কোমলদি ছোটবেলায় আমার খেলার সাথী ছিল। আমার থেকে বছর কয়েকের বড়। কোমলদির দাদা, সুবলদার বিয়ে তাই ওদের বাড়ীতে মাটির দেয়াল দিয়ে ঘর উঠছে। যেখান থেকে মাটি কাটা হচ্ছে সেখানে একটা বিশাল গর্ত হয়েছে। মাটি নীচ থেকে উপরে তোলার জন্য গর্তের পাশে ধাপ কেটে কেটে পথ । সেই পথ দিয়ে নামা ওঠা করাও আমাদের একটা খেলা। কোমলদি বলল,
— চল আমরা গর্তের দেয়াল কেটে একটা পুতুলের ঘর বানাই।
কোদাল আর শাবল নিয়ে লেগে পড়লাম। শাবল দিয়ে খোঁচা দিতেই খট করে একটা শব্দ হল।
— এখানে একটা ইট আছ।
কোমলদি বলল, তুইও যেমন! এত মাটির নিচে ইট আসবে কোত্থেকে?
— দেখো।
কোমলদি একটা শক্ত মত কী যেন তার পাশ দিয়ে শাবল চালিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। চেষ্টাটা এমন যেন বুঝিয়ে ছাড়বে ওটা কোন ইট নয়। আস্তে আস্তে গোলা ঘরে ধান রাখার মত বিরাট একটা কোলার চেহারা দেখা গেল। এক পাশে মুখে একটা ঢাকনা আঁটকানো। খোলার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। গর্ত থেকে উপরে উঠে কোমলদির মা— জ্যেঠিমাকে খবর দিলাম। জ্যেঠিমা বললেন, গর্তে নেমে খেলতে হবে না। ভাত দিচ্ছি খেয়ে নে।
সুবলদা বলল, চল তো দেখি, কী? সুবলদা গর্তে নামল। আস্তে আস্তে খবরের গন্ধ ছুটল। আমার মেজকা’ মানে অসীম কাকা আসল। দু’জন মিলে ঢাকনাটা ভাঙার চেষ্টা করে না-পেরে কুড়াল এনে কোলার একটা অংশ ভেঙে ফেলল। ভিতরে চকচকে সাদা কি যেন দেখা গেল। কাকারা কেউ চিনতে পারছে না। জ্যেঠিমা এসে বলল,
— ম্যা গো ম্যা! এ তো কড়ির কোলা। শিগ্গির পালা। ওর ভিতর পঞ্চমুখী সাপ আছে। ঘর বানাতি গিয়ে কি সব্বনাশি কান্ডটাই হল।
অথচ কান্ডর তখনও কিছুই হয়নি। সবে শুরু মাত্র। সবাই গর্ত থেকে উঠে আসলাম। আমার ঠাকুরদা তখন বাঁশের লাঠি বানচ্ছিলেন। খবর রটেছে দেশে যুদ্ধ লাগলে পাকিস্তানি বাহিনীরা উড়োজাহাজ থেকে প্যারাসুটে করে নামবে। আর ওরা মাটিতে পড়ার সাথে সাথে ঠাকুরদা ওদের পিটিয়ে মেরে ফেলবে। একটাকেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেবে না। আমাকেও একটা ছোট লাঠি দিয়েছে। যেদিন প্যারাসুট নামবে সেদিন আমিও যাব আর্মি মারতে।
ঠাকুরদা একটা বাঁশের লাঠি নিয়ে এসে গর্তে নামল। কিন্তু লাঠিটা কোলার মধ্যে ঢোকানোর সাহস পেল না। পাশের বাড়ীর দাদু এসে বলল, বুঝেচ নগেন, এগুলো হল যক্ষের ধন। আগের দিনে গড়াই নদী তো এ দিক দিয়েই ছিল। সেই নদী দিয়ে যক্ষের কড়ির কোলা যেত রাতের বেলা। একবার উমেদ কাজী নামে এক লোক রাতে মাছ ধরতে যেয়ে দেখে কড়ির কোলা ভেসে যাচ্ছে। এক দুই তিন করে ছয়টা কোলা পার হওয়ার পর সাত নম্বর কোলা ধরে ফেলল। তখন সাদা ধবধবে কাপড় পরা এক লোক নদীর মাঝখান থেকে উঠে বলল, তুই একবার কোলার ভিতর হাত দিয়ে যা তুলে নিতে পারিস তুলে নে। লোভ করবি না, ক্ষতি হবে। উমেদ কাজী যেই দ্বিতীয় বার হাত ঢুকিয়েছে ওমনি তার হাত কেটে নিয়ে কোলা ভেসে গেল।
কাকা জিজ্ঞাসা করল,
— আপনি কি উমেদ কাজীর কাটা হাত দেখেছেন?
— আমি উমেদ কাজীকে কোত্থেকে দেখব। সেকি আজকের কথা। তবে কথাতো আর মিথ্যে নয়, নিজ চোখেই তো দেখতে পারছ। এখন দেখ তোমাদের আবার কোন বিপদ হয়।
— আমাদের আবার নতুন করে কী বিপদ হবে। আজ বাদে কাল পাক আর্মির সাথে যুদ্ধে যেতে হবে। আর আপনারা আছেন কোলার ভিতরে সাপ আছে সেই ভয়ে।
কেউ আর কথা বাড়ায় না। গ্রামময় এমনিতেই একটা থমথমে পরিবেশ। কখন আর্মি নামবে গ্রামে তার ঠিক নেই। তার উপরে গুপ্তধনের খবর। খবর দ্রুত পাঁচ কান হচ্ছে। কেউ কেউ খবর নিয়ে আসছে, কোলা ভর্তি সোনা পাওয়া গেছে কিন্তু পঞ্চমুখী সাপ পাহারা দিচ্ছে তাই তুলতে পারছে না। সবাই গর্তের কাছাকাছি গিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ফিরে যাচ্ছে। একজন সাপের ওঝা এসেছে। বেশ নাম করা ওঝা। সবাই অনুরোধ করল ওঝাকে সাপটা ধরার জন্য। ওঝা বলল, কুলিন কেউটে হলেও তো সমস্যা ছিল না। কিন্তু এ যে পঞ্চমুখী সাপ। ও আমার কম্ম নয়। তা ছাড়া এমন কাজে ওস্তাদের নিষেধ আছে।
রাত বাড়লে যখন লোকজনের আনাগোনা কমে গেল তখন সুবলদা আর মেজকা’ মিলে ধামা-বস্তা ভরে ভরে সব কড়ি নিয়ে ধানের ঘরে গাদা দিল। সুবলদা আর মেজকা’ তখন কেবল কলেজ পাশ করেছে। সাপ তো দূরের কথা বাঘ দেখেও ওরা ভয় পায় না। এর মাঝেই তারা ঠিক করে ফেলেছে যুদ্ধে যাবে। বাড়ী থেকে অনুমতি মিলছে না। তবু তাদের প্রস্তুতির সীমা নেই। আম বাগানের ভিতরে গোপনে নানা রকমের শরীর চর্চা চলছে। সাথে কী কী নেবে তা একটা ব্যাগে গোছানো হচ্ছে।
কড়িগুলো তোলার পর গর্তের উপরে রাতারাতি একটা টিনের ছাউনি দিয়ে কোম তৈরি করা হয়েছে। ছাউনির উপরে ধানের খড় আর বাঁশের কুঞ্চি গাদা দেয়া। ছোট্ট একটা মুখ রাখা হয়েছে ভিতরে ঢোকার। জ্যেঠিমার পরিকল্পনা আর মেজকা আর সুবলদা’র কাজ। আর্মি আসলে সবাই যাতে এখানে লুকাতে পারে। আমাদের নতুন একটা খেলার জায়গা হল।
জ্যেঠিমা শিল্পী মানুষ। গান করেন। রুমাল সেলাই করেন। তার কোনায় লেখা থাকে ‘মনে রেখো’। ঘরের দেয়ালে বাঁধানো কাপড়ে সেলাই করা দুটো পাখি— সাথে লেখা ‘যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভুলে না মোরে’। জ্যেঠিমা নতুন মাটির দেয়ালে কড়ি বসিয়ে বসিয়ে শেখ মুজিব, নৌকা, আর নতুন পতাকা আঁকলেন যার মাঝে পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ। পরদিন ভোর রাতে মেজকা’ আর সুবলদা কাউকে কিছু না বলে উধাও। সাথে কাকার বন্ধু আরও দুজন— হালিম কাকা আর আনোয়ার কাকা। সবাই জানে ওরা কোথায় গেছে কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। যেন বিষয়টা খুবই গোপন। তবে গোপন কথাটা গোপন থাকে না। এ গ্রাম সে গ্রাম থেকে লোক আসছে কড়ি দেখতে। কড়ি দিয়ে তৈরী জ্যেঠিমার শিল্পকর্ম দেখছে আর বাড়ী থেকে দুটো ছেলের মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিঙে যাওয়ার গোপন খবর ডালপালা গজাচ্ছে চারিদিকে।
দুপুরের দিকে খবর আসে আমাদের বাড়ী লুট হবে। বাড়ীর সবাই দিশেহারা। প্রতিবেশি আপনজনদের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে। কেউ অভয় দিচ্ছে, কেউ ওপারে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে, কেউ মূল্যবান জিনিসপত্র নিজ হেফাজতে নিচ্ছে— পরে ফেরত দেবে বলে। বেশির ভাগেরই মত, হিন্দু লোকজন গ্রামে থাকলে মিলিটারি ঢুকবে গ্রামে। তখন সবাই মিলে মরতে হবে। তারচেয়ে তোমরা ইন্ডিয়া চলে যাও। অবস্থা ভাল হলে আবার ফিরে এসো।
বিকেল গড়াতেই শত শত মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করল আমাদের বাড়ী। যে যা হাতের কাছে পাচ্ছে তাই বস্তা ভরে নিচ্ছে। বাড়ীর সবাই কান্নাকাটি করছে। এমন সময় কোমলদি ছুটে এসে আমার হাত ধরে টান দিয়ে বলল, তুই এখানে কি করছিস? আয় আমার সাথে। আমরা সেই গর্তটার মধ্যে লুকিয়ে দুজনেই গলাগলি ধরে কাঁদছি। বাইরে বিভৎস স্বপ্নের মত সব লুট হয়ে যাচ্ছে। ঘর ভেঙে জানালা, দরজা, চালের টিন নিয়ে ভাগাভাগি করছে।
রাত বাড়লে লুটপাট শেষ করে সবাই যখন চলে গেছে তখন বাবা আর জ্যেঠিমা আমাদের দুজনকে খুঁজে বের করল। রাতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে। সাথে নেয়ার মত কিছুই অবশিষ্ট নেই। পাড়ার ভিতর থেকে কেউ একজন কিছু চাল আর চিড়া দিয়ে গেল রাস্তায় খাওয়ার জন্য। আমার আর কোমলদির হাতে দু’পোঁটলা কড়ি।
কোমলদির মা আমাদের সাথে গেলেন না। বললেন, সুবল ফিরে এসে আমাকে খুঁজবে। আমি কিভাবে যাব? যেতে হলে আমি সুবলের সাথেই যাব। তোমরা বরং কোমলকে নিয়ে যাও। ওকে একটু দেখে রেখ।
নদী পার হয়ে আমরা যখন বড় রাস্তায় উঠলাম তখন আমাদের সাথে আরো কিছু লোক যোগ হল, পাশের কোন গ্রাম থেকে। আমরা যতই সামনে আগাতে থাকলাম ততই আমাদের সাথে লোক বাড়তে থাকল। অনেক মানুষ আমরা এক সাথে হাঁটছি । নানা বয়সের মানুষ। কেউ পথ চেনে না। গ্রামের মানুষ কেউ পথ দেখাচ্ছে — কেউ ভয় দেখাচ্ছে। কোথাও মাঠের ভিতর দিয়ে, কোথাও বনের ভিতর দিয়ে, কোথাও নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চলেছি। দুপুরের দিকে যা খেয়েছিলাম তা হজম হয়ে গেছে। পেটে খাবার নেই । পা চলতে চাচ্ছে না। তবু থামার সুযোগ নেই বর্ডার পার না হওয়া পর্যন্ত কোথাও নিরাপদ না। যে কোন সময় বিপদ আসতে পারে।
তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার কাছাকাছি হবে। কোমলদি বলল, তার পোটলা থেকে কড়ি পড়ে যাচ্ছে। পিছনে তাকিয়ে দেখে রাস্তায় একটা একটা কড়ি পরে আছে। কোমলদি কড়ি খুঁটতে খুঁটতে পেছন দিকে হাঁটা শুরু করল। বাবা বকা দিলেন, ক’টা বরই হাতে করে আসলেও তো রাস্তায় খেতে পারতিস, কড়ি দিয়ে কি হবে। ততক্ষনে কোমলদি অনেকটা পেছন পড়ে গেছে। থামার সুযোগ নেই। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকার আর মানুষের ভিড়ে কোমলদিকে আর দেখা যাচ্ছে না। আমি ডাকলাম, কো-ম-ল-দি। বাবা ডাকলেন কোম-ল।
কোমলদির কোন সাড়া পাওয়া গেল না। রাতে একটা স্কুলে আশ্রয় নিলাম। সেখানে আমরা সবাই মিলে কোমলদিকে খুঁজলাম। পেলাম না। ভোরের দিকে আমরা সবাই আবার হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তায় আমার কড়িগুলো ফেলতে ফেলতে গেলাম। যাতে কোমলদি রাস্তা চিনে আসতে পারে।
কোমলদি আর কোনদিন ফিরে আসেনি। কোমলদির মাকে রাজাকাররা পাক বাহিনীর ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কোমলদির মা’র আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। মেজকা’ যুদ্ধ শেষে ফিরে এসেছে, ফিরে এসেছে হালিম কাকা আর আনোয়ার কাকা কিন্তু সুবলদা’র কোন খবর পাওয়া যায়নি।
এখন এতো বছর পরেও বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে গেলে শামুক বা ঝিনুকের যে সাদা টুকরো গুলো ভেসে ওঠে, মনে হয় আমাদের হারিয়ে যাওয়া কোন কড়ি ভেসে উঠেছে। যে কোন মেলা বা জন সমাগমে গেলেই মনে হয়, এখনই বুঝি কেউ আমার হাতটা ধরে টান দিয়ে বলবে,
— তুই এখানে কি করছিস? এদিকে আয়।
ঝাপসা চোখে কোমলদির কচি মুখটা ভেসে ওঠে।
স্বপন বিশ্বাস
জন্মঃ ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৪। কৃষি বিষয়ে স্নাতক ও ব্যবসা ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের শুল্ক বিভাগে কৃষি বিশেষজ্ঞ হিসাবে কর্মরত। বসবাস নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। প্রকাশিত গ্রন্থ একটি।