রণা ভোগের সময়। এ সময়ে রাহেলা জীবনকে দেখতে পায় ভিন্নভাবে। দুলাল যে তার জন্য দূরের কেউ হয়ে যাব এ কথা সে কখনো ভাবতে পারেনি। সেও চায়নি তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে। কিন্তু নানা বিচিত্র ঘটনার অভিঘাতে কতকিছুই তো পরিবর্তন হয়ে যায়। সে কি জানতো তার কোনদিন সন্তান আসবে না। সেটা তার দিক থেকে না হয়ে দুলালের দিক থেকেও তো হতে পারতো। ডাক্তারের দেয়া পরীক্ষায় দুলালের ত্রটি ধরা পড়লে কি হতো? এভাবে তাকে যন্ত্রণায় বিদ্ধ হতে হতো? আর তার যে সন্তান ধারণের ক্ষমতা নেই এজন্য তো সে নিজে দায়ি নয়। তার শারীরিক গঠনের কোন ত্রটির দায় তো সে নিতে পারে না।
এছাড়া বড় ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে দুলালের ঘনিষ্ঠতা ততদিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভাই মারা গেলে তার স্ত্রী সন্তানকে তো অন্য ভাই দেখাশোনা করতেই পারে। সেটা দোষের কিছু নয়, বরং প্রশংসারই দাবি রাখে। কিন্তু যখন দায়িত্ববোধের সীমা পেরিয়ে ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য সামনে এসে পড়ে তখনই প্রশ্ন জাগে। আর প্রশ্ন রাহেলাকে ক্রমাগত বিদ্ধ করতে থাকে। দুলাল কি তার কাছ থেকে কিছু পাচ্ছে না? কই, সন্তান না হলেও তো তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক সে বন্ধ রাখেনি। সেও দুলালকে বাধা দেয়নি তার সাথে মিশতে। তারও তো চাহিদা আছে। সেও চাইতো দুলাল তাকে জড়িয়ে ধরুক, সুখে ভরিয়ে দিক শরীর এবং মন। এভাবেই চলছিল সবকিছু। কিন্তু হঠাৎ করে কেন দুলালের এ পরিবর্তন? নাকি আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে এটা চলছিল যা সে ধরতে পারেনি? হয়ত স্বাভাবিক সম্পর্কের ভেতর এমন অস্বাভাবিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে যায় যা দৃষ্টি এড়িয়ে নির্বিঘ্নে চলতে থাকে। কিন্তু এ লুকোচুরি কয়দিন আর চলতে পারে। রাহেলা ঠিকই ধরে ফেলেছে দুলালের চোখমুখ অন্য কথা বলছে।
ভাবীর সাথে দুলালের অন্তরঙ্গতা যেদিন রাহেলা হাতেনাতে ধরে ফেলে সেদিন রাতে দুলাল তাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলে সে বাধা দেয়। সে আগেই ঠিক করে রেখেছিল এভাবেই প্রথম আঘাতটা দেবে। দুলাল হতচকিত হয়ে যায় এ ধরনের প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়ে। মন না চাইলে বা শরীর খারাপ লাগলে রাহেলা কখনো কখনো মিলন থেকে বিরত থাকতে বললেও এভাবে বাধা দেয়নি। প্রথমে মুখে কিছু বলেনি, শুধু হাত দিয়ে দুলালকে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে এতে না থামলে তার মুখে কথা আসে-‘ আমাকে একদম ছুঁইবা না। ভাবীর সঙ্গ লইছ তো, তার সাথে গিয়া ঘুমাও।’ তার এ কথায় দুলালে মেজাজও শান্ত থাকেনি। সে-ও রুঢ় গলায় বলে-‘ কি কও তুমি। তুমার মুখে এই কথা আয় কেমনে। বজ্জাত মাইয়্যা।’
-মুখ সামলাইয়্যা কথা কও। ভাবীর সাথে গলাগলি কর আর এখন আইছ আামারে রাগ দেখাইতে।
-থাম হারামজাদি, বেশি কথা কইতাছস। আমি কি করছি?
-কি করছ, না, নিজেরে জিগাও । আমার কইতে অইব না। আমি তো জানি ই।
এদিনের মতো মতো কথা শেষ হয়ে যায় দুলাল বাইরে চলে গেলে। হয়ত বেশি কথা বললে আরো কিছু বের হয়ে আসবে তাই সে আগায় না।
এরপর ভীষণ জড়তা এসে ভিড় করে রাহেলার শরীর-মনে। যদি কারো সাথে এ বিষয়টা শেয়ার করতে পারত তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও শান্তি পেত। কিন্তু এটা এমনই এক বিষয় যা অন্যকে বলা যায় না। কোন কোন যন্ত্রণায় এভাবেই নিজে নিজে পুড়তে হয়। এই পোড়ায় ভেতরটা ছাই হয়ে যায়। এই ছাই ফুঁ দিয়ে উড়িয়েও দেয়া যায় না। এই উপজাতকে বয়ে বেড়াতে হয়। এসব ডিঙিয়ে দুলালকে কাছের কেউ ভাবতে আর মন থেকে সায় আসে না।
এই অবস্থায় আর কি স্বতঃস্ফূর্ত হওয়া সম্ভব? রাহেলা হতে পারেনি। তার চোখে কেবল ভেসে উঠে ভাবীর সাথে দুলালের ঘনিষ্ঠ অবস্থান। দুলালের সাথে তার সম্পর্কের মাঝখানে এ দৃশ্য এসে দাঁড়ালে দূরত্ব আরো বেড়ে যায়। তার মনে হয় সে চলে গেছে অনেক দূরে। দৃশ্যত সে দুলালের বউ হয়ে থাকলেও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের স্বাভাবিকতা আর থাকে না। কিন্তু রাহেলা বাধা দেয়া সত্ত্বেও দুলাল শারীরিক সম্পর্ক চালিয়ে যেতে দ্বিধা করে না। তার যুক্তি হলো রাহেলা তো তার বউ তাহলে সে নিজেকে গুটিয়ে রাখবে কেন? রাহেলাকে তাই একসময় পরাস্ত হতে হয়। নিজেকে সঁপে দিতে হয় দুলালের আলিঙ্গনে ভেতর। কিন্তু সে এ থেকে আনন্দ নিতে পারে না। জোর করে যৌন মিলনের মধ্যে আনন্দ কিসের? যদিও দুলাল তার স্বামী তবু এসব মূহুর্তে তাকে মনে হয় অনাকাঙ্খিত কেউ যে জোর করে তাকে চেপে ধরেছে।
অথচ বিয়ে পরবর্তী যুগল জীবন শুরু করার দিনগুলো এমন ছিল না। একে অপরকে কাছে পাওয়ার জন্য সর্বদা উদগ্রীব হয়ে থাকত। এ জীবনের সাথে রাহেলার পরিচয় ছিল না, পরিচয় ছিল না দুলালেরও । এই অপরিচিতি তাদেরকে পরস্পরের ঘন সান্নিধ্যে আসতে ঠেলে দিত। দুলাল যে তাকে সবসময় কাছে চায় তা রাহেলা বুঝতে পারত। কিন্তু যুগল জীবনের আনন্দ বাড়িয়ে নিতে সারাক্ষণ কাছে থাকার সুযোগ কই? দুলালকে বাইরে যেতে হয় কাজ করার জন্য। রোজগার করতে হলে বাইরে না গিয়ে কোন উপায় নেই। রাহেলাকেও ব্যস্ত থাকতে হয় গৃহস্থালির নানা কাজে। তাই রাত ছাড়া পরস্পরের কাছে আসার সুযোগ হয় না। এ সময়টা তাই হয়ে উঠে মধুর আর চরম আনন্দঘন। দুলালের হাত যখন তার পেট, বুক ছঁয়ে যেত, ঠোঁট লাগতো ঠোঁটে তখন এক অদ্ভত পুলক খেলে যেত শরীরে। এর প্রভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসলে সে দুলালকে আরো কাছে টেনে নিত। বিয়ের আগে রাহেলা শরীরের এ স্বাদ পায়নি। দুলাল পেযেছে কিনা তা সে জানে না। তা জানার প্রয়োজনও মনে করেনি।
ইশিতা ও তমালকে পরস্পরের ঘন সান্নিধ্যে দেখলে তার সুখের দিনগুলোর কথা বেশি মনে পড়ে। তার মনে হয় সে দুলালকে যেভাবে কাছে পেতে চাইত, ইশিতাও কি এভাবে তমালকে কাছে পেতে চায়, বা তমাল ইশিতাকে? এখানে আসার আগের দিনগুলোর কথা জানা নেই। সে আসার পর থেকে দেখে যে অফিস থেকে ফিরে দুজনই পরাগকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পরাগও যেন সারাদিন মা বাবাকে না পাওয়ার অপূর্ণতা পুষিয়ে নিতে চায়। কিন্তু পরাগ কোনদিন একটু আগে ঘুমিয়ে গেলে তারা এক অপরের সান্নিধ্য উপভোগ করার চেষ্টা করে। দুজনে পাশাপাশি বসে চা খায় বা টিভি দেখে বা কোনদিন লাইট নিভিয়ে দিয়ে পারস্পরিক মন্থনে মেতে যায়।
এসব একান্তে থাকার মূহুর্তগুলোতে সবসময় সচেতন থাকা সম্ভব হয় না। হয়ত অজান্তেই ঘটে যায় এটা। তারা কখনো এমন অবস্থায় চলে যায় যেভাবে কারো সামনে থাকা সম্ভব নয়- হয়তো তমালের হাত ইশিতা স্তনের আশেপাশে ঘুরছে বা ইশিতা তমালের গায়ে আলতো হাত বুলিয়ে সারাদিনের ক্লান্তি মুছিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থায় থাকাকালে কোনদিন রাহেলা তাদের সামনে এসে পড়ে যা তাদের কাছে কোনভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না। রাহেলাও বিব্রত বোধ করে তাদেরকে না দেখার ভান করে চলে যায়, কখনো আবার তারা টের পেলে ডেকে জিজ্ঞেস করে কোনকিছু বলতে এসেছে কিনা। রাহেলা কখনো সাড়া দেয় কখনো বা কিছু না বলেই সামনে থেকে চলে যায়। এরকম অবস্থায় রাহেলা যতবার তাদের সামনে পড়েছে ততবারই বলেছে নিজেকে বলেছে তারা একত্রে বসা থাকলে আর সামনে যাবে না। তবু কেমন করে যেন এ ব্যাপারটা ঘটে যায়; তাদের অন্তরঙ্গ দৃশ্য সে দেখে ফেলে।
সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে যেদিন দুলাল ভাবীকে বিয়ে করে ফেলল সেদিন রাহেলা টের পায় তার পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। এই অসম্ভব ঘটনাটি তার বিশ্বাসই হতে চায়নি। ভাবীর সাথে দুলালের মেলামেশা যে বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে তা সে যেমন ভাবতে পারেনি তেমনি ভাবতে পারেনি অন্য কেউ। সে ভেবে পায় না দুলাল এ কাজ কেন করল। এখন কি করবে সে? ভাবীর সাথে শারীরিক মেলমেশা এতদিন লুকোচুরির ভেতর দিয়ে হলেও এখন আর কোন বাধা রইল না। স্বামী স্ত্রীকে কে বাধা দেবে শরীর রোমন্থন থেকে? রাহেলা এটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না যে দুলাল তার জ্ঞাতসারেই এখন আরেকজন মহিলার সাথে ঘুমাবে। তাকে সে কোন কথাও বলতে পারবে না। অর্থাৎ দুলালের কাছে কোন অবস্থান আর তার রইল না।
দিনদিন দূরত্বের অনুভব বেড়ে চললে রাহেলা নিজেকে দেখতে পায় বদ্ধ অবস্থায় । তখন মুক্তির জন্য মন হাঁসফাঁস করতে থাকে। কতদিন এ অবস্থায় থাকা সম্ভব বা আদৌ থাকা সম্ভব কি? নিজের সাথে কত আর নিজে যুদ্ধ করা যায়। এরকম চলতে চলতে ভবিতব্য কি হবে তা আর না ভাবেই তা জেনেই বাবার বাড়ি চলে আসে।
তবে এটা মেনে নেয়নি দুলাল। তাকে ছেড়ে এভাবে চলে আসাটা সে তার প্রেস্টিজের ব্যাপার বলে মনে করে। তাই ফিরিয়ে নিতে এসেছিল। সে কিছুদিন একা একাই এ প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। এতে সফল না হয়ে পরিবারের লোকজনও নিয়ে আসে। কিন্তু কেউই রাহেলাকে টলাতে পারেনি। যে তীব্র যন্ত্রণা সে ভোগ করেছে, তার আর পুনরাবৃত্তি চায় না।
ইশিতা ও তমালকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে বা তাদের মিলনের শব্দ শুনে কখনো কখনো তার মধ্যে একটি শূন্যতার অনুভব জেগে উঠে। এই শূন্যতা কি দুলালের জন্য? কেননা এখনো, এতদিন পরেও দুলাল ছাড়া অন্য কারো স্পর্শ সে কল্পনায়ও আনতে পারে না। ইচ্ছে করলে এখনও তার কাছে যেতে পারে। সে পথ তো বন্ধ হয়নি। সে যেতে চাইলে দুলাল হয়ত নাও করবে না। কিন্তু প্রচণ্ড বাধা আসে তার মনের গভীর থেকে। দুলাল অন্য কারো সাথে শারীরিক মিলন ঘটিয়েছে এটা ভাবলেই গা রিনরিন করে উঠে তীব্র ঘৃণায়। যে উষ্ণতা জেগে উঠে সুখস্মৃতি রোমন্থনকালে তা হারিয়ে যায় নিমেষেই। কিন্তু যেহেতু চলেই এসেছে আর ফিরে না যাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে তাই কোন সম্ভাবনাই নাই লটকে থাকা সম্পর্কটাকে আবার আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে। অনেকে আবার তাকে বলেছে দুলালের কাছ থেকে যেহেতু চলেই এসেছে তাহলে সম্পর্ক একবারে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে নতুন করে বিয়ে করে ফেলে না কেন। তার নিজের মাথায়ও যে এমন ভাবনা আসেনি তা নয়। কিন্তু সে চায় না আর কেউ কার শরীর স্পর্শ করুক।
রাত আরও নির্জন হয়ে এসেছে। ইশিতা ও তমাল হয়ত তৃপ্ত হয়ে ঘুমের অতলে ডুবে গেছে। হয়ত এখন এভাবেই সঙ্গম শেষে তৃপ্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে দুলাল আর তার দ্বিতীয় বউ। আর সে একাকী নির্ঘুম জেগে আছে। জীবনের সমীকরণ এভাবে বদলে যাবে কে জানতো?
মাঝে মাঝে তার এমন হয়। এই রাতের বেলাতেই নিজের একাকিত্বকে সে ভালো করতে অনুভব করতে পারে। তখন মনে হয় কে আছে আসলে তার? স্বামী তো থেকেও নেই । বাবাও চান না সে আর তার বাড়িতে থাকুক। তাহলে কি দাঁড়াল? সে নিজেই আছে কেবল নিজের জন্য। আপাতত তাই। ভবিষ্যতে কি হবে এটা তো আর কল্পনা করা যাচ্ছে না। অনিশ্চিত ভবিষ্যতে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে যার উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তাই সে মনে করে বর্তমানকে নিয়ে থাকাই ভালো। রাত পোহালেই তার কাজ শুরু হয়ে যাবে। পরাগকে নিয়ে সারাদিন কাটাবে। বর্তমান জীবনে পরাগই যেন তার একমাত্র স্বস্তির উৎস। মন্দ কি এই ছোট শিশুটির সাথে তার সময় তো কেটে যাচ্ছে।
শামসুল কিবরিয়া
জন্ম হবিগঞ্জ জেলায়। প্রভাষক সিলেটের একটি সরকারী কলেজের। গল্প ও কবিতা লিখেন। চারবাক ও শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। সম্প্রতি বইকথা নামে একটি কাগজ সম্পাদন করছেন।