‘নাস্তিক’ বলে যে আদৌ কিছু হয় না, হওয়া সম্ভব নয়; একথা অনেকেই এখনো বুঝতে পারেন না। যে মানুষ কোনওরকম প্রাতিষ্ঠানিক-ভগবানকে বিশ্বাস করে না, সে প্রাকৃতিক শক্তিতে বিশ্বাস করে। কোনও কিছুতেই বিশ্বাস নেই, এমন মানুষ এক মুহূর্ত্তও বেঁচে থাকতে পারে না। এখুনি যদি একটা ভূমিকম্প হয় আর ছাদটা যদি এখুনি ভেঙে পড়ে যায়, যেখানে পা ফেলব সেখানে যদি পা-টা ঢুকে যায়, যদি ওই গাছের তলা দিয়ে যাওয়ার সময় গাছটা মাথায় ভেঙে পড়ে! ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি একটা গরু কিংবা কুকুরও প্রাকৃতিক নিয়মগুলির উপর বিশ্বাস করে তবে বেঁচে থাকতে পারে। অন্যথায় তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।
কিংবা, আপনি ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলেছেন, রাস্তার গাড়ীটা যে লাফ দিয়ে এসে আপনার ঘাড়ে পড়বে না, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত এই নিয়মের উপর একটা বিশ্বাস তো আপনার আছেই। ওই বিশ্বাস না-থাকলে কলকাতার ফুটপাথ দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ হাঁটতেই পারত না, আপনিও পারতেন না। কোনও একটা জীব ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, অথচ তার প্রাকৃতিক বা সামাজিক কোনওরকম বিশ্বাসের ক্ষেত্রই নাই, এটি একটি অবাস্তব কল্পনা। একটা জীব বেঁচে বর্ত্তে আছে, অথচ তার কোনও কিছুর উপর বিশ্বাস নেই এটা একেবারেই অসম্ভব। জগতের সবকিছু যে-যার নিয়মে চলছে, এই বিশ্বাস সকল জীবের মনের গভীরে অন্তঃসলিলা। আর ভালো মানুষেরা ওই বিশ্বাসকেই অনুবাদ করে নেন নিজের নিজের ঈশ্বর-প্রতীকে। এছাড়া আস্তিকতা আর কিছুই নয়। আমি প্রাতিষ্ঠানিক আস্তিকতা বা ধান্দাবাজী আস্তিকতার কথা বলছি না।
যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক-ভগবানকে নিয়ে নানান ব্যবসা চলছে, আপনি কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভগবানে বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মগুলিতে বিশ্বাস করলেন। অর্থাৎ আপনার নাস্তিকতা কেবল তথাকথিত ঈশ্বর-অবিশ্বাসেই সীমাবদ্ধ। ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে আপনার মৃত্যুচিন্তা হবে কেন? মৃত্যু বলতে, আমি বলছি— অফ্ হয়ে যাওয়া। বাতিটা জ্বলছিল, নিভে গেল তো মরে গেল, উবে গেল, এইরকম। তেমন কি মানুষের ক্ষেত্রে কখনও হয়, না হওয়া সম্ভব? না, সেভাবে মানুষ কখনো মরে না। মানুষ তো একটা দ্বৈত সত্তা, কেননা প্রত্যেক মানুষই তো আসলে একটা ‘দৈহিক-মানুষ’ আর একটা ‘মানসিক-মানুষ’। দৈহিকভাবে তো মানুষ এই পৃথিবীতে থেকেই যায়, মানসিকভাবেও থেকে যায়। আর অমৃতপান করলে তো কোনও কথাই নেই। তার মৃত্যু হবার কোনও উপায়ই নেই তখন।
দৈহিকভাবে মানুষ থেকে যায় কেমন করে? ‘পুত্ররূপে জন্মে লোক ভার্য্যার উদরে। তেকারণে জায়া বলি বলয়ে ভার্য্যারে।'(১)। তো, দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীর গর্ভে আপনি যে সন্তান উৎপাদন করলেন, সে আসলে আপনিই। তাই তো সন্তান উৎপাদনকে ‘রি-প্রোডাকশান’ বলে। সেই কারণেই তো রাজা হেনরি-১-এর ছেলের নাম হয় হেনরি-২, তার ছেলে হেনরি-৩ ইত্যাদি।
কিন্তু ‘স্ত্রী’ (যাহাতে গর্ভ সংহত হয়’,) তো মানুষের একটি নয়, হতে পারে না। তাই তার ‘গর্ভ সংহত হয়’ আরও অনেক ‘ক্ষেত্রে’ই। জমিতেও গর্ভ সংহত হয়, সেখানে আপনার লিঙ্গের কাজটা করে ‘লাঙ্গল’। ‘পুত্র'(২)-রূপে সেখানে ‘উপজাত’ হয় শষ্যফল। এমনকি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আপনি পড়াচ্ছেন, সেখানেও ‘গর্ভ সংহত হয়’। সেখানে আপনার লিঙ্গের কাজটা করে আপনার ডিগ্রির লেজ বা ‘লাঙ্গুল’, যেটা থাকে আপনার নামের পিছনে। আর সে ক্ষেত্র থেকে বহু এম.এ.পাশ বি.এ.পাশ উৎপাদিত হয়।
‘পুত্র’ উৎপাদনের জন্য মানুষের এ’রূপ অজস্র রকমের লিঙ্গ(৩) ও অজস্র রকমের যোনি (zon-e বা ক্ষেত্র) রয়েছে। তার মানে, একটা মানুষ সারাজীবন ধরে যত রকমের ক্ষেত্রের সংস্পর্শে এসে যত রকমের ‘পুত্র’ উৎপাদন করে, সেসব কিছুর মধ্যেই সে দৈহিকভাবে একটু একটু করে থেকে যায়। এর পরও যে মানুষটা বাকী থাকে, তার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয় গেলে আমরা তাকে গোর দিয়ে দেই। বাকী মানুষটা তখন গিয়ে জমা হয় আমাদের মাটির তলায় সংগৃহীত পেট্রলের রেকারিং ডিপজিটে আর বসুধার ফিক্সড্ ডিপজিটে। দৈহিকভাবে মানুষটার মরার কোনও উপায়ই নেই।
আর ‘মানসিক-মানুষ’টাও শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হলেই তৎক্ষণাৎ মরে যায় না। সে জায়গা নেয় উত্তরসূরীদের মনের মাটিতে। সেখানে দুটো ‘লোক’ বা স্ফিয়ার রয়েছে। উত্তরসূরীদের মনের মাটির ওপরটা ‘স্মৃতিলোক’, আর তলাটা ‘বিস্মৃতিলোক’। ‘মানসিক-মানুষ’টা প্রথমে জায়গা নেয় স্মৃতিলোকে। সেখানে যতদিন সে থাকে ততদিন সে মরে না, ততদিন সে অমর হয়ে থাকে। তবে কতদিন সেখানে সে থাকতে পারবে, সেটা নির্ভর করে সে কী পরিমাণে ‘পুণ্য’ অর্জ্জন করেছে তার ওপর। ‘পুণ্যক্ষয়’ হয়ে গেলেই তাকে মনের মাটিতে গোর দিয়ে দেওয়া হয়; সে চলে যায় বিস্মৃতিলোকে। একমাত্র বিস্মৃতিলোকে চলে গেলেই ‘মানসিক-মানুষ’টা মরে যায়।
রবীন্দ্রনাথের অর্জ্জিত সমস্ত ‘পুণ্য’ ক্ষয় হয়ে এখনও শেষ হয়ে যায়নি বলে বাঙলা সাহিত্য-পাঠকেরা তাঁকে তাঁদের মনের মাটিতে এখনও গোর দিয়ে দেননি, তাই তিনি আজও অমর। কিন্তু ‘পুণ্য’ ফুরিয়ে গেছে বলে, সৌরীন্দ্রমোহন, শৈলজানন্দদেরকে বাঙলা সাহিত্যপাঠকেরা তাঁদের মনের মাটিতে গোর দিয়ে দিয়েছেন। তাই তাঁরা আজ মৃত। কারণ উত্তরসূরীর স্মৃতিলোকে বেঁচে থাকতে হলে ‘পুণ্য’ চাই। ‘পুণ্য’ই এই ‘লোক’-এর মাস্টার কার্ড, পাশপোর্ট ভিসা। হাতে ‘পুণ্য’ নাই তো স্মৃতিলোকে মানুষটার স্থান নাই। সে তখন বিস্মৃতিলোকে প্রেরিত এবং অতএব মৃত।
অমৃত পান করতে পারলে মানুষ নাকি অমর হয়ে থাকে অর্থাৎ উত্তরসূরীদের স্মৃতিলোকে দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু ‘অমৃত’ জিনিসটা কোথায় পাওয়া যায়, সেটা এখনও কেউ জানে না। কোনও কর্পোরেট হাউস ‘অমৃত’ নামে কোনও প্রোডাক্ট এখনও মার্কেটে লঞ্চ্ করেনি। আদিকালে যে অমৃত পাওয়া যেত বলে শোনা যায়, মহেঞ্জদড়ো বা হরপ্পা থেকে সেরকম কিছু আদৌ পাওয়া যায় নি। পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা রয়েছে, পুরাতত্ত্ববিদ শ্রীব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তেমন কোনও আশ্বাসবাক্যও আমাদের শোনাননি।
তবে হ্যাঁ, অমৃত না পাওয়া গেলেও ‘অমৃতসমান’ একটা জিনিস বহুকাল থেকে সর্ব্বত্রই পাওয়া যায়। তার নাম ‘মহাভারতের কথা’। এই কথা আগে লিখেছিলেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। পরে সেকথাই বাঙলায় লিখে গেছেন আমাদের কাশীরাম দাশ। তাঁর মতেঃ-
‘মহাভারতের কথা অমৃতসমান।
কাশীরাম দাশ কহে শুনে পুণ্যবান’।
তাই বলে অমৃতসমান এ-জিনিসটা কিন্তু খেতে নেই, শুনতে হয় এবং শুনলে নাকি অনেক ‘পুণ্য’ হয়। আর,সেই ‘পুণ্য’ফলের জোরে মানুষ উত্তরসুরীদের মানসলোকের মাটির উপর অনেকদিন টিকে থাকতে পারে। কারণ ‘পুণ্য’ই স্মৃতিলোকের ভিসা-কাম-মাষ্টার কার্ড। এই ‘পুণ্যে’র কারণে উত্তরসূরীরা তাদের মনের মাটিতে ‘পুণ্যবান’ মানুষকে ‘পুণ্যক্ষয়’ হয়ে শেষ না হওয়া পর্য্যন্ত গোর দিয়ে দেয় না। উপরেই থাকতে দেয়। যতদিন থাকতে দেয়, ততদিন মানুষটা বেঁচে থাকে, অমর হয়ে থাকে।
অতএব, মরতে যদি না-চান, (কেই বা চায়?) আর অমৃত যখন সরাসরি পাওয়াই যাচ্ছে না, তখন ওই ‘অমৃতসমান’ জিনিসটাই আপনাকে জোগাড় করতে হবে, শুনতে হবে, ‘পুণ্য’ অর্জ্জন করতে হবে। নইলে মরতে হবে; অমর হওয়া যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল : মহাভারতের কথা ‘অমৃতসমান’ কেন? তা শুনলে মানুষ ‘পুণ্যবান’ হয় কেন? এবং তার ফলে অমর হয় কেন? কীভাবে হয়?
সর্ব্বযুগের সর্ব্বমানবের যৌথরূপটি নিয়েই ‘মহামানব’ কনসেপ্টটি কল্পনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কনসেপ্টটি কেমন? আজ আমরা পরমাণু চুলো জ্বালিয়ে অনেক কাজই চালাচ্ছি। কিন্তু এই চুলোতে পৌঁছতে আমাদেরকে অনেক চুলো পেরিয়ে আসতে হয়েছে। সেই আগুন আবিষ্কার থেকে শুরু করে পরমাণু চুল্লী পর্য্যন্ত একটা দীর্ঘ যাত্রার ইতিহাস ও স্মৃতি রয়েছে আজকের এই পরমাণু চুল্লীর পিছনে। তার মানে, আজ আমরা যেখানে আছি, সেখানে কেবল আজকের ছশো কোটি মানুষ নেই। মানুষের উদ্ভবের পর থেকে আজ পর্য্যন্ত যত মানুষ জন্মেছেন, তাঁদের সকলের শ্রম নিষ্ঠা ও অভিজ্ঞতার ফলের সমগ্র ভাণ্ডারটাই আজ আমরা ধারণ করে বয়ে নিয়ে চলেছি।
অর্থাৎ বিগত যুগসমূহের সমস্ত মানুষেরাই তাঁদের সমস্ত অর্জ্জন ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে বিরাজ করছেন। বিরাজ করতেন না, যদি অতীতের সঙ্গে আমাদের ‘আত্মবিচ্ছেদ’ ঘটে যেত। ইতিহাসজ্ঞান আমাদের ওই অতীতটাকে বংশানুক্রমে নবায়ন করতে থাকে। এর ফলে, পূর্ব্বসূরী বেঁচে থেকে যায় উত্তরসূরীদের স্মৃতিলোকে। তাই ইতিহাসকথাই অমৃতসমান কথা। মহাভারতকথায় রয়েছে মানবসভ্যতার সেই অমৃতসমান কথাসমূহ।
তবে রামায়ণ মহাভারত পুরাণাদিকে আমাদের তথাকথিত ঐতিহাসিকেরা ইতিহাস বলে মানতে চাননি। কেন, এবং এর ফলে কী বিপদ হয়েছে আমাদের, সেসব কথা অন্যত্র (৪) আমি কমবেশী লিখেছি। তবে রবীন্দ্রনাথের মতে, ওগুলিই আমাদের ইতিহাস। আর ইতিহাস বলেই সেগুলি অমৃতসমান। আজকের আলোচনায় মহাভারতে কী ইতিহাস বিধৃত রয়েছে, তার অতি সংক্ষিপ্ত কিছু নিদর্শন দেওয়ার চেষ্টা করব।
মহাভারতকথা বুঝতে গেলে সর্ব্বাগ্রে জানতে হয় কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসকে। কে এই ভদ্রলোক? জেনে রাখা ভালো, ইনি একজন চিরজীবী। চিরজীবী তো, এখন তিনি কোথায় থাকেন? কেউ সেকথা জানে না, কেউ তাকে চেনে না। অথচ সবাই জানেন, আমাদের বেদপুরাণাদি গ্রন্থসমূহের রচনা তাঁরই মহান কীর্ত্তি। ভাষাবিশেষজ্ঞগণ সেইসব গ্রন্থের ভাষার স্বভাব বিশ্লেষণ করে রায় দিয়েছেন যে, ওই গ্রন্থগুলি কমপক্ষে এক হাজার বছর সমকালের বিভিন্ন সময়ে লেখা। তার মানে, ব্যাস মরে গিয়ে থাকলেও অন্তত এক হাজার বছর বেঁচে ছিলেন। … যাই হোক, সমগ্র ব্যাসকাহিনী আজ এখানে ব্যাখ্যা করা যাবে না। কেবল আমার অনুসন্ধানলব্ধ ফলটুকু বলে দিয়ে আমরা মহাভারতের কথায় চলে যাব।
ব্যাস কোনও একজন ব্যক্তি নয়, ব্রাহ্মণ নয়, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের একটা সমিতি। সমিতির প্রত্যেক সদস্যকেই ব্যাস বলা হত, লায়ন্স ক্লাবের প্রত্যেক সদস্যকে যেমন লায়ন বলা হয়, সেইরকম। এই সমিতি ভারতবর্ষে কমপক্ষে একহাজার বছর সক্রিয় ছিল। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ‘ব্যাস-পূর্ণিমা’য় এই সমিতির সাধারণ সম্মেলন (মেলা’) অনুষ্টিত হত, আজকের ইতিহাস কংগ্রেসের মতো। এরাই ভারতের ইতিহাস নানা রূপে লিখে তা প্রচার করতেন। এই সমিতির সদস্যদের উত্তরসূরীরা এখনো তাঁদের নামের শেষে ‘ব্যাস’ পদবী ব্যবহার করে থাকেন। জেনে রাখা ভালো, ‘ব্যাস’ পদবীধারী বহু মানুষ এখনও রয়েছেন ভারতে।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে বৌদ্ধবিপ্লব সর্ব্বাপেক্ষা যুগান্তকারী ঘটনা। এই সময় ব্রাহ্মণের বিশেষাধিকার প্রায় বিলুপ্ত করে দেওয়া হয় ও ষোড়শ মহাজনপদ গঠন করে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়, ভারতবর্ষ বৈদিক যুগ পেরিয়ে বৌদ্ধযুগে প্রবেশ করে, আর সে কাহিনী লিখে রাখেন বিপ্লববাদী বাল্মীকিরা। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে হয় কাউণ্টার রেভলিউশান। ব্রাহ্মণের সুপ্রিমেসী পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, বিগত যুগের প্রতিবাদীদের ক্ষত্রিয়ত্ব কেড়ে নেওয়া হয় ও তাদেরকে শূদ্র ও অস্পৃশ্য বলে ঘোষণা করা হয়। ভারতবর্ষ এবার বৌদ্ধযুগ পেরিয়ে হিন্দুযুগে প্রবেশ করে। তাই রবীন্দ্রনাথ এই নতুন যুগটিকে বলেছেন ‘প্রতিক্রিয়ার যুগ’। প্রতিশোধ স্বরূপ বাল্মীকিদেরকেও শূদ্র ও অস্পৃশ্য বলে ঘোষণা করে দেওয়া হয়।
বর্ত্তমান ভারতে ‘বাল্মীকি’ পদবীধারী যে কয়েক লক্ষ মানুষ আজ রয়েছেন, তাঁরা সবাই সেকারণেই মেথর শ্রেণীর।… ব্যাসেরা এবার মহাভারত লেখেন। তাতে স্বভাবতই ব্রাহ্মণের জয়গান গাওয়া হয়। লেখা হয় ‘দণ্ডীপর্ব্ব’। ব্রহ্মহত্যার ফল কত মন্দ হতে পারে, সেবিষয়ে সবাইকে সতর্ক করা হয়। তবে, নিজেদের উত্তরসূরীরা ইতিহাস ভুলে গিয়ে যাতে আত্ম-বিচ্ছেদে না ভোগে, তাই, বলতে গেলে, সভ্যতার সূত্রপাত থেকে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্য্যন্ত সমগ্র ইতিহাসটাই সংক্ষেপে লিখে রাখা হয় মহাভারতে; এমনভাবে যাতে আত্মজ ‘উত্তম-অধিকারী’রা প্রকৃত অর্থটা বুঝতে পারে এবং অনাত্মীয় ‘নিম্ন-অধিকারী’রা অন্য অর্থ বোঝে। এই সেই কারণ, যেজন্য বলা হয়, যা নেই মহাভারতে, তা নেই ভারতে। এখন প্রশ্ন হল : কী আছে মহাভারতে?
মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে ভারতের প্রকৃত ইতিহাস। বৈদিকযুগের প্রাক্কাল থেকে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্য্যন্ত সমকালের ঘটনাবলী এই ইতিহাসে সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তবে এই ইতিহাস লেখা হয়েছে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনসুরণকারী ভাষায়(৫), যে শব্দার্থবিধি নানান কারণে পরবর্ত্তীকালে সবাই ক্রমশ বিস্মৃত হন। ব্রিটিশযুগে সেই বিস্মৃতি আরও বাড়ে। তাই ওই গ্রন্থের যথার্থ মানে আর বোঝা যায়নি। সম্প্রতি সেই বিধি এই লেখকের হস্তগত হওয়ার পর, সেই বিধির সাহায্যে মহাভারতের যথার্থ পাঠ সমাপন করা হয়, ও মহাভারতে বর্ণিত ভারতের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারা যায়।
ভারতের ইতিহাস হল মূলত দেবাসুর সংগ্রামের ইতিহাস, অসুর বনাম সুরের, দানব বনাম দেবতার একটানা দ্বন্দ্বের বা সংগ্রামের ইতিহাস। ওই এক দ্বন্দই নানা যুগে নানা নামে বর্ণিত হয়েছে। কখনো তা বৈদিক বনাম তান্ত্রিক, দক্ষ বনাম শিব, আর্য্য বনাম অনার্য্য, বেদবাদী বনাম উপনিষদবাদী, জ্ঞানজীবী বনাম পণ্যজীবীর সংগ্রাম রূপে বর্ণিত; কখনো বা ব্রহ্মপুত্র বনাম সিন্ধু(৬), হিমালয় বনাম বিন্ধ্য, অশ্বত্থ বনাম বট, সূর্য্যবংশী বনাম চন্দ্রবংশী, রাবণ বনাম রাম, বৈদিক বনাম অর্হৎ(বৌদ্ধ), সদাচারী বনাম ম্লেচ্ছাচারীদের সংগ্রাম নামেও বর্ণিত এবং অবশেষে সেই একই দ্বন্দ্ব কৌরব বনাম পাণ্ডবদের সংগ্রামের ইতিহাস নামে বর্ণিত হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এ’ হল সমাজতন্ত্রবাদী বনাম ধনতন্ত্রবাদীদের একটানা সংগ্রামের ইতিহাস(৭)। সেকালে সমাজতন্ত্রবাদীকে অসুর ও ধনতন্ত্রবাদীকে দেবতা বলা হত। অবশেষে দেবতারা পর্য্যুদস্ত হয় ও মহাপ্রস্থান করে, আর বিপরীতে সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ করে দিয়ে ভারতবর্ষে ধনতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সিল করে দেওয়া হয়।
মহাভারতের কাহিনী শুরু হচ্ছে উপরিচর (aperture) বসু থেকে। যেমন জলের ‘উপরে চরে’ যে বুদবুদ, একটু ছিদ্রযুক্ত বায়ু, তেমনি সামাজিক ছিদ্রে (মার্ক্স কথিত ‘in the pores of the society’-তে) তখন মালিকানার বোধটুকু সবেমাত্র দেখা দিচ্ছে। তার বহু পরে মালিকানার গন্ধ এসে হাজির হচ্ছে মৎস্যগন্ধায়, ব্যক্তিমালিকানা কিন্তু তখনও দূর-অস্ত। তখন এসেছে শুধু যৌথ সমাজের যৌথসম্পত্তির যৌথমালিকানার বোধ। গরু ছাগলের কিংবা বাঁদর-যূথের যেমন আহরিত বস্তুসমুহের প্রতি কোনওরকম মালিকানার বোধই জন্মায় না, তেমনি আদি মানবের কোনওরকম মালিকানার বোধই ছিল না। প্রথম জন্মায় যৌথসম্পত্তি আর তাই তখন সবেমাত্র যৌথ-মালিকানার বোধ জন্মাচ্ছে। পণ্য উৎপাদন, ব্যক্তিমালিকানা, এসব তখনো বহু দূরের কথা।
…আর কাহিনী শেষ হচ্ছে গিয়ে জন্মেজয়ে। ‘জন্মেজয়’ শব্দের অর্থ ‘বিদ্রোহ’ (ও বিদ্রোহীগণ)। এটি ভারতে জ্ঞানজীবীদের (বেদজীবীদের) বিরুদ্ধে শেষ বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ কেবলমাত্র অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গে বা বাঙলা বিহার উড়িষ্যায় কিছুকালের জন্য [হর্ষবর্দ্ধনের(৮) কালে] সফল হয়েছিল, তারপর পর্য্যুদস্ত হয়। ‘দাঁতে কাঠি দিয়ে ঘোরানো হয়’ বিদ্রোহীদের। আর কী কী করা হয়, তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে মহাভারতের শেষ পর্ব্ব ‘দণ্ডীপর্ব্বে’। বৈদিকযুগের সূচনাপর্ব্ব থেকে হিন্দুযুগের সূত্রপাতের কাল পর্য্যন্ত ভারতে যা যা ঘটেছিল, তার প্রায় সব কথাই রয়েছে মহাভারতে। এখানে, এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের পরিসরে, এখন আমরা মূল দু-চারটি ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে দেখব।
অতীতের কথা জানতে গিয়ে আমরা যখন পিছন দিকে তাকাই এবং আমাদের অতীত ইতিহাসটাকে বুঝে নেবার চেষ্টা করে, তখন সবচেয়ে বেশী ঝামেলা পাকায় আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে গেড়ে বসে থাকা বর্ত্তমান ধারণাগুলো। আমরা প্রথমেই খুঁজতে যাই ব্যক্তিকে। কে করল, কী করল, কার ওপর করল, তাদের নাম কী কী, তাদের বাবার বা মায়ের নাম কী কী, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সেজন্যেই অতীত ইতিহাসের পাতাগুলি পড়তে গিয়ে বেশীর ভাগ ঐতিহাসিকই ব্যর্থ হন, ব্যর্থ হয়েছেনও।
কারণ, একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায়, ওরকম ভাবনাটাই ভুল। সুদূর অতীতে, সমাজে যখন ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠিতই হয়নি, ব্যক্তিমানুষ আসবে কোত্থেকে? আর ব্যক্তিমানুষ না-জন্মালে,ব্যক্তিনাম পাবেন কীভাবে? সেকারণেই, আমাদের ভারতীয় টিভিতে যখন বি-আর-ফিল্মসের ‘মহাভারত’ প্রচার চলছিল, সেসময় কোলকাতার এক ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া শিশু স্বভাবতই তার মাকে প্রশ্ন করেছিল— ‘মা, যুধিষ্ঠিরের টাইটেল কী?’ আনন্দবাজারের কড়চা-লেখকেরও খটকা লাগে, তাই তিনি ওই শিশুটিকে তার কড়চায় স্থান করে দেন।
তবে কেবল যুধিষ্ঠিরের কেন, বেদপুরাণাদিতে বর্ণিত সেকালের চরিত্রগুলির কারোরই তো টাইটেল নেই। কারণ, তারা কেউই তো ব্যক্তিমানুষ নয় যে তাদের ব্যক্তিনাম থাকবে, টাইটেল থাকবে আমাদের মতন। তখন তো ধারণা যৌথ, লোকে ব্যক্তিকে বা কারককে গুরুত্ব দেয় না, গুরুত্ব দেয় ক্রিয়াকে। সামাজিক সত্তা হচ্ছে কতকগুলি ‘অ্যাকশন’, ‘অ্যাকটর’ নয়। ভাষাও গড়ে উঠছে, ‘অ্যাকটর’কে ভিত্তি করে নয়, ‘অ্যাকশন’কে বা ক্রিয়াকে ভিত্তি করে। লোকে দেহকে গুরুত্ব দেয় না একালের মতো, গুরুত্ব দেয় প্রাণকে (আত্মাকে)। তাই ব্যক্তি সেখানে গুরুত্বহীন। যৌথসমাজের, যে সমাজ পণ্যবাহী সমাজের দিকে পা ফেলবে ফেলবে করছে, সেই সমাজের এটাই স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গী। কেননা তখনো খণ্ডবাদিতার সূত্রপাত হয়নি, ডিটারমিনিজম আসেনি, আত্মাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী তখনও স্বভাবতই বজায় রয়েছে।
অতএব, মহাভারতে আমরা যাদের কাহিনী পড়ছি, তারা কতকগুলি সামাজিক সত্তা বই অন্য কিছু নয়। কোন্ কোন্ ব্যক্তিমানুষ সেই সকল সত্তার ভূমিকায় অভিনয় করছে, সেটা মহাভারতের লেখকের কাছে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাছাড়া, লেখক নিজেও তো একটি সামাজিক সত্তা, একটা চেয়ার, একটা সমিতি, একটা ফাংশনারী চরিত্র। ব্যক্তিমানুষেরা সেই সত্তার ভুমিকায় অভিনয় করে যায় মাত্র। সেভাবেই মহাভারতের চরিত্রগুলিকে বুঝতে হয়,বুঝতে হবে। তা নইলে ইউরোপীয়ানদের মতো আপনারও মনে হবে— যত্তো সব মিথ্যা, মাই্থলজি, রূপকথা।
তা সে যাই হোক, ঝামেলার সূত্রপাত মৎস্যগন্ধার আবির্ভাবের পর থেকেই, যে কিনা তার কানীন পুত্র ব্যাসের মা এবং ব্যাসপিতা পরাশরের বরে দুর্গন্ধবতী থেকে সুগন্ধবতীতে পরিণত হয়েছে। তার দাবী, তার সন্তানই পৈতৃক সম্পত্তির বা সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবে, গঙ্গাপুত্র নয়। অতএব সূত্রপাত হয়ে গেল দুই ধারার। সেই দুই ধারার নবায়ন হল, ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর আবির্ভাবে। দুটোরই উদ্ভবের পিছনে রয়েছে মৎস্যগন্ধার সেই কানীন পুত্রের হাত, বলা ভালো, কানীন পুত্ররূপে জাত এক ব্রাহ্মণের হাত, জ্ঞানজীবীর হাত, ব্যাসের হাত।
সে কাহিনী অনুসারে ধৃতরাষ্ট্র জন্মদোষে জন্মান্ধ, আর পাণ্ডু জন্মদোষে পাণ্ডুবর্ণ। বাকী শারীরিক অবস্থা তার ভালো হলেও সন্তান উৎপাদনের ব্যাপারে সে অভিশপ্ত। ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী গান্ধারী চোখ বেঁধে রাখেন, তাঁর দুর্যোধন দুঃশাসন প্রভৃতি শত পুত্র আর এক কন্যা দুঃশলা। আর পাণ্ডুর দুই রানী, কুন্তী ও মাদ্রী, পাণ্ডুর ঔরসে তাঁদের পুত্র হবার উপায় নেই, তাই ধর্ম্ম বায়ু ইন্দ্র ও অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের ঔরসে তাঁদের গর্ভে পাঁচটি ক্ষেত্রজ পুত্র যুধিষ্ঠির ভীম অর্জ্জুন নকুল ও সহদেব জন্মে। আর সূর্য্যের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে কানীন পুত্ররূপে জন্মায় কর্ণ।
এখন প্রশ্ন দাঁড়াল, কারা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে, সিংহাসন পাবে, ক্ষমতায় বসবে অর্থাৎ কারা সমাজ চালাবে, কৌরবেরা না পাণ্ডবেরা? ঔরসজাত পুত্রেরা না ক্ষেত্রজ পুত্রেরা? অসুরের উত্তরসূরীরা না দেবতাদের উত্তরসুরীরা? সমাজতন্ত্রবাদীরা না ধনতন্ত্রবাদীরা? ফল হয় এই যে, উভয়েই উভয়কে মেরে প্রায় নিকেশ করে ফেলে। ধনতন্ত্রবাদীরা প্রায় নিঃশেষে নির্মূল হয়ে ভারতভাগ করে বা ‘মহাপ্রস্থান’ করে। ক্ষত্রিয়নিধন প্রায় সাঙ্গ হয়, অর্থা্ৎ ষ্টেট পাওয়ার একেবারে ক্ষীণদেহ হয়ে পড়ে। ব্যবসাবিরোধী মানসিকতার বিজয় ঘোষিত হয় ও সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়, (৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) বেঁচে থাকা গুটিকয় ব্রাহ্মণ তাঁদের মন্দিরকেন্দ্রিক সভ্যতাকে কোন মতে টেনে চলতে থাকেন। এই হল ভারতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, যা মহাভারতে লেখা রয়েছে।
তার পরের কথা সবাই কমবেশী জানেন। সমগ্র ভারতের সমস্ত জমির সকল সম্পদের মালিক হল মন্দির— এ বিধি (৮০০ খ্রিষ্টাব্দে) পুনঃপ্রতিষ্ঠিত, অথচ তাকে রক্ষা করার জন্য বেঁচে নেই কোনও ক্ষত্রিয়। অতএব মন্দির হয়ে দাঁড়াল লুঠের একমাত্র লক্ষ্য, আর ক্ষত্র-শক্তিহীন অনন্যোপায় ব্রাহ্মণ সেই মন্দিরকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল দুর্গম থেকে দুর্গমতর স্থানে, পাহাড়ের শীর্ষে এবং বলা ভালো, বিদেশী লুঠেরাদের শিকার রূপে এভাবেই তার কেটে গেল প্রায় পাঁচশো বছর। অবশেষে একদিন হাজির হল মোগল মাস্তান। দশ বিশ জন অশ্বারোহী নিয়ে যারা অরক্ষিত ভারতের এলাকা দখল করতে লেগে গেল, যাকে বলে ‘ওয়াক অভার’। তার পরের কথা সবাই জানেন।
পরাশর ও মৎস্যগন্ধার কথা
মৎস্যগন্ধা সেই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা দুটি যৌথ সামাজিক গোষ্ঠীর মাঝে মাল লেনদেন ঘটাতো, বা পারাপার করত। এদের চাল বয়ে নিয়ে গিয়ে দিত ওদেরকে, তো ওদের গরুছাগল এনে দিত এদেরকে। আর স্বভাবতই, পারানির কড়ি স্বরূপ রেখে দেওয়া হত কিছু চাল এবং কিছু গরুছাগল। এগুলি হতো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নিজেদের সম্পদ। মালিকানার গন্ধের জন্ম এভাবেই।
এই বার, হল কি, সমাজে যারা বেদের বা জ্ঞানের সুপ্রিমেসী দাবী করে আসছিল, সমাজ যাদেরকে নিন্দা করছিল ‘পরপরিশ্রমভোগী’ (পরাশর) ব’লে, তারা এসে জুটল এই মৎস্যগন্ধার দলে। যৌথসমাজের কেউ যাতে বুঝতে না পারে, তাই তারা মিথ্যার কুয়াশা সৃষ্টি করে এই মৎস্যগন্ধাদের সঙ্গে মিলিত হল, তাদেরকে পরামর্শ দিল। এদের মিলনে, কিছুদিনের মধ্যেই জন্মাল এক নতুন বেদজীবী বা জ্ঞানজীবী গোষ্ঠী। নিষিদ্ধ সামাজিক আচরণকে চিরকালই কৃষ্ণ বা ব্ল্যাক (যেমন ব্ল্যাক-মানি) বলা হয়। জনসমুদ্রের ফাঁকে মিথ্যার কুয়াশা ঘেরা দ্বীপে (মার্ক্স কথিত ”in the pores of the society’) সেই কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের জন্ম হয়ে গেল।
কেবল তাই নয়, এতকাল মৎস্যগন্ধা গোষ্ঠীটির সমাজে দুর্নাম ছিল যে তাদের মধ্যে মালিকানার গন্ধ দেখা যাচ্ছে আর এই জন্য যৌথসমাজের চোখে তারা ছিল নিন্দিত, ঘৃণিত। এবার পরাশর গোষ্ঠীর চেষ্টায় তারাই সমাজে সুনাম পেতে লাগল। একালে যেমন এখনও বলা হয়— ‘লোকটার নজর তো কেবল টাকার দিকে। ছি ছি’। এটা মালিকানার দুর্গন্ধ। আবার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময়— ‘জান তো গিন্নি, ছেলেটার বাবা খুব হিসেবী মানুষ। অনেক খেটে আজ দুটো পয়সা করেছে, বিশাল ব্যবসা, একটা কারখানার মালিক, ঘরে দু’দুটো মারুতি, বিরাট চারতলা পাকাবাড়ী; কম কথা!’ এটা মালিকানার সুগন্ধ। এভাব মৎস্যগন্ধা যৌথসমাজের মানুষের চোখেই ক্রমশ গন্ধবতী হয়ে উঠতে থাকে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকলে লোকে আর তার নিন্দা করে না, তার প্রশংসা করে।…
অবশ্য যৌথসম্পদের চরিত্র বা ধর্ম্ম বা ক্রিয়া প্রথমদিকে যা যা ছিল, সেই ক্রিয়া অনুসুরণ করে তখন তার নাম হয় পুষা, সবিতা ইত্যাদি। কিন্তু যখন তা রীতিমত রাষ্ট্রীয় পুঁজি, তখন তার নাম হয় সূর্য্য বা তপন ইত্যাদি। যখন যেমন ক্রিয়াকারী সেইরকম নাম। চন্দ্রের ক্ষেত্রেও তাই। যৌথপুঁজির আধারেরা তাই সূর্য্যবংশী এবং ব্যবসায়ী পুঁজির আধারেরা তাই চন্দ্রবংশী। তবে, যেহেতু সূর্য্য নিজের আলোতেই আলোকিত, তাই সূর্য্যবংশীরা সব ঔরসজাত আর চন্দ্রের ক্ষেত্র জাত বলে চন্দ্রবংশীরা সব ক্ষেত্রজ। তো, প্রধান প্রশ্ন হল : সামাজিক ক্ষমতা পাবে কারা? সূর্য্যবংশীরা না চন্দ্রবংশীরা, সমাজতান্ত্রিকরা না ধনতান্ত্রিকরা? জ্ঞানজীবীরা না পণ্যজীবীরা? ঔরসজাত পুত্রেরা না ক্ষেত্রজ পুত্রেরা? মূল লড়াইটা এখানেই।
ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু
দু-জনেই জন্মদোষে দুষ্ট। একজন জন্মান্ধ আর একজন পাণ্ডুবর্ণ। কেন? ভীষণদর্শন ব্যাস যখন অম্বালিকার সঙ্গে মিলিত হন, কখন সে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। তাই তার পুত্র ধৃতরাষ্ট্র হয় জন্মান্ধ। আর আম্বিকার সঙ্গে যখন মিলিত হন, তখন সে ভয়ে সিঁটিয়ে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তাই তার পুত্র হয় পাণ্ডুবর্ণ, অতএব পাণ্ডু। কী আছে এই কাহিনীতে?
এই কাহিনীতে প্রাচীন ভারতে আদিম রাষ্ট্রহীন সাম্যবাদ কেমন করে প্রথমে রাষ্ট্রহীন সমাজতন্ত্রে ও রাষ্ট্রহীন ধনতন্ত্রে এবং পরে রাষ্ট্রযুক্ত সমাজতন্ত্রে ও রাষ্ট্রযুক্ত ধনতন্ত্রে উত্তীর্ণ হয়েছিল, অতি সংক্ষেপে সেই সমস্ত ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। একই কাহিনী পুরাণে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে ‘দক্ষো্ৎপত্তি’ ‘মারুতোৎপত্তি’ ও ‘পৃথু উপাখ্যান’-এ। সেই বর্ণনায় ‘মহর্ষিগণের আক্রমণে’ বেণীয়াবৃত্তি তার জন্মলগ্নেই কীভাবে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে যায়, আর রাষ্ট্র কীভাবে উদ্ভুত হয় অন্ধ হয়ে, তার সমস্ত বিবরণই রয়েছে।
‘পৃথিবী’তে ব্যবসা নিষিদ্ধ হয়ে যায়, ছাড় পায় কেবল ‘বারাণসী’গুলি, যেগুলি কিনা ‘পৃথিবীর বাইরে’।(১০)। ‘পৃথিবীর বাইরে’ মানে রাষ্ট্রের শাসনাধিকারের বাইরে বা ‘পৃথু’র এলাকার বাইরে। আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয় প্রজাদের নিকট থেকে, সামাজিক উৎপাদন কর্ম্মযজ্ঞ থেকে তাদের উৎপাদনে ভাগ বসিয়ে সেই উৎপাদিত সম্পদ এনে বেদজীবীদের ভরণপোষণ করা এবং ঠিক হয়, রাষ্ট্র এটা করবে অন্ধভাবে।(১১)।
কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকেনি,থাকে না। বলতে গেলে একধরণের খর্ব্ব জ্ঞানজীবিতা ও খর্ব্ব পণ্যজীবিতা যথাক্রমে এক ধরনের খর্ব্ব-‘রাষ্ট্রযুক্ত সমাজতন্ত্র’ ও এক ধরনের খর্ব্ব-‘রাষ্ট্রযুক্ত ধনতন্ত্র’রূপে অর্থাৎ যথাক্রমে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুরূপে এবার মাঠে নামে। দুটো ধারাই রিনিউড্ হয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। খর্ব্ব পণ্যজীবিতা বা পাণ্ডু রাষ্ট্র-ক্ষমতায় বসলেও, অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রযুক্ত ধনতন্ত্র’ প্রচলিত হলেও, রাষ্ট্রীয় পুঁজি ব্যবহার করে ব্যাপক ব্যক্তিমালিকাধীন পণ্য সে উৎপাদন করতে পারবে না, এটাই ব্রাহ্মণের শাপ। তা করতে গেলেই তার মৃত্যু হবে। ক্ষমতায় সে থাকতে পারবে না।
অতএব কারুজীবী ও ব্যবসাবৃত্তিধারী জনসাধারণের (বা কুন্তী ও মাদ্রীর) গর্ভে ধনতন্ত্রের পক্ষে রাষ্ট্রীয়-পুঁজি নিষেক করা সম্ভব হয় না, পণ্যজীবীদের নিজস্ব পুঁজি বা দেবতাদের ঔরস নিষিক্ত হয়। ফলত ধনতান্ত্রিক বিধি ও তার আধারেরা (বা যুধিষ্টির), ধনতান্ত্রিকে প্রচার ও তার আধারেরা (বা ভীম), ধনতান্ত্রিক পুঁজি ও তার আধারেরা (বা অর্জ্জুন) ইত্যাদি (১২) জন্মলাভ করে। কিন্তু একদিন সে লোভ সামলাতে পারে না, রাষ্ট্রীয় পুঁজিতে হাত দিয়ে বসে। হয়ে যায় ‘ঘোটালা’, চলে যায় ক্ষমতা। পাণ্ডুর মৃত্যু ঘটে।
রাষ্ট্র সম্পর্কে আমাদের বর্ত্তমান জ্ঞানবৃদ্ধির অনেকটাই ইউরোপের দান। যদিও ভারতবর্ষই রাষ্ট্রসৃষ্টির ও ধর্ম্মসৃষ্টির বা আইনসৃষ্টির আদি দেশ, কিন্তু সে কেমন রাষ্ট্র ও কেমন ধর্ম্ম বা আইন সেসব বিষয়ে আমরা এখন প্রায় কিছুই জানিনা। তবে, সেই সমস্ত কথায় এখন আমি যাব না। এই মুহূর্ত্তে আমার প্রয়োজন কেবল ধৃতরাষ্ট্রকে বা খর্ব্ব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে।
প্রাচীন ভারত রাষ্ট্র বলতে ‘লিমিটেড টেরিটোরি, সভারেণ্টি…’ এসব বুঝত না। বুঝত এক ধরণের ‘রাষ্ট্র-করা’ নিয়মাবলীকে বা প্রচারকে যা জনসাধারণ বিশ্বাস করত। আর সেই বিশ্বাসের উপরই দাঁড়িয়ে থাকত রাষ্ট্রব্যবস্থাটা। এই নিবন্ধের শুরুতে যে সামাজিক বিশ্বাসের কথা বলেছিলাম, এ সেই বিশ্বাস। এটা রয়েছে বলেই মানুষও যেমন সামাজিক নিয়ম কানুনের মধ্যে রয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রটাও টিকে রয়েছে।
সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় ওই সকল প্রচারিত নিয়মাবলীর উপর মানুষের বিশ্বাস যদি না-থাকত, রাষ্ট্রব্যবস্থাটি ভেঙে পড়তে কয়েক মুহূর্ত্ত সময় নিত না। এখন এই ব্যাপারটাকে বুঝতে অসুবিধা হয়, ব্যাপারটি অত্যন্ত বেশী প্রথাসম্মত হয়ে গেছে বলে। কিন্তু ২০০০ খ্রিষ্টপূর্ব্বাব্দের রাজা হামুরাবির ঘোষণা থেকে খুব সহজেই বোঝা যায়, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যূষে ওই বিশ্বাস কত স্পষ্ট ছিল। এখনও বহু শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রনেতা বা নেত্রী ব্যাপারটি অনুধাবন করে থাকেন। তাঁদের বক্তৃতায় কদাচিৎ ব্যাপারটা তাই উঁকিঝুঁকি দেয়।
তা সে যাই হোক। জ্ঞানজীবী বা বেদজীবীদের ঔরসে সৃষ্ট সেই খর্ব্ব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বা ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম হলে পর, তার থেকে স্বভাবতই জন্মায় কু-পরামর্শ ও কু-পরামর্শদাতারা (বা দুঃশলা), কু-শাসন ও তার আধারেরা (বা দুঃশাসন) এবং কু-বিচার ও তার আধারেরা (বা দুর্য্যোধন) প্রমুখেরা। দুটো ধারাই এবার মুখোমুখী দাঁড়ায়, কৌরব ও পাণ্ডব নামে। পাণ্ডবদেরকে বা পণ্যজীবীদেরকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার জন্য নানা সদুপায় ও অসদুপায় অবলম্বন করা হয়। সেই বিশাল বিশাল সামাজিক ঘটনাগুলিকে জতুগৃহদাহ থেকে শুরু করে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ পর্য্যন্ত বিভিন্ন কাহিনীর সাহায্যে বিবৃত করা হয়েছে মহাভারতে।
অসুরের উত্তরসূরীরা ও দেবতাদের উভয়সূরীরা
মানুষের ভাষার যে একটা গভীর সমস্যা আছে, সেটা ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি আবিষ্কৃত হবার আগে আমাদের জানা ছিল না। সমস্যাটি হল, সমাজ যতদিন যৌথভাবে বা অখণ্ডস্বভাব-সম্পন্ন থাকে, ততদিন মানুষের ভাষা হয় আত্মাভিত্তিক, ক্রিয়াভিত্তিক, বহুরৈখিক। আর সমাজ যখন খণ্ডস্বভাবসম্পন্ন হয়ে পড়ে, তখন সেই সমস্ত সমাজের মানুষের মুখের ভাষাও হয়ে যায় দেহভিত্তিক, প্রতীকী, একরৈখিক। প্রকৃতির এ এক অমোঘ অনিবার্য্য নিয়ম।
কিন্তু সমাজটা তো দুম করে তার অখণ্ডস্বভাব ত্যাগ করে খণ্ডস্বভাব সম্পন্ন হয়ে যায় না। তার একটা পর্য্যায়ক্রম আছে, পদ্ধতি আছে। ডিটারমিনিজম, রিডাকসনিজম ধীরে ধীরে সবল হতে হতে সমস্তটা গ্রাস করে। স্বভাবতই একটা সময় অবশ্যই দেখা দেয়, যেটাকে আমরা ‘ট্রানজিশনাল পিরিয়ড’ বলতে পারি। সেসময় একই সঙ্গে দুরকম ভাষারই প্রকোপ দেখতে পাওয়ার কথা, দেখাও যায়। ভারতে সেই অধ্যায় ছিল ৬০০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের সময়কালে, যখন গ্রন্থাদি রচিত হচ্ছে প্রধানত ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় এবং অপ্রধানত প্রতীকী ভাষায়, আর লোকসাধারণ কথাবার্ত্তা বলছে প্রধানত প্রতীকী ভাষায় এবং অপ্রধানত ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায়।
ব্যাপারটা আর কারও নজরে না পড়ুক, ভারতীয় ব্যাসেদের চোখে পড়ে যায়। তাঁরা দেখেন, লোকে ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলির অর্থ আর বুঝতে পারছে না। এমনকি উত্তম-অধিকারীরাও পারছে না। মহাভারত লিখে ইতিহাস জ্ঞানটাকে যে প্রবহমান রাখা যাবে ভাবা হয়েছিল, সেটা তো তাহলে থাকবে না। কারণ সমাজ ক্রমশ প্রতীকী ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে এবং ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা ভুলে যাচ্ছে। অতএব ব্যাসেরা যুক্তি করে লিখে ফেললেন হরিবংশ পুরাণ বা ‘খিল হরিবংশ’। উদ্দেশ্য, খিল খুলে যেমন ঘরে ঢুকতে পারা যায়, এই গ্রন্থটির সাহায্যে তেমনি মহাভারতের খিল খুলে তার ভিতরে ঢুকে পড়া যাবে। অবশ্য তা সত্ত্বেও শেষরক্ষা করা যায়নি।
সেই হরিবংশপুরাণে ‘দেবগণের অংশাবতরণ’ নামে একটি অধ্যায় রয়েছে। তাতে দেখানো হয়েছে, কৌরব পাণ্ডবেরা আসলে কারা?
“…যথাসময়ে এবং যথানিয়মে সুরবৃন্দ নিজ নিজ অংশে অবতীর্ণ হইলেন। তন্মধ্যে যুধিষ্ঠির ধর্ম্মের, অর্জ্জুন ইন্দ্রের, ভীমসেন বায়ুর, নকুল ও সহদেব অশ্বিনীকুমার যুগলের, কর্ণ সূর্য্যের, দ্রোণাচার্য্য বৃহস্পতির, অষ্টমবসু-ভীষ্ম বসুগণের, বিদুর যমের, দুর্য্যোধন কলির, অভিমন্যু চন্দ্রমার, ভূরিশ্রবা শুক্রের, শ্রুতায়ুধ বরুণের, অশ্বথ্থামা মহাদেবের, কণিক মিত্রের, ধৃতরাষ্ট্র কুবেরের, এবং দেবক, অশ্বসেন ও দুঃশাসন প্রভৃতি সকলে যক্ষ, গন্ধর্ব্ব ও উরগগণের অংশে অবতীর্ণ হইলেন। এই প্রকারে দেবতারা স্বীয় স্বীয় অংশে স্বর্গ হইতে মর্ত্ত্যে অবতীর্ণ হইলে দেবর্ষি নারদ সুরগণকে লইয়া নারায়ণের সভায় উপস্থিত হইলেন।”
অন্যত্র দেখানো হয়েছে ত্রেতার রাবণ, কালনেমী প্রমুখেরা দ্বাপরে কী কী রূপ পরিগ্রহ করেছিলেন … ইত্যাদি ইত্যাদি।
ছিন্নসূত্র জোড়া দিন
ভারতের সমস্ত দুর্দ্দশার কারণ, মার্কস ও রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘অতীতের সঙ্গে ভারতের আত্মবিচ্ছেদ।’ এই আত্মবিচ্ছেদ ঘটেছে, বেদপুরাণ রামায়ণ মহাভারতাদিতে বর্ণিত আমাদের ইতিহাসটা আমরা পড়তে ভুলে গিয়েছিলাম বলে। এখন ‘ইতিহাসের সেই ছিন্নসূত্রগুলি জোড়া দেবার’ সময় উপস্থিত। অতীতের অধ্যয়ন সাঙ্গ করে, তাকে ‘আপডেটেড’ করে নিয়ে বর্ত্তমানের সঙ্গে জুড়ে নিতে হবে। অতএব, নতুন উদ্যমে নতুনভাবে মহাভারতটা এবার পড়ে ফেলা দরকার। এটা করে ফেলতে পারলে, পূর্ব্বপুরুষ পুনরায় উত্তর-পুরুষের স্মৃতিলোকে দিব্যি বেঁচে থাকতে পারবেন। আর আমাদেরকে আত্মবিচ্ছেদে ভুগতে হবে না। অমৃতসমান কথা শোনা আমাদের সার্থক হবে।
টীকা ও টুকিটাকি
১। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষে ‘জায়া’ শব্দ দেখুন। এই নিবন্ধের মূল তথ্যভিত্তি ওই গ্রন্থ। পরে আর তা পৃথকভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে না।
২। এই শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ ‘পুং নামক নরক থেকে ত্রান করে যে’। এই অর্থ, আমাদের বিনিময়যোগ্য সমস্ত উৎপাদনই পুত্র-পদবাচ্য। এ-ভাষা যখন গড়ে উঠেছিল, তখন son-পুত্রও বিক্রয়যোগ্য ছিল; গাধিকে তার বাবা গলায় দড়ি বেঁধে গরুর মতো বেচতে এনেছিল। ইনিই চন্দ্রবংশীয় নৃপতি বিশ্বামিত্রের পিতা।
৩। লিঙ্গ ও যোনি কত প্রকারের হয়, তার বিস্তারিত বিবরণ পাবেন, এই লেখকের লেখা ‘যোজনগন্ধবিকার ঃ সিষ্টেম ডিজাইনিং-এর একটি সমস্যা’ নামক নিবন্ধে, যা পাওয়া যাবে লেখকের ‘দিশা থেকে বিদিশায় ঃ নতুন সহস্রাব্দের প্রবেশবার্ত্তা’ গ্রন্থে।
৪। আমার চর্চ্চার মুখ্য বিষয় প্রাচীন ভারতের ইতিহাস।
৫। বিস্তারিত বিবরণের জন্য উপরোক্ত ‘পরমাভাষার সংকেত…’ গ্রন্থটি দ্রষ্টব্য।
৬। এই বিষয়টিকে বিস্তারিত করা হয়েছে, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার ‘নদী’ সঙ্খ্যায়। পত্রিকাটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়ে থাকে। এই গ্রন্থের দ্বিতীয় নিবন্ধরূপে সেটি সঙ্কলিত হয়েছে।
৭। বিষয়গুলি লেখকের ‘মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে’ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্য করা হয়েছে।
৮। বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাবেন লেখকের তৃতীয় গ্রন্থে। উপরে ৪নং টীকা দেখুন।
৯। ভূবিজ্ঞানী সঙ্কর্ষণ রায়ের ‘পাথরচাপা ইতিহাস’ থেকে।
১০। রামায়ণ-মহাভারতে এবং পুরাণাদিতে এসব কথা বহুবার লিখা রয়েছে।
১১। বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাবেন লেখকের ‘ফ্রম এনলাইটেনমেণ্ট …” গ্রন্থে। উপরে ৪ নং টীকা দেখুন।
১২। বিষয়টির ব্যাখ্যা পাবেন লেখকের ‘দ্রৌপদী থেকে শতরূপায়’ শীর্ষক নিবন্ধে, যা ডলি দত্ত সম্পাদিত ‘দধীচি’ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
কলিম খান
জন্ম: ০১ জানুয়ারী ১৯৫০ মামুদাবাদ (মেদিনীপুর)। মৃত্যু: ১১ জুন ২০১৮ কলকাতা।
কলিম খান’র প্রকাশিত গ্রন্থাবলী :
১. মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে (১৯৯৫)
২. দিশা থেকে বিদিশায় : নতুন সহস্রাব্দের প্রবেশবার্তা (১৯৯৯)
৩. জ্যোতি থেকে মমতায় : ফ্রম এনলাইটেনমেন্ট টু…. (২০০০)
৪. পরমাভাষার সংকেত (২০০১)
৫. আত্নহত্যা থেকে গণহত্যা : আসমানদারী করতে দেব কাকে (২০০২)
৬. পরমা ভাষার বোধন উদ্বোধন : ভাষাবিজ্ঞানের ক্রিয়াভিত্তিক রি-ইঞ্জিনিয়ারিং (২০০২)
কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী’র প্রকাশিত গ্রন্থাবলী :
১. বাংলাভাষা : প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ (২০০৬)
২. অবিকল্পসন্ধান : বাংলা থেকে বিশ্বে (২০০৮)
৩. বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ১ম খণ্ড (২০০৯) ও বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ২য় খণ্ড (২০১১)
৪. সুন্দর হে সুন্দর (২০১১)
৫. বঙ্গযান (২০১২)
৬. সরল শব্দার্থকোষ (২০১৩)
৭. বাংলা বাঁচলে সভ্যতা বাঁচবে (২০১৩)
৮. বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান : বাংলাভাষা থেকে সভ্যতার ভবিতব্যে (২০১৫)
৯. ভাষাই পরম আলো (২০১৭)