গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর ‘রিপাবলিক’গ্রন্থে শিক্ষানীতি আলোচনার এক পর্যায়ে সক্রেটিসের শিষ্য গ্লকন বলেছিলেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানকে শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা দরকার, কারণ তা নাবিক, কৃষক ও সমর-নায়কদের কাজে সহায়তা করবে। কিন্তু সক্রেটিস জ্যোতির্বিজ্ঞান শিক্ষার পেছনে ওই কারণকে নাকচ করে দেন। কোনো জাগতিক প্রয়োজন নয়, বরং মানুষের সত্যানুসন্ধান ও আত্মিক সমৃদ্ধির মৌল তাগিদই হবে নক্ষত্রময় আকাশ অধ্যয়নের কারণ, এই ছিল তাঁর মত। গণিত ও জ্যামিতির মতো বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা সম্পর্কেও তিনি একই দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছিলেন।
কালের পরিক্রমায় প্রায় আড়াই হাজার বছর গত হয়েছে, একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় আজ আমরা উপনীত, প্লেটোর তীব্র ভাববাদী চিন্তার একদেশদর্শিতা থেকেও আমরা মুক্ত। কিন্তু প্লেটোর মেরু থেকে পালাতে গিয়ে বিপরীত মেরুর এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমরা যেন আটকা পড়েছি। মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ আর বিজ্ঞানের কাজের মধ্যে পড়ে না; মানুষের জাগতিক প্রয়োজনের খাঁই মেটানোই এখন তার একমাত্র কাজ। বিজ্ঞান এখন আরব্যোপন্যাসের সেই দৈত্য; আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপটি যাদের হাতে তাদের খেয়াল খুশির আজ্ঞাবহ দাস হওয়াই সেই দৈত্যের ললাটলিখন।
আসলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা বিস্মৃত হয়েছি। আরব্যোপন্যাসের আলাদিন ঐ আশ্চর্য প্রদীপটি পেয়েছিল দৈবক্রমে; কিন্তু মানুষ বিজ্ঞানের প্রদীপটিকে যাদুবিদ্যার বলে পায়নি, পেয়েছে মেধা, শ্রম ও নিষ্ঠার দ্বারা একটি পদ্ধতিকে আবিষ্কারের মাধ্যমে। এটি মানুষের একটি অর্জন এবং প্রকৃত অর্থে সামাজিক অর্জন। এই অর্জিত বিদ্যার বাহ্যিক প্রয়োগ ও প্রকাশ যত বিচিত্র এবং আশ্চর্যজনকই হোক না কেন, তার চাইতে হাজারো গুণে আশ্চর্য ও অনুপম হচ্ছে ওই পদ্ধতি এবং ওই সামাজিক মন যা সেই পদ্ধতিকে লালন করেছে। সামান্য অসাবধানতার জন্য এমনকি আলাদিনও তার প্রদীপটি একবার হারিয়েছিল, কাজেই আমাদের সামাজিক মন যদি একবার ওই পদ্ধতি থেকে সরে যায় তাহলে এই নতুন প্রদীপ সেই সঙ্গে দৈত্যটিকেও যে আমরা হারাব সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো কারণ আছে কি?
কিন্তু তবু আমরা সচেতন নই; দৈত্যটির কর্মকাণ্ডে আমরা এত নিমগ্ন, এত আত্মবিস্মৃত যে তার মূল চালিকাশক্তি সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ রয়েই যাচ্ছি। আর এই অজ্ঞতার ভাষাগত প্রকাশ হিসেবে, বিজ্ঞান সম্পর্কে এই প্রচলিত ধারণার আবশ্যিক ফলশ্রুতিতে উৎপত্তি হয়েছে ‘জনপ্রিয় বিজ্ঞান’ নামক শব্দটির। একই কারণে ওই শব্দটি দ্রুত জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে। আমাদের বিজ্ঞান সম্পর্কিত চিন্তা-চেতনার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ।
‘জনপ্রিয় বিজ্ঞান’এই শিরোনামের আওতায় আমরা সাধারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞানকে পৌঁছে দিতে চাই। কিন্তু কতটুকু দিতে চাই? আমার কেন জানি মনে হয়, রাষ্ট্রনায়করা যেভাবে সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে বিজ্ঞানের আশির্বাদকে পৌঁছে দিয়ে দেশকে উন্নত করার শ্লোগান দেন, অথচ দেশ পরিচালনার মূলনীতি নির্ধারণে অংশ গ্রহণের ক্ষেত্রে জনসাধারণকে যথাসম্ভব বঞ্চিত রাখেন, সে ভাবেই আমরা বিজ্ঞানের একটি মাত্র অংশকে তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে তার মূল অংশকে জনগণের থেকে আড়ালে রাখতে চাই। আমরা তাদের শিক্ষা দেই পানি ফুটিয়ে খেতে, জানিয়ে দিই পাখা কিভাবে ঘোরে; খবর দিই যে সমুদ্রের নিচে অনেক খাবার আছে— এমনিভাবে হাজারো তথ্য আমরা জানাই। কিন্তু আমরা কি কখনো এটা জানানোর সমন্বিত ও কার্যকরী প্রয়াস নিয়েছি যে তাদের রয়েছে একটি সজীব মন, যার উপর অবিশ্বাস আর কুসংস্কারের ময়লা এত বেশি জমে আছে যে ফুটন্ত পানিতেও তা ধোয়া যাবে না, সেই মনে এত দুর্গন্ধ বাসা বেঁধেছে যে শক্তিশালী পাখার বাতাসও তা উড়িয়ে দিতে পারবে না, সে মন এত অনাহারী যে সাত-সমুদ্রের খাবারও তাকে পুষ্টি জোগাতে পারবে না। আমরা তথাকথিত জনগণের মনকে আলোকিত করতে কোনো বাল্ব কি জ্বেলেছি? না-কি আসলে আমাদেরই মনে রয়েছে এখনও অন্ধকার, আমরা নিজেরাও আসলে ‘জনগণ’, আমাদেরই হৃৎপিণ্ডের সর্বাধুনিক কৃত্রিম প্রেস-মেকারের পাশে ঝুলছে কোনো মন্ত্রপুত তাবিজ।
ইউরোপীয় রেনেসাঁর অন্যতম আদি পুরুষ পেট্রার্ক বলেছিলেন, ‘It is not Nature but human nature you should be studying, if you care how to live’রেনেসাঁ এবং তৎপরবর্তী বিজ্ঞানীরা তাঁর কথাটিকে পুরো মেনে নেননি, প্রকৃতিতেও তাঁরা অনুসন্ধান চালিয়েছেন, কিন্তু প্রায় সবাই একই সঙ্গে মানব প্রকৃতি সম্পর্কেও ভাবনা-চিন্তার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সর্বোপরি প্রকৃতি-বিজ্ঞানে গবেষণালব্ধ ফলাফলের সঙ্গে মানুষের জীবন ও সমাজের সম্পর্ক তাঁরা বিশ্লেষণ করেছেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস, দেকার্তে, হবস্, নিউটন এঁরা সবাই একদিকে বিজ্ঞানী, অন্যদিকে দার্শনিক। অন্যপক্ষে এ সময়ের যে সব প্রতিভা সরাসরি বিজ্ঞানী নন তাঁরাও বিজ্ঞান সম্পর্কে উদাসিন থাকেননি, ভলতেয়ারের মতো লোক নিউটনকে অনুবাদের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন। জ্ঞানের এই সমন্বিত ধারা ঊনবিংশ শতকের প্রায় শেষ দিক পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান হয়ে উঠেছে মূলত কারিগরি জ্ঞান। বিজ্ঞানের প্রাণপ্রবাহ থেকে, বিজ্ঞানের মূলস্রোত থেকে শিল্প-সাহিত্য-দর্শন ইত্যাদি অন্যান্য মানবীয় সৃষ্টি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, মানবজীবনের প্রায় প্রতিটি কর্মেই যে বিজ্ঞানীরা নিজেরাও মানবীয় চর্চার অন্যান্য অঞ্চল থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে সংকীর্ণ এক নিজস্ব কোণে তত্ত্বের গদিময় আসনে জটিল সব কারিগরি শব্দের অ্যাপ্রন গায়ে দিয়ে বসে আছেন।
বৃহত্তর মানবসমাজ থেকে প্রকৃত বিজ্ঞানীদের এই অনুপস্থিতির সুযোগে বিজ্ঞানের মুখোশধারী সুবিধাবাদীর দল আসর গেড়ে বসেছে। সমাজের সঙ্গে সঙ্গতিহীন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী দিয়ে কেউ ব্যবসা ফেঁদেছে, কেউ-বা বিজ্ঞানীকে তার বস্তাপচা আদর্শের মোড়ক হিসেবে ব্যবহার করছে। আর সবচেয়ে মারাত্মক যে ব্যাপারটি ঘটছে তা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নীতি-নির্ধারণী কক্ষ থেকে বিজ্ঞানের নির্বাসন। যেহেতু বিজ্ঞানকে ঠেলে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র টেকনোলজির পর্যায়ে সেহেতু বলা হচ্ছে যে, বিজ্ঞান নিজে কোনো জীবনপদ্ধতি দেয় না, বিজ্ঞান শুধু ব্যক্তি বা সামষ্টিক মানুষের ইচ্ছা বাস্তবায়নের হাতিয়ার। বিজ্ঞানকে আজ আমরা বিভিন্ন জন্তুর নখর হিসেবে দেখতে পাচ্ছি— ভাল জন্তুর হাতে তা ভাল উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, খারাপ জন্তুর হাতে তা খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার একই জন্তুর হাতে ভাল-মন্দ দুই উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে।
কিন্তু বিজ্ঞানের আদর্শ তো ভাল-মন্দ উভয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় নয়— বিজ্ঞান তো ধূর্ত গ্রাম্য মোড়ল নয়। বস্তু এবং জীবনের প্রকৃত স্বরূপ ও সত্য উদ্ঘাটনে নিরলস প্রয়াসী বিজ্ঞানতো কোনো অশুভকে প্রশ্রয় দিতে পারে না। বিজ্ঞান তো শুধু নখর নয়, বরং নখরকে শুভ পথে, সত্যের পথে পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বময় নিয়ন্ত্রকও বটে। তাহলে আজকের বিজ্ঞানীরা কি অনেকাংশে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক চেতনার পরিপন্থী কাজ করছে? তারা কি জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে বিজ্ঞানবিরোধী সমাজনায়কদের কুমতলব সাধনের হাতিয়ার হয়ে আছে? যদি তাই হয়, তাহলে অবস্থা আপাতভাবে যা দৃশ্যমান তার চাইতেও আরো অনেক খারাপ। কারণ এর সমাধান এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিরোধ শুধু বিজ্ঞানীদের হাতে আর নেই। সমস্যাটি হয়ে উঠেছে সামাজিক-রাজনৈতিক, বোঝাটি হয়ে উঠেছে প্রচণ্ড ভারী, তাকে ঠেলে ফেলা একা বিজ্ঞানী সমাজের পক্ষে অসম্ভব। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সমন্বিত অংশগ্রহণ এর জন্য অত্যাবশ্যক। আর এ কাজে সফলতা আনতে হলে, জনপ্রিয় বিজ্ঞানের নামে জনসাধারণকে অ-এ অজগর শেখালে চলবে না; রাষ্ট্রনায়কদের মতো বৈজ্ঞানিক খেলনা দিয়ে শিশু জনসাধারণের মন ভুলালে চলবে না; বিভ্রান্তির ধূম্রজালে বিজ্ঞানের একটি উপজাতকে বিজ্ঞান বলে ভাবতে শেখালে চলবে না। এ কাজে সফলতার জন্য দরকার বিজ্ঞানের মর্মবাণীকে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দেয়া, বিজ্ঞানের চেতনাকে প্রতিটি মানুষের জীবনবোধের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তোলা— এর জন্য দরকার বিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা।
একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবিক ধর্ম হিসেবে বিজ্ঞানেরও উদ্দেশ্য সত্যানুসন্ধান। জীবন ও জগতের রহস্য উন্মোচনে, Appearance থেকে reality-তে যাওয়ার অবিশ্রাম পথ পরিক্রমায় সে নিরলস যাত্রী। এ উদ্দেশ্য সাধনে জ্ঞানের অন্যান্য শাখার তুলনায় সুশৃঙ্খল, সুস্পষ্ট ও ফলপ্রসূ পদ্ধতির সন্ধান সে দিয়েছে। নিছক কল্পনা, যা অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রাপ্ত তথ্যের বিরোধিতাকে নাকচ করে দিয়ে, দৈব কিংবা মানবীয় কোনো আপ্তবাক্যের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে, পর্যবেক্ষণ ও যুক্তি-বুদ্ধির ভিত্তিতে, তথ্যের সুসংবদ্ধ শ্রেণিবিন্যাস, আন্তঃসম্পর্ক বিশ্লেষণ এবং তাদের গুরুত্ব ও প্রভাব প্রতিক্রিয়া অনুধাবনের মাধ্যমে বিজ্ঞান এমন এক বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতির জন্ম দিয়েছে যা প্রকৃতি এবং মানবজীবন উভয় ক্ষেত্রেই নানা রহস্যের উদ্ঘাটন ও সমস্যার সমাধানে অসীম অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছে। তথ্য ও পর্যবেক্ষণের প্রতি এই তন্নিষ্ঠ শ্রদ্ধা এবং অন্ধবিশ্বাস ও প্রবৃত্তিনির্ভর বিচার-বিবেচনার স্থানে যুক্তি-বুদ্ধির সুসংবদ্ধ প্রয়োগকে ছড়িয়ে দেয়া অর্থাৎ বিজ্ঞানের পদ্ধতিকে প্রতিটি মানুষের জীবনযাপনের ও চিন্তাচেতনার গাইড করে তোলাই হচ্ছে বিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা। এই শব্দবন্ধ আবশ্যিকভাবেই ‘জনপ্রিয় বিজ্ঞান’কথাটিকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের প্রয়োগ কৌশলগুলোকে কাজে লাগায়, কিন্তু তার আগে সে নিজের চেতনার গভীরে অনুভব করে বিজ্ঞানের মূল প্রাণপ্রবাহকে।
বিগত কয়েক শতাব্দিতে বিজ্ঞানের অভাবনীয় বিকাশ ‘মানবসংস্কৃতি’নামক মুদ্রাটির দু’টি পরিপূরক কিন্তু ভিন্ন পীঠকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। আগের শতাব্দীগুলোতে শিল্প-সাহিত্য ও দর্শনের প্রায় একপেশে বিকাশের কারণে ‘literary mind’-ই সমাজে অধিক প্রভাব ফেলেছে— বিশ্ববিক্ষায় এই মনই অধিক প্রাধান্য পেয়েছে। আর তাই, ওই সময়ের অধিকাংশ উন্নত সংস্কৃতিই মুখ্যত literary ছিল। পরে বিজ্ঞানের বিকাশ জন্ম দিতে শুরু করে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির। এ দুই সংস্কৃতির প্রত্যেকটিরই রয়েছে নিজস্ব mode of intellect; প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয়বস্তু, প্রকাশভঙ্গি, যুক্তি, পদ্ধতি, মূল্যবোধ, আগ্রহ, অনাগ্রহ এবং সমস্যা। তবে শুধু যে পার্থক্য আছে তাই নয়, একই মানব-বৃক্ষের দু’টি শাখা হিসেবে তাদের শিকড় প্রোথিত রয়েছে একই ভূমিতে— কল্পনার ব্যাপ্তি, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, সত্যনিষ্ঠা আকর্ষণীয় প্রকাশক্ষমতা— এ দুই সংস্কৃতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
বর্তমানকালে আমরা এই দুই সংস্কৃতির পার্থক্যগুলোকেই বেশি করে দেখছি, তাদের মৌলিক অখণ্ডতাকে ভুলে যেতে বসেছি। অর্থাৎ মানবসংস্কৃতির এই দুই ধারা, এক লক্ষ্যাভিমুখী না হয়ে এমনকি সমান্তরাল পথেও না গিয়ে, ভিন্ন খাতে এগিয়ে চলেছে। দুইটি ধারাই এগোচ্ছে দ্রুত আর তাই তাদের ব্যবধানও বাড়ছে ক্রমাগত। আর সেজন্যেই আধুনিক কবিতা কিংবা চিত্রকলা বোঝেন এমন বিজ্ঞানীর সংখ্যা হাতে গোণা যাবে; অন্যদিকে কারিগরি শব্দের কথা বাদ দিয়েও শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির মর্ম অনুধাবনে সক্ষম এমন সাহিত্য-প্রেমিকও বিরল। আধুনিক ইংরেজ কবি W.H. Auden তো বলেই ফেলেছেন, ‘When I find myself in the company of scientists. I feel like a shabby curate who has strayed by mistake into a drawing room full of dukes.
The true men of action in our time, those who transform the world are not politicians and statesmen, but the scientists.
Unfortunately poetry can not celebrate them, because their deeds are concerned with things, not persons and are therefore speechless.’
মানুষের ব্যক্তিত্বের ভারসাম্যের জন্য এই দুই সংস্কৃতির সম্মিলন প্রয়োজন; এর অভাবে ব্যক্তিত্বের বিকাশ একপেশে হতে বাধ্য। জন্মগতভাবে প্রাপ্ত শক্তিশালী প্রবৃত্তিসমূহ এবং সেই সঙ্গে সভ্যতার শৈশব থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিকশিত ‘literary mind’-এর প্রভাবে আমরা এখন পর্যন্ত বলতে গেলে উত্তরাধিকারসূত্রে literary সংস্কৃতির মধ্যে জন্মাই। বাংলাদেশে এ অবস্থা আরও প্রকট, কারণ সামাজিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন কারণে বিজ্ঞানের চর্চা এদেশে বিলম্বিত। তাই আজ পর্যন্ত আমরা মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব পদাবলীর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছেড়ে পুরোপুরি বের হতে পারিনি। এদেশের শিল্পী, রাষ্ট্রনায়ক, সমাজচিন্তাবিদ, আইনজ্ঞ এমনকি অধিকাংশ বিজ্ঞানী পর্যন্ত যুক্তির আবহে বর্ধিষ্ণু মানুষ নন, মুখ্যত ভাবাবেগে আপ্লুত মানুষ। তাই এদেশের সংস্কৃতিতে যদি ভারসাম্য আনতে হয় তাহলে বিজ্ঞানকেও সংস্কৃতির অংশ করে তুলতে হবে। এতদিন এ দায়িত্ব শুধু আমরা দিয়ে আসছি শিল্প-সাহিত্যের ভুবনের লোকদের। কবিতা দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে, চিত্রকলা বিমূর্ত হয়ে যাচ্ছে— এই অভিযোগ আমরা হরহামেশা করে যাচ্ছি। কিন্তু তাঁরা যদি অভিযোগ তোলেন যে, বিজ্ঞানকেও আমরা ক্রমশ টেকনিক্যাল ও বিমূর্ত করে তাদের কাছ থেকে যোজন যোজন দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তাহলে কি জবাব দেব? সুতরাং দায়িত্ব আমাদেরও রয়েছে এবং সমান পরিমাণে।
শুধুমাত্র মঞ্চে বা টেলিভিশনে নাটক-সংগীতানুষ্ঠান উপভোগ নয়, কিংবা ১লা বৈশাখ বা একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে কিছুক্ষণ অবকাশ যাপন নয়, বিজ্ঞান সাধকদেরকে এদেশের জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সঙ্গে একাত্ম হতে হবে এবং তার মাধ্যমে এদেশের সংস্কৃতির মধ্যে বৈজ্ঞানিক চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটাতে হবে, বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে।
অডেন যেমনটি বলেছেন, সমাজের নেতৃত্ব আর রাজনীতিবিদদের হাতে থাকছে না, বিজ্ঞানীদের হাতে চলে আসছে। কথাটি অত্যন্ত সত্য। একসময় দৈবশক্তিতে বলিয়ান হয়ে পুরোহিতরা সমাজে নেতৃত্ব দিতেন। ইউরোপে রেনেসাঁর পরে তা চলে আসে বিধানদাতাদের হাতে। সমাজ হয়ে ওঠে একটি চুক্তি এবং এই চুক্তি বাস্তবায়নে কতকগুলো মূলনীতি তথা আইন সৃষ্টি করা হয়। Holy scripture-এর বদলে সৃষ্টি হয় human scripture-এর। মানবসমাজ এখন মূলত এই মানবীয় আইন দ্বারা শাসিত। রাজনীতি এখনও বিধানদাতাদেরই চারণভূমি।
সমাজের এই নেতৃত্ব থেকে বিধানদাতাদের বিচ্যুত করতে যাচ্ছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের সঙ্গে আইনের বিরোধ সুস্পষ্ট। প্রথমত আইন বহুল পরিমাণে প্রথা উদ্ভূত এবং তার অস্তিত্ব ও কার্যকারিতা প্রথার ওপর নির্ভরশীলও বটে। অনেক সময় খারাপ জেনেও প্রথাকে উৎপাটিত করতে আইন সময় নেয়। দ্বিতীয়ত, আইনের আওতায় কোনো প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে মানুষকে সবসময় পেছনে ফিরে মূলনীতিটির দিকে তাকাতে হয়। সামনের দিকে তাকানোর চেয়ে অর্থাৎ প্রকল্পটি আজ এবং আগামী দিনের মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে কি-না সে বিবেচনার চেয়ে প্রচলিত আইনের সঙ্গে সেটি খাপ খেল কি-না, সে ব্যাপারে অধিক গুরুত্ব দেয়াই হচ্ছে এ ধরনের সমাজ নেতৃত্বের একটি আবশ্যিক শর্ত। এর আওতায় একজন কার্যনির্বাহি আইনের শৃঙ্খল দ্বারা অতিমাত্রায় আবদ্ধ। লক-এর ভাষায় : ‘The executive as power is subordinate to the legislative and his duty is to execute the laws.’
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এসবের বিরোধী পর্যবেক্ষণ এবং যুক্তি-বুদ্ধির ভিত্তিতে প্রাপ্ত নতুন সত্য যদি এতদিনের গৃহীত সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ পরিপন্থীও হয়, তবু তা তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করতে সে দ্বিধা করে না। আর মানুষের নিত্য-নতুন প্রয়োজনের প্রতি নজর রেখে, শুভ ফলাফলের লক্ষ্যে সে নবনব পদক্ষেপ গ্রহণ করে— এ কাজে পেছনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগায় ঠিকই, কিন্তু কোনো আপ্তবাক্যের সন্ধান করে না অর্থাৎ বিজ্ঞান মূলনীতি দ্বারা শৃঙ্খলিত নয়, সে Policy বা প্রকল্পনির্ভর।
সুতরাং বিজ্ঞানের এ-বিকাশের যুগে গতানুগতিক রাজনীতিবিদদের বিদায় নিতেই হবে। তাদের স্থান দখল করতে দরকার সমাজ নেতৃত্বদানে সক্ষম এবং মানুষের সমস্যার প্রকৃতি অনুধাবন ও তার সমাধানে সমর্থ কিছু বিজ্ঞানমনষ্ক ব্যক্তি। ওই ধরনের ব্যক্তি আমাদের দেশের জন্য এখন অপরিহার্য। এদের সৃষ্টি করতে হবে, আর তার জন্য প্রয়োজন দেশের প্রতিভাবান ও মেধাবী সন্তানদের কারিগরিবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনার আলো ছড়িয়ে দেয়া। একই সঙ্গে এই নতুন নেতৃত্ব ও সমাজনীতি যাতে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে সেজন্য সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে।
আমাদের সভ্যতা একটি পূর্ণাঙ্গ জৈবসত্তার মতো। সে ভাগ্যবানেরা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে পেরেছেন, তাঁরা শুধু উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ, পদার্থবিদ, রসায়নবিজ্ঞানী ইত্যাদিই নন, তাঁরা মানুষ এবং তাঁদের কালের সন্তান, একটি অখণ্ড সাংস্কৃতিক পরিবেশের সদস্য। এ সত্য মেনে নিলে বিজ্ঞানীরা তাঁদের দায়িত্বকে এড়িয়ে যেতে পারেন না, সে দায়িত্বের প্রকৃতি যাই হোক না কেন।
আমাদের দেশে যেখানে বিজ্ঞানের বৃক্ষশাখায় কেবলমাত্র মুকুল দৃশ্যমান, সেদেশে আমদানিকৃত কিছু নমুনা প্রদর্শন করে জনগণকে ঐ বৃক্ষের টসটসে ফলের লোভ দেখাতে কেবল আমরা ব্যস্ত। অথচ আমাদের আশু সামাজিক দায়িত্ব হচ্ছে বিজ্ঞানের মর্মবাণীকে জনপ্রিয় করে তোলা, এদেশের বাস্তবতা তাই দাবি করে।
বর্ষ ২, সংখ্যা ৩, ফেব্রুয়ারি ২০০৩