ফারহান ইশরাকের দশটি কবিতা

0

গর্ভপাত

মা এক মধুর ক্লিনিক; স্তন-সলিণ্ডারে দুধ আর অক্সিজেন
স্বপ্ন দেখে হেসে ওঠে এক তাল মাংসের ছক।

হায় কপাল! দেখো এ্যাপ্রোনের চামড়ায় মুড়ে সিজারের
ছুরি হাতে ছুটে আসে শাদা জানোয়ার, হুশিয়ার!

পচা করিডোরে পা ফেলে ফেলে সে আসে আয়, বর্বর পশু
আগুনের ছানি বরফের হাতল-টানা চেয়ার
তাকে বসতে দেবে বলে পা শক্ত করে কাছে ডাকছে।

মায়ের মুঠোয় ওম, রোদ্র, শিশির আছে স্বপ্ন দেখে শিশু
মা এক মধুর ক্লিনিক, সত্য জেনে হেসে ওঠে মাংসের ছক

ভ্রুণের ভেতর থেকে উঠে আসছে কাটা কচি হাত,
ঠোঁট মাথা যোনি জঙ্ঘা চিবুক চোয়াল মাড়ি আর মৌনতা।

রক্তপুঁজের হৃৎপিণ্ড থেকে উঠে এলো  গাঢ় আশীর্বাদ:
নিপাত যাও সব সিজার, সেবিকা শাদা জানোয়ার।

গোলাকার স্তনের সিলিন্ডার ফেঁটে যাও জাতকের ফুৎকারে
শব্দের হুঙ্কারে ছুরি চাকু ট্রে টেবিল উল্টে পড়ে যায়।

মশা মাছি ব্যাকটেরিয়া ছুটে যায় এক দলা লাল মাংসের
দিকে । ঘেউ ঘেউ করে ওঠে নীরবতা, শান্তি যাচ্ছে ঘুমিয়ে

মা এক মধুর হাসপাতাল, স্বপ্নে দেখে হেসেছিল শিশু
অস্বস্তির কাটা মাংস ঢোক গিলে উদরে লুকায় স্নেহময়ী মা।

লবণ ও ললিপপ

সল্ট ইজ কামিং ফ্রম দ্য ব্লু সী-প্রসেসিং প্রায় শেষ
হুঁশিয়ার ভাতমাছি পান্তার প্লেট ছেড়ে
এক্ষুণি পালাও বলছি।

সম্ভোগের রেস্তোরাঁ খোলা
তৃপ্তির ঢেঁকুর উড়ে যাচ্ছে আলতো আরামে
ডেন্ট লুজ হার্ট

প্রতীক্ষার পাকস্থলি, জাস্ট এ্যান আওয়ার অর লেস

লবণ সংকট
এমন কিছু নয়

লাবণ্যের ন্যায্য লোভ সহজে কী সামলানো যায়!
জিভে উষ্ণ জল, মাংসের ললিপপ অবেলায় তবু কী সম্ভব!

দুধের স্মৃতি পাত্র চেটে মোটামুটি তৃপ্ত বেড়াল।

পানতা ফুরোতে বসলো: আজ তবে আর আসছো না, খাদ্যনুন?
প্লিজ গেট কুয়িকার-লবণ ও ললিপপ, আর পারছি না!

পাহারা

স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
জেগে দেখি চুরি হয়ে গেছে সে।

ফিরে পেতে পুনরায় চোখ বুঁজলাম
দেখি কয়লা হয়ে গেছে লোভের লালায়

হারানোর হিম শ্বাসে বরফ জমলো হাড়ে
কাঁদলাম; শব্দ শুনে চেতনা ফিরে এলো।

এবার সিদ্ধান্ত পাকা স্বপ্নকে একা রেখে
চোখের পাতা মেলাবো না।

শিয়রে আপেল রেখে ঘুমানো চলে না।

গন্ধম

এক প্রকার সোর্ন্দয আছে যার প্রশংসা উচ্চারিত হতে না হতে
জিহ্বায় ছুরি কষে একটানে নামিয়ে ফেলা শ্রেয়োতর।

কেউ একজন প্রশ্ন করে, কোথায় দেখেছো সে নিষিদ্ধ প্রভা।

আমি হাসি। সামান্য বাঁকা বটে সেই তরোবারি
দেখেছি ছাতার নিচে, যে ছাতা সুরক্ষা দেয় রাজা ও মন্ত্রীর
মূর্খতার প্রশ্রয় ছাড়া সে কুসুম কখনো ফোটে না।

সামান্য রোদের ভরে যে লাবণ্য টলে পড়ে ক’ পয়সা তার দাম
মুকুটের চূড়ায় যে রাখে পা, সেই তবু সেরা প্রজাপতি!

এক প্রকার সত্য আছে-আলো, তবু দেখামাত্র গুলি করা শ্রেয়
কেউ একজন প্রশ্ন তোলে, কোথায় দেখেছো সে বরেণ্য চাতুরি?

দেখেছি ফলের খোসায়, চারু, চকচকে-ত্বকে বা চামড়ায়
ভেতরে বিঁষের ফোড়া রক্ত পুঁজ অন্ধকার তুমুল গন্ধম।

চলো তবে মূহুর্তে বেরুই লাবণ্য বিনাশে বা সোন্দর্য প্রহারে।

www.charbak.com

> ফারহান ইশরাকের ড্রইং <

চিনিপুতুল

মধ্যরাত। চিনি খাওয়ার স্বপ্নে ঘুম ভাঙে
একটি পিঁপড়ের। ভাঙে আশা, চিকন চাতুরি

হা ঈশ্বর, তবে কী সে অভুক্ত ছিল!

নিজেকে সে খুঁজে পেলো যথারীতি
শাদা ত্বক চিনি পুতুলের পাশে। আধশোয়া।

আস্তে এগিয়ে এলো পুতুলের জোড়া হাত
তালুতে তিরতির কালো দুধ ধলো জ্যোৎস্না।

লিবিডো তাড়িত পিঁপীলিকা, শুনতে পাচ্ছো?
এমার্জেন্সি কালে এই ঘন নীল রাতে
বিব্রত করেছি বলে লজ্জ্বিত। রিয়্যালি স্যরি।

নুন

চাষার শরীরে সৃষ্টিশীল নুন, মালির চামড়ায়ও তাই-
শাদাটে আস্তর। বৃষ্টির চুমু রোদের পোড়ানি খেয়ে
দোঁয়াশের গর্ভ ফাটলে ভ্রুণ, রোদে জলে ঘামে ভিজে
সবুজের দানায় দানায় কে জমায় অপরূপ শালদুধ;
স্বপ্ন শিশুর চোখে নতুন দিনের নরোম ঝংকার।

সপুষ্পক ছোট্ট গাছের শাখা গ্রন্থি ফুঁড়ে মাঠে মাঠে
চাঁদ ওঠে, সঙ্গম ফলিত শস্যের ঘ্রাণে জ্যোৎস্নার থালা উপচায়,
গোলায় ডাকে বান পাকাশয়ে পুষ্টি সাধনা দেহ কোষে প্রাণ সঞ্চার
যোনিতে জননজৌলুস। প্রবাহ চিত্রের শেষ ধাপ:
সিরামিক প্যানে ব্যাকটেরিয়ার লালায় গুয়ের ভাণ্ড
লণ্ডভণ্ড ড্রেনে নেমে যায়, তীব্র ত্যাগ। স্তর বিন্যাসে
হলুদ কস্তুরি। সুন্দরতা, তবু তার কীর্তনে কে রাজি?

চিনিপিঁপড়ে

প্রতি শুক্রবার যেটুকু পারি পিঁপড়ের জন্য চিনি ছেঁটাই। মাটির মেঝে চিনিগন্ধে মৌ মৌ-
অন্য দিন রোবটের হাত কাজের চাপে চড়কি অবিকল। ছুটির দিনে

মনেও একটা মিষ্টি মিষ্টি ভাব।

পয়সা কামিয়ে যারা জাতে উঠলো, রক্তের গ্লুকোজ কমাতে দাড়ি কামাতেও ভুলে
যায়; দুশ্চিন্তার দাড়ি কমা কিছুই থাকে না। হৃৎপিণ্ডের মিটার ঘুরছে তো ঠিকঠাক! পা-গুলো পার্কে পার্কে ছোটে।

দৌড়ে কমছে শরীরের শর্করা।

পিঁপড়ের জন্য এটা কোনো সুসংবাদ নয়। শীত নিদ্রায় রসদ ফুরিয়ে পতঙ্গ ফতুর,
আমি ছাড়া কে আছে ওদের! সারি বেঁধে যখন আসে মিষ্টি গলায় বলি,

জোট বাঁধতে হবে মিয়ারা

জিভের নিচে দুটো চিনিদানা আমারো গলছে, ওরা যায় ঠোঁট চেটে চেটে চিকন
কাতারে পিলপিল। এয়ারটাইট প্যাকেট পড়ে আছে। মজুদ ফুরিয়ে না যেতেই

আখের গোছাতে হবে।

আখের কারবার লাটে উঠতেই জমিদার ফেরে কারখানায়। সামনের শুক্রবার যেটুকু
আছে চেটে খেয়ে মিছিল বের হবে গুদাম লুণ্ঠনে;

সঙ্গে আছো তো তোমরা, পিঁপড়ে ভায়েরা ?

সংশয়

স্বপ্ন দেখে কেঁদে ফেললাম। শিশু। ক্রাচে করে ঈশ্বর কাছে এসে তোমাকে দিলেন
অলৌকিক সোনার কাঠি। বললেন, যথাক্রমে পেটাও প্রেমিক, শয়তান,
নাফসে আম্মারা  এবং ঢোল।

ঈশ্বর। এ-হলো তাঁর স্বরূপের সেই দশা যা তোমার সংশয়-দর্পণে চিকচিক।
তোমার অহম  যাকে তুমি সৃষ্টিশীলতা  বলছো সে মৌচাকে মগ্ন তুমি। সৃষ্টি-এ সম্ভ্রম
সত্যি তবে একান্ত তোমার?

নিজের চাক  থেকে লুণ্ঠিত মধুর কাপে উপুড় হয়ে আছো। মৌমাছি। তোমার এই চুমুক
একটি করুণা যা তুমি মানতে পারো না। তাই তুমি তোমার ঈশ্বরকে  দিয়েছো একটি ক্রাচ।
তাঁর পঙ্গুত্বের প্রবোধ তোমার তুমিত্বকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

তোমার প্রহারদ- প্রেমিক, শয়তান, নাফসে আম্মারার পিঠ ছুঁয়ে ফিরে এলো।
অবশিষ্ট রইলো সংবেদনশীলতার সটান ছাউনি-ঢোল। তোমার অহঙ্কারের টঙ্কার
অন্যের কানে তুলে দিতে এখানে ঘা বসাও। পীড়ন। আঘাতের প্রতিটি তরঙ্গ
তোমাকে খ্যাতির তুঙ্গে তুলে ধরবে।

দৃশ্যপটে চোখ রেখে তোমাকে বোঝার আশায় দাঁড়িয়ে কাটলো সত্তর বছর । অসহায়।
শতাব্দীর পর্দা উল্টালো। তোমার লক্ষ্যচ্যুত ড্রামস্টিক, দেখলাম, ঘা বসাতে
তেড়ে এলো বুকের বাঁ পাশে। আমার। আল্লাগো ! আমি একটি চিৎকার হয়ে গেলাম।

প্রহারে দুলছি। পা কাঁপছে। অগ্নিচুল্লি! অসহায়ত্বের তোপে প্রভুনাম জপতেই
দেখলাম, ক্রাচ উল্টে পড়ে যাচ্ছে পঙ্গু ঈশ্বর । দেখলাম তোমার সংশয়ের ঘাম
হাসি হয়ে রোদে ছড়িয়ে পড়ছে। চিকচিক।

লবণ-চিনির দ্বন্দ্ব

জ্যোৎস্না রাতে কাঁদতে গেলে শরম লাগে, চোখের জলে চাঁদ ডুবে গেলে গ্রহণদশা
দুঃখ কম না, বিলাপ করে হালকা হতে দিনে তবু সময় জোটে না
বাস্তু-বিরোধ। মাথার উপর ছাদ উড়ে যায়। হলপ করে বলি, আমার অশ্রুতে
নুনটুন নেই; বহুমূত্রের কৃপায় ঝরে চিনি শরবত। কান্না এলেই মিষ্টি মিষ্টি ভাব!

লবণ চিনির দ্বন্দ্বে আমার জীবনের সব সুখ হাওয়া কর্পুর। কাকে বলি!
চা খেতে খেতে দর্শনের পিরিচ পেয়ালা ভেঙে ফেলেছি বহুবার। নির্বাণে নেমে
লাপাত্তা হবার জো। স্বরূপাকে বোঝাতে চাইলে বিদ্রূপ করে বলে, মেঘের ডানায়
অট্টালিকা গড়ো । না কাঁদতে কাঁদতে ভেতরটা পাতাল হয়ে গেছে। বুকের তলা ডিপফ্রিজ।

তর্ক থামছে না। কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি। ছুঁড়তে ছুঁড়তে জল শুকায়, ঘোলা হবার ফুরসুত
জোটে না; নতুন চর জেগে ওঠে! কাঁটা ঘাস! বিতর্কের সরীসৃপ-ঠাঁসা মনোজমি।

হায়! দমকল বাহিনী হয়তো অচমকা আসবে একদিন। পাতাল সেচে সেরে উঠবো।

কর্পোরেট

ঘুম থেকে জেগে চোখ কঁচলিয়ে বলো তো কী দেখলাম?
দেখলাম সিভিল রাইট-সেপটিপিনে লটকানো বাটারফ্লাই।

দেখলাম কুঁচকানো টিনপ্লেট ফুটপাতে পড়ে আছে, কপাল!
বুলেট বেঁধা অপেক্ষা, রক্ত, আর্তি-মুঠোভাত, কালসিটে ক’টি কয়েন

দুপুর দেবে হামাগুড়ি। গ্যালভানাইজড রোদে অভাবের বেলুনে রুটি
বেলছে যেন কারা; রেডি হচ্ছে সূর্যের তাওয়া, ওয়ান টু থ্রি

আলপিন। আলজিভে নীল হলো। গলা ফাটা বাক স্বাধীনতা!

ফারহান ইশরাক

ফারহান ইশরাক

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার