ছোটবেলায় মেঘ দেখলে ভয় করতো খুব। মনে হতো কালো কালো মেঘের মধ্যে থেকে কোনো দত্যি , দানো বেরিয়ে আসবে, আর আমাকে নিয়ে চলে যাবে, ওই মেঘেদের মধ্যে। আর ফিরতে পারবো না আমার চেনা বাড়িটার ছাদে, চেনা রাস্তার মোড়ে। আর কোনোদিন ফেরা হবে না সেই ফেলে আসা দীঘির ধারে, দেখতে পাবো না মাছরাঙার টুপটাপ ডুব। হয়ত আর খেলতে পারবো না আমার বন্ধুদের সঙ্গে। সারা গায়ে কাদা মেখে, উপুর চুপুর ভিজে সন্ধ্যে বেলা বাড়ি ফেরা হয়ত আর কোনোদিন হবে না। সত্যি বলছি খুব ভয় পেতাম। মেঘের সাথে কড়কড় করে বাজ পরতো যখন, দৌড়ে ঘরে ঢূকে যেতাম।
আজ, যখন বয়স রুপোলি রেখার সাথে ভাব করে নিয়েছে , বুঝতে পারি আমার অত ভীতু ভীতু ভাবটা না হলেও পারতো। তাহলে দিব্যি মেঘ গুলোকে চিনতে পারতাম। ওদের সাথে আরো কথা বলতে পারতাম। মেঘেরাও তো বন্ধু হয়ে যায়। এই যে প্রতিদিন অফিস যাই, অফিস থেকে বাড়ি ফিরি, সত্যি কথা বলতে কি, এই একঘেয়েমি প্রতিদিন ভালো লাগেনা। এক একটা দিন কেমন মেঘময় হয়। মনের মধ্যে একটা আলসেমি দানা বাঁধতে থাকে। মনে হয় বালিশটা আকরে জানলা দিয়ে আকাশ দেখি। দেখতেই থাকি। কী করে একের পর এক মেঘ এসে জুড়ে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে একটার সাথে একটা। গোটা আকাশ জুড়ে তুমুল মেঘ পার্বণ শুরু হয়ে গেছে। সেদিন কিন্তু সত্যি আমার অফিস যেতে ভালো লাগেনা। হয়ত অফিস এসেছি, কিন্তু মন পরে আছে আমার বিছানার পাশের জানলাটার কাছে। মনে হচ্ছে ফিরে যাই। একটা বই নিয়ে শুয়ে থাকি, আর মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে চুরি করে বাইরেটা দেখতে থাকি। পাখিগুলোও সেদিন জোরে ডাকে না। ওদেরও যেন আলসেমিতে পেয়েছে। মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়ায় সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে লাল লাল ফুল গুলো ঝরে পরছে। কিন্তু আমার অফিস থেকে বাড়ি ফেরা হয় না। এমনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে কত কত মুহূর্ত আঙুলের ফাক দিয়ে গলে গলে যায়। এইসব কিছুই হয়না। আমরা অন্য কিছু নিয়ে ব্যাস্ত থাকছি আর এই খুশীগুলো অভিমান করে আরো দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা বড় হয়ে যাচ্ছি, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।
স্লেট স্লেট মেঘ দেখলেই আমার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কোনো এক ফাকা লোকাল ট্রেনের জানলার ধারে বসবো। বাইরে বৃষ্টির ছাঁট আমার চোখ, মুখ ভিজিয়ে দেবে। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া নাকে, মুখে এসে লাগবে। পকেটের রুমালটা জানলার সামনে ধরে থাকবো। ওটা ভিজতে থাকবে। তারপর কোনো এক নাম না জানা স্টেশনে নেমে যাবো স্টেশনের বাইরের কোনো এক বুড়ি মাসির চায়ের দোকানে বসবো। গরম লিকার চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। আহ। এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে যায় মনটা। কিন্তু এগুলো কিছু হয় না, হবে না। অনেক অপ্রয়োজনীয় কাজ আর অপ্রয়োজনীয় মানুষের ভিড়ে আমার এই দিনগুলো হারিয়ে যায় কেবল।
সবুজ মাঠের ধারে আমার একটা বাড়ি থাকবে, যার একটা গোটা দেওয়াল কাঁচ দিয়ে মোড়া। বৃষ্টির ফোঁটারা কাচের গায়ে গাল ঘষে যাবে। কাঁচের জানলার ওপার থেকে বৃষ্টি আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে। কিছু প্রিয় বই আর গান নিয়ে আমি ভিজতেই থাকবো। চারিদিক সাদা হয়ে যাওয়া বৃষ্টিতে যখন চারিদিক ভেসে যায়, তখন এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে যায় মনটা। আশপাশ ঝাপসা হয়ে যায়। কানে কানে তোমার ডাক শুনি। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। তুমি একটিবার ডাকলেই ছেড়ে চলে যাবো আমার সমস্ত দিনলিপি। চেনা পৃথিবী নিমেষে অচেনা লাগে। মনের ভিতর ঘরের কাঙালপনা জেগে ওঠে অনেক ঘুমের পরে। আমি আঙুল দিয়ে ব্যাথাদাগ স্পর্শ করি। তোমার সামান্য ইশারায় রাতভোর ভিজতে থাকি। ভয়ে ভয়ে চোখের পাতায় স্বপ্ন সাজাই আবার। আমি বিষাদ জ্বর থেকে সেরে উঠি তোমার স্নেহ পরশে। আমার না বলা অভিমানেরা অবিরাম বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে থাকে। সব কোলাহল মুছে গিয়ে ঝরাপাতার স্তুপ পেরিয়ে এক নীলচে বিকেল এসে সামনে দাঁড়ায়। আমি স্বপ্ন ছুঁয়ে বাঁচতে থাকি… রূপকথা ছুঁয়ে বাঁচতে শিখি…
জয়ন্ত পোদ্দার
জন্ম : কলকাতা
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতোকত্তর
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত
ভালোলাগা : নির্জনতা, বন্ধুর সাথে সময় কাটানো, বৃষ্টি ভিজে রাস্তা হাঁটা